মাত্র ৩০ মাসেই শক্তিশালী একটি পরিবারতন্ত্র শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া করে দিলো!
২০১৯ সালের নভেম্বরে নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী গোতাবায়ে রাজাপাকসে ব্যাপক হারে কর হ্রাসের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তৎকালীন সরকার প্রাথমিকভাবে ধারণা করেছিল, এটি হয়তো নির্বাচনী প্রচারণারই একটি কৌশল হবে।
শ্রীলঙ্কার সে সময়ের অর্থমন্ত্রী মঙ্গলা সামারাবিরা, মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করা এবং অন্যান্য শুল্ক বাতিলের 'বিপজ্জনক' প্রতিশ্রুতির বিষয়ে একটি ব্রিফিংও ডেকেছিলেন। তার কাছে এটি ছিল একদম সহজ হিসাব- শ্রীলঙ্কা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে তুলনামূলক কম রাজস্ব সংগ্রহ করবে এবং উচ্চ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে হাত পাততে বাধ্য হবে।
সাবেক মন্ত্রী সতর্ক করে বলেছিলেন, "এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশ (শ্রীলঙ্কা) শুধু দেউলিয়াই হবে না, আরেকটি ভেনিজুয়েলা বা গ্রিসে পরিণত হবে।"
তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হতে সময় লেগেছে মাত্র ৩০ মাস। মহামারি, যুদ্ধ, এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে অনেকটা নড়বড়ে অবস্থাতেই রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। এরমধ্য দিয়ে লঙ্কান নেতাদের অবিচক্ষণ পদক্ষেপ হয়ে উঠেছে একটি সতর্কতামূলক গল্প।
২০১৯ সালের নির্বাচনে রাজাপাকসে সরকার জয়ী হওয়ার মাধ্যমে এশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী রাজবংশগুলোর মধ্যে অন্যতম এই পরিবারতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ক্ষমতায় এসেই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপসে তার প্রথম মন্ত্রিসভা বৈঠকে অবিলম্বে কর হ্রাসের বিষয়টি চূড়ান্ত করে নেন। টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থাকা (২০০৫ থেকে ২০১৫) তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসের শাসনামলেই তিনি দ্রুত নিজের রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করে নিয়েছিলেন।
দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে জনবান্ধব নীতির পরিবর্তে, রাজাপাকসে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি বৌদ্ধদের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত কর্তৃত্ববাদী পরিবারতন্ত্র কায়েম করে বসে। শ্রীলঙ্কার মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ শতাংশই সিংহলি বৌদ্ধ জনগণ। তবে সরকারের জনতুষ্টিবাদী সেই কৌশল দ্রুতই ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হয়।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই সরকার বিরোধী বিক্ষোভ চলছে পুরো শ্রীলঙ্কাজুড়ে। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলা আন্দোলনের অংশ হিসেবে সোমবার (৯ মে) প্রেসিডেন্ট গোতবায়ে রাজাপাকসে এবং সদ্য প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয় মাহিন্দা রাজাপাকসের পৈতৃক বাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। শুধু রাজাপাকসেদের বাড়িতেই নয়, ক্ষমতাসীন দলের এক এমপি ও সাবেক এক মন্ত্রীর বাড়িতেও বিক্ষোভকারীরা আগুন দিয়েছে একই দিনে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, জ্বালানি ও খাদ্য সংকট, দিনব্যাপী বিদ্যুৎ বিভ্রাট, নগদ অর্থের অভাব- সব মিলিয়ে বিশৃঙ্খল এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্র। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়েছে শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকার। খাবার ও ওষুধের সংকটে বিক্ষুব্ধ জনতা ভাঙচুর চালিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে, রুটিতে আগুন দিয়ে জানিয়েছে প্রতিবাদ।
বিক্ষোভকারীরা গোতাবায়ে রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে কলম্বোতে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের বাইরে অবস্থান নিয়েছে। আর রাজাপাকসে পরিবার এখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের। দেশের সাধারণ জনগণের খাদ্য, চিকিৎসা ও জ্বালানি পণ্যের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে সরকার এখন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, চীন এবং অন্যান্য ঋণদাতাদের কাছ থেকে জরুরি তহবিলের সন্ধান করছে। সম্প্রতি বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রেও নিজেকে ঋণখেলাপি ঘোষণা করেছে দেশটি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর প্রথমবারের মতো খেলাপি হয়েছে শ্রীলঙ্কা। এ বছর বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে দেশটির স্টক এক্সচেঞ্জের কার্যক্রম।
এমনকি, ২০১৯ সালের নির্বাচনের পরে বাস্তবায়িত দুটি প্রধান নীতি থেকেও পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে রাজাপাকসে সরকার; প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকেও সরে দাঁড়িয়েছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। তবে এরপরেও থেমে নেই জনসাধারণের বিক্ষোভ। ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, এমপিদের বাড়িতে বিক্ষোভকারীদের হামলার খবর পাওয়া গেছে স্থানীয় গণমাধ্যমে।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ