ডনবাস: যে কারণে পূর্ব ইউক্রেনের দখল নিতে চাচ্ছে রাশিয়া
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের ডনবাস দখলে কিছুদিন আগে যুদ্ধ শুরু করেছে রাশিয়ান বাহিনী। এতদিন ধরে ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিরোধ করে গেলেও এখন জানা যাচ্ছে তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে।
কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে জানা গেছে, রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী দাবি করেছে তারা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ডনবাসের লাইমান শহর দখল করে নিয়েছে।
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন-এর তথ্যমতে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের যেসব অঞ্চল এখনো দখল করা যায়নি, সেসব স্থানে বোমা ও আর্টিলারি হামলার তীব্রতা বাড়িয়েছে রাশিয়ান বাহিনী। সেখানকার স্থানীয় ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন, প্রতিরক্ষার জন্য তাদের এখন আর পর্যাপ্ত সেনা ও অস্ত্রশস্ত্র নেই।
কিয়েভ ও খারকিভ দখলের আয়োজন বাদ দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিন চাইছেন রাশিয়ানভাষী পূর্ব-ইউক্রেনের দখল নিতে। সেখানে ইউক্রেন গণহত্যা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পুতিন।
পূর্বাঞ্চলে জয় পেলেই কেবল এ যুদ্ধ শেষ করে জয় ঘোষণা করতে পারবেন ভ্লাদিমির পুতিন। ইউক্রেনের দক্ষিণের বড় একটি অংশ এখন রাশিয়ান বাহিনীর দখলে। ইউক্রেন জানিয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডনবাসের যুদ্ধ হতে যাচ্ছে ইউরোপের মাটিতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি শপথ করেছেন, তার সেনাবাহিনী 'বিনাযুদ্ধে নাহি দিবে সূচ্যগ্রমেদিনী'।
ইউক্রেনের ডনবাস
পুতিন যখন ডনবাস নিয়ে কথা বলেন, তখন তিনি কেবল ইউক্রেনের কয়লা ও স্টিল তৈরির অঞ্চলটি নিয়ে কথা বলেন না। বরং তার মাথায় থাকে পূর্ব ইউক্রেনের দুটি বড় অঞ্চল, লুহানস্ক ও দনেৎস্কের কথাও।
ডনবাসের মানুষ প্রধানত রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পরে এর প্রক্সি বাহিনী (রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহী) ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের তিনভাগ এলাকা দখল করে নিয়েছে।
রাশিয়ার এ প্রক্সি বাহিনী সেখানে তথাকথিত পিপলস রিপাবলিক তৈরি করেছে, তবে কেউ তার স্বীকৃতি দেয়নি এখনো। রাশিয়ার বর্তমান পরিকল্পনা পূর্বের বাকি থাকা এলাকাগুলোও দখল করে নেওয়া।
ভাষা রাশিয়ান হলেও লুহানস্ক ও দনেৎস্ক-এর মানুষেরা এখন আর রাশিয়াপন্থী নন। ২০২২ সালের মে মাসে ইউক্রেনের করা এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ২৪ ফেব্রুয়ারি আক্রমণের পর থেকে ইউক্রেনের রাশিয়া কর্তৃক দখলিকৃত অঞ্চলের মানুষদের ৮২ শতাংশ মস্কোর প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে।
আক্রমণ চালানোর এক মাসের মধ্যে রাশিয়া কিয়েভ থেকে মনোযোগ সরিয়ে ডনবাসের দিকে নজর দিয়েছে। মার্চের শেষের দিকে দেশটি দাবি করেছিল এটি লুহানস্কের ৯৩ শতাংশ ও দনেৎস্কের ৫৪ শতাংশ এলাকা দখল করেছে। তবে সমালোচকেরা রাশিয়ার এ দাবিকে অতিরঞ্জন বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।
এপ্রিলে জেলেনস্কি জানিয়েছিলেন, রাশিয়া ডনবাসের যুদ্ধ শুরু করেছে, এবং তার বাহিনী দীর্ঘসময় ধরে এ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এখন পর্যন্ত পুরো ডনবাস অঞ্চল জয় করা থেকে অনেক দূরে রাশিয়া। তবে এটি যদি বড় দুটি শহর, সেভেরোদনেত্স্ক ও লিসিচান্স্ক দখল করতে পারে, তাহলে পুরো লুহানস্ক দেশটির অধীনে চলে আসবে।
পুতিন কেন ডনবাসের নিয়ন্ত্রণ চান?
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন লুহানস্ক ও দনেৎস্ককে স্বাধীন অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেন।
ইউক্রেন পূর্বাঞ্চলে গণহত্যা চালিয়েছে বলে বারবার অভিযোগ করেছেন পুতিন। ২০১৪ সাল থেকে লুহানস্ক ও দনেৎস্কে যুদ্ধ চলছে। এ যুদ্ধে প্রায় ১৪০০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে তিন ভাগই ছিল যোদ্ধা।
কিয়েভ যখন দখল করা অসম্ভব বলে স্পষ্ট হয়ে উঠলো, তখন ডনবাসের স্বাধীনতাকে নতুন লক্ষ্য হিসেবে ঠিক করলো রাশিয়া। মস্কোর সম্ভাব্য পরবর্তী পদক্ষেপ হতে পারে ডনবাস ও তৎসংলগ্ন এলাকাকে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করা, যেমনটা পুতিন ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রে করেছিলেন ২০১৪ সালে।
পুতিনের কৌশল কী?
পুতিনের বাহিনী এখন লুহানস্ক ও দনেৎস্কের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দক্ষিণে আরও গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা করছে এটি। খেরসন, ক্রিমিয়ার উত্তর ও পশ্চিম, জাপোরিজজিয়ার কিছু অংশও দখল করতে সক্ষম হয়েছে তারা।
মারিওপোল দখলের মাধ্যমে ক্রিমিয়া থেকে রাশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত আগে থেকেই একটি ভূমি করিডোর রাশিয়ার হাতে ছিল। এছাড়া ক্রিমিয়ার পানি সরবরাহ ও ইউরোপের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রও এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।
ডনবাসের বিজয় যথেষ্ট পুতিনের জন্য?
পুতিন কী ভাবছেন বা সামরিক কমান্ডের সাথে তার সম্পর্ক কেমন তা এখন জানা অসম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট-এর স্যাম ক্যানি-ইভান্স। তবে তিনি মনে করেন, লুহানস্ক ও দনেৎস্কে রাশিয়া সফল হলে এটি সুযোগ বুঝলে আরও বেশি অঞ্চল দখলে নিতে পারে।
রাশিয়ার সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারি নিকোলাই পাত্রুশেভসহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় রাশিয়ান নেতারা পরিষ্কার করে জানিয়েছেন যুদ্ধ শেষ করার তাদের নির্দিষ্ট কোনো তাড়া (ডেডলাইন) নেই। তবে দীর্ঘায়িত যুদ্ধের জন্য তারা প্রস্তুত।
জাপোরিজজিয়া শহরে রাশিয়ান বাহিনী মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন নতুন একটি ডিক্রি জারি করেছেন। সেই ডিক্রি অনুযায়ী রাশিয়ার দখলিকৃত এলাকাগুলোয় বাস করা নাগরিকেরা চাইলেই সহজে রাশিয়ান পাসপোর্ট গ্রহণ করতে পারবেন।
একজন রাশিয়ান জেনারেলের মতে রাশিয়ার লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনের উত্তর সাগর উপকূল থেকে পশ্চিমের ওডেসা পর্যন্ত দখল করা। তবে আপাতত তা কেবল একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা হিসেবেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
যেভাবে এগোচ্ছে রাশিয়ান বাহিনী
গত কয়েকসপ্তাহ ধরে রাশিয়ান বাহিনী সেভেরোদনেৎস্ক ও লিসিচান্স্কে বোমা হামলা চালিয়েছে। ফলে লিম্যান থেকে ইউক্রেনীয় বাহিনী পিছু হটেছে। এছাড়া পপসানার প্রতিরক্ষাও ভেদ করেছে রাশিয়ান বাহিনী। ফলে ইউক্রেনের গোলাবারুদ সরবরাহের রাস্তা এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
লুহানস্কের অনেক শহর ইতোমধ্যে কয়েক বছর ধরে যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে। সেভেরোদনেৎস্কে প্রায় এক লাখ মানুষের বাস, তাদের মধ্যে এখনো ১৫০০০ মানুষ শহরটিতে আটকা পড়ে আছেন। তারা বিভিন্ন বম্ব শেল্টারে আশ্রয় নিয়েছেন।
রাশিয়ার আরেকটি বড় লক্ষ্যবস্তু হলো স্লভিয়ানস্ক শহর। এখানে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার মানুষের বাস। ২০১৪ সালে রাশিয়ানপন্থী বিদ্রোহীরা এটি দখল করে। এছাড়া এর দক্ষিণে অবস্থিত ক্রামাটর্স্ক দখলও রাশিয়ার একটি বড় লক্ষ্য।
কিন্তু এখন পর্যন্ত রাশিয়ার অগ্রগতি খুবই ধীর, আর ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা মনে করছেন, তারা হাই-প্রিসিশন অস্ত্রের ঘাটতিতে রয়েছেন।
পূর্বাঞ্চলে বেশিরভাগ রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা আটকে দিতে সফল হয়েছে রাশিয়া। এটি ছিল বেসামরিক লোকদের নিরাপদে সরে যাওয়ার ও ইউক্রেনীয়দের সেনা ও অস্ত্র পরিবহনের সবচেয়ে কার্যকরী পথ। ডনবাসের ভেতর ও বহির্মুখী সব রেলপথ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়ান বাহিনী, কেবল পোকরোভস্কের সাথে রেল যোগাযোগ চালু আছে।
লুহানস্কের স্থানীয় সামরিক প্রশাসনের প্রধান সেরি হাইদাই মনে করেন, ভ্লাদিমির পুতিন এখন যেকোনো মূল্যে লুহানস্ক দখল করার মনস্থির করেছেন।
টিকে থাকতে পারবে ইউক্রেনীয় বাহিনী?
যুদ্ধের শুরুতে পূর্বাঞ্চলে থাকা ইউক্রেনের জয়েন্ট ফোর্সেস অপারেশন (জেএফও)-এর ১০টি ব্রিগেডকে ইউক্রেনের সবচেয়ে সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত সেনাদল বলে ধরা হতো।
এর আগে গত ২২ মে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি জানিয়েছিলেন, পূর্ব ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত থাকা সৈন্যদের প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ জন রাশিয়ান বাহিনীর আক্রমণে নিহত হচ্ছেন। তার মানে হচ্ছে, এর চেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা আহত হচ্ছেন। স্যাম ক্র্যানি-ইভানস মনে করেন, খুব সম্ভবত এখন অনেকগুলো ব্রিগেডের আর যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়ন অনুযায়ী মোটামুটি ৯৩টি রাশিয়ান ব্যাটালিয়ন ট্যাকটিক্যাল গ্রুপ পূর্ব ইউক্রেনে অভিযান পরিচালনা করছে। প্রতিটি ব্যাটালিয়নে ৭০০ থেকে ৯০০ সদস্য রয়েছে। তবে রাশিয়ান বাহিনীরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং তাদের নৈতিক মনোবল ভেঙে পড়েছে বলেই মনে করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
রাশিয়া স্টাডিজ বিশ্লেষক মাইকেল কফম্যান বলেন, এ যুদ্ধে সামরিক ভারসাম্য সার্বিকভাবে ইউক্রেনের পক্ষে, কারণ ইউক্রেনের জনবল বেশি ও তাদের পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ডনবাস নিয়ে কোনো কিছু এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। আপাতত ইউক্রেন ভূমি হারালেও সেগুলো দীর্ঘকালীন দখলে রাখতে সমস্যায় পড়তে হতে পারে রাশিয়াকে, এমনটাই মনে করেন এ বিশ্লেষক।
এ কারণে লং-রেঞ্জ আর্টিলারিসহ ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র দ্রুত সরবরাহের জন্য পশ্চিমা মিত্রদের আহ্বান জানিয়েছে ইউক্রেন।
মূল প্রতিবেদনটি বিবিসি থেকে অনূদিত