ড্রোন, ক্রাচ, আলু—নিজ সৈন্যদের জন্য চাঁদা তুলে সীমান্তে যাচ্ছে রাশিয়ার সাধারণ মানুষ
মস্কোর উত্তরের শহর নিঝনি নোভগ্রোদের বাসিন্দা নাতালিয়া আবিয়েভা। পছন্দসই বাড়ি/ ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে হলে গ্রাহকেরা তার দ্বারস্থ হন। পেশায় রিয়েল এস্টেট এজেন্ট হলেও- নাতালিয়া এখন যুদ্ধক্ষেত্রের চিকিৎসা সম্পর্কে অনেক কিছু জানছেন।
যেমন জেনেছেন- হেমোস্টেটিক ওষুধের গুঁড়ো মারাত্মক রক্তক্ষয় বন্ধ করতে পারে; গুলি বা শেলের আঘাতে ছিদ্র হওয়া বুকের চাপ কমাতে পারে ডিকম্প্রেশন সূঁচ। সম্প্রতি এক সামরিক হাসপাতালে যান নাতালিয়া। সেখানে ভর্তি এক রুশ কমান্ডার জানান, যুদ্ধের ময়দানে গুরুতর আহত এক সহযোদ্ধাকে এয়ারওয়ে টিউবের অভাবে বাঁচাতে পারেননি তিনি।
ইউক্রেনের রণাঙ্গনে নিজ দেশের সেনাদের এমন দুর্দশা নাতালিয়াকে ভাবিয়ে তোলে। ৩৭ বছরের এ নারী তাই নিজেই তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত নেন, দরকারি রসদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে সরবরাহের। গত বুধবারই একটি গাড়ি ভর্তি পেঁয়াজ, আলু, টু ওয়ে রেডিও, বাইনোকুলার, ফার্স্ট এইড কিট ইত্যাদি নিয়ে ইউক্রেন সীমান্তের দিকে যান তিনি। তার সঙ্গে যোগ দেন আরও দুই বন্ধু। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এনিয়ে তারা সপ্তমবারের মতো রসদ নিয়ে গেছেন রুশ সেনাদের জন্য।
নাতালিয়ার অবশ্য জানা আছে তার সামর্থ্য সীমিত। তাই সহমর্মী অন্য রুশ নাগরিকদের থেকেও অর্থ নিয়েছেন রসদ কেনার। সেনাদের খাদ্য, পোশাক ও অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার জন্য এপর্যন্ত তিনি ও তার বন্ধুরা মিলে ৬০ হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ চাঁদা তুলেছেন।
রুশ সেনাদের প্রতি আন্তরিক সমর্থনের ব্যাখ্যা করে তিনি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, "মনে হচ্ছে, পুরো পৃথিবী আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রুদের পক্ষ নিচ্ছে। তাই আমরাও আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য এগিয়ে এসেছি।"
পুরো রাশিয়াজুড়ে তৃণমূল পর্যায়ের এমন সহযোগিতার স্বেচ্ছাসেবক নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে; তাতে প্রধানত নারীরাই অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। চাঁদা তুলে রুশ সেনাদের ত্রাণ পাঠাতে এগিয়ে আসছেন তারা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের যুদ্ধের পেছনে জনসমর্থনও তুলে ধরছে এসব উদ্যোগ।
ত্রাণের সাথে নাগরিকদের পাঠানো উদ্দীপনামূলক বার্তাও পৌঁছে যাচ্ছে সেনা সদস্যদের কাছে। তবে ইরাক যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনারা যেমন কেয়ার প্যাকেজ পেয়েছেন নিজ দেশের নাগরিকদের থেকে- এগুলো তার থেকে অনেকটাই আলাদা। রুশ নাগরিকেরা তাদের সেনাদের জন্য অতি-দরকারি আমদানিকৃত ড্রোন ও নাইট ভিশন গগলস ও পাঠাচ্ছেন। সে তুলনায় মার্কিন সেনাদের যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু পেন্টাগনই দিয়েছিল।
এতে আরও প্রমাণিত হয়, রাশিয়ার ৬৬ বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট একটি আধুনিক যুদ্ধের জন্য জরুরি সরঞ্জাম পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন করতে পারেনি। সেই ঘাটতি পূরণেরই চেষ্টা করছে জনসাধারণ।
তবে অনেকে দাবি করছেন, যুদ্ধের দরকার হবে রাশিয়া তা আগে বুঝতে পারেনি। ভলগা তীরের নোভোকুয়েবিশেস্ক শহরের এক ব্যবসায়ী তাতিয়ানা প্লতনিকোভা টেলিফোন সাক্ষাৎকারে টাইমসকে বলেন, "এমন যুদ্ধ হবে আমরা কেউ আশা করিনি। তাই আমার মনে হয়, সে অনুযায়ী প্রস্তুতির কিছুটা অভাব তো ছিলই।"
যুদ্ধ শুরু পর থেকে এক হাজার মাইল পথ গাড়ি চালিয়ে ইউক্রেন সীমান্তে এপর্যন্ত দুই বার গেছেন ৪৭ বছরের তাতিয়ানা। এভাবে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন ৩ টনের বেশি সরঞ্জাম। রাশিয়ার সামাজিক মাধ্যম ভিকনটাক্টে তিনি জরুরি ভিত্তিতে দরকার এমন সব সরঞ্জামের নতুন তালিকা পোস্ট করেছেন। ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যানাস্থেটিকসহ এতে রয়েছে পঙ্গু বা আহত যোদ্ধাদের জন্য হুইল চেয়ার ও ক্রাচের উল্লেখ।
পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করছে। এতে হতাহত রুশ সেনাদের সংখ্যাও বাড়ছে।
ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্নতা ঘোষণাকারী একটি অঞ্চলের সেনা কমান্ডার ও রুশ পার্লামেন্টের সদস্য আলেস্কান্ডার বোরোদই ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে টাইমসকে জানান, গোলার টুকরোর আঘাতে বা বিস্ফোরণে পুড়ে যাওয়া যোদ্ধাদের চিকিৎসায় তাদের এখন বিপুল পরিমাণ চিকিৎসা উপকরণ দরকার। কিছু কিছু এলাকায় মোট আহত রুশ সেনাদের ৯০ শতাংশই শত্রুর দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষণের কারণে হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বোরোদই আরও জানান, আমেরিকার সরবরাহ করা ১৫৫ মিলিমিটার ক্যালিবারের দূরপাল্লার কামান দিয়ে তার সেনাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। তাতে মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।
অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনপুষ্ট ইউক্রেনীয় বাহিনী পশ্চিমা নাগরিকদের ক্রাউড ফান্ডিং উদ্যোগগুলির সুবিধা পাচ্ছে। এভাবে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ড্রোন, নাইট ভিশন স্কোপ, অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেলসহ অন্যান্য প্রযুক্তি দেওয়া হচ্ছে তাদের।
সে তুলনায় রাশিয়ায় বেশিরভাগ চাঁদা সংগ্রহকারী গ্রুপ স্বাধীনভাবে নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। অর্থাৎ, তারা সরকারের সাথে সম্পৃক্ত নয়। সামরিক হাসপাতাল ও ইউক্রেনে মোতায়েন করা সেনা ইউনিটের পরিচিত সদস্যদের মাধ্যমে তারা যুদ্ধের খোঁজখবর নেয় এবং চাহিদা অনুসারে সহায়তা পাঠানোর চেষ্টা করে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে অবশ্য বেসামরিক নাগরিকদের অবদান স্বীকার করে নেওয়া খুবই বিরল ঘটনা। বরং সেনাদের দরকারি সব সরঞ্জাম রয়েছে এমন বার্তাই সেখানে সব সময় প্রচারিত হচ্ছে।
রাখঢাক সত্ত্বেও স্বেচ্ছাসেবকদের অবদান মাঝেমধ্যে প্রকাশ হয়ে যায়। যেমন গত এপ্রিলে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এসব স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপের ব্যাপারে বলা হয়, "আমাদের সেনাদের যা যা দরকার, তার সবই আছে। তবু মায়েদের মন তো মানে না, তারা আরও অনেক কিছু পাঠাতে চান।"
রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বাইরের আলোচনায় ইউক্রেন যুদ্ধের সমর্থকরা বলছেন, বেসামরিক অনুদান এ যুদ্ধ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। রুশ সামরিক বাহিনীর সমর্থক ব্লগাররাও নাইট ভিশন সরঞ্জাম আর ড্রোন কিনতে সকলের প্রতি আর্থিক অনুদান দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।
এমন একজন ব্লগার লিখেছেন, "পুরো পশ্চিমা দুনিয়া ইউক্রেনকে সহায়তা (ড্রোন ও নাইট ভিশন) দিচ্ছে। অন্যদিকে, এ ধরনের সরঞ্জামের অভাবে আমাদের সেনারা মারা পড়ছে।"
রাশিয়ায় এসব সরঞ্জামের উৎপাদন সীমিত। বেশিরভাগই আসে আমদানির মাধ্যমে। পাওয়া যায় স্পোর্টিং সরঞ্জামের দোকান বা অনলাইন স্টোরে। রুশ সেনাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চীনা কোম্পানি ডিজেআই এর তৈরি বেসামরিক খাতের জন্য নির্মিত ড্রোনগুলি।
এব্যাপারে জনপ্রিয় রুশ সামরিক ব্লগার স্টার্শে এডি লিখেছেন যে, 'ডিজেআই এর মতো বেসরকারি ভোক্তা বাজারের জন্য উৎপাদিত ড্রোন আমাদের সামরিক অভিযানের এতটাই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে যে এগুলো ছাড়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার কল্পনাই করা যায় না।"
নাতালিয়া আবিয়েভা টাইমসকে ক্যামেরা জায়ান্ট নিকনের তৈরি একটি প্রোস্টাফ-১০০০ লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডারের ছবি দেখান, এটি তিনি ৪০০ ডলার মূল্যে কিনেছেন। নিকন এটি বন্যপ্রাণি শিকারী বা চিত্রগ্রাহকদের জন্য তৈরি করেছে। কোম্পানিটির দাবি, এটি দিয়ে ৬০০ মিটার দূরে থাকা একটি হরিণকে শনাক্ত করা যায়।
আবিয়েভা বলেন, "এটি দিয়ে সব কিছু আরও দ্রুত ও ভালোভাবে (শত্রুর অবস্থান শনাক্ত ও তার দূরত্ব নির্ণয়) করা সম্ভব, তাই নয় কি!"
নাতালিয়ার স্বামী রুশ সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন পদমর্যাদার একজন জুনিয়র কর্মকর্তা। যুদ্ধ শুরুর পর তাকে ইউক্রেনে মোতায়েন করা হয়। তখন থেকেই স্থানীয় সামরিক ঘাঁটিতে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে স্বামীর খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন এ নারী। পরিচিত সামরিক সার্জনদের মাধ্যমে দরকারি অনেক সরঞ্জাম পাঠানোর অনুরোধ, এরপর থেকেই পেতে শুরু করেন নাতালিয়া।
একবার একজন সার্জন তার কাছে জরুরি ভিত্তিতে ধমনীতে জমাট বাধা রক্ত অপসারণের সরঞ্জাম চান। এটি সংগ্রহে নিজ শহর থেকে ৭০০ মাইল দূরে সেন্ট পিটার্সবার্গে যান, তারপর সেখান থেকে পাঠিয়ে দেন এমন ১০টি যন্ত্র। ফিরে এসে এক সপ্তাহ পর ওই সার্জনের সাথে দেখা হলে তিনি নাতালিয়াকে জানান, তার পাঠানো সাহায্য অনেক প্রাণ বাঁচিয়েছে। এরমধ্যেই ৬টি সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে।
নাতালিয়া বলেন, "আমি সেদিন উপলদ্ধি করলাম, চাইলে আমিও ছয়টি জীবন বাঁচাতে পারি।"
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস