ক্রিকেট রঙ্গ: রিচার্ড হ্যাডলির রঙিন ক্রিকেট
আইসিসির হল অব ফেমে অন্তর্ভুক্ত কিউই কিংবদন্তি স্যার রিচার্ড হ্যাডলি। আক্ষরিক অর্থেই একসময় সমগ্র নিউজিল্যান্ড বোলিংয়ের ভার নিজের কাঁধে বহন করেছেন তিনি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে টেস্ট ও ওয়ানডে মিলিয়ে উইকেট নিয়েছেন ৫৮৯টি। ব্যাট হাতেও করেছেন প্রায় পাঁচ হাজার রান।
খেলোয়াড়ি জীবনে অবসরের পর একজন মিডিয়া এক্সপার্ট হিসেবে ধারাভাষ্যকার ও বিশ্লেষকের ভূমিকায় নিয়মিতই দেখা গেছে বর্তমানে ৭০ বছর বয়সী স্যার হ্যাডলিকে। জাতীয় নির্বাচক প্যানেলের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
সব মিলিয়ে ক্রিকেটের সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের একজন স্যার হ্যাডলি। অন্য অনেক কাজের ফাঁকে অবসরে বেশ কিছু বই লিখেছেন তিনি, যেখানে তুলে ধরেছেন ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মজার ঘটনার কথা। আপনাদের সামনে হাজির করছি স্যার হ্যাডলির এমনই কিছু মজার অভিজ্ঞতা।
মেঘমুক্ত মাঠ, কর্দমাক্ত আকাশ!
১৯৬০ সালে জ্যামাইকার সাবিনা পার্কে চলছিল ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে একটি টেস্ট ম্যাচ। শেষ পর্যন্ত ড্র হওয়া সেই ম্যাচের কথা এত দিন বাদে মনে করার আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু তবু সেই ম্যাচটি স্মরণীয় হয়ে আছে এক ধারাভাষ্যকারের করা অদ্ভুত ভুলের কারণে। আবহাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলে বসেন, 'Well, it's a nice day here at Sabina Park. The wind is shining and the sun is blowing gently across the ground.'
পাঠক, নিশ্চয়ই ওপরের এই উক্তিটাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছে? বাংলাদেশের দুজন ধারাভাষ্যকারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই একই ধরনের ধারাবর্ণনা। বলা হয় তাঁরা খেলার বর্ণনা করতে গিয়ে উত্তেজনায় কাব্যিক হওয়ার চেষ্টা করে খেলার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলতে থাকেন, 'আজ মেঘমুক্ত মাঠ, কর্দমাক্ত আকাশ, মাঠ চলে গেল বলের বাইরে!'
রবার্ট কেনেডির দুর্ভাগ্য
এবারের গল্পটা রবার্ট কেনেডিকে নিয়ে। না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল রবার্ট কেনেডির কথা বলছি না। এই রবার্ট কেনেডি হলেন নিউজিল্যান্ডের হয়ে মোট ১১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা রবার্ট কেনেডি।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। তরুণ ফাস্ট বোলার রবার্ট কেনেডি সদ্যই পা রেখেছেন আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায়। নেপিয়ারের ম্যাকলিন পার্কে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে খেলছিলেন তাঁর দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচ। কিন্তু সেই ম্যাচেই তিনি এমন একটি বোলিং স্পেলের মালিক বনে যান, যা হয়তো আজও দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে তাঁকে।
কী করেছিলেন সেদিন তিনি? নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একের পর এক ওয়াইড ও নো-বল ডেলিভারি দিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে তাঁর সেদিনকার ৯ ওভারের স্পেলে ওয়াইড ছিল পুরো এক ডজন, আর নো-বলের সংখ্যা ৫।
বলাই বাহুল্য, সুযোগের অপেক্ষায় ওত পেতে থাকা ধারাভাষ্যকারেরাও সেদিন মজা নিতে ছাড়েননি তাঁর। জন রাইট ঠাট্টা করে বলেন, 'রবার্ট কেনেডির নিজের লাইন নিয়ে খুব সমস্যা হচ্ছে। এই ওভারটি খুব লম্বা হতে চলেছে। চলুন আশা করি, লাইট জ্বলে ওঠার আগেই যেন তিনি ওভারটি শেষ করতে পারেন!' অথচ জন রাইট যখন কথাটা বলছিলেন, তখন ঘড়িতে বাজে সবে বেলা ৩টা ১০; আর মাঠে ফ্লাডলাইট জ্বলার কথা ৬টা ৪৫-এ।
এদিকে গ্র্যান্ট নেসবিট স্যার হ্যাডলির দিকে তাকিয়ে বলেন, 'আমার রেস আছে, রেসের ধারা বর্ণনা শুনতে হবে।' যখন স্যার হ্যাডলি জানতে চাইলেন ঘৌড়দৌড় কখন শুরু হবে, তিনি জবাব দিলেন, 'বিশ মিনিটের মধ্যে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে (রবার্ট কেনেডি) যেভাবে বল করছে, তাতে আমি হয়তো রেসটা মিসই করব।'
বাদ যাননি স্বয়ং স্যার হ্যাডলিও। ম্যাচের বিরতির সময় এক অনুষ্ঠানে তিনি অতিথিদের স্বাগত জানাতে গিয়ে বলেন, 'রবার্ট কেনেডি আমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তিনি এখনো তাঁর কোটার ওভারগুলো শেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।'
যত কাণ্ড জকের
১৯৭৮ সালে নিউজিল্যান্ডের এক নম্বর উইকেটকিপার হিসেবে ইংল্যান্ডে যান জক এডওয়ার্ডস। তবে তিনি ছিলেন মূলত একজন ব্যাটার। ফলে উইকেটের পেছনের বাড়তি দায়িত্ব প্রভাব ফেলছিল তাঁর সামগ্রিক পারফরম্যান্সে। ব্যাট হাতে লজ্জাজনক সব স্কোর উপহার দিয়ে চলেছিলেন তিনি। উইকেটকিপার হিসেবেও হচ্ছিল ভরাডুবি।
ট্রেন্টব্রিজে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টে একটু বেশিই খারাপ করে ফেলেন জ্যাক। ইংল্যান্ড বেশ কিছু বাই রান তুলে নেয় তাঁর ভুলের কারণে। এ ছাড়া সহজ সহজ কয়েকটি ক্যাচও হাত ফসকায় তাঁর।
সব মিলিয়ে জকের অবস্থা এতটাই সঙ্গিন হয়ে পড়ে যে ধারাভাষ্যকার ট্রেভর বেইলি বলে বসেন,'If Jock Edwards went to the North Pole, he wouldn't catch a cold!' মানে বুঝতেই পারছেন, ওই সময় যদি জক উত্তর মেরুতেও যেতেন, তবুও ঠান্ডা ছুঁতে পারত না তাঁকে!
জককে নিয়ে আরেকটি মজার ঘটনা ঘটে ১৯৭৫ সালে। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সেবার অস্ট্রেলিয়ান ওয়ানডে কম্পিটিশন জয়ের জন্য ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে লড়ছিল নিউজিল্যান্ড।
নিজেদের ইনিংসের শুরুতেই ব্যাটিং বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া। ২৮ রানে সাত উইকেট হারিয়ে রীতিমতো ধুঁকতে থাকে তারা। তারপরও অবশ্য শেষ অবধি ৮০-এর ওপর রান তুলে ফেলে দলটি। \
সহজ লক্ষ্য তাড়া করতে নিউজিল্যান্ডের হয়ে ওপেনিংয়ে নামেন জক এডওয়ার্ডস। তিনি তখন ছোটখাটো, হাড্ডিসার শরীরের এক তরুণ। ভালোবাসেন বলকে বেদম পেটাতে। বিশেষত হুকি ও কাট তাঁর সবচেয়ে প্রিয়।
অন্যদিকে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বল হাতে ওপেন করেন ডেনিস লিলি। তরুণ জক তো তখন কাউকেই পরোয়া করেন না। তাই লিলির চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে পরপর কয়েকটি বল সীমানাছাড়া করেন তিনি। এর মধ্যে একটি বল তিনি উড়িয়ে দেন উইকেটকিপার রডনি মার্শের মাথার ওপর দিয়ে।
লিলি জককে স্লেজ করতে বলেন, 'হুক করতে কোথায় শিখলে, সনি?' (বয়োজ্যেষ্ঠরা বয়সে ছোট বা তরুণদের সম্বোধনে ইংরেজিতে 'সনি' বলে থাকে)
জকের প্রত্যুত্তর, 'এই তো, এ রকম বোলারদের খেলতে খেলতেই শিখছি, স্যার!'
যোগাযোগে গোলযোগ
ভারতীয় ক্রিকেট দলে বসে নানা ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের মিলনমেলা। বিভিন্ন ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণির মানুষেরা এক ছাতার তলায় আসে ভারতের হয়ে খেলতে। কিন্তু বিচিত্র মানুষেরা একত্র হলে অনেক সময় অবতারণা ঘটে নানা মজার ঘটনার।
সে রকমই একটি ঘটনা ঘটে ১৯৮০-৮১ মৌসুমে। ভারত তখন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলছে বেসিন রিজার্ভে। ব্যাটিংয়ে সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত। দ্রুত একটি সিঙ্গেল বের করতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিংয়ে টান লাগে তাঁর। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে ব্যাটিং চালিয়ে যেতে গেলে একজন রানারের সাহায্য ছাড়া উপায় ছিল না তাঁর। তাই কপিল দেব ক্রিজে আসেন রানার হিসেবে।
প্রথম কয়েক ওভার নির্ঝঞ্ঝাটে কাটে। কিন্তু এরপরই শুরু হয় চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। একটি সিঙ্গেলের ডাক দেওয়াকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির ফলস্বরূপ তিনজন খেলোয়াড়ই নিজেদের আবিস্কার করেন ক্রিজের একই এন্ডে। তিনজনই একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। বেচারা গাভাস্কার আউট হলেন।
এই ঘটনায় প্রচণ্ড নারাজ হন গাভাস্কার। তাই লাঞ্চ ব্রেকে দলের সবাইকে ডাকেন তিনি। সবাই তাঁর চারপাশে জড়ো হলে তিনি প্রশ্ন ছোড়েন, 'হচ্ছেটা কী? কপিল, তুমি পাঞ্জাবি ভাষায় ডাক দিয়েছ, কৃষ (কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত) ডাক দিয়েছে হিন্দুস্তানি ভাষায়, আর আমি ডাক দিয়েছি মারাঠি ভাষায়। কেন ভাইয়েরা, এখানে পুরোনো কায়দায় ইংরেজিতে ডাক দিলে কী হতো!'
ব্যাট যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে
১৯৭৬ সালে ভারত-নিউজিল্যান্ড তৃতীয় টেস্টে ব্যাট করছিলেন ভারতীয় কিপার সৈয়দ কিরমানী। তাঁর নামের পাশে ইতিমধ্যে জড়ো হয়েছে ১২ রান। এমন সময় একটি কুইক সিঙ্গেল নেওয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু ফিল্ডার ঝড়ের বেগে বলটি লুফে নিয়েই ছুড়ে দেন, ফলে ভেঙে যায় বোলারের এন্ডের উইকেট। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটাররা খুব ভালোভাবেই দেখেছেন, বল উইকেট উপড়ানোর সময় ক্রিজ থেকে অন্তত এক মিটার দূরে ছিলেন।
তবে মজার ব্যাপার হলো, উইকেট ভাঙার আগমুহূর্তে মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে ক্রিজে ব্যাট স্লাইড করেন সৈয়দ। এতে প্রাথমিক লাভ যেটি হয় তা হলো, ভেজা পিচের কিছুটা উঠে আসে তাঁর ব্যাটের সঙ্গে। ফলে তিনি হারিয়ে ফেলেন ব্যাটের গ্রিপ। ব্যাট তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে গিয়ে পড়ে উইকেটকিপারের এন্ডের দিকে। সৈয়দ তখনো ভাসছেন শূন্যে, তবে হাত থেকে ছুটে গিয়ে ব্যাট ক্রিজ অতিক্রম করে গেছে ঠিক। আম্পায়ার তাঁকেই গুরূত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বোধ করি।
তাই আম্পায়াররা অম্লানবদনে সৈয়দকে নট আউট ঘোষণা দেন। 'লাইফ' পেয়ে কিরমানী ৪৪ রান করেন।
পরবর্তীতে জিওফ হাওয়ার্থ তাঁর সতীর্থদের জানান, তিনি নাকি শুনতে পেয়েছেন আম্পায়াররা বলাবলি করছেন, 'এটি নট আউট, কারণ ব্যাট আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল।'
আবর্জনা!
১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ইংল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তান সফরকারী দলে ডাক পান স্যার হ্যাডলির ভাই ডেল হ্যাডলি। স্যার হ্যাডলির মতে, এটি ছিল একটি 'সারপ্রাইজ সিলেকশন'।
যদিও ইংল্যান্ডে বল হাতে খুব একটা সুখকর সময় পার করেননি ডেল, কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানে তিনি খুবই জোরে বল করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়ে যানÑপ্রায় ১৫ গড়ে ২১ উইকেট।
ঢাকায় পাকিস্তানের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্টে, পাকিস্তান ব্যাট করছিল তাদের দ্বিতীয় ইনিংসে। জয়ের জন্য ১৪৩ মিনিটের মধ্যে ১৮৪ রান করতে হতো তাদের। বুরকি ও আসিফ কিছু শর্ট সিঙ্গেল নিলে মাঠে আগত দর্শকেরা উন্মাতাল হয়ে পড়ে। থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে ফিল্ডিং করতে থাকা ব্রুস মারের দিকে দর্শকেরা ঢিলসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা ছুড়ে মারতে থাকে।
মারে এ ব্যাপারে অভিযোগ জানায় অধিনায়ক গ্রাহাম ডাউলিংয়ের কাছে। মারে গ্রাহামকে বলেন, আর একবারও আবর্জনা ছোড়া হলে যেন খেলা থামিয়ে দেওয়া হয়। এর কিছু সময় পরই মারের কাঁধের পেছন দিকে আঘাত হানে একটি কলা। মারে সেটি তুলে নিয়ে পিচের দিকে ছুটতে শুরু করেন।
মারেকে উইকেটের দিকে ধেয়ে আসতে দেখে গ্রাহাম ডাউলিং বোলার ডেলকে বোলিং বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু চোখের নিমিষে কতগুলো ঘটনা ঘটল: রান-আপ শুরু করা ডেল থামল না, তার মুঠো থেকে বল বেরিয়ে গেল।
ডেলের করা এই শর্ট বল আসিফের ব্যাট ছুঁয়ে চলে গেল গালি পজিশনে। ঠিক ওই মুহূর্তে গালি অবধিই আসতে পেরেছিলেন মারে। শূন্যে বলকে ভাসতে দেখে তিনি ড্রাইভ দেন, তালুবন্দি করেন বলটি। এক আজব দৃশ্যের অবতারণা ঘটে : মারের এক হাতে বল, অন্য হাতে কলা!
দুর্ভাগ্যের বিষয়, ডেলের এমন বীরোচিত প্রয়াস শেষ পর্যন্ত বিফলেই যায়। আম্পায়াররা 'ডেড বল' ডাক দেওয়ায়, আউট হিসেবে গণ্য হয়নি ডেলের ক্যাচটি।
শেষ যাত্রা?
ভারতের রাস্তায় ভ্রমণকে স্যার হ্যাডলির এতটাই রোমাঞ্চকর ও ভীতিজাগানিয়া বলে মনে হতো যে তিনি একে অভিহিত করেছেন 'আ ক্লোজ সেকেন্ড বিহাইন্ড রাশিয়ান রুলেত' হিসেবে।
হ্যাডলির ভাষ্যে, ভারতের রাস্তাঘাটে নিয়মকানুনের বালাই নেই। একসঙ্গে সব ধরনের যানবাহন নেমে পড়ে রাস্তায়। এত ভিড় চারদিকে যে গাড়িচালকদের সারাক্ষণই হর্ন বাজিয়ে চলতে হয়। অথচ এমন অবস্থাতেই অনেকে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি ছুটিয়ে চলেন।
১৯৯৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ক্রিকেট। টিভিএনজেডের হয়ে সেটি কভার করতে গ্র্যান্ট নেসবিট, ইয়ান স্মিথের সঙ্গে ভারতে হাজির হন স্যার হ্যাডলি। একদিন অনেক কষ্টে তাঁরা এমন একজন চালককে খুঁজে পান, যিনি রাজি হন তাদের হোটেলে পৌঁছে দিতে। প্রথমবারের মতো ভারতে আসা নেসবিটের ভাগ্যে ছিল 'সুইসাইড সিট' নামে পরিচিত চালকের পাশের ফ্রন্ট প্যাসেঞ্জার সিটে বসা।
গাড়ি রাস্তায় নামার কিছুক্ষণ পরই দেখা যায়, সংকীর্ণ রাস্তায় সেটি একের পর এক পাশ কাটিয়ে চলেছে প্রকাণ্ড সব ট্রাককে। ভয়ে তো নেসবিটের অবস্থা কাহিল। এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি যে কিছুক্ষণ পর পেছনের সিটে বসা রিচার্ড হ্যাডলি ও ইয়ান স্মিথের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, 'আমি সামনে বসতে একদমই পছন্দ করি না!'
বিন্দুমাত্র সহানুভূতি না দেখিয়ে স্মিথ জবাব দেন, 'এবং তুমি নিশ্চয়ই নিয়মটা জানো, নেসবো, সামনে বসা ব্যক্তির ওপরই বর্তায় ড্রাইভারকে টাকা দেওয়ার দায়িত্ব!'
এরপর কিছুটা বিরতি দিয়ে স্মিথ সুসংবাদটি দেন, 'কিন্তু আমরা যদি শেষ পর্যন্ত গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে না পারি, তাহলে তোমার টাকাটা বেঁচে যাবে।'
টাকায় স্বাক্ষর!
১৯৯৬ বিশ্বকাপের সময় রিচার্ড হ্যাডলিকে একটি গ্র্যান্ডস্লাম ফিল্ম ইউনিটের সঙ্গে বাসযোগে আহমেদাবাদ থেকে বরোদায় যাত্রা করতে হয়। চার ঘণ্টার সেই যাত্রায় ধারাভাষ্যকার ছাড়াও ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তানের অনেক ধারাভাষ্যকার ও টিভি ক্রু।
আড়াই ঘণ্টার মতো বাস চলার পর এক জায়গায় থামল বাস। অধিকাংশ যাত্রীই বাস থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি করতে থাকেন। কেউ কেউ পানীয় কেনেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে এ কথা ছড়িয়ে পড়ল যে বিশ্বকাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারকা খেলোয়াড়েরা বাসে রয়েছেন। হ্যাডলি ও অন্যান্য মহৎ ক্রিকেট ব্যক্তিদের দেখতে মুহূর্তের মধ্যেই ভিড় জমে যায় বাসের চারদিকে।
রিচার্ড হ্যাডলি বসে ছিলেন বাসের উইন্ডো সিটে। তাই তাঁর ওপর নজর পড়ে যায় উৎসুক জনতার। তারা জানালায় ধাক্কা দিতে থাকে হ্যাডলির অটোগ্রাফের জন্য। হ্যাডলিও খুশিমনে বিভিন্ন কাগজের টুকরো থেকে শুরু করে অ্যাড্রেস বুক, এমনকি টাকার ওপরও দিতে থাকেন নিজের স্বাক্ষর।
কিছুক্ষণ একটানা স্বাক্ষর করতে করতে হ্যাডলির মাথায় খেলা করে যায় একটি চিন্তা। তিনি ভাবেন, চার থেকে আট ডলার মূল্যমানের এসব টাকার নোটে যদি তিনি নিজের সই দেন, তাহলে নির্ঘাত এগুলোর মূল্য আরও বেড়ে যাবে!
ঠিক তখনই বাসের পেছনের দিকে বসা একজন ইংরেজি ক্রু মেম্বার ব্যঙ্গ করে বলেন, 'এই লোকটা (স্যার হ্যাডলি) যে জিওফ বয়কট নন, তা খুব সহজেই বলে দেওয়া যায়। বয়কট হলে টাকায় সই করতেন ঠিকই, কিন্তু এরপর সেগুলো নিজের কাছে রেখে দিতেন!'
সাফল্যের সূত্র
সে এমন একসময়ের কথা, যখন ক্রিকেট হন্যে হয়ে খুঁজছে একটি নতুন চরিত্রকে। এমন কাউকে, যাকে ভালোবাসা যাবে, অথবা যাবে ঘৃণা করা। ঠিক তখনই ক্রিকেট বিশ্বের প্রতি অস্ট্রেলিয়ার উপহার হিসেবে আবির্ভূত হন মার্ভ হিউজ। ভিক্টোরিয়ার এক স্থূলকায়, গোঁফওয়ালা ফাস্ট বোলার।
মার্ভ ছিলেন একজন 'লার্জার-দ্যান-লাইফ' ব্যক্তিত্ব। তাঁর মনটাও ছিল বিশাল এবং দেশের জন্য একজন বড় সম্পদও ছিলেন তিনি। মাঠের ভেতর ও বাইরে যেসব কাণ্ড-কারখানায় তিনি জড়াতেন, সেগুলোর ব্যাপারে প্রচুর চমকপ্রদ কাহিনিও রয়েছে।
সে রকম একটি কাহিনি রিচার্ড হ্যাডলি শোনেন ১৯৯৬-৯৭ সালে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের কোচ স্টিভ রিক্সনের কাছ থেকে। মার্ভ হিউজকে এই অস্ট্রেলিয়ান ডাকতেন 'দ্য ফ্রুট ফ্লাই' নামে।
পাকিস্তানের জাভেদ মিয়াঁদাদকে বল করতে গিয়ে বেশ ঝক্কি পোহাতে হতো মার্ভের। মিয়াঁদাদ ব্যাট হাতে রীতিমতো শাসন করতেন তাঁকে। মিয়াঁদাদের হাতে মার্ভকে বেদম প্রহারের শিকার হতে দেখে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক অ্যালান বোর্ডারও। এতটাই যে মিয়াঁদাদ ব্যাটে এলে মার্ভের হাতে খুব কমই বল তুলে দিচ্ছিলেন তিনি।
মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে এক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া খেলছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের একটি উইকেটের পতন ঘটলে ক্রিজে আসেন মিয়াঁদাদ। মার্ভ তাঁর অধিনায়কের কাছে পীড়াাপীড়ি করতে থাকেন তাঁকে বোলিংয়ে আনার জন্য। শুরুতে অ্যালান রাজি ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মার্ভের কাছে হার মানেন তিনি।
এবং সেটি করার সময় দারুণ একটি কৌশল খাটান অ্যালান। মার্ভের কানের কাছে একের পর এক নেতিবাচক কথা বলে তাঁকে তাতিয়ে দেন তিনি। ফলে মার্ভও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন, যে করেই হোক মিয়াঁদাদকে আউট করতেই হবে।
হ্যাঁ, মিয়াঁদাদকে আউট করেছিলেন তিনি। মার্ভের একটি বাউন্সার খেলতে ব্যর্থ হন মিয়াঁদাদ। বল মিয়াঁদাদের গ্লাভসে চুমু খেয়ে উঠে যায় গালিতে। বল লুফে নেন স্টিভ ওয়াহ।
স্বভাবতই, উইকেট উদযাপন করতে অস্ট্রেলিয়ার সকল খেলোয়াড় সমবেত হন স্টিভ ওয়াহকে ঘিরে। কিন্তু উইকেটটির মূল নায়ক যিনি, সেই মার্ভ গেলেন কই! মাঠে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না তাঁকে।
মার্ভ কোথায় ছিলেন, জানেন? ৯০ মিটার দূরে মাঠের বাউন্ডারির বাইরে। সেখানে মিয়াঁদাদের প্রবেশের গেট ধরে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মিয়াঁদাদ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেই তিনি হাত বাড়িয়ে বলে উঠলেন, 'টিকেটস প্লিজ!'