বজ্রপাত যদি একই দিনে, একই জায়গায় হয়, তাহলে কী হবে?
আচ্ছা, দুনিয়ার সব বজ্রপাত যদি একই দিনে, একই জায়গায় হয়, তাহলে সেই স্থানটার কী হবে?
লোকে বলে, একই জায়গায় নাকি দুবার বজ্রপাত হয় না! ভুল বলে তারা।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসের আলোকে পর্যালোচনা করলে কথাটা যে আজও টিকে আছে, তা মানুষকে অবাক করার কথা! এই প্রবাদ যারা বিশ্বাস করে, তারা আস্তে আস্তে মানবসমাজ থেকে বিলুপ্ত হলেই বরং তা স্বাভাবিক হতো।
জ্ঞানের বিস্তার তো এভাবেই হবার কথা, তাই না?
মানুষ প্রায়ই প্রশ্ন তোলে: বজ্রপাতের বিদ্যুৎকে কোনো এক উপায়ে আটকে ফেলে নিজেদের কাজে ব্যবহার করা যায় না? খালি চোখে দেখতে গেলে, আমাদের শক্তির সমস্যার দারুণ এক সমাধান কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে আছে! হাজার হলেও বজ্রপাত মানেই তো বিদ্যুৎ। আর বজ্রপাতের মধ্যে যথেষ্ট শক্তিও আছে।
কিন্তু সমস্যা একটাই- যেখানে চাই, সেখানে বাজকে পড়তে বাধ্য করার তো কোনো উপায় নেই!
সাধারণত একেকটা বজ্রপাতে যে পরিমাণ শক্তি থাকে, তা দিয়ে সাধারণ, ছাপোষা মানুষের একটা পরিবারের দিন দুয়েক আরামসে চলে যাবার কথা। এর অর্থ: এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, সাধারণত বছরে যেখানে এক শবার বজ্রপাত হয়, আপ্রাণ চেষ্টা করেও সেই বাজের শক্তি কাজে লাগিয়ে একটা বাড়ির চাহিদা মেটাতে পারবে না।
বিশ্বের যেসব জায়গায় অনেক বেশি বজ্রপাত হয়- এই যেমন ফ্লোরিডা আর কঙ্গোর পূর্ব দিককার এলাকা- সেখানেও সূর্যালোকের ফলে মাটিতে চলে যাওয়া শক্তি, বজ্রপাতের ফলে মাটিতে যাওয়া শক্তির চাইতে কমপক্ষে দশ লাখ গুণ বেশি। বজ্র থেকে শক্তি সংগ্রহ করাকে তাই তুলনা দেওয়া যায় টর্নেডোর হাওয়াকে কাজে লাগানো বায়ুকলের সঙ্গে...দুটোই ভাবনার জগতে অসাধারণ হলেও দুনিয়ার বুকে অবাস্তব!
ওপরের প্রশ্নটার জবাব নিয়ে এখন ভাবা যাক। ধরে নিলাম, পৃথিবীর বুকে কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানে সব বাজ একসঙ্গে পড়ল। 'একই স্থানে' বলতে ধরে নিলাম: বাজগুলো একসঙ্গে, পরস্পরের গায়ে গা ঠেকিয়ে সমান্তরালে পতিত হচ্ছে। বজ্রের দেহের যে অংশটা বিদ্যুৎ পরিবহন করে, সেটা এক বা দুই সেন্টিমিটার ব্যাসের। আমাদের এই বান্ডিলে আছে প্রায় দশ লাখ ভিন্ন ভিন্ন বজ্র, তার মাঝে ব্যাস হবে কমবেশি ৬ মিটার।
যেকোনো শক্তি-সংক্রান্ত আলোচনায় একক হিসেবে সাধারণত হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমাকে তুলনায় আনা হয়। তাই সেটার সাপেক্ষেই বলা যায়: আমাদের আলোচ্য পরীক্ষার বজ্র-বান্ডিল হবে দুটো পারমাণবিক বোমার সমান শক্তিধারী। আর যন্ত্রপাতির সাপেক্ষে বললে: একটা গেম কনসোল আর টিভিকে কয়েক মিলিয়ন বছর চালাতে পারবে সেই শক্তি। অথবা...যুক্তরাষ্ট্রের পুরো 'পাঁচ' মিনিটের বৈদ্যুতিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে!
বাস্কেটবল কোর্টের মাঝখানে যে সরু বৃত্তটা থাকে, সেটার সমান হবে ওই বজ্র-বান্ডিল। কিন্তু মাটিতে পড়ার পর যে গর্তটা হবে, তার আকৃতি হবে আস্ত কোর্টের সমান!
বান্ডিলের ভেতরে যে বাতাস আটকা পড়বে, সেটা পরিণত হবে উচ্চশক্তিসম্পন্ন প্লাজমায়। আলো এবং উত্তাপ যা জন্ম নেবে, তা কয়েক মাইল দূরত্বে থাকা জিনিসপত্রও জ্বালিয়ে দেবে! শকওয়েভের ফলে গাছ তো মাটিতে পড়বেই, দালানকোঠাও আস্ত থাকবে না একটাও। সার্বিক বিচারে বলতে গেলে, হিরোশিমার সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য থাকবে বলে মনে হয় না।
বজ্রপাত থেকে কীভাবে রক্ষা পাব?
লাইটনিং রড
লাইটনিং রড কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ওগুলো বজ্রপাতকে দূরে হটায় বাতাসের শক্তি শুষে নিয়ে তা মাটিতে 'ঢেলে' দেওয়ার মাধ্যমে। ফলে মেঘ থেকে মাটির ভোল্টেজের পটেনশিয়াল কমে যায় এবং বজ্রপাতের সম্ভাবনাও অনেকটা কমে আসে। তবে আমেরিকার ন্যাশনাল ফায়ার প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশন এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নয়।
জানি না, সংস্থাটি আমাদের প্রশ্নের বজ্র-বান্ডিলের ব্যাপারে কী বলবে। তবে লাইটনিং রড যে আমাদের সেই বান্ডিলের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না, সেটা পরিষ্কার। তামার এক মিটার ব্যাসের তার অবশ্য তত্ত্বীয়ভাবে না গলেই বজ্রপাতের বিদ্যুৎ পরিবহন করতে সক্ষম। কিন্তু বান্ডিলটা যখন রডের শেষ মাথায় পৌঁছাবে, তখন মাটি খুব ভালোভাবে তা গ্রহণ করতে পারবে না। তাই তখন যে বিস্ফোরণ হবে, তাতে আপনার-আমার বাড়ির আর আস্ত থাকার কথা না।
ক্যাটাটুম্বো লাইটনিং
সারা বিশ্বের সব বজ্রপাত একত্র করার বুদ্ধিটা অবশ্যই অবাস্তব। কিন্তু কোনো ছোট্ট একটা এলাকার ক্ষেত্রেও কি তা সম্ভব না?
বিশ্বের এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে সারাক্ষণ বজ্রপাত হতে থাকে...তবে ভেনেজুয়েলার এক জায়গায় প্রায় তেমনটা হয় বলা চলে। লেক মারাকাইবোর দক্ষিণ তীরে দেখা যায়, অদ্ভুত এক ঘটনার দৃশ্যায়ন: রাতের বেলায় বজ্রঝড় চলতেই থাকে তো চলতেই থাকে! এমন দুটো স্থান আছে, যেখানে প্রায় প্রতি রাতেই বজ্রঝড় হয়: একটা ওই হ্রদ, আরেকটা পশ্চিমের একটু দূরের স্থান। সেখানে প্রতি দুই সেকেন্ডে একবার করে দেখা যায় বজ্রের ঝলকানি। বলা যায়, লেক মারাকাইবো আসলে পৃথিবীর বজ্রপাতের রাজধানী!
ক্যাটাটুম্বোর বজ্রঝড়ের ফলে সৃষ্ট বজ্রগুলোকে যদি কোনোভাবে একটা লাইটনিং রডের মাধ্যমে এক করা যায় এবং সেটা ব্যবহার করা যায় কোনো বিশাল ক্যাপাসিটর চার্জ করার কাজে, তাহলে তাতে যে শক্তি জমা হবে, তা ব্যবহার করে একটা গেম কনসোল ও প্লাজমা টিভি চালানো যাবে প্রায় এক শতাব্দী ধরে!
তবে তা যদি সম্ভব হয়, তাহলে প্রথমে যে প্রবাদটা বললাম, তাকে নতুন করে লিখতে হবে!