মরণসাগরপারে: অবন ঠাকুর আর তিনতরেত্তো
আজ এক অদ্ভূত শিল্পীর গল্প বলবো, কিন্তু গল্প বলবার আগে একটু আমড়াগাছি করবো, সেটা সইতে হবে কিন্তু। করোনার এই ভয়াল মৌসুমে লোকে ফিরে ফিরে মহামারীর দিনগুলো স্মরণ করছে, পুরনো ছড়ার সেই ব্ল্যাক ডেথ, কবি আপোলিনেয়ারের মৃত্যুদূত সেই স্প্যানিশ ফ্লু, শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের প্লেগ... আমি বলবো কলকাতার প্লেগের কথা, যে প্লেগের কথা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন। দিনরাত অবনীন্দ্রনাথ তখন ছবি আঁকছেন আর এস্রাজ বাজাচ্ছেন, কলকাতার প্লেগে ঘরে ঘরে মানুষ মরছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বাড়ির সকলকে নিয়ে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছেন, চুন বিলি করছেন, সিস্টার নিবেদিতার সাথে মিলে পাড়ায় পাড়ায় রবীন্দ্রনাথ ইন্সপেকশনে যাচ্ছেন।
প্লেগ এসে একদিন ঢুকল অবনীন্দ্রনাথের ঘরে, তাঁর ন'দশ বছরের মেয়েটি মৃত্যুবরণ করলো। ফুলের মতো মেয়ে, সন্তানশোকে অবনীন্দ্রনাথ ঘর ছাড়লেন, চৌরঙ্গীতে একটা বাড়িতে যেন পালিয়ে এলেন। একটা টিয়েপাখির ছানা কিনে সেটাকে ছোলা-ছাতু খাওয়ালেন আর বুলি শেখালেন, নাম দিলেন 'চঞ্চু'। সেসময় একদিন আর্টস্কুলের ডাক এলো, সাহেব ওপরওয়ালা আতসীকাচ ধরে তাঁকে দেখালেন মোগল মিনিয়েচারে আঁকা বকপাখি, অসামান্য তার ডিটেইল। অবনীন্দ্রনাথ দেখলেন সুন্দরের আর সুক্ষ্ণতার অসামান্য সেই আয়োজনে কেবল ভাবের অভাব, বাড়ি ফিরে অবনীন্দ্রনাথ আঁকলেন 'শাজাহানের মৃত্যু', মৃত্যুপ্রতীক্ষিত সম্রাটের ব্যথা এসে ভর করলো সন্তানশোকাকুল পিতার তুলিতে, বুকের সমস্ত ব্যথা উজাড় করে ছবি আঁকলেন তিনি। মহামারীও যে ফুল ফোটায়, সে ফুল বেদনার, সে ফুল শিল্পের, কালে কালে সে কথার সাক্ষী হলো শিল্পের ইতিহাস।
আজ যে শিল্পীর গল্প শোনাবো, তাঁর যশস্বী নামও মহামারীর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, তিনি ইয়াকোপো তিনতরেত্তো, ভেনিসের শিল্পী, ওঁর জন্মের সময়কার ভেনিস রীতিমতো সাতশো বছর পার করে ফেলেছে সার্বভৌম নগরী হিসেবে, চিত্রশিল্পের শহর সে, রেশমের শহর, রঙ্গিলা কাঁচের শহর। তার নাম হয়েছে 'লা সেরিনিসিমা' অর্থাৎ শান্তি-সুমধুরা। জর্জিয়ন কিংবা তিশানের মতো শিল্পীরা ভেনিসে এসেছিলেন অন্যান্য জেলা থেকে, কিন্তু তিনতরেত্তো জন্মেছিলেন খোদ ভেনিসেই, রিয়াল্টো ব্রীজের কাছাকাছি একটা জল ছলছল জায়গায়, এই ষোল শতকের ভেনিসিয়ান ছবির দুনিয়ায় দানবের মতো শক্তি নিয়ে আবির্ভুত হয়েছিলেন, রেনেসাঁর শেষপর্বের সবচেয়ে বিখ্যাত শিল্পী তিনি।
অল্পবয়েসে আমার মতো অনেকেই হয়তো এই শিল্পীর নাম প্রথম শুনেছেন সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা পড়তে গিয়ে, উপন্যাসের নাম 'টিনটোরেটোর যীশু'। জাঁ পল সার্ত্রে এই শিল্পীকে বলতেন 'চলচ্চিত্রকার', এমন নাটকীয় এমন অভিনব তাঁর শিল্প, আর ডেভিড বোয়ি বলতেন—উনি চিত্রশিল্পীদের ভিতর রকস্টার যেন, ইগোয় উদ্দীপনায় বদমেজাজে আর কারো সাথে তুলনা চলে না। যেমন তাঁর তুলির জোর, তেমনি সেই তুলির ক্ষীপ্র- অসংযত গতি। সেই তুলিকে সমসাময়িক শিল্পীরা রীতিমতো ডরাতেন। আমাদের এস এম সুলতানের মতোই তিনতরেত্তোর আঁকা মানুষ ছিল সুঠাম, পেশীবহুল, পিটার পল রুবেন্সের আঁকা মানুষদের মতো তেলালো নয়, সত্যিকারের বলিষ্ঠ মানুষ, যেন তাদের শরীর তাদের জীবনের গল্প বলছে, তাদের চেতনাকে দীপ্যমান করে তুলছে। তিনতরেত্তোর ক্যানভাস বিশাল, সিনেমাটিক; তেমনি তাঁর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিটেইল।
শিল্পকলাকে তিনতরেত্তো বলতেন এমন এক কাজ, যা উদার আর নিষ্পাপ। ছবির পেছনের মানুষটিও ছিল ছবির মতোই বিচিত্র, তাঁর মন ছিল শিল্প, বিজ্ঞান আর ব্যক্তিগত বিশ্বাসের এক নিদারুণ সমষ্টি। তাঁর রোখ খুব, সংকল্প খুব স্থির, উচ্চাশাও প্রচন্ড। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চিত্রকলার রথী-মহারথীরা—এই যেমন ভেলাজকেস, রেমব্রা, গুস্তাভ কুর্বে, পল সেজান...এঁরা এই তিনতরেত্তোর শিল্পীসত্তার কাছে শিক্ষা নিয়েছেন। শুধু চিত্রশিল্পীদের নন, তিনি প্রভাবিত করেছিলেন শতবর্ষ পরের অন্যান্য শিল্পীদেরও, প্রমাণ ডেভিড বোয়ি, স্ট্যানলি কুব্রিক। এ এমন এক নাম যাঁকে বাদ দিয়ে ইউরোপের চিত্রকলা পড়ানো যাবে না।
১৫৭৬ সালের গ্রীষ্মের কথা, প্লেগের প্রকোপে ভেনিস তখন ভুতুড়ে নগরী। এমনিতে ভেনিস বন্দরনগরী, এন্তার বন্দরের জাহাজ ভিড়ছে প্রতিদিন সেখানে, নামছে নাবিক আর খালাসী, মালসামান নামছে, নামছে জাহাজের ইঁদুর। ভেনিসের লাজারেত্তো নামের দ্বীপে সেকালে চল্লিশদিনের জন্য কোয়ারেন্টিন্ড করে রাখা হতো ভেনিসে আসা নাবিকদের। তবু প্লেগের ধাক্কাটা ভেনিসের দিকে আসছিলই। যে নগরীর বাসিন্দারা ভাবতো তারা নবম শতকীয় সন্ত মার্কের অভয়হস্তের ছায়ায় নিরাপদ, দু'বছরের মধ্যে সেই নগরীর জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ তখন ব্ল্যাক ডেথের কারণে শেষ হয়ে গেছে। 'লা সেরিনিসিমা' আর শান্তি সুনিবিড় নেই। সামান্য পয়সাকড়ি যাদের আছে, তারা ভেনিস ছেড়ে মূল-ভূখন্ডে পালিয়েছে। পথে-পথে প্লেগে মৃত মানুষের স্তূপ পচছে, ভিখিরিদের দিয়ে লাশ সরানোর কাজ করাবার চেষ্টা চলছে। জেলখানায় ছুটি হয়ে গেছে, আসামীরা ছাড়া পেয়েছে।
এই প্লেগের সময় কিন্তু তিনতরেত্তো ভয় পেয়ে পালিয়ে যাননি, সাধারণ মানুষের মতো ভেবে নেননি এই প্লেগ ঈশ্বরের ক্ষমাহীন ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ, জীবনে বহু প্লেগ দেখেছেন তিনি। আর ভেনিস ছেড়ে তিনি কোথায় পালাবেন? ভেনিসের পথের বদলে এই যে অজস্র খাল...এই খালের মুহুর্মুহু ঢেউয়ে যে আলোর দোলা সেটাই তো তাঁর ক্যানভাসে এসেছে, ভেনিসের বাড়িঘর আঙিনা এই যে একের ওপর আরেক দাঁড়িয়ে আছে...ফলে তৈরি হয়েছে আলো-ছায়ার এক আশ্চর্য লীলা, সেটাই তো তাঁর ছবিতে লীলায়িত হয়েছে। ছবিতে আলো-ছায়ার এই প্রমত্ত বৈপরীত্যই তো তাঁকে 'তিনতরেত্তো' বানিয়েছে। তিনি আঁকলেন সন্ত রশ প্লেগরোগীদের আরোগ্য করছেন সেই বিখ্যাত দৃশ্য। সিস্টিন চ্যাপেলের মতো সিলিং উপুড় করে আঁকলেন 'দ্য ব্রেইজেন সারপেন্ট' (নির্লজ্জ সর্পদানো), এমনকি মিকেলেঞ্জেলোর চেয়েও বড় স্কেলে পুরো একটি বিল্ডিংকে (স্কলা গ্রান্দে দি সান মার্কো) ধরে কাজ করলেন তিনি। এই প্লেগপীড়িত ভেনিসেই শিল্পী তিনতরেত্তো রয়ে গেলেন, কয়েক শতাব্দী পরের আরেক শিল্পী অবনীন্দ্রনাথের মতো করে কন্যার মৃত্যুশোকে বিলাপ করলেন।
সেকালের ভেনিসে, মানে তিনতরেত্তোর শৈশবের ভেনিসে বাস করতো হাজার হাজার বয়নশিল্পী, শত শত রঞ্জক। তিনতরেত্তোর বাপ বাতিস্তা ছিলেন পশম-রঞ্জক, উল রঙ করতেন, পরে তিনি হলেন রেশম-রঞ্জক। তিনতরেত্তোর নামের মানে হচ্ছে 'ক্ষুদে রঞ্জক'। ভাপে-অন্ধকারে সেইসব ঘরে টগবগিয়ে ফুটছে রঙ ভরা বিশাল বিশাল পাত্র, রঙ গুঁড়ো হচ্ছে, রঙ মেশানো হচ্ছে। এমন ঘরের দেয়ালেই একদিন একটুকরো কাঠকয়লা দিয়ে আঁকতে শুরু করলেন ক্ষুদে রঞ্জক অর্থাৎ তিনতরেত্তো। এই ছবির নমুনা দেখে তাঁর স্বজনরা অবাক হলেন, বাতিস্তা তাঁকে ভর্তি করে দিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী তিশানের ওয়ার্কশপে। তিশান তখন ভেনিসীয় চিত্রজগতের গুরু, ইউরোপ মাতিয়ে ছবি আঁকছেন, রাজা-রাজড়ারা তাঁর ছবি পেলে বর্তে যান।
এই গুরু কিন্তু রঘুনাথ শিরোমণির সেই গুরুর মতো ভারী হিংসে-ভরা, তিনতরেত্তোর কাজের নমুনা আর ক্ষমতা দেখে তিশান ছাত্রকে তাড়িয়ে দিলেন। তাতে কি আর এই শিষ্য দমে! গুরুহীন ছাত্র ফার্নিচার পেইন্টারদের কাজ দেখে দেখে ড্রয়িং শিখতে লাগলেন, তাঁর আশপাশে রাজ্যের যত কারিকরের বাস—কেউ সাবান বানায়, কেউ সিল্ক রঙ করে, কেউ জুতো-সেলাই করা মুচি। স্বশিক্ষিত এই শিল্পীর সাথে তিশান সারাজীবন শত্রুতা করেছেন।
গ্রান্ড ক্যানালের পাশে থাকতেন তিশানের বন্ধু শিল্পসমালোচক আরেতিনো, আরেতিনো শিল্পজগতের সব্বাইকে চিনতেন। এই আরেতিনোর নজর কাড়বার জন্য তিনতরেত্তো ওঁর মহল্লায় নির্মানাধীন বাড়ির দেয়ালে ছবি আঁকা শুরু করলেন। আরেতিনো দেখলেন— কে এই লোক? যার ড্রয়িং মিকেলেঞ্জেলোর মতো পোক্ত, যার তুলি তিশানের মতো বর্নাঢ্য অথচ স্টাইলে উলটো! এ তো সাংঘাতিক! বাক্স ফুটো করে প্রদীপের আলোকসম্পাত করে সে দ্যাখে স্পটলাইটিং কেমন হবে, মোমের মানুষ গড়ে বাতির আলোয় রেখে ছায়া কোথায় কোথায় পড়ে সেটা শেখে। আরেতিনো চমৎকৃত হলেন।
তিশানের ছবি যেখানে রাজারাজড়া আর ধনাঢ্য পোপের মসৃণ জীবনের খোশামুদে চিত্রণ, যেখানে তুলির আঁচড় প্রায় অদৃশ্য, উজ্জ্বল রঙ, কোমল শাদা আন্ডারকোটের ওপর অত্যন্ত সুক্ষ্ণ ডিটেইলের খেলা; তিনতরেত্তো সেখানে গর্জমান, সৌন্দর্য নিয়ে তিনি আদৌ চিন্তিত নন, আলোছায়ার কিয়েরোস্কুরো টনটন করছে, শরীরগুলো মুচড়ে উঠছে নাটকীয়তায়, অ্যাম্বার কিংবা ব্রাউন আন্ডারকোটের ওপর স্বল্প ডিটেইলে সরাসরি ক্যানভাসে আঁকা ছবি, দগদগে তুলির কাজ, স্টাইল 'নন-ফিনিতো' তথা অসমাপিকা। ওঁর ছবি শুধু ছবি তো নয়, ছবি আর্তনাদ, ছবি প্ররোচনা, ছবি মুর্চ্ছনা, ছবি একই সঙ্গে ক্রিয়া- প্রক্রিয়া এবং ধ্যান। আর ছবি সমকালের তুচ্ছতম মানুষের গাঁথা।
তিনতরেত্তোর ছবি আঁকবার গতি এত বিধ্বংসী যে কেউ তাঁর সাথে এঁটে উঠতো না। শুধু কি তাই! তিনতরেত্তো ছবির দাম রাখতেন কম, অন্যের কমিশন পাবার লোভে সবচেয়ে কম বাজেট পেশ করতেন আর চোখের নিমিষে ছবি শেষ করতেন, যে কমিশন জিততে পারবেন না সেটাতে গিয়ে নিজের ছবি বিনামূল্যে উপহার দিয়ে আসতেন। চিত্রশিল্পী পাওলো ভেরোনেজের ছবি লোকের ভাল লাগছে বুঝতে পেরে তিনতরেত্তো ভেরোনেজের স্টাইল নকল করে ফেললেন। ভেরোনেজের ব্যবহৃত রঙগুলি ছিল নরম প্যাস্টেল কালার, উজ্জ্বল, চোখকাড়া, ঝকঝকে লেবু হলুদ- বাতাবিলেবুর গোলাপি- হালকা নীল- ফিকে সবুজ, তিনতরেত্তোও সেই জৌলুস নিয়ে এলেন। তবে ভেরোনেজের কম্পোজিশন ছিল পরিপাটি— যাকে বলে 'রেগুলার' ('দ্য ম্যারেজ অ্যাট কানা'), ক্ল্যাসিকাল, ওয়ান পয়েন্ট পার্সপেক্টিভে সাজিয়ে তোলা; বিপরীতে তিনতরেত্তোর পারস্পেক্টিভ মানে ছবি আঁকবার দৃষ্টিকোণটাই ডায়াগোনাল ('দ্য প্রেজেন্টেশন অভ দ্য ভার্জিন'), তেরচা, ফিগারগুলো কখনো ওপর থেকে ঝুলন্ত ('জেলখানায় সন্ত রশ আর পরী'), কখনো পেছন থেকে দেখানো ('অ্যাপোলো আর ড্যাফনি'), কম্পোজিশন চমকপ্রদ, স্কেল বিশাল ('প্যারাডিসো' তে মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০০, অর্ধশত ক্যানভাস জুড়ে টেনিসকোর্টের সমান বড় ক্যানভাসটা সেলাই করা হয়েছিল)।
তিনতরেত্তো অনেকগুলো 'লাস্ট সাপার' এঁকেছেন, সেখানে বিদায়ী ভোজসভার করুণাঘন কোমল দৃশ্যের শান্ত-সমাহিত ফিগারের বদলে তিনতরেত্তোর ফিগারগুলো অস্থির-গতিময়- এই ক্যানভাসে ঢুকছে হাতের ভঙ্গিমায়-এই ক্যানভাস থেকে ছুটে বের হয়ে যাচ্ছে। তিনতরেত্তোর ছবিতে গরীবগুর্বোদের জন্যে ভারী মায়া, তারা মহিমময়, তাঁর সন্তদের জামা ছেঁড়া, সন্তদের আসনগুলো ভাঙা, সেই সন্তদের পটভূমি গাঁয়ের সামান্য সরাইখানা। লাস্ট সাপারে বড় বড় ফিগারগুলো সরাইখানার চাকর-বাকরদের, বহুদূরে দেখা যায় জ্যোতির্ময় যীশুকে। 'দ্য মিরাকল অভ দ্য স্লেভ'এ সন্তর চেয়ে তিনি ফোকাস দিচ্ছেন ক্রীতদাসের শরীরের দিকে। শুধু সমাজের নীচতলার লোক কেন্দ্রে আসেনি, চিত্রকলার ইতিহাসে বোধহয় সেই প্রথম ক্যানভাসের সেন্ট্রাল ফোকাসে এসেছে নারী, রাণী নয়, নেহাত দাসীগোত্রের নারী।
সেকালের ভেনিসে তিন বিখ্যাত শিল্পীকে নিয়ে চলতি কথা ছিল—তিশান রাজাদের আর পোপদের, ভেরোনেজ জমিদারদের আর অ্যারিস্টোক্র্যাটদের, আর তিনতরেত্তো সর্বহারার। দেখুন, যে ক্রুশবিদ্ধ যীশু এঁকে তিনতরেত্তো কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানেও দর্শক যেন স্বয়ং কম্পোজিশনের অংশ (মাতিসের 'লা ডান্স' এর পূর্বসুরী যেন তিনি)। ক্যামেরা যেভাবে দর্শককে হলঘরে ঢুকিয়ে নেয়, সুড়ঙ্গতে ডেকে নেয় কিংবা করিডোরের শেষে উঠোনে উন্মুক্ত করে দেয়, তিনতরেত্তো সেভাবে ছবির দর্শককে যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হবার বদ্ধভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, সে-ও যেন সমবেত জনতার অংশ। এইভাবে দর্শককেও কম্পোজিশনের অংশ করেছেন তিনি 'সুজানা অ্যান্ড দ্য এল্ডার্স'এও, যেখানে বুড়ো হাবড়া দু'জনের মতো আমি কিংবা আপনিও যেন দর্শকামীর মতো লুকিয়ে দেখছি সুজানার সুন্দর শরীর। মোটের ওপর আর্টের গ্রামারে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেই তিনতরেত্তো রাজা হয়েছেন।
তিশান ১৫৭৬ এ প্লেগে মারা গেলেন, তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী সন্তানও মারা গেলেন, তাঁর সমাধির নিশানাও রইলো না। তিনতরেত্তোর হাতে তদ্দিনে প্লেগের তাবৎ ধ্বংসলীলা পরিণত হয়েছে শিল্পে। ১৫৭৭এ প্লেগ শান্ত হলো। গুরুর মৃত্যুর ১৮ বছর পর দু'সপ্তাহের সর্দিজ্বরে ভুগে যখন তিনতরেত্তো মারা গেলেন, তখন দেখা গেল তিনি তিশানের মতো ভুল করেননি, উইল করে রেখে গেছিলেন, সেই উইলে ছেলেমেয়েদের তাঁর ছবির ওয়ারিশ করে গেছেন, ছেলে ডমিনিকোকে বাপের অসমাপ্ত ছবিগুলো একই স্টাইলে শেষ করবার নির্দেশ দিয়ে গেছেন, শুধু নিজের সমাধিস্তম্ভ বা অন্তেষ্ট্যিক্রিয়া নিয়ে কিছুই বলে যাননি। তিনতরেত্তোর মৃত্যুর ৬০ বছর পর পর্যন্ত ওঁর স্টুডিও এবং ওয়ার্কশপ চালু ছিল।
শুরু করেছিলাম অবনীন্দ্রনাথের গল্প দিয়ে, শেষ করছি তিনতরেত্তোকে দিয়ে। মহামারীর কুটিল কালো পটভূমিতে দাঁড়িয়ে দুই সময়ের দুই যূগপুরুষ সৌন্দর্য নির্মাণ করে গেছেন। অবনীন্দ্রনাথ প্লেগে কন্যা হারিয়ে প্রচন্ড বেদনায় শিল্পকে যষ্টি করে আবার উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, সারনাথের বরুণা নদীর পারে সারস উড়ে যাচ্ছে এমন দৃশ্য দেখে রবীন্দ্রনাথের মতো করেই ভেবেছিলেন 'ঐ আলোকমাতাল স্বর্গসভার মহাঙ্গণ, হেথায় ছিল কোন যূগে মোর নিমন্ত্রণ', সর্বতোভাবে কাম্য স্থিতি এসেছিল তাঁর শিল্পীসত্তায়, আরেকবার।
প্লেগ-জর্জরিত ভেনিসের শিল্পী তিনতরেত্তো তাঁর কন্যা হারিয়েছেন অজানা অসুখে, কিন্তু সেই শোক থেকে তিনি জীবদ্দশায় উদ্ধার পাননি। কন্যার ডাকনাম ছিল 'লা তিনতরেত্তা', ভাল নাম 'মারিয়েত্তা', বাপের মতোই তুলির কাজ, ছেলের ছদ্মবেশে বাপের সাথে সে যেত কমিশন পেতে, লোকে বলে বেঁচে থাকলে মেয়েটি তিনতরেত্তোর সুযোগ্য কন্যা হতো। কন্যার অকালপ্রয়াণে তিনতরেত্তো শোক করছেন এমন দৃশ্য রোমান্টিক শিল্পীদের কাছে ছবির বিষয় হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল।
১২/০৮/২০২০