যে অপেক্ষার শেষ নেই
১. এখনকার কথা
এ বাড়ি থেকে সাটিন একদিন হারিয়ে গেছে, আজ তিন বছরের বেশি হতে চল্লো। আমাদের সবচেয়ে ভাল বেড়াল, কোনোদিন কাউকে আঘাত করেনি, কারো দিকে চেয়ে কান উল্টে ফ্যাঁশ করে ওঠেনি, আজন্ম আমার ছেলের সাথে সবচেয়ে মাখামাখি ছিল তার...বকা খেলে গাল ফোলা বাচ্চার মতো করুণ করে তাকাতো। সারা শরীরে তরমুজের খোসার মতো লম্বা লম্বা দাগ বলে আমি ওকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে বলতাম, "ওলে আমার 'কন্টিনিউয়াস-লাইন' বয়, পেন্সিল কাগজ থেকে না তুলে একটানা লাইনে কে আমার ছানাটাকে এঁকেছে?" এ পাড়া থেকে দুটো বেড়াল একই সময়ে চুরি গেছে, দুটোই এমনি সদাশয়, এমনি ভোলাভালা। মানুষকে বিশ্বাস করলে প্রাণীরও ঢের বিপদ। সাটিন হারিয়ে যাবার পর আমার চরম দুষ্টু বেড়াল কাশ্মীর কেমন একেবারে চুপ করে ছিল কয়েকদিন। মনে ভয় হলো, প্রাকৃতিক জ্ঞানে ও তো অনেক ঋদ্ধ, জন্ম-মৃত্যুর সংবাদ ওর কাছে তো অনেক আগে পৌঁছায়, ও কি কিছু জানে যা আমি জানি না?
যখন প্রবল শীত নামে কিংবা রাতে ঝড়বৃষ্টি হয়, আমার অভ্যাস মনে মনে ঘরের মাথাগুলো গোনা, সব্বাই বাড়ি আছে তো? একটা মাথা কম পড়ে। আর আমি মনে মনে বলি, হে আল্লা, হে ঈশ্বর, আমার বিল্লুটা যেন কোনো বাড়িতে আশ্রয়ে থাকে, হ্যাঁ? সেবাড়িতে যেন অনেক আদর হয়, হ্যাঁ? আর আপেল ঠাসা হাঁসেদের রোস্ট হয় হান্স ক্রিশ্চিয়ন অ্যান্ডারসনের গল্পের মতো, হ্যাঁ? কিন্তু এ বাড়ি তো আমি ছেড়ে যাচ্ছি। পরে পথ চিনে চিনে ফিরে এলে আমাকে কোথায় খুঁজবে সে?
শীতকালে ছয়তলা বাড়ির সমান গাছগুলোতে তিরিশটা টিয়ার ঝাঁক উড়ে আসে দেখি। নিষ্পত্র গাছের মেইকশিফট পাতা যেন, সবুজ কাকলী। কবরখানায় দেখি পতপত করে ব্রাজিলের পতাকা উড়ছে একটা কবরে। ওয়ানস্টেড ফ্ল্যাটসের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম একদিন, চাতালের মতো বিশাল সমতলভূমি, তাতে অনেক ঘাস আর কাঁটাগাছ, বহুদূরে দেখা যায় আলোজ্বলা সব কাউন্সিল হাউজ আর বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি। এইসব ঘরবাড়ি-মহল্লা আর বাদাজমির কোথায় আমার বেড়াল হারিয়ে গেল? আকাশে তারা নেই। ধিকিধিকি জ্বলে নিভে যাবার আগে অঙ্গার যেমন দেখতে হয় তেমন রঙের রাতের আকাশ, শীতের মেঘ লালচে, এই আকাশ নাকি 'সেইলারস ডিলাইট'। কিন্তু আমার নাবিক মন মহাসমুদ্রে পথহারাই থাকে, বাড়ি ফিরে সুমিত্রা সেনকে কিছুতেই খুঁজে না পেয়ে সুচিত্রা মিত্রর কাছে যাই। 'মোর সন্ধ্যায় তুমি সুন্দর বেশে এসেছ, তোমায় করি গো নমস্কার।' কম কী! গভীর আনন্দ আর প্রগাঢ় অমঙ্গল উভয়কে আভূমি প্রণতি জানিয়েছি একজীবনে, আবার জানাই। মাঝে মাঝে রাতে স্বপ্নে দেখি সাটিন বাড়ি ফিরে এসেছে, একটু বুড়োটে গম্ভীর মুখ তার...এমন ছিল না সে, তার মুখ ছিল শিশুর সদাকৌতূহলী মুখ। তারপর তাকে আদর করতে গিয়ে দেখি গায়ের একপাশ থেতলানো একেবারে, অত আঘাত আমি কী করে সারাই! কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেলে যদি দেখি সে নেই...স্বপ্নেই বিড়বিড় করতে থাকি, আল্লা এটা যেন স্বপ্ন না হয়।
বসন্তকাল আসতে আসতে ঝোপগুলো গেরুয়ারঙের বেরিতে ফেটে পড়ে। আত্মহারা ব্ল্যাকবার্ডের গান শোনা যায় সকালের আলো ফুটবার আগ থেকেই। সকালে 'তোরে না হেরিয়া ওরে উন্মাদ, পান্ডুর হলো আকাশের চাঁদ' শুনে ভীষণ কাঁদি। গায়কের ভীষণ সাধা গলা, ভারী মিষ্টি।
ইস্কুলফেরতা এখনো প্রতিদিন ভাবি বাড়িতে গেলেই দেখব বাগানের গেটে সাটিন এসে দাঁড়িয়ে আছে। সাটিন প্রায়ই দরজায় অপেক্ষা করতো, আমরা এসে পৌঁছলেই খড়্গদন্ত বের করে চেঁচাতো, কররররররমাউউউউউউ… বেড়াল কেন কোর্মা খেতে চাইবে? বলে লাভ নেই, ছোট্টবেলায় সাটিনের প্রিয় খাবার ছিল ডিমপোচের শাদা অংশ আর ক্রিম।
২. হারিয়ে যাবার আগের কথা
সকালবেলা দেখি সাটিন বাড়ির পেছনের দেয়ালের ওপর গুঁড়ি মেরে বসে কিসের দিকে তাগ করছে, আমি তো মনের সুখে – "সাটিইইইইইন সাটিইইইইইইন ওলে সাট্টিনু"...এইসব ডেকে যাচ্ছি। সাটিন আমার দিকে একঝলক দৃষ্টি দিল। এর মানে হলো, "এইসব নামে ডেকো না তো মা। সাউন্ডস লাইক আ বারলেস্ক ডান্সার, ইটস আ কোশ্চেন অভ মাই ইমেজ। আউট হিয়ার আই অ্যাম নোন অ্যাজ 'রোর', অত্র এলাকায় আমার নাম 'গর্জন', বুঝলে?"
তারপর সে তার কোমর দুলিয়ে তেড়ে গেল আরেক বেড়ালের দিকে, ভাব দেখে মনে হলো আমরা লন্ডনের পোস্টকোডে আর থাকি না, এটা এখন সেরেঙ্গেটি। সাটিনের গায়ের রঙ অবশ্য হায়েনার মতো, প্রতিটি রোম হাইলাইট করা, শুধু ফুটকির বদলে ডোরা, একেবারে টানা চারকোল না উঠিয়ে টানা ডোরা, সেই চারকোল শিল্পীর হাতে লেগে আবার একটু ঝাপসাও হয়ে গেছে কোথাও কোথাও। পেটটা হায়েনাদের গায়ের কমলার মতোই ছিল একদা। এখন ফিকে ঝাপসা একটা হলদে ভাব রয়ে গেছে। চোখ ছিল নীল, বেড়ালছানাদের চোখের সেই বিপুল অবারিত নীল, যা উত্তর আকাশে মেঘমুক্ত দিনে দেখা যায়। এখন সেটা ঘোলা সবুজ, প্রেয়নাইট পাথরের মতো অবিকল। সাটিনের গায়ের গন্ধ রোদপোহানো কবুতরের মতো, তবে সে চোখে কম দ্যাখে বলে আমার ধারণা, ঘ্রাণশক্তিও কম। আর সাটিন বেশ বোকা। তবু সে মাথা খাটিয়ে বের করেছে, নিজের নাম 'সাটিন' না হয়ে যদি কাশ্মীর হয়, মানে সে যদি 'কাশ্মীর' –এর নাম ডাকলে সাড়া দেয়, তাহলে বেশি কিছু মিলতে পারে। বাড়িতে কাশ্মীরকে ডাকলেই তাই সাটিন এসে এক লাফে হাজির হয়।
৩. হারিয়ে যাবার পরের কথা
কাল থেকে অনেক ডাকছি কাশ্মীরের নাম ধরে অথবা সাটিনের নিজের নামে, সাটিন আসছে না। আজন্ম যা ভয় পেয়েছি তাই হচ্ছে। স্টোক নিউয়িংটনে যখন ছিলাম তখন একবার এক ইহুদি দোকানের গুদামঘরে সাটিন গিয়ে আটকা পড়লো, রবিবারের সাবাথের কারণে কেউ দোকানে আসেনি, সেও আর বের হতে পারেনি। আমরা খুঁজে অস্থির। পরে গিয়ে উদ্ধার করে আনি, কোলে চড়ে বাড়ি ফেরে সে, তখন মাত্র বেড়ালছানা। এবার কোথায় গেল সে?
গরমকালে আমাদের বাগানে গাঢ় গোলাপি বুনোফুল ধরে, রোমশ ডাঁটি, তাতে নাকফুলের মতো ফুল, এর নাম রেড ক্যাম্পিয়ন। একবার বীজ ফেলে দিলে এই ফুল আপনিই গজায় প্রতিবছর। ঘাসগুলি ক'দিনেই বড় হয়ে ওঠে সেসময়ে। সাটিন দীর্ঘ ঘাসের আড়ালে ঘাপটি মেরে সারা বেলা শুয়েবসে থাকতো। আজ দেখি লম্বা ঘাসের আড়ালে তেমনি একটা অবতল তৈরি হয়েছে। চমকে উঁকি দিই, সে কি ফিরে এলো? দেখি, পুপু (পাশের বাড়ির শাদা-লাল বেড়াল) একইভাবে ঘাসের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে আছে, একটু পরে সে গরমে গা টানটান মেলে শুয়ে পড়লো। প্রকৃতির শূন্যতা পরিহারী নিয়মে আরেক বেড়াল এসে ঘাসের রাজত্বে অলস বাঘ সেজে বসে আছে।
সাটিন যেদিন বাড়ি ফিরলো না, সেদিন সারাবেলা বড় উৎকন্ঠায় কাটলো। পরদিন সাটিনের ছবিসহ হারানো বিজ্ঞপ্তি সেঁটে এলাম স্টেশনের কাছে, কালভার্টের দিকটায়, ব্রীজের পরের ঢালে, দোকানে দোকানে। একদিন ফোনে এক বুড়ির মেসেজ পেয়ে দৌড় দিলাম তার বাড়ি। দেখি টুকটুকে একটা বাড়িতে পোলকা ডটের পর্দা- চীনামাটির রয়্যাল ডল্টন পুতুল- সবুজ সরস বীরুতের মাঝখানে এক আশিরপদনখ অফফ হোয়াইট বুড়ি দাঁড়িয়ে, তার কোলেরটা আমার সাটিন না। খামাখাই সারা পথ হাতে ক্যাটবক্সখানা দুলিয়ে দুলিয়ে হেঁটে গেলাম অতটা দূর। বুড়ি কিন্তু আমায় চা বানিয়ে খাওয়ালো, বল্লো—কেউ আসবে না জেনেও সে প্রতিদিন সকালে উঠে গরমজলে স্নান করে, কাপড় বদলায়, সেজেগুজে একটি দীর্ঘ একাকী দিনের মুখোমুখি হয়। পশম বোনার গোলা গোটানো সোফা, সোফার সামনে টিভি এন্তার শব্দ করে যাচ্ছে। টিভির মালকিন বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে কারখানায় কাজ করে প্রায় কালা হয়ে গেছে। দেয়ালে কত ছবি, বুড়ির বাড়ির আঙিনায় তার তেরটি ভাইবোনের ঝাপসা হয়ে আসা মুখের ছবি, বুড়োর সাথে বিয়ের ছবি, মেয়েদের আর তাদের কুকুরের ছবি, স্ট্রিপার হয়ে যাওয়া ভাগনের ছবি আর তরুন ক্লিফ রিচার্ডের ছবি। হাতের সুচিকর্মের কাজ দেয়ালে বাঁধানো। আমি কিছু দেখলাম, কিছু শুনলাম, কিছু চেষ্টা করেও মনোযোগ দিয়ে বুঝতে পারলাম না। বুড়ি বল্লো, "আবার এসো, যখন খুশি।" আমিও বললাম, "আসবো। সকালবেলা উঠেই যেদিন বুক ভেঙে যাবে সেইসব দিনে মেরামতির জন্য আসবো তো। তেমন তেমন দিনেও কেমন করে গা ধুয়ে কাপড় বদলে প্রতিকূল দিনের সামনা করা যায় শিখব।" একেবারে সুনীল আকাশের দিনগুলিতে দিশেহারা বেদনা আমাকে ভিজিট দেয়। বরাবরই। ভুলে গেলাম কি করে! ঝাঁ ঝাঁ রোদে ফিরে আসবার সময় দেখি টেরাকোটারঙ পাবলিক লাইব্রেরির সামনের গাছটা শাদা হয়ে আছে ম্যাগনোলিয়ায়। মোড় ঘুরবার সময় এই দুপুররোদে খাপছাড়াভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পগুচ্ছের একটা লাইন মনে পড়লো- "সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া অন্ধকারের ভিতর হইতে যে দক্ষিণ হাত বাড়াইয়া দিয়াছে যতীন স্নিগ্ধ বিশ্বাসের সহিত তাহার উপরে আপনার রোগক্লান্ত হাতটি রাখিল…"
রান্নাঘরে আলু ভাজতে গিয়ে কতবার জানালায় দেখলাম সাটিন এসে বসে আছে কি না। বোকারাম বাড়িতে থাকলে এই আলুভাজা খেত নির্ঘাত, আজ যেন কোথায় সে, 'আগন্তুক'-এর উৎপল দত্তের মতন 'ফিল্ড র্যাট' খাচ্ছে হয়তো।
ছেলেকে ইস্কুলে দিয়ে আমি আবার বেড়ালের খোঁজে বের হলাম। পার্কের শেষে শুনসান একলা বাড়িটার দু'পাশে গিয়ে সাটিনের নাম ধরে চেঁচালাম। কাশঝোপ আছে যে বাড়িটায় সেই বাড়িটা অব্দি নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এসেছি, হঠাৎ শুনি ভাঙা বিকৃত গলায় কে ডাকছে- মিঞঁ। আমি যতবার ডাকি, সেও জবাব দেয়। এমন ভাঙা গলা হয়েছে, নিশ্চয়ই পাঁচদিন ধরে খাওয়া নেই বলে... আমি আওয়াজ বরাবর দৌড় দিলাম। তারপর চমকে গিয়ে মনে হলো কাঁচ তোলা ধূসর গাড়িটা থেকে একটা কালো লোক আমার সাথে ফাজলামি করছে। রেগে গিয়ে কাছে গেলাম। গাড়িতে তো কই কোনো লোক নেই, কালো শাদা লাল অথবা গেরুয়া। আবার সাটিনের নাম ধরে ডাকলাম, আবার ভাঙা গলায় – মিঞঁ। এবার রাস্তার ওপাশ থেকে। আবার দৌড়ে রাস্তা পার হলাম। এবার শুনলাম নীল গাড়িটার তলা থেকে ডাক। আমি উবু হয়ে দেখি, একটা নেহাত মুখচোরা বেড়াল ভাঙা গলায় ডাকছে মিঞঁ।
ফিরতে ফিরতে আমাদের দু'বাড়ি পরের সেই 'বু র্যাডলি'মার্কা লোকটার রহস্যময় বাড়ির দরজায় টোকা দিলাম। এদের আঙিনায় ক্র্যাব অ্যাপল গাছটার নীচে আমি হুবহু সাটিনমার্কা একটা বেড়ালকে প্রায়ই বসে থাকতে দেখেছি, সাটিন প্রায়ই সেটার সাথে ঝগড়া করতো। বেড়াল নাকি তার মতন দেখতে অন্য কোনো বেড়ালকে প্রতিপক্ষ মনে করে, ভাবে ওটা ওর নাম ভাঙিয়ে খাবে! তা কী করে হয়, বেড়াল বুঝি নিজের চেহারা চেনে! চেহারা চিনতে হলে তো আয়না দেখতে জানতে হবে।
টোকা দিতে দরজা খুলে দিল এক মহিলা, টুকটুকে লাল নেলপলিশ হাতে, কলপ করা কুচকুচে চুল। পরিচয় হলো। সাটিন কে, কবে হারিয়েছে, আমি প্রডিগ্যাল ক্যাটের মা, এইসব নানান কিছু বললাম। মহিলা বল্লো, "ঠিক তিনদিন আগে আমি তোমার বেড়ালটাকে দেখেছি আমার আঙিনার কাছে খুব জোরে ব্যথার আওয়াজ করতে!"
আমি বললাম, শেয়ালের বাচ্চারাও আমাদের বাড়ির চৌহদ্দিতে ফোঁসফোঁস করে!"
-না, না, জোরে বাচ্চার কান্নার মতো করে আওয়াজ।"
আমি বললাম, দ্যাখো তো, এইরকম কি না। (বলে আমি আওয়াজ করলাম, ওঁওঁঅঁঅঁ। সাটিন বা কাশ্মীর অন্য বেড়ালকে 'তুই বেড়াল না মুই বেড়াল' বোঝাতে এই আওয়াজ করে।)
মহিলা লাফিয়ে উঠে বল্লো- ঠিক ঠিক। এই আওয়াজ।"
-এটা টেরিটরি বুঝিয়ে দেবার আওয়াজ। (আমিও সীমা বুঝিয়ে দিতে এই আওয়াজ করি। সেটা বললাম না।) কবে দেখেছ ঠিকঠাক বলতে পারবে?"
-আরে, তিনদিন আমি বিছানায়, ফ্লু। এই দ্যাখো না জামায় কত ছোপ। বিছানায় বসেই খেয়েছি। আমার বাগানে এসে তিনদিন আগে বেড়ালটা এমন করে বাচ্চার কান্না দিচ্ছিল...ইয়ে ফেব্রুয়ারি তো ২৮ দিনের...ইয়ে এবার কি লীপইয়ার ছিল...আচ্ছা, আবার গুনছি। আচ্ছা, ফেব্রুয়ারি! সে তো মাদি বেড়াল তাড়া করতে বেরিয়েছে নির্ঘাত, তুমি নির্ঘাত দাদী হবে... আহ, তোমার ফোন নাম্বার দাও, আমি দেখলেই জানাব। তুমিও ফিরে পেলে জানিও।"
বাড়ি আসতে আসতে মনে হলো, একটা লোক প্রতিদিন বাড়িগুলোর ব্যাকইয়ার্ড আর গলিগুলিতে তাদের হারিয়ে যাওয়া বেড়ালটাকে খোঁজে, অভিজ্ঞতাগুলির জট খুলতে খুলতে বেরিয়ে আসে বিরাট এক জটা, তার নাম 'দ্য ওয়াইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল'। আমার বড় প্রিয় বই, মুরাকামির লেখা। পড়বার সময়কার উত্তেজনায় আমি একদিন একটা লোককে বুঝিয়েছিলাম, বাস্তব খুব নেবার অযোগ্য হয়ে উঠলে গলিত নিকৃষ্ট জগত থেকে উদ্ধারের একটা পথ আছে, সেটা হচ্ছে নিজের ঘরের মেঝে খুঁড়ে একটা মনোরম গর্তে চলে যাওয়া... আহা, তখনও আমার মাথায় কত কত আলো জ্বলা উদ্দীপনার কুঠুরি।
শৈশবে কত হারানো বিজ্ঞপ্তি শুনতাম, দুপুরের নিস্তরঙ্গ বুক চিরে রিকশায় প্রদক্ষিণরত মাইকের সেই আওয়াজ। কী ভীষণ ভয় পেতাম সেই হারিয়ে যাওয়াকে। ছেলেধরা নিয়ে গেল? ছেলেধরা নিয়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে ভিক্ষে করাবে এই ছিল আমার কল্পনার দৌড়। এখন জানি, পিডোফিলরাও হাত ধরে নিয়ে যেতে পারে সেইসব শিশুদের। শিশুর মতো অবোলা জীবেরও যে কত অগাধ বিপদের সম্ভাবনা তা আমি জেনেছি সাটিন হারাবার পরে, তিলে তিলে। গাড়িচাপা পড়তে পারে, কেউ নিয়ে গিয়ে বেচে দিতে পারে, কেউ কুকুরের খেলায় ছুঁড়ে দিতে পারে, কেউ শিকারী পাখির জ্যান্ত খাদ্য হিসেবে খামারে বেচতে পারে। অতসব ভয়ানক সম্ভাবনার বিপরীতে আমি স্থির থাকতে পারি না, সুস্থ থাকতে পারি না। ফলে আমি ভাবতে শুরু করি, গৃহত্যাগের বাসনা অনেক প্রাণীরই অন্তরের একান্ত হাতছানি। বেড়াল কিংবা হাতির। সাটিন নিশ্চয়ই কোনো আলো-জ্বলা পুতুলে সাজানো ঘরে কোনো দয়ালু মানুষের কোলে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। মাকে ঠিক ভোলেনি সে, আবার খুব মনেও রাখেনি, যেদিন ভীষণ মনে পড়বে সেদিন ফিরবে। ইস্কুলে থাকতে 'মুভি অভ দ্য উইক'এ একটা ছায়াছবি দেখেছিলাম, 'জীবনের তরে বন্ধু' বা এইরকম কোনো নাম, রুশ একটি মানুষ বেড়ালছানা ভেবে বাঘের প্রজাতির একটা ছানা পালে। ছানা বড় হয়ে ভয়ানক উৎপাত শুরু করে, তারপর একদিন তারা আলাদা হয়ে যায়, কিন্তু একে অন্যকে অবলম্বন করে বাঁচতে শিখে গেছিল তারা, ফলে তাদের সেই বিচ্ছেদ স্থায়ী হয় না। বরফঝরা এক দিনে বাঘ ফিরে আসে লোকটার কাছে। সেই জনমানবশূন্য বনে-প্রান্তরে তাদের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হয়। ছায়াছবির ইতিবাচক সমাপ্তি খুব ভাল জিনিস, কত মানুষের হৃদয়ে আশা জাগিয়ে রাখে।