যে পোশাকে কাক বঙ্গভবনে আসে
যন্ত্রযান আর জনতার কোলাহল ছাপিয়ে কেবলমাত্র কাকের জোরালো ডাকই কানে যায় ঢাকা নগরীর পথে ও পার্কে। কাকের কা কা চিৎকার শুনে আমরা মুগ্ধ নই। তবে গাড়ির নিরবচ্ছিন্ন হর্নের চেয়ে তা কম অপ্রীতিকর। তা ছাড়া কাক অকারণে ডাকে না। গাড়িচালকদের পক্ষে এ কথাটিও তো বলা যায় না।
অনেকে বলেন, কাকের পোশাকটি দৃষ্টিনন্দন নয়। কিন্তু এ কথা কি মেনে নেয়া যায়! কালো স্যুট ভালো নয়, এ রায় কি গ্রহণযোগ্য হতে পারে! আদালতপাড়া ও বাণিজ্য এলাকায় কালো স্যুটের চেয়ে মহীয়ান কিছু নাই। পুরুষের ফরমাল ড্রেস ডিজাইনার-মাত্রেই বলেন, কালোই হলো আভিজাত্যের রং।
কাক দেখার জন্য একদিন আমি বঙ্গভবন হতে আমন্ত্রণ পেলাম। কাকের দল প্রায়ই নাকি বঙ্গভবনের সম্মানিত আগন্তুকদের আক্রমণ করছে। প্রতিকারের পরামর্শ দেওয়ার জন্য আমাকে ডাকা হলো। ভাবলাম, প্রতিকারের আগেই একটি সিনেমা বানানোর জন্য হিচককের কোনো শাগরেদকে ডাকলে ভালো হতো।
নির্ধারিত দিনে কালো জ্যাকেটে সুসজ্জিত হয়ে আমি বঙ্গভবনে ঢুকলাম। কাকেরা কী পোশাকে বঙ্গভবনে আসে, সেটা দেখার কৌতূহলও আছে মনে। ফটকের খাতায় স্বাক্ষর নিয়ে নিরাপত্তা কর্মকর্তা আমার জ্যাকেটের পকেটে একটি কার্ড আটকে দিলেন। আমি ভবনের দিকে পা বাড়ালাম।
পাঁচ ডজন কাক মাথার ওপরে শোরগোল করে চক্কর দিতে থাকল। দু-একটি এসে প্রায় মাথা ছুঁয়ে উড়ে গেল। যা ভেবেছিলাম তাই। আভিজাত্যে ও কৌলীন্যে কাকসমাজে কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিটি কাক নিখুঁত কালো স্যুট পরেই বঙ্গভবনে এসেছে। পরনে ম্রিয়মাণ ছাই রংয়ের ট্রাউজারটার জন্য আমি বিব্রত বোধ করলাম।
পথের দু-ধারে ও পার্কিং চত্বরে সারি দেয়া বোতল-ব্রাশ গাছ। বাগানের সাজসজ্জার অঙ্গ। গাছের দৈর্ঘ্য পনেরো ফুটের বেশি নয়। প্রতিটি গাছেই পাতিকাক বাসা করেছে। এত বাসা আমি কোনো দিন দেখিনি। ডিম ও ছানা পরিষ্কার দেখা যায়। ভালো করে দেখার জন্য দাঁড়াতেই কাকের দল শোরগোল শুরু করল। যেন বলল, এদিকে পা বাড়ালে মাথা আস্ত থাকবে না। আমি দ্রুত সরে পড়লাম।
যথাস্থানে গিয়ে আমি বাদীর বয়ান শুনলাম। তিনি বললেন, বঙ্গভবনের আগন্তুককে সম্প্রতি দল বেঁধে কাক আক্রমণ করছে। সম্মানিত অতিথিগণ গাড়ি-বারান্দায় নামেন বলে কাকের নাগালের বাইরে থাকেন। পদব্রজে যারা আসেন, সেই নিরীহ মানুষের ওপরেই কাকের আক্রমণ চলে। বিবাদীর এই যুদ্ধংদেহী আচরণের একটা বিহিত করতে হবে।
পাতিকাকের বাসা গুরুতর কোনো সমস্যা নয়। তবু এ সমস্যাটির সহজ কোনো সমাধান আমি দিতে পারলাম না। মতিঝিলের আবর্জনা-স্তূপে পর্যাপ্ত আহার্য পেলেও গগনচুম্বী কংক্রিটের বস্তিতে কাকেরা বাসযোগ্য স্থান খুঁজে পায় না। বঙ্গভবনের এ বাগানখানা ঊষর মতিঝিলে সবুজ মরুদ্যান। তাই এত কাক এখানে আসে।
মতিঝিলের কংক্রিটের বস্তির চেয়ে বঙ্গভবনকে যদি কাক বেশি বাসযোগ্য মনে করে, তো এর রুচির প্রশংসাই করতে হয়। কাক-পক্ষীরাও বঙ্গভবনের ছায়া না মাড়ালে কি তা সম্মানজনক হতো! এ বাগানের বাইরে কোথাও এত নিচে পাখির বাসা থাকলে দুষ্টু ছেলেদের হাতে সব ডিম খোয়া যেত। এখানে বাসা বেঁধে কাক তো একটা ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিয়েছে: 'বঙ্গভবনের ছেলেরা দুষ্টু নয়।'
পরামর্শক হিসেবে আমি বললাম, সমস্যাটি সাময়িক। প্রজননের দেড় মাস পার হলে কাক আর মারমুখী থাকবে না। ছোট গাছে বাসা বেঁধে এবার কাক বেশি সন্দেহবাদী হয়েছে। আগামী বছরে গাছ দুহাত বেড়ে গেলে কাক আরও উদার হবে। অমূলক ভয়ে ছুটোছুটি না করে সোজা হেঁটে গেলে পথিককে কাক কম উত্ত্যক্ত করবে। এই সাময়িক অসুবিধার জন্য এতগুলো পাখির বাসা ভাঙা তো যায় না। বাসা ভাঙলে কাকের আক্রমণ কমবে না, বাড়বে।
আমার কথা স্বভাবতই কর্তৃপক্ষের চেয়ে কাকের পক্ষে বেশি গেল। বিবাদীর প্রতি সহানুভূতিশীল এ উকিলকে কী করা যায়, তা নিয়ে বাদী কিছু সময় ভাবলেন। তারপর উকিলকে হস্টাইল ঘোষণা না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নমনীয় হয়ে তিনি বললেন: 'বঙ্গভবনে বাসা হলে একটা ভালো পাখির বাসা হোক, কাক কেন!'
কাক নয় কেন? বঙ্গভবনের মর্যাদা রেখে এরা তো সর্বদা ব্ল্যাক স্যুট পরে থাকে। পুরুষানুক্রমে বঙ্গভবনই এদের বাস্তুভিটা। বঙ্গভবনের আর কোনো বাসিন্দা তো এ দাবি করতে পারে না। বঙ্গভবনের চতুর্দিকে প্রতিদিন আবর্জনার যে স্তূপ হয়, তার একটি অংশ কাক পরিষ্কার করে। তারপরও কি এখানে এদের বাসা বাঁধার অধিকার হবে না!
এই বাসাগুলো তো শুধু কাকের নয়, কোকিলেরও বাসা। বঙ্গভবনে কাকের এই বাসায়ই অনেক কোকিল ছানার জন্ম হবে। কোকিলের ডিমে তা দেয়া আর ছানা পালার কাজটি কাকের মতো মহানুভব পাখিরাই করে থাকে। অন্যের ছানা পালন করেও কোনো ক্ষতি হয় না এদের। হলে তো পৃথিবী থেকে কবেই কাক বিলুপ্ত হতো।
ঢাকা নগরীতে কোকিলের মতো ফলভুক পাখির টিকে থাকাটা সহজ নয়। এদের প্রিয় বট, পাকুড়, ডুমুরের মতো ফলদ গাছ এখানে কম। তবু এ নগরীতে অনেক কোকিল আসে। অগুনতি কাকের বাসাই সম্ভবত এ নগরীর প্রতি কোকিলের পক্ষপাতিত্বের প্রধান কারণ।
কাককে প্রতিপক্ষ না ভাবার জন্য কর্তৃপক্ষকে কিঞ্চিৎ প্রভাবিত করেছি মনে হলো। হৃষ্ট মনে প্রত্যাবর্তনের জন্য পা বাড়ালাম। এবার মাত্র দুই ডজন কাক মাথার ওপরে চক্কর দিল। দীর্ঘ পথ হেঁটে ফটকের কাছে এলাম। কোনো কাক আমার মাথায় ডাইভ-বমিং করল না।
কাকেরা হয়তো বুঝে ফেলেছে আমি আসলে কোনো পক্ষের উকিল! খামোখা ছুটোছুটি করিনি বলেও হয়তো ওরা উত্তেজিত কম হয়েছে। ঘণ্টাখানেক আগে বিনা সংঘাতে এ পথে একবার গেছি, তা-ও হয়তো কাকের মনে আছে। মানুষের চেহারা মনে রাখায় দক্ষ বলে কাকের খ্যাতি আছে। বঙ্গবাজারে কেনা আমার কালো জ্যাকেটের জন্যও কাকের মনে কোনো অনুকম্পা ছিল কি!
কাকের মনে কী ছিল, তা কোনো দিন আমি জানতে পারব না। আমি একজন পাখিদর্শক। পাখিদর্শকেরা পাখির চেহারা দেখে, পাখির মনের কথা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে না। পাখির মনের কথা সম্ভবত জীবনানন্দের মতো কবিরা কিছুটা জানেন।