চশমার উদ্ভাবক কি আরবরা!
মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের মধ্যে চশমা একটি। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে ঠিক কোথায় এবং কবে চশমার উদ্ভব ঘটেছিল? পশ্চিমা সভ্যতার বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে যে চশমা উদ্ভাবনের কৃতিত্ব তাদের, সত্যিই কি তাই? নাকি তৎকালের অন্যান্য অনেক প্রায়োগিক ক্ষেত্রের মতো আরব এবং মুসলিমরা এদিক দিয়েও পশ্চিমা সভ্যতার চেয়ে এগিয়ে ছিল? পশ্চিমা সভ্যতার সাহিত্য খুঁজে চশমার যেসব প্রাসঙ্গিক উল্লেখ পাওয়া যায়, তা মূলত পৌরাণিক, আবার কিছু পর্যটকদের বিবরণে পূর্ণ। এমনকি কিছু কিছু বৃত্তান্তে সত্যের লেশমাত্র নেই। বরং পশ্চিমারা জাতিগতভাবে সবার চেয়ে ঊর্ধ্বে, এই জাত্যাভিমানকে পুঁজি করে স্রেফ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কখনো কখনো কিছু গল্পের জালও বোনা হয়েছে।
চশমা উদ্ভাবনের প্রাচীন ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছেন সৌদি আরবের ইসলামিক স্কলার এবং গবেষক লুতফাল্লাহ গরী। কখন এবং কোথায় চশমার উদ্ভাবন ঘটল— এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য একটি তদন্ত চালাতে গিয়ে উনি সাহায্য নিয়েছেন বিভিন্ন প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক সূত্রের। সেগুলোর বরাত দিয়ে তিনি দাবি করেছেন যে আধুনিক সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই আবিষ্কারটি উদ্ভাবনের জন্মলগ্নে আরব এবং মুসলিমদের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি পশ্চিমা এবং আরবের সূত্রগুলোতে চশমার কী রকম উল্লেখ পাওয়া গেছে, তা পাশাপাশি উপস্থাপন করে বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে তুলেছেন।
লেন্সের ইতিহাস
ভূতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, সভ্যতার প্রারম্ভ থেকেই মানুষ স্ফটিক শিলা ব্যবহার করে এসেছে। একই সাথে, মিসরীয় এবং ফিনিশীয়দের মতো বেশ কয়েকটি সভ্যতার মধ্যে প্রাচীনকালে তৈরি কাচের ব্যবহারও লক্ষ করা গেছে। প্রাচীন অনেক সভ্যতায় কাচনির্মিত বিভিন্ন তৈজসপত্র খুঁজে পাওয়া যায়।
রোম, গ্রিক, ইসলামিক, হেলেনিস্টিক সভ্যতায় লেন্সের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রমাণ এবং বিবরণ থেকে জানা যায় যে এই লেন্স তৎকালে আতশ কাচ হিসেবে ব্যবহৃত হতো না। বরং সূর্যরশ্মির দিকে তাক করে আগুন জ্বালানোতেই এদের প্রয়োগ সীমাবদ্ধ ছিল। এ জন্য তাদের 'বার্নিং মিরর' বা জ্বলন্ত আয়না নামে ডাকা হতো। এ বিষয়ে ইসলামিক সভ্যতাগুলো থেকে বেশ কিছু রচনাবলিও পাওয়া গেছে।
বিশ্বের বহু মিউজিয়ামে অনেক পুরোনো লেন্স এখন শোভা পায়, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটি সহস্রাব্দ পুরোনো। তবে নমরুদের লেন্স, যেটি ১৮৫০ খিষ্টাব্দে ইরাকের নিনেভ নগরীতে আবিষ্কৃত হয়, সেটিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। এই লেন্সটি যে স্ফটিক দিয়ে তৈরি, তা খ্রিষ্টের জন্মেরও প্রায় ৭০০ বছর পুরোনো। আধা ইঞ্চি ব্যাসের এই লেন্সের এক পাশ সমতল হলেও অন্য পাশ অবতল। বর্তমানে এটি লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, এটি থেকেই মেসোপটেমিয়ার সভ্যতায় কী ধরনের টেলিস্কোপ ব্যবহৃত হতো, তার ধারণা পাওয়া যায়। এই বক্তব্যের পেছনে তারা প্রমাণও পেশ করেছেন। মেসোপটেমীয় বিভিন্ন নথিতে তারকারাজির অবস্থানের বিবরণ পাওয়া যায়, আর সেগুলো নিখুঁতের কাছাকাছি। তাই তা অর্জন করতে টেলিস্কোপের এই আদি রূপকে ব্যবহার করা হয়েছে— এমনটাই অভিমত এই ঐতিহাসিকদের। তবে অধিকাংশ গবেষক বিশ্বাস করেন যে কোনো বস্তুকে বড় করে দেখার জন্য নয়; বরং সৌন্দর্যবর্ধনের কাজেই এই কাচটি ব্যবহৃত হতো।
রোমান সম্রাটেরা কলোসিয়ামের মতো প্রকাণ্ড ছাদবিহীন মঞ্চে বসে গ্লাডিয়েটরদের মুষ্টিযুদ্ধ উপভোগ করতেন। বিশেষ প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের এই লড়াই ছিল টানটান উত্তেজনায় পূর্ণ এবং এর পরিণতি ছিল নিষ্ঠুর। রোমান সম্রাটেরা এই লড়াইয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি বসতেন; চোখের সামনে রাখতেন স্বচ্ছ পান্না। রোমান ঐতিহাসিক প্লাইনির রচনাবলি থেকে এমনটিই জানা যায়। অন্যদিকে অনেক ইতিহাসবিদের দাবি, কুশপুত্র নমরুদও এই কাচ ব্যবহার করেছেন একই উদ্দেশ্য নিয়ে। তবে রোম সম্রাট নিরো, তার সমসাময়িক এবং উত্তরসূরিরা কোনো বস্তুকে বড় করে দেখার জন্য লেন্সকে ব্যবহার করেননি। তা ছাড়া প্লাইনির বিবরণ থেকেও কিন্তু এটি স্পষ্ট না যে স্বচ্ছ পান্নাটিকে সম্রাট আসলে বিবর্ধনের জন্যেই ব্যবহার করছেন। এমনও হতে পারে যে সূর্যরশ্মি থেকে নিজেকে সুরক্ষা দিতেই সম্রাট তার চোখের সামনে এটিকে ধরে রেখেছেন। তৎকালে, রোমানরা দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতাকে জন্মগত ত্রুটি হিসেবে দেখতেন, যেটি থেকে কখনো আরোগ্য লাভ সম্ভব নয়। এমনকি দাস বেচাকেনার বাজারেও তাদের দরদামের সিদ্ধান্ত এটি দ্বারা প্রভাবিত হতো। দাসদের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করার জন্য তারা কিছু চিরকুটও পড়তে দিত।
চীনা পরিব্রাজকদের রচনাবলি থেকে দেখা যায় যে তারা চশমার সাথে বহু আগে থেকেই পরিচিত। অবশ্য লিখিত চৈনিক ইতিহাসে এটি নথিভুক্ত হয়নি। তবে তারা মালয়েশিয়ার মালাক্কার শাসকদের কাছ থেকে চশমা ক্রয় করত। আবার কিছু ইউরোপীয় ঐতিহাসিকের মতে, চীন এবং ইউরোপের আন্তবাণিজ্যের কারণে চীনে চশমার প্রচলন শুরু হয়।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইংরেজ স্কলার রজার বেকন আতশ কাচ সম্পর্কে লেখেন এবং কীভাবে এটি ব্যবহার করে কোনো কিছুকে বড় করে দেখা যায়, তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি সেখানে লিখেন, এই ছোট লেখাকে এই ধরনের কাচ বড় করে তুলতে পারে। তাই বয়োবৃদ্ধ এবং যাদের দৃষ্টিশক্তিতে ত্রুটি আছে, তাদের জন্য এটি বিশেষভাবে উপকারী। অনেক বিজ্ঞানবিষয়ক ঐতিহাসিকই মনে করেন, আল-হাসান ইবনে আল-হাইথামের লিখিত 'কিতাব আল-মানাজির' বইটি বেকনের উপযুক্ত অনেকগুলো কথার সূত্র হিসেবে কাজ করেছে। কারণ, আলোকবিজ্ঞানে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ইবনে আল-হাইথামের এই বইটি সে সময় ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল, যার নাম 'বুক অব অপটিকস'। চোখ কীভাবে আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাথে সংযুক্ত, তা-ও এখানে এঁকে দেখিয়েছিলেন আল-হাইথাম। এই পর্যবেক্ষণটি ইতিপূর্বে অন্য কারও রচনায় দেখা যায়নি। তবে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যেসব নথি-প্রমাণ রয়েছে, তা থেকে দেখা যায় যে রজার বেকনের লেখাতেই প্রথম কাচকে পড়ার কাজে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।
অক্ষিবিদ্যার আরেকজন ঐতিহাসিক জার্মান চিকিৎসক জুলিয়াস হার্শবার্গ। তিনি উল্লেখ করেছেন, বইকে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পাঠানোর সময় সেগুলোকে যে বাক্সে বন্দী করা হতো, তার সাথেই রংবিহীন বেরিলিয়াম পাথর দিয়ে দেওয়া হতো। অর্থাৎ এই কাচগুলো বিবর্ধকের কাজে ব্যবহৃত হতো এবং ১৩ শতকের প্রারম্ভে এখান থেকেই চশমার আবির্ভাব ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু হার্শবার্গের নিজের বক্তব্যেই মতবিরোধ লক্ষ করা যায়, যখন তিনি নিজেই আরেক জায়গায় বলছেন যে ইবনে আল-হাইথাম ১১ শতক থেকেই বিবর্ধক কাচ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন।
ইউরোপে চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর সময় চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বইয়ে চশমার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন ফ্রান্সের মন্টপেলিয়েঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক বার্নার্ড গর্ডন চশমার বিকল্প হিসেবে বয়স্কদের জন্য চোখের ড্রপ ব্যবহারের পরামর্শ দেন। ১৩৫৩ সালে গি দ্য শুলিয়াকও চোখের ড্রপের কথা উল্লেখ করেন, তবে সেগুলো কাজ না করলে চশমা ব্যবহার করাই শ্রেয় বলে জানান।
চশমা ঠিক কে উদ্ভাবন করেছিল, তা জানা না গেলেও এটি কত সালের দিকে উদ্ভাবিত হয়েছিল, তার কিছু নথি পাওয়া যায়। ইতালীয় স্কলার রেডির বিবরণ থেকে তিনটি ভিন্ন ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। জানা যায়, রেডির কাছে একটি পাণ্ডুলিপি ছিল, যেটি ১২৯৯ খ্রিস্টাব্দের। সেটির লেখক ছিলেন একজন বয়স্ক লোক আর ছোট লেখা তিনি পড়তে পারতেন না। চশমার সাহায্য নিতে হতো তাকে। দ্বিতীয় গল্পটিতেও রেডি দেখাচ্ছেন যে চশমার উল্লেখ পাওয়া গেছে ১৩০৫-এর আরেকটি লেখায়। তৃতীয় গল্পটি বলছে পূর্বাঞ্চলীয় ইতালির স্পিনা থেকে আসা একজন যাজকের কথা, যার নাম অ্যালেকজান্ডার। চশমা কীভাবে বানাতে হয়, তা তিনি নিজে শেখার পাশাপাশি বাকিদেরও শিখিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৩১৩ সালে তিনি মারা যান।
রেডির মৃত্যুর পর অন্যান্য বইয়ে তার এই বিবরণগুলো বারবার উঠে আসতে থাকে। তবে অনেক ইতিহাসবিদের মতে, রেডির এই বিবরণ নির্ভরযোগ্য নয়, কারণ, তাতে বানোয়াট বক্তব্য আছে। জুলিয়াস হার্শবার্গের বইয়েও রেডির গল্পগুলো উঠে এসেছে। তবে জার্মান ভাষায় লিখিত এই বইটির কিছু তথ্যের হালনাগাদ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যথাযথ সম্পাদনা ছাড়াই এটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়। তাই দেখা গেছে যে রেডির গল্পগুলো ইংরেজিতে প্রচলিত হয়ে পড়ে। অথচ যেসব গবেষণা তার গল্পগুলোকে বানোয়াট বলছে, সেগুলো ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি।
হার্শবার্গ নিজেও কিছু বৃত্তান্তকে নাকচ করে দিয়েছিলেন। যেমন কোনো কোনো গবেষকের মতে, মার্কো পোলোর ভ্রমণবৃত্তান্ত থেকে চীনাদের দীর্ঘদিন ধরে চশমা ব্যবহার করার 'আভাস' পাওয়া যায়। আভাস শব্দটি উল্লেখ করছি এ জন্য যে মার্কো পোলো সরাসরিভাবে তার বৃত্তান্তে এটি লেখেননি। এ ছাড়া চীন সম্পর্কে মার্কো পোলোর দেওয়া তথ্যকে অনেক ঐতিহাসিকই নির্ভরযোগ্য বলে মানেন না।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে একদল সাংবাদিকও দাবি করেন যে রজার বেকনই চশমার উদ্ভাবক এবং ইতালিতে ভ্রমণের সময় তিনি তার বন্ধুকেও এক জোড়া উপহার দিয়েছিলেন। আবার তিনিই যাজক অ্যালেকজান্ডারকে চশমা কীভাবে বানাতে হয়, তা শিখিয়েছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে অ্যালেক্সান্ডারের মাধ্যমেই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আরেকটি গল্পে ফ্লোরেন্সের সালভিনো দি'আরমাতি নামক এক ব্যক্তিকে চশমার উদ্ভাবক হিসেবে দাবি করা হয়। তবে এ নামে আদৌ কেউ ছিলেন কি না, তা নিয়েও ইতিহাসবেত্তারা সন্দিহান।
তাই চশমা ঠিক কার হাতে উদ্ভাবিত হয়েছিল, তা নিয়ে ঐতিহাসিকেরা দ্বিধাবিভক্ত। অনেকে এমনটাও মনে করেন, চশমা হয়তো স্রেফ একজনের দ্বারা উদ্ভাবিত হয়নি। বরং বিবর্ধক কাচ নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই চশমা বর্তমান অবস্থানে এসে পৌঁছেছে।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষাংশে ইউরোপে চশমার আবির্ভাব ঘটে। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন চিত্রকলায় উঠে আসে। ১৩৫২ সালে আঁকা দুটো চিত্রকর্মে মানুষ চশমা পরছে, তা দেখা যায়। প্রথম চিত্রকর্মটি দেয়ালে আঁকা এবং দ্বিতীয়টি তৈলচিত্র। তৎকালের চশমা বেশ ব্যয়বহুল হওয়ায় উইল বা অসিয়তনামায়ও তা তালিকাভুক্ত হতো।
রেনেসাঁর শুরুর দিককার শিল্পীদেরই একজন ইতালীয় কবি লুইজি পুলচি। তিনি সে সময়কার অন্যতম প্রভাবশালী মেডিসি পরিবারের সাথে যুক্ত ছিলেন। তার কাব্যরচনায়ও চশমার উল্লেখ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ইতালীয় মিলনান্তক বিভিন্ন নাটকেও চশমার বিবরণ রয়েছে। তবে সেসবের অধিকাংশই বৃদ্ধদের জন্য ব্যবহৃত চশমা। ক্ষীণদৃষ্টির সমাধানের জন্য ব্যবহৃত চশমার উল্লেখ সেখানে নেই। কিন্তু ইতালীয় রেনেসাঁর অন্যতম জনপ্রিয় শিল্পীদের একজন রাফায়েল, ষোড়শ শতকে তার আঁকা একটি চিত্রকর্মে এটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে দেখা যায় যে পোপ দশম লিও এটি পরে রেখেছেন। রাফায়েলের এই ছবির পর বেশ কিছু বইপত্রে এই চশমা নিয়ে অল্পবিস্তর লেখালেখি পাওয়া গেলেও মূলত বিখ্যাত জার্মান গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলারের ১৬০৪-এ লেখা একটি রচনায় বিস্তারিতভাবে চশমার বৈজ্ঞানিক বিবরণ পাওয়া যায়। আবার চোখের ড্রপ আসার পর থেকে চক্ষুবিশেষজ্ঞদের কাছে চশমার গুরুত্ব বেশ কমে গিয়েছিল।
ইবনে আল-হাইথামের গ্রন্থে বিবর্ধনের উল্লেখ
এখন পর্যন্ত লেখাটিতে স্রেফ ইউরোপীয় সূত্রগুলোকেই দেখলাম। খ্যাতনামা আলোকবিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইথাম দ্বারা রজার বেকন প্রভাবিত হয়েছিলেন, যা ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে। তারও আগে আধুনিক আলোকবিজ্ঞানের ভিত গড়ে দেওয়ার অনেকটা কৃতিত্ব আল-কিন্দির। তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ইরাকের বসরা নগরীর প্রখ্যাত গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইথাম। তিনি আলোর প্রতিসরণ নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। বর্ণহীন কোনো পৃষ্ঠতল যেমন কাচ, বাতাস বা পানির মধ্যে দিয়ে আলো ভ্রমণ করার সময় তার পথ কীভাবে বেঁকে যায়, তা নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। আল-হাইথামের ভাষায়: যখন কোনো বস্তুকে বর্ণহীন কোনো কিছু দিয়ে দেখা হয়, তখন দৃশ্যমান এ বস্তুগুলোর আকৃতি ভিন্ন রকম দেখা যায়। এটা মূলত সেসব বর্ণহীন বস্তুর পৃষ্ঠতলের আকৃতির কারণে হয়ে থাকে। কিন্তু তার মতে, যেহেতু দৈনন্দিন জীবনে এর বিশেষ কোনো প্রয়োগ নেই, তাই এই বিষয়ে বাড়তি কোনো গবেষণা জরুরি না। আবার একই সাথে নিজের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ার পর, তিনি লেখা বৃহদাকার এবং স্পষ্ট করার কাজে উত্তল লেন্স ব্যবহার করতেন।
এ ছাড়া আল-হাইথাম বলেছিলেন, দৃশ্যমান বস্তু যে আমাদের গোচরে আসে, তা মূলত আলোর প্রতিসরণের কারণে ঘটে থাকে। পুরু উপাদান যেমন পানির মধ্যে দিয়ে আলোর এ প্রতিসরণ ঘটে থাকে। তাই বলা যায় যে তিনি বর্ণহীন পৃষ্ঠতলের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হওয়া বস্তুর বিবর্ধন সম্পর্কে জ্ঞাত হলেও প্রাত্যহিক জীবনে এই ঘটনাটির অসাধারণ উপযোগিতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। তবে লেন্সের ক্ষেত্রে ইবনে আল-হাইথামের রচনাবলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব ইউরোপীয় লেখালেখির অগ্রজও ছিল, অন্তত ৩০০ বছর পুরোনো।
ইবনে হামদিসের স্তবক
ইবনে হামদিস ছিলেন সিসিলির একজন কবি। ২৪ বছর বয়সে তিনি সিসিলি থেকে স্পেনের আন্দালুসিয়ায় চলে আসেন এবং সেভিলের রাজা আল-মু'তামিদ ইবনে আব্বাদের কাছাকাছি বসবাস শুরু করেন। এর কিছু সময় পর, ১০৯২ সালে তিনি তিউনিসিয়ায় এসে পড়েন এবং মৃত্যুর আগপর্যন্ত এখানেই ছিলেন। তিউনিসিয়ায় থাকাকালে তিনি সেখানের তিনজন রাজার সংস্পর্শে এসেছিলেন। ওনেক ইতিহাসবিদের ধারণা, চশমার বিবরণী পাওয়া যায় তার একটি কবিতায়। এখানে উল্লেখ্য, চশমার উদ্ভাবন যখন হয়েছে বলা হচ্ছে, তারও ২০০ বছর আগে লেখা হয়েছে এই কবিতা। আরবি ভাষায় লেখা এ কবিতার বাংলা অনূদিত রূপটি নিচে দেওয়া হলো:
তালুতে রাখা যায় এমন শক্ত ফ্রেম
যেন আলোকরশ্মির ঝরনা
বাতাসের মতো স্বচ্ছ
বইয়ের ছোট হরফকে চোখের সামনে স্পষ্ট করে তুলে
পাথর দিয়ে তৈরি
গালের ওপর একটা দাগও রেখে যায়...
চোখ যখন ক্লান্ত
তখন এটি চোখের ওপর রাখি
আর চোখ যেন তার দ্যুতি ফিরে পায়
যেন কোনো ধীমানের মস্তিষ্কের মতো কাজ করে
বুঝতে কষ্টসাধ্য এমন কিছুর অর্থোদ্ধার করে
বার্ধক্যে যখন দৃষ্টিশক্তি হয়ে পড়ে দুর্বল আর বইয়ের হরফ হয়ে পড়ে ছোট
এটি ব্যবহারের মাধ্যমে ছত্রগুলো হয়ে ওঠে আরও বড়
কাব্যগ্রন্থটির সম্পাদক এখানে ইবনে হামদিসের লেখা পঙ্ক্তি পড়ে ভেবেছিলেন যে হামদিস হয়তো কলমকে নির্দেশ করেছেন। তবে 'বাতাসের মতো স্বচ্ছ, বইয়ের হরফ দেখতে সাহায্য করে এবং পাথরের তৈরি'— লাইনগুলো থেকে বুঝতে বাকি থাকে না যে হামদিস কলমকে না বুঝিয়ে, মূলত চশমাকে বোঝাচ্ছেন। কারণ, তৎকালে পাথর দিয়ে না, বরং পাখির পালক দিয়ে কলম তৈরি হতো। পরের দুটি ছত্রেও দেখা যায় যে বৃদ্ধের জন্য উপযোগী, লেখাকে বড় করে দেখায়। এটি চশমাকে বোঝাতেই বলা হচ্ছে। আর গালের ওপর একটা দাগ রেখে যায় কথাটি থেকে এটা স্পষ্ট যে উল্লিখিত বস্তুটি বিবর্ধক কাচও না। বরং পুরোনো দিনের চশমা বেশ ভারী হওয়ার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে পরে রাখলে গালের ওপর দাগ পড়ে যেত। সেটির কথাই বলেছেন হামদিস।
মুসলিমদের মাঝে চশমার বিস্তার
ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মাঝে চশমার ব্যবহার দ্রুতই বাড়তে থাকে। কাব্য-সাহিত্য-ইতিহাসের বই কিংবা চিত্রকলায় বারবার ওঠে আসতে থাকে। 'তারুণ্যের পর বার্ধক্য আমার কাছে এল। একসময় আমার দৃষ্টিশক্তি ছিল প্রখর, কিন্তু এখন আমার চোখ কাচের তৈরি'। আহমাদ আল-আত্তার আল-মাসরির কবিতার এই পঙ্ক্তি শুনলে মনে হয় যেন উনি চশমার কথাই বলছেন।
অন্যত্র ক্যালিওগ্রাফার শারাফ ইবনে আমির আল-মারদিনিকে নিয়ে ইতিহাসবেত্তা আল-সাখাওয়ি বলছেন, 'তিনি বেঁচে ছিলেন ১০০ বছরেরও বেশি। ১৪৪৭ সালে মারা যান তিনি। জীবনসায়াহ্নে এসেও তিনি নিজের ইন্দ্রিয়ের গুণ হারিয়ে ফেলেননি এবং আয়না ছাড়াই সুন্দর লিখতেও পারতেন।' এখানে 'আয়না' শব্দটি দিয়ে হয়তো চশমার কাচকেই বোঝানো হয়েছে।
চক্ষুবিদ্যার ইতিহাস সম্পর্কে জুলিয়াস হার্শবার্গ বলেছেন, মুসলিম চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞেরা নিজেদের বইপত্রে চশমার উল্লেখ করেছেন। তবে চশমা যে মানুষের দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতাকে ঘোচাতে পারে, চশমার এত বড় একটি উপযোগিতার দিকটিকে ইউরোপীয় চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞেরা উপেক্ষা করে গেছেন। এমনও হতে পারে যে মুসলিম বিশ্বে চশমা তত দিনে বেশ প্রচলিত।
পাশাপাশি ইউরোপীয় চিত্রশিল্পে চশমার উপস্থিতি অনেক বেশি পাওয়া গেলেও শুরুর দিককার ইসলামিক চিত্রকর্মে চশমা দেখতে পাওয়া যায় না। এর কারণ এমনও হতে পারে যে যেহেতু ইসলামে মানুষ বা প্রাণীর অবয়ব আঁকার ক্ষেত্রে বারণ আছে, তাই সেখানে মানুষের চোখে চশমা দেখতে পাওয়া যায় না। মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো যে ছবিটিতে একজন ব্যক্তিকে চশমা পরিহিত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো পারস্যের শিল্পী রিধা আল-আব্বাসির একটি প্রতিকৃতি (১৬৩৫)। বার্ধক্যে ওনারই শিষ্য মু'ইন আল-মুসাওয়ের এটি আঁকেন। ছবিটি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত অবস্থায় আছে।
সত্যি বলতে, প্রমাণের অপ্রতুলতা এবং বানোয়াট গল্পের কারণে চশমা উদ্ভাবনের আদি ইতিহাস পূর্ণতা পায় না। পক্ষান্তরে, বর্ণহীন বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে আলোর প্রতিসরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন বিজ্ঞানী ইবনে আল-হাইথাম। যদিও তিনি এর কোনো সরাসরি প্রাত্যহিক উপযোগিতা পাননি, কিন্তু তার রচনাবলিকে ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে চশমার উদ্ভাবন ঘটেছে। আবার আরব সাহিত্যে চশমার উল্লেখ বারবারই দেখা গেছে। বিশেষ করে, চশমার আবির্ভাব ঘটেছে ইউরোপে রেনেসাঁর সময়, ১৪ শতকের ইতালিতে। ধারণা করা হয়, চশমার উদ্ভাবনও ঘটেছে ঠিক তখন। অথচ তারও দুই শতাব্দী আগে ইবনে হামদির লেখায় চশমার বিবরণ পাওয়া যায়। তাই প্রথমে ঠিক কারাই বা চশমা উদ্ভাবন করেছিল, তা নিয়ে বর্তমান সময়ে এসেও দ্বিধা-সংশয় বিদ্যমান। কিন্তু তাতে তখনকার আরব এবং মুসলিমদের অবদান ছিল, তা অস্বীকার করবার জো নেই।