কে সে শয়তান—নাকে বসে টানে কান!
১. এই শোলোকের উত্তর সব্বাই জানেন। বরং একটা চুটকি শুনুন, তবে নতুন নোটের মতো চকচকে নয়। পুরোনো হয়তো আপনি জানেন। ইন্টারনেটের এ যুগে টাকশাল থেকে সদ্য 'প্রসবিত' মুদ্রার মতো ঝাঁ চকচকে চুটকি খুঁজে পাওয়া সোনার পাথর বাটি বা ডুমুরের ফুল জাতীয় ঘটনা হতে পারে। হ্যাঁ, ফিটফাট কেতাদুরস্ত ভদ্রমহিলার তিন তিনটি চশমা। ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, একটা দূরে দেখার। একটা কাছে দেখার আর অন্যটা হলো কোনটা কোন চশমা তা দেখে বের করার!
এবার বরং আদালতে যাই। তা-ও খোদ শেরেবাংলা ফজলুল হককে নিয়েই ঘটনা। তার মক্কেলের মামলার মেয়াদ অনেকবার বাড়ানো হয়েছে। নতুন করে সময় বাড়ানোর আরজি মানবেন না বিচারক। ঘাগু আইনজীবী ফজলুল হক এবারে ভিন্ন পথে হাঁটলেন।
মামলা শুনানিতে ওঠার পর হন্যে হয়ে গেলেন হক সাহেব। নিজের আচকানের এ পকেট, সে পকেট, ব্রিফকেস তালাশ শুরু করলেন। বিচারক জানতে চাইলেন—কী খুঁজছেন হক সাহেব?
—জি ধর্মাবতার, চশমা। পাচ্ছি না। বোধ হয় ভুলে রেখে এসেছি।
—তা হলে নিন আমার চশমাই ব্যবহার করুন। বিচারকের সহৃদয় আচরণে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার মতো ছিটকে উঠলেন হক সাহেব।
—না না। কি যে বলেন। না না ধর্মাবতার। তা হয় না। হতে পারে না। আপনার চশমা দিয়ে আমার মক্কেলকে দেখলে তার সর্বনাশ হয়ে যাবে!
অভিজ্ঞ বিচারক বুঝলেন হক সাহেব কী বলে কী বোঝাতে চাইছেন। তিনি বিনা বিলম্বে মামলার নতুন তারিখ দিলেন।
এদিকে এক রোগী ডাক্তারের কথা শোনার পর প্রশ্ন করছেন—ডাক্তার সাব, আপনি কইলেন চশমা নিলে আমি পড়তে পারব। ডাক্তার বললেন, নিশ্চয়ই, এ বিষয়ে সন্দেহ কী? রোগী এবার আহ্লাদী গলায় বললেন—তাহলে ভালোই হবে। আমি তো পড়তেই জানি না।
ভিন্ন আরেক রোগীকে চক্ষু চিকিৎসক বললেন, আপনার চশমা পাল্টাতে হবে। রোগী বললেন—সত্যিই পাল্টাতে হবে? ডাক্তার বললেন, অবশ্যই আপনার চশমার পাওয়ারটা বদলাতে হবে। রোগী এবারে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, আরে, আপনি আমার চোখ না দেখেই কীভাবে বুঝলেন? ডাক্তার বললেন, তার দরকার নেই। কেননা আপনি দরজার বদলে জানালা দিয়ে চেম্বারে ঢুকেছেন।
২. আজকাল আমরা সবাই রোদচশমা বা সানগ্লাস ব্যবহার করি। আপনি হয়তো জানেন, সানগ্লাস বা রোদচশমা প্রথম ব্যবহারের কৃতিত্ব পাবেন সম্রাট নিরো। 'দ্য ব্লিনক অব এন আই-কালচারাল হিস্ট্রি অব স্পেক্টাকেলস' গ্রন্থে চশমা নিয়ে এ তথ্যসহ চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন স্টেফানা সাবিন।
নিরো গ্লাডিয়েটরদের লড়াই উপভোগ করতেন চোখে 'স্মারাকদুস' লাগিয়ে । পান্নাকে লাতিনে 'স্মারাকদুস' বলা হয়। চোখধাঁধানো সূর্যের আলোর মধ্যে নিরোর চোখে আরামের পরশ বুলিয়ে দিত এই 'স্মারাকদুস'-এর সবুজ রং। নিরোকে নিয়ে এ তথ্য দিয়েছেন প্রাকৃতিক ইতিহাস গ্রন্থে জ্ঞানী বৃদ্ধ প্লেইনি। তবে এখানে 'স্মারাকদুস' বলতে কেবল পান্নাই বোঝাননি তিনি। বরং সবুজ রঙের বিবিধ রত্নকে বুঝিয়েছেন। নিরো দেখার জন্য চ্যাপ্টা বা সমতল রত্ন ব্যবহার করেছে, তাই এটি মোটেও দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সহায়তা করেনি। হয়ে উঠতে পারেনি সত্যিকার অর্থে দৃষ্টিসহায়ক।
সেনেকা তার প্রাকৃতিক ইতিহাসের প্রথম গ্রন্থের ষষ্ট অধ্যায়ে এ রকম একটি দৃষ্টি সহায়কের কথা বলছেন। তিনি লিখেছেন, গোল পাত্রে পানি ভরে ধরা হলে তাতে খুদে অক্ষরকে বড় দেখা যায়। পানির বির্বতন গুণের কারণে এমনটি ঘটে বলে ধারণা করেন তিনি। তিনি অবশ্য কাচের এমন গুণের কথা ভাবতেই পারেননি।
লাতিন ভাষায় আল হাজেন নামে পরিচিত হাসান ইবনে আল-হায়সাম, পুরো নাম আবু আলি হাসান ইবনুল হাসান ইবনুল হায়সাম ইসলামি স্বর্ণযুগের মুসলমান আরব গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিদ। ১০২১ খ্রিষ্টাব্দে তার 'কিতাব আল মানজির' বা 'বুক অব অপটিক্স' বা 'আলোকবিজ্ঞান' গ্রন্থে উত্তল কাচের বিবর্ধন গুণের বর্ণনা দেন। রিডিং গ্লোব বা পঠন বৃত্ত তৈরি করে এ কাচকে কাজে লাগান তিনিই। তার গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছিল আরবিতে; এ কারণে পাশ্চাত্য এমন উল্লেখযোগ্য কাজের খবর পায়নি বহুকাল।
ইতালির ফ্রান্সসিসক্যান সন্তরা আল হাজেনের লেখা আরবি থেকে লাতিনে অনুবাদ করেন দ্বাদশ শতকে। এবারে পাশ্চাত্যের নজরে এল বিষয়টি। তারও বহু বছর পরে অক্সফোর্ডের পণ্ডিত রবার্ট বেকন বৃত্তাকার বর্ণহীন বা সাদা কাচের বাস্তব প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেন। পঠন বৃত্ত বা রিডিং স্ফেয়ার তৈরিতে সে সময় বিশেষভাবে শক্তিশালী বিবর্ধক হিসেবে কোয়ার্টজ, শিলা স্ফটিক, বেরিল বা ফিরোজাজাতীয় রত্ন ব্যবহার হতো।
১২৬০ থেকে ১২৭২ খ্রিষ্টাব্দে লেখা জার্মান সাহিত্যে বিবর্ধনের গুণের কথা এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, 'বেরিলের মধ্য দিয়ে দেখলে যেমন লেখাকে বড় দেখা যায়, একইভাবে তার হৃদয়ে সব গুণই উচ্চ, প্রশস্ত, বড় এবং দীর্ঘ আকার পেয়েছে।'
ভেনিস থেকেই চশমার আদি 'পিতার' যাত্রা শুরু। ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকের কথা। ভেনিসের কাচ নির্মাতারা বানালেন কাচের স্ফটিক। বহু গুণে বিশুদ্ধ হওয়ায় এ কাচের স্ফটিকও স্বচ্ছ হলো অধিক মাত্রায়। বেরিলের চেয়ে কাচ দিয়ে কাজ করা অনেক বেশি সহজ এবং আরামদায়ক। এই বৃত্তাকার কাচের এক পাশ অনেক বেশি সমতল ছিল। ফলে বই বা পাঠ্যবস্তুর ওপর রাখার বদলে এ কাচকে সহজেই চোখের কাছে ধরে রাখার ব্যবস্থা করা সম্ভব হলো।
চশমার ইংরেজি স্পেক্টাকেলসের উৎপত্তি হয়েছে ইতালীয় ভাষায় চোখের প্রতিশব্দ ওকিও থেকে। এ শব্দ থেকেই জন্ম নেয় ওকিয়ালি এবং সেখান থেকেই এসেছে ইংরেজি স্পেক্টাকেলস।
সে যুগের ভেনিসে কাচশিল্পের সাথে জড়িয়ে ছিল কঠোর গোপনীয়তা ও সতর্কতা। এরপরও কাচশিল্প ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইতালি এবং আল্পস পর্বতমালার উত্তরে। বলা হয় এ শিল্প চীনে নিয়ে যান অভিযাত্রী মার্কো পোলো।
পঠনে দৃষ্টিসহায়ক হিসেবে চশমার ব্যবহার পুরো ইউরোপেই কেবল ছড়িয়ে পড়েনি, বরং পাড়ি দেয় ইংলিশ চ্যানেলও। লন্ডন বন্দরের দপ্তরে সংরক্ষিত তথ্য থেকে দেখা যায় ১৩৮৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর—এই তিন মাসের মধ্যে ইউরোপ থেকে এক হাজার জোড়া চশমা ইংল্যান্ডে ঢুকেছে।
তবে সেকালের এমন চশমা দিয়ে পড়া মোটেও সুখকর হতো না। চোখের সামনে ধরে রাখার জন্য দুই হাত ব্যবহার করতে হতো। পাঠ্যবস্তুর ওপর আঙুল রেখে পড়ার চল ছিল সেকালে। এভাবে সে আঙুল ব্যবহার করাই যেত না। এ ছাড়া পাতা উল্টানোর জন্য ও দুটোকে পাশে নামিয়ে রাখতে হতো। এ সমস্যার সহজ এবং বাস্তব সমাধান দরকার। তা-ও পাওয়া গেল। কাচের অর্ধগোলককে জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। কাঠের তৈরি কাঠামো দিয়ে এ কাজ করা হলো। রিভেট চশমা নামে পরিচিত ছিল এগুলো।
রিভেট চশমা পরা প্রথম দেয়ালচিত্র পাওয়া গেছে ভেনিসের টেভিসোরের চেইসা ডি সান নিকোলা মঠে। সেখানে কার্ডিনাল হুগোর একটি প্রতিকৃতিতে এ ধরনের চশমার দেখা মেলে। এ জাতীয় চশমার দামের একটি হিসাব পাওয়া গেছে। বলা হয়েছে, চশমার ওজনে ১৫ ক্যারেট সোনা দিতে হতো। অনেক টাকার ব্যাপার। তারপরও এ চশমা জনপ্রিয় হয়েছিল।
কোথায় প্রথম চশমা আবিষ্কার হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। ইতালির দুই নগরীর নাম এ ক্ষেত্রে নেওয়া হয়। একটি হলো হেলান টাওয়ারের নগরী পিসা আর অন্যটি হলো ফ্লোরেন্স। অগ্নিগর্ভ এ বিতর্ক চলেছে আধুনিক কাল অবধি। ১৯৮০ সালের সর্বাধিক বিক্রিত মধ্যযুগীয় হত্যা রহস্যের বই 'দ্য নেম অব দ্য রোজ'-এও বিতর্কের বিষয়টি পথ করে নিয়েছে।
পণ্য বিক্রির বেলায় পছন্দ না হলে মূল্য ফেরতের আধুনিক যে ধারা রয়েছে, তারও উদ্ভব হয়েছে এ চশমাকে কেন্দ্র করে। ১৩৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ফ্লোরেন্সের এক বণিকের কাছে ভেনিসের ব্যবসায়ী এভাবে চশমা বিক্রি করেন। তবে চশমার ব্যাপক চাহিদা থাকলেও দাম তখনো তেমন কমেনি।
এদিকে ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি এসে ভেনিস ও ফ্লোরেন্স নগরী উভয়েই কেবল পাঠ চশমাই বিক্রি করত না। বরং দূরের জিনিস দেখার কষ্ট দূর করতে দৃষ্টিকে সহায়তা করার মতো চশমাও সে সময়ে পাওয়া যেত।
চশমার ব্যবহার ব্যাপক হারে শুরু হওয়ায় সাংস্কৃতিক জগতেও তার পড়েছে গভীর প্রভাব। রেনেসাঁ নিয়ে লিখতে গিয়ে এমন কথা বলেন জার্মান ইতিহাসবিদ বার্ন্ড রক। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গ্রন্থে তিনি লিখেন, চশমার জোরে বহুসংখ্যক মানুষের পাঠকজীবনের আয়ু বাড়ে। এতে পরোক্ষে সাক্ষরতা বাড়ার কাজটিও হয়। একই সাথে কর্মজীবনও দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যায়।
চশমা সাক্ষরতার জগৎকেও পুরোপুরি বদলে দেয়। চশমার জোরে সাক্ষরতা আজীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠে। ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিক থেকে বয়স বাড়ার কারণে আর কোনো পণ্ডিতকে তার জ্ঞানচর্চার ইতি ঘটাতে হয়নি। এর আগে চোখে ভালো করে না দেখার কারণে এমনটি অহরহ ঘটত। চোখে চালসে ধরলে সারস্বত জগৎ থেকে বিদায় নিতে হতো। এর মধ্যে কাগজও এসে গেছে। চামড়াজাত দামি লেখ্যবস্তু পার্চামেন্টের তুলনায় কাগজ সস্তা। ইতিহাসবিদ রক বলেন, চশমা ও কাগজের সম্মিলনে জ্ঞানচর্চা, লেখালেখি ও ব্যবসায়িক তৎপরতার ব্যাপক বিকাশ ঘটে।
চশমা এ সময়ে সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে। খরুচে হওয়ায় সম্পদের প্রতীক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে পড়া অর্থাৎ শিক্ষারও প্রতীক হয়ে ওঠে চশমা। চশমা ব্যবহারকারীরা বিত্তবান অভিজাত সমাজের সদস্য ছিলেন। সর্বোপরি পড়ালেখার সাথে চশমার সম্পর্ক থাকায় চশমাধারীকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণি হিসেবে পরিচিত বণিক, পণ্ডিত বা সন্ত সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে গণ্য করা হতো। জোহানেস গুটেনবার্গ ১৪৪৫ সালে ছাপাখানার উদ্ভাবন করেন। ফলে বইয়ের উৎপাদন ঝট করে বেড়ে যায়। পাল্লা দিয়ে বাড়ে চশমার চাহিদাও।
এ সময়ে ভারী লোহার রিভেটের বদলে কাঠের তৈরি তুলনামূলক হালকা রিভেট ব্যবহারের সূচনা হয়।
চশমা ব্যবহারের উপকার পেয়েছেন নারীরাও। সেলাই এবং নকশার কাজে অভিজাত নারীরা ব্যবহার করতেন চশমা। সপ্তদশ শতকের পর থেকে শিল্পীদের আঁকা পোট্রেটেও চশমাধারী নারীদের দেখা পাওয়া যেতে থাকে।
এদিকে চশমার বির্বতনও চলতে থাকে। চশমা বানানোর প্রক্রিয়া সহজতর হওয়ার সাথে সাথেই বিস্তারও ঘটতে থাকে। জ্ঞানীর প্রতীক হিসেবে চশমার অবস্থান ঠিক থাকলেও সম্পদশালীর প্রতীকের আসন থেকে চশমা সরে যায়। ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে আঁকা তেলচিত্রে চোরের চোখেও চশমার দেখা মেলে।
পঞ্চদশ শতকের শেষ দিক থেকে মানুষ চশমা ব্যবহার করত কেবল পাঠের প্রয়োজনে নয় বরং দূরের দৃষ্টিসহায়ক হিসেবেও।
প্রসারের সাথে সাথে চশমাকে ঘিরে অর্থনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। গড়ে ওঠে চশমা তৈরির সাথে জড়িত একটি গোষ্ঠী। চশমা বিক্রেতার প্রথম বাণিজ্য সংঘ বা গিল্ড গঠিত হয় নুরেনবার্গে ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে। সেকালের সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত চশমা বিক্রেতা ছিলেন ইউলেনস্পিগেল।
সে যুগে চশমা মানে লোহা বা তামার স্প্রিং দিয়ে সংযুক্ত দুটো ফ্রেম এবং নাকের ওপর চাপ কমানোর জন্য এটি থাকে চামড়ায় মোড়া। এ জাতীয় ডাঁটিহীন চশমাকে পিন্স-নেজ বলা হতো।
রিভেট চশমার তুলনায় পিন্স-নেজ ব্যবহার আরামদায়ক ছিল। এর পরের ধাঁপে চশমার এক পাশে ডাঁটি লাগানো হলো। এতে চশমা চোখের কাছে ধরে রাখা সম্ভব হলো। তবে একটা হাত আটকে রইল চশমায়। এর পরের ধাপে কানে সুতা বেঁধে চশমাকে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হলো। চশমা যেন নড়াচড়া না করে, তেমন ব্যবস্থা এতে করা হলো। এমন চশমার ব্যাপক চল ছিল জাপানে।
এর মধ্যে চশমার লেন্স বা পরকলা তৈরির প্রযুক্তি অনেক এগিয়েছে। অষ্টাদশ শতকের কথা বলছি। ব্যক্তি প্রয়োজনের উপযোগী করে পরকলা তৈরি করা সম্ভব হতে থাকে। সে যুগে চশমা কেবল দৃষ্টিসহায়ক নয়, ফ্যাশনের উপাদানও হয়ে ওঠে।
ফ্যাশনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে লন্ডনের যন্ত্রনির্মাতা এবং খ্যাতিমান অণুবীক্ষণ নির্মাতা জেমস আইসকফ চশমায় ডাঁটি লাগানোর ব্যবস্থা করেন। এসব ডাঁটি বেশ বড়সড় ছিল। গোটা মাথায় বা পরচুলার নিচে বা ওপরে জড়িয়ে রাখা যেত। এ জাতীয় চশমা এ কারণে পরচুলা চশমা বা উইগ গ্লাস হিসেবে পরিচিত হয়। আর অভিজাত শ্রেণিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। রঙিন রোদচশমা বা সানগ্লাস তৈরির সাথেও আইসকফের নাম জড়িয়ে রয়েছে। নিরোর সবুজ রত্ন ব্যবহারের কথা মনে রেখেই হয়তো নীল-সবুজ রংওয়ালা পরকলা ব্যবহার করেন তিনি। সে যুগে মনে করা হতো, সবুজের রোগ সারানোর ক্ষমতাও আছে।
চশমা নিয়ে যেসব সমস্যা দেখা দেয়, তা দূর করার জন্য আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহারের কাজ গুরুত্বের সঙ্গে নেন লন্ডনের চশমা প্রস্তুতকারক বেনাজামিন মার্টিন। ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে এ তৎপরতা শুরু করেন তিনি। শিং বা কচ্ছপের খোল দিয়ে চশমার ছোট বৃত্তাকার ফ্রেম তৈরি করেন তিনি। ডাঁটির সাথে কবজা জুড়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেন। নানা আদল, ধরন এবং কায়দার কেতাদুরস্ত চশমা তৈরি করেন তিনি। এভাবে কেতাদুরস্ত চশমার নির্মাতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন তিনি।
মাছের রাজা নাকি ইলিশ। তাহলে চশমার পরকলা তৈরির রাজা হবে পলিকার্বনেট। চোট সহ্য করার ক্ষমতা থাকায় চট করে ভাঙে না। নানা বরণ গাভীর একই বরণ দুধের সূত্র ধরে বলা যায়, যতই বাহারি বা রকমারি চশমার ফ্রেম দেখুন কেন। মূলত তাদের ধরন তিনটি। ফুল ফ্রেম, সেমি রিমলেস এবং রিমলেস। দৌড়ের ওপর যাদের থাকতে হয়। ব্যস্ত জীবন। তাদের জন্য সেরা ফুল ফ্রেম।
হরদম কম্পিউটার ব্যবহার করতে হয় অনেককে। তাদের জন্য বাজারে রয়েছে শূন্য পাওয়ারের চশমা। কম্পিউটার বা স্মার্টফোন ব্যবহারে চোখের যে পীড়ন হয়, তা কমিয়ে দেয় এ জাতীয় চশমা। চক্ষু চিকিৎসকেরা যেসব চশমার ব্যবস্থাপত্র দেন, তার সঙ্গে এসব চশমার তফাৎ আছে। এ চশমা ব্যবহারের জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
এদিকে লাইব্রেরি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোলকে কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।' স্মার্টচশমা নামে এক জাতের চশমা বাজারে আসছে। এটি একাধারে বৃহৎ পর্দার টিভি, কম্পিউটার এবং স্মার্টফোনের পর্দার কাজ করবে। অন্যদিকে বাইরের দৃশ্য দেখার কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। তা ছাড়া এতে থাকবে উন্নত শব্দব্যবস্থা। ভিডিও ক্যামেরা। আর এসব একান্তভাবে আপনিই কেবল দেখবেন। শুনবেন। উপভোগ করবেন। উঁকি মারার সাধ্য কারও থাকবে না। এমন বস্তুকে রবীন্দ্রনাথ কীভাবে বর্ণনা করতেন। লাইব্রেরির আলোকে তাই ভাবছি।
সব চশমা একই মাপের হয় না। কিন্তু চশমার মাপের বিষয়টি জানব কোথা থেকে। হ্যাঁ, এ তথ্য লেখা থাকে চশমার ডাঁটিতে। ডাঁটিতে তিনটি তথ্য লেখা থাকে। চোখের আকার। যা সাধারণত ৪৪ থেকে ৫৮ মিলিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। দুই ফ্রেমের সেতু বা সংযোজকের আকার। এটি সাধারণত ১৪ থেকে ২৪ মিলিমিটার হতে পারে। সর্বশেষ থাকে ডাঁটির আকার, এটি ১২০ থেকে ১৫০ মিলিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
৩. চশমা নিয়ে জ্ঞানের কথা তো অনেক হলো। এবার না হয় আবার ফিরি চুটকিতে, কনে দেখতে গিয়ে এক বিজ্ঞ পাত্র কইলেন, চশমা না পরলে আপনাকে না বেশ ভালো লাগে, এ কথা শোনার পর নরম-শরম কনেটি আস্তে আস্তে বললেন, জি—চশমা না পড়লে আপনাকেও আমার চোখে দেখতে বেশ ভালোই লাগত।
চশমা ছাড়া চোখ 'থাকিতেও' অন্ধ এমন এক ব্যক্তি আমাকে বললেন, ভাইরে কোভিডের সবচেয়ে বড় অভিশাপে ভুগেছেন চশমাওয়ালারা। মুখে বাধ্যতামূলক মুখোশ (মাস্ক) আঁটার সাথে সাথেই ঘোলা হয় চশমার কাচ! ফলে না হয় 'অর্দ্ধান্ধ' না হয় পুরো অন্ধ! কী এক অভিশাপ!
চোখ থেকে চশমা খুলতে হলে দুই হাত ব্যবহার করতে হয়। এক হাতে চশমা খোলা উচিত নয়। চশমা যারা পরেন, তারা এটা ভালো করেই জানেন। এ কথা চশমার দোকানদাররা সব সময়ই বলেন। ভারসাম্যহীন ঘুড্ডিকে ঠিক করার জন্য কান্নি দিতে হয়। এতে ঘুড্ডির একদিকে কাত হওয়া ঠেকে। চশমা খুলতে বা পরতে দুই হাত ব্যবহার না করলে এমনি কান্নি দশা হতে পারে চশমার। কান্নি দিয়ে ওটা সারান যায় না। নিতে হয় চশমার দোকানে। এমন যন্ত্রণায় পড়েননি কিন্তু চশমা ব্যবহার করেন তেমন আদমসন্তান পাবেন না। পই পই করেই দোকানিরা চশমা ব্যবহারে দুই হাত লাগাতে বলেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কি কখনো কোনো চশমা ব্যবহারকারীকে চশমা খুলতে বা পরতে দুই হাত ব্যবহার করতে দেখেছেন?
এদিকে এক রোগী হতাশ গলায় বললেন, ডাক্তার আপা আমার মনে হয় চশমা নিতেই হবে।
—এক শ ভাগ খাঁটি কথা কইছেন। কারণ, এইটা চশমার ক্লিনিক বা চোখের হাসপাতালও না। আর আমিও চোখের ডাক্তার না। এইটা ব্যাংক। আমি ব্যাংকের ম্যানেজার!
চশমা পরেন এবং মধুচন্দ্রিমায় যাবেন, তাদের সতর্ক করা উচিত এ আসরে। এবারের ঘটনা তাদের জন্যই। চশমা ছাড়া মধুচন্দ্রিমা গেছেন এক নারী। ফিরে আসার পর কী ঘটল, তাই বলা হয়েছে। ঘরে পা দিতেই মা রেগে বলছেন— হতভাগী, তোর জামাই শোওয়ার ঘরে বসে ফুঁসছে। চশমা না নিয়ে তুই পনেরো দিন কার সাথে ঘোরাঘুরি করে আসলি!
এককালে এ ভূখণ্ডে চশমা বিক্রি করতে আসত একটি যাযাবর সম্প্রদায়। তারা 'ইরানি' নামে পরিচিত ছিল। তাদের ভাষাও ছিল ফারসি বা দারি ফারসি। ফারসি জানা একজনকে তাদের সাথে সহজেই 'সোহবত' বা আলাপ করতে দেখেছি চাঁদপুরের ফৌজদারি আদালত প্রাঙ্গণে। আলাপে খুশি হয়ে ভদ্রলোককে জিপসি নারী একটা আতিক পাথর 'হাদিয়া' (উপহার) দিয়েছিলেন।
ওই দলটি তাঁবু ফেলেছিল চাঁদপুরের দশ কোয়াটার নামে পরিচিত রেলওয়ে কলোনির কাছাকাছি, চাঁদপুর কোর্ট স্টেশনের আউটার সিগন্যালের পাশেই নিচু এবং ছোট এক মাঠে। এ সম্প্রদায়ের নারীরাই সব কাজ সামাল দিতেন। পুরুষদের খুব একটা কাজ করতে দেখেনি। খুব রংচংয়া ঘাঘরা পরতেন নারীরা। তার ঘেরও ছিল বিশাল। তাদের গায়ের রং ছিল পাকা গমের মতো। রোদে পুড়ে ফর্সা রং অমন হয় বলে শুনেছি। গলায়, কানে এবং হাতে থাকত পাথর বা পুঁতির অলংকার। আঙুলে শোভা পেত নানা রকম আংটি। এক আঙুলে একের অধিক আংটি পরা ওদের জন্য সাধারণ ঘটনা। এ ছাড়া নাকেও বিচিত্র অলংকার পরত। ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকের কথা বলছি। বাংলাদেশ হওয়ার পর এই 'ইরানি'দের আর দেখা যায়নি।
চশমা নিয়ে ট্রাডিশন ঘরে ঘরে আজও চলছে, চলবে...
চোখে রেখে ঘরে তোলপাড় করে চশমা খোঁজার সেই ট্রাডিশন সমানে আজও চলছে। আব্বা চশমা না পেয়ে যখন হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, তখন আম্মা বললেন— তোমার চোখে ওটা কী! আব্বা নিজ মান রাখতে সে সময় রবীন্দ্রনাথের গল্প শোনালেন একটু আগেই চশমার তালাশে শশব্যস্ত আমাদের। রবিবাবুও নাকি চোখে চশমা রেখে সারা ঘর খোঁজাখুঁজি করেছেন।
আম্মা স্কুলের প্রধান গেট দিয়ে ঢোকার আগেআগে বললেন, বাবা চশমা বাসায় রেখে এসেছি। সর্বনাশ আজ দরকারি ক্লাস আছে। চশমা ছাড়া নিতে পারব না। দৌড়ে বাসায় যা আর চশমা নিয়ে দৌড়ে আয়। নানাভাবে খুঁজেও ঘরের কোথাও চশমার নামগন্ধ পেলাম না। মন খারাপ করে ফিরে সে কথা জানাতে গিয়ে দেখি, ক্লাসে চশমা চোখে হাজিরা বই খুলে নাম ডাকছেন আম্মা।
তেহরানের বাসায় চশমা খুঁজে না পেয়ে মন খারাপ করে রাগ দেখানো উচিত কি না, ভাবছি; তখন বড় ছেলে রাইয়ান বলল, বাবা তোমার চোখে ওটা কী!
রাইয়ান অনেকক্ষণ কী যেন খুঁজছে। বিরক্তিতে ফেটে পড়ছে। হঠাৎ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,– চশমা তো চোখেই রয়েছে। আর ছোট ছেলে রাসতিন চশমা কই...হাঁক দিতে যেয়ে হেসে ফেলল, এই তো চোখেই রয়েছে আমার চশমা। তাদের মায়ের চশমা খোঁজার বিত্তান্ত আর এখানে বললাম না।