স্নায়ুযুদ্ধকালের ফুটবল
ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমরবিশারদেরা রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকে ভিন্ন চরিত্রের দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ বিবেচনা করছেন, সুদূরপ্রসারী ফলাফল বিশ্ব অর্থনীতিসহ বিভিন্ন প্রাঙ্গণে প্রভাব রাখতে শুরু করেছে। তারই একটি হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনকে খোঁড়া বানিয়ে দেওয়া। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ যে এর মধ্যেই দুজন ফুটবলারের জীবন সংহার করেছে, তা সম্ভবত বৈশ্বিক ডামাডোলে তলিয়ে গেছে। ফুটবলারদের একজন ভিতালি সেপিরো এবং দমিত্র মার্টিনেনঙ্কো।
মাত্র চার বছর আগে ২০১৮ সালে শেষ ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবলের যারা হোস্ট ছিল, সেই রাশিয়া ২০২২ সালের কাতার ফিফা বিশ্বকাপ থেকে বাদ! কেন? এককথায় উত্তর—তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন করা যেতেই পারে, ভূরাজনীতিতে কার কী অবস্থান এবং কার বিরুদ্ধে কার লড়াই—তার সাথে ফুটবলের কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক থাকারই কথা। কিন্তু বৈশ্বিক ফুটবল প্রশাসন অনেকটাই স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিচার বিভাগের মতো; নামে স্বাধীন, কাজ চলে নির্বাহী হুকুমে। আন্তর্জাতিক ফুটবল ফেডারেশন তাত্ত্বিকভাবে অবশ্যই স্বাধীন কিন্তু শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষের চাপ ঠেলে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। ভিন্ন ধরনের কয়েকটি পুরোনো উদাহরণ দিই। দুই রকমই ঘটছে—ফিফা নিষিদ্ধ করছে আবার কখনো কখনো হাস্যকর, কখনো সিরিয়াস কারণ দেখিয়ে কোনো কোনো দেশই বিশ্বকাপ ফুটবল বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
১.
২০০৮ সালে ফিফা ইরাককে ২০১০ সালের ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফাইয়িং রাউন্ডে অংশগ্রহণ করা থেকে নিষিদ্ধ করে দেয়। কারণ, ইরাক সরকার তাদের জাতীয় অলিম্পিক কমিটি ও স্পোর্টস ফেডারেশন ভেঙে দিয়েছে। পরবর্তী সময় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়। ইরাক নিয়ে, সাদ্দাম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার শেষ ছিল না, উইপন অব মাস ডেস্ট্রাকশনও তারা সেখানে আবিষ্কার করতে চেয়েছে। ২০১৪ সালে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার মোকাবিলা করে নাইজেরিয়া। ২০১৪-এর ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপে বাজে ফলাফল করার জন্য সে দেশ ফুটবলের জাতীয় নির্বাহী কমিটি ভেঙে দেয় এবং নাইজেরিয়ার আদালত একজন আমলাকে সেখানে প্রশাসক হিসেবে বসিয়ে দেয়। অমনি ফিফা নাইজেরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভাগ্য ভালো নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘায়িত হয়নি।
২০১৭ ও ২০২১-এ পাকিস্তানের ওপর ফিফার নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কারণ, পাকিস্তান ফুটবল ফেডারেশন নিষ্ক্রিয়, একটি তৃতীয় পক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ২০২২ সালে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
২০২২ সালে কেনিয়ার ওপর ফিফার নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়; কারণ,পুরোনো ফুটবল ফেডারেশন ভেঙে দিয়ে সরকার একটি কেয়ারটেকার ফুটবল ফেডারেশন নিয়োগ করেছে। কেনিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত আছে।
২০১৫ সালে কুয়েত ও ইন্দোনেশিয়া নিষিদ্ধ হলো। ফিফা জানাল কুয়েতের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন নয় বরং প্রশাসন ফুটবলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার বেলায় সরকার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন ভেঙে দিয়ে নতুন কমিটি তৈরি করে ফুটবলের দায়িত্ব দিয়েছে, যা ফিফা নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক। সুতরাং দুই দেশের ওপরই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। গুয়েতেমালায় ফুটবল ফেডারেশনের পরিচালকেরা ফিফার বিধিবিধান মানতে রাজি হয়নি বলে নিষিদ্ধ ছিল ২০১৫ থেকে ২০১৮, তিন বছর।
২.
১৯৭৩ সালে ফুটবল বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে চিলির সান্তিয়াগো স্টেডিয়ামে সোভিয়েত ইউনিয়ন খেলতে রাজি নয় বলে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয়। রাজি না হবার কারণ এমন নয় যে মাঠ ভালো নয় কিংবা চিলিতে আদরযত্নের ঘাটতি হবে। সমস্যা হচ্ছে অগাস্তো পিনোশের সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের শাসনামলে এই স্টেডিয়ামটি একটি বন্দিশিবির ও নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর এখানেই সোভিয়েত ইউনিয়নের খেলা চিলির বিরুদ্ধে। প্রতিদ্বন্দ্বী সোভিয়েত ই্উনিয়ন হাজির না হওয়া ফিফা চিলিকে ওয়াকওভার দিয়ে দেয় আর তাতে ১৯৭৪-এর বিশ্বকাপে চিলির অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়ে যায়।
২০১১ সালে বসনিয়ান ফেডারেশনকে কিছুকালের জন্য সদস্যপদ থেকে সরিয়ে রাখা হয়; কারণ, সেখানকার ফুটবল ফেডারেশন ফিফা বিধি অনুসরণ করে গঠিত হয়নি। পেশাদারত্বের বিষয় বিবেচনায় না এনে সরকার চক্রকারে একজন সার্ব, একজন ক্রোট এবং একজন জাতিগত মুসলমানকে ১৮ মাসের জন্য প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব প্রদান করে।
২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম রাউন্ডেই নাইজেরিয়া বাদ পড়ে যাওয়ায় সে দেশের প্রেসিডেন্ট গুডলাক জোনাযান খুব ক্ষেপে যান এবং পরবর্তী দুই বছর নাইজেরিয়া কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা করেন। ফিফা এই ঘোষণার পর নাইজেরিয়াকে ফিফা থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের হুমকি দিলে প্রেসিডেন্টের ক্রোধ কিছুটা কমে আসে। তাপরও ২০১০-এর অক্টোবর থেকে কিছু সময়ের জন্য নাইজেরিয়ার সদস্যপদ স্থগিত রাখা হয়। কেবল ফিফা নয়, সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফেডারেশন অব আফ্রিকান ফুটবলও যথেষ্ট ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত আফ্রিকান ন্যাশনস কাপ থেকে নাইজেরিয়া দল প্রত্যাহার করে নেয়। কারণ, দক্ষিণ আফ্রিকা নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট সানি আবাচার সামরিক সরকার সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেছে। কনফেডারেশন অব আফ্রিকান ফুটবল নাইজেরিয়ার অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৯৯৮ সালেও এই দেশটি আফ্রিকান কাপে অংশ নিতে পারেনি।
সম্প্রতি মিয়ানমারের কো-স্পনসরশিপে আয়োজিত টুর্নামেন্ট থেকে নাম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় মালয়েশিয়া। প্রত্যাহারের কারণ রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন।
একদা সোভিয়েত দলের গোলকিপার লেভ ইয়াসিনকে মনে করা হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোলকিপার। বিশ্বকাপে খেলার সকল যোগ্যতা নিয়ে সকল শর্ত পূরণ করার পরও ২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে রাশিয়া নেই। ইউক্রেন আক্রমণ করার কারণে ফেব্রুয়ারিতে ফিফা রাশিয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ইউরোপিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফিফার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাশিয়া আপিল করলেও যুদ্ধাবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় তা নাকচ হয়ে যায়।
২০২২ কাতার বিশ্বকাপের ছয়টি দলে ২৪টি দেশ চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলার জন্য মনোনীত হয়েছে।
এর মধ্যে গ্রুপ বিতে আছে : ইংল্যান্ড, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, ওয়েলস। সংকট তৈরি হয়েছে বি গ্রুপের ইরানকে নিয়ে। ফিফার সাবেক প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার দাবি জানিয়েছেন ইরানকে বিশ্বকাপ থেকে বহিষ্কার করা হোক। ইরান মানবতাবিরোধী ও নারী নির্যাতনকারী। ইরান জাতীয় দলের সাবেক গোলকিপার ইরান সরকারকে খুনি সরকার আখ্যা দিয়ে ইরানিদের কাতারে যাওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। ইরানের ফুটবল ফেডারেশন সম্পর্কেও অভিযোগ পেশাদারত্বের ভিত্তিতে তা না চালিয়ে রেভল্যুশনারি গার্ডদের মাধ্যমে তা পরিচালিত হচ্ছে। রাশিয়াকে ওয়ার্ল্ড কাপের কোয়ালিফায়িং রাউন্ডে বাদ দেওয়ায় ইউক্রেন খুশি হয়েছে। ইউক্রেন একই সঙ্গে ইরানকে বহিষ্কারেরও আবেদন জানিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই ইউক্রেনের ফুটবলারদের অনেকেই যুদ্ধে নাম লিখিয়েছে এবং লড়াই করে যাচ্ছে। তবে ইরানকে বাদ দেওয়া হয়নি।
৩.
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ-পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধ ১৯৯১-এর সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর শেষ হয়েছে বলে মনে করা হলেও বাস্তবে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এটা কোল্ড ওয়ার টু।
ইতিহাস বিশেষজ্ঞ জেমস রিওর্ডানের স্নায়ুযুদ্ধ ও ক্রীড়াবিষয়ক কয়েকটি মন্তব্য লক্ষণীয় :
১. স্নায়ুযুদ্ধের সময় রাজনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শনগত দ্বন্দ্বে খেলাধুলাতে হাতিয়ার হিসেবে এবং শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
২. ১৯৪০ দশকের শেষভাগ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফুটবলের সকল ক্রীড়ায় এবং ক্রীড়ার অবকাঠামো গঠনে বিপুল বিনিয়োগ করেছে।
৩. বিনিয়োগে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও সমর্থনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাপক সাফল্য দেখাতে পেরেছে।
৪. স্নায়ুযুদ্ধের পরিণতিতেই রক্তাক্ত লড়াই মাঠে এবং পানিতেও নেমে এসেছে। ১৯৫৬-এর মেলবোর্ন অলিম্পিকের সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং হাঙ্গেরির মধ্যকার ওয়াটার পলো 'ব্লান্ড ইন ওয়াটার' নামে পরিচিতি পেয়েছে।
৫. স্নায়ুযুদ্ধের সময় নব্যজোট গঠনে ক্রীড়া ভূমিকা রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার পিং পং ডিপ্লোম্যাসি (১৯৭১- ১৯৭২) এবং গুড উইল গেইমস (১৯৮৬–২০০১) তার প্রমাণ।
১৯৪৮ সালের অলিম্পিকে যোগ দেবার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, কিন্তু জোসেফ স্ট্যালিন সম্মত না হওয়ায় তারা যেতে পারেনি। অবশ্য স্ট্যালিনের চাওয়া ছিল ভিন্ন, খেলতে গেলে জিততে হবে, পরাজিত হয়ে ফেরা যাবে না। সুতরাং ১৯৫২-এর হেলসিংকি অলিম্পিকের আগে বিপুল বিনিয়োগ করা হয় এবং সোভিয়েতরা ৭১টি পদক জেতে, তার মধ্যে ২২টি স্বর্ণপদক। একইভাবে লড়াই করার মানসিকতা নিয়ে পূর্ব জার্মানিও বিনিয়োগ বাড়ায় এবং সুফল ঘরে আনতে থাকে। ১৯৭২-এর মিউনিক অলিম্পিক বাস্কেটবলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ৫১-৫০ পয়েন্টে জিতে যায়। কিন্তু রানার্সআপ যুক্তরাষ্ট্র সিলভার পদক নিতে অস্বীকার করে। স্বর্ণপদকের দাবি তারা প্রত্যাহার করেনি।
স্নায়ুযুদ্ধের রাজনীতিতে ১৯৭২ অলিম্পিকে বাস্কেটবলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কানাডার লড়াই কূটনৈতিক যুদ্ধে পরিণত হয়।
এটাও বিস্ময়কর—আন্তর্জাতিক ক্রীড়া সংস্থাগুলো ১৯৮০ পর্যন্ত চীনের মতো দেশকে অগ্রাহ্য করেছে, কোনো অলিম্পিকেই অংশগ্রহণ করতে দেয়নি। চীনের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করায় ১৯৭৬-এর মন্ট্রিয়েল অলিম্পিকে চীন যোগ দেয়নি। ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিকে যুক্তরাষ্ট্র আসেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক ব্লকের ১৪টি দেশ ১৯৮৪-এর লস অ্যাঞ্জেলেস অলিম্পিকে যায়নি।
দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধে ইউক্রেন হয়ে উঠেছে বার্লিন ওয়াল। স্নায়ুযুদ্ধকালে বার্লিন ওয়ালের কোন পাশের পক্ষ, সেটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ, সোভিয়েত আগ্রাসন নেই, কিন্তু রুশ শক্তিমত্তার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অযাচিত হস্তক্ষেপ চরিত্র এখনো বহাল আছে। স্নায়ুযুদ্ধ পৃথিবীকে দ্বিখণ্ডিত করে রাখলে শেষ পর্যন্ত মুনাফা পৌঁছবে বৈশ্বিক মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ঘরে। ভুগতে থাকবে সাধারণ মানুষ, ভুগবে ক্রীড়াঙ্গন।