'বিগ বুল' হারশাদ মেহতা
২০২২ সালের জুলাই মাসের শুরুর দিকে স্টক মার্কেটের 'বিগ বুল' হিসেবে খ্যাতি পাওয়া হারশাদ শান্তিলাল মেহতার বিধবা স্ত্রী জ্যোতি এবং তার পরিবার তার নামে একটি ওয়েবসাইট খোলেন। ওয়েবসাইটটি খোলার উদ্দেশ্য আয়কর বিভাগের কাছ থেকে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত হয়রানির কথা প্রকাশ করা, যার শিকার হতে হচ্ছে তার স্বামী মারা যাওয়ার দুই দশক পরেও। এমনকি বিভিন্ন বিচারে ১২০০ মামলায় জেতার পরেও এ হয়রানি পিছু ছাড়ছে না তাদের।
মামলাগুলোর বেশিরভাগই ১৯৯২ সালের কুখ্যাত (এমনকি অমরও বলা চলে) জালিয়াতির ফসল, যার জন্য হারশাদ মেহতাকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৯২ সালে তিনি যা করেছিলেন, তাকে প্রায় অসম্ভব মনে হতে পারে। কোনো টাকা-পয়সা ছাড়াই তিনি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করেছেন, কামিয়েছেন মিলিয়ন মিলিয়ন অর্থ। এবং এটি করতে গিয়েই গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু কোম্পানির স্টকমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছেন। স্টক মার্কেট ব্যবস্থাতেই লুপহোল খুঁজে বের করে জালিয়াতি করে পয়সা পুরেছেন নিজের পকেটে।
সহজভাবে বলতে হলে, বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের (বিএসই) প্রতি দুই সপ্তাহে একবার ট্রেড মার্কেটে কেনাবেচা হতো। কয়েকজন ব্যাংকারকে হাত করে মেহতা অস্বয়ংক্রিয় এই ব্যবস্থার নিরাপত্তা বলয়কে ভেদ করেন। ব্যাংকারদের সাহায্যে ইস্যু করা নকল ব্যাংক রিসিপ্ট হাতে পেয়ে সেগুলোকে কাজে লাগান অন্য ব্যাংককে স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করানোর জন্য। যেহেতু অন্য ব্যাংকগুলো তার ব্যাংক রিসিটগুলোকে আসল মনে করেছিল, তাই ব্যাংকগুলোও মেহতাকে টাকা ধার দিতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি। এভাবেই মেহতা পুরো স্টকমার্কেটের মূল্য ৪ গুণ বাড়িয়ে দেন কয়েক মাসের মধ্যেই। রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার তৎকালীন ডেপুটি গভর্নর আর জানাকিরামানের নেতৃত্বে থাকা কমিটি আন্দাজ করে যে, এই জালিয়াতির পরিমাণ ছিল ৪,০২৪ কোটি রুপি।
এক অবিস্মরণীয় নাম
ভারতের স্টক মার্কেটে নতুন কেউ বিনিয়োগ করতে শুরু করলেই সে প্রথম যে নামের সাথে পরিচিত হবে, সেটি হলো হারশাদ মেহতা। 'বিগ বুল' আর 'স্টক মার্কেটের অমিতাভ বচ্চন' হিসেবে খ্যাতি পাওয়া হারশাদ মেহতার নাম শুনলে সবাই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়: একভাগ তাকে বাণিজ্যিক মার্কেটের মাস্টারমাইন্ড মনে করেন, অন্যদের কাছে তিনি কেবল একজন ছিঁচকে জালিয়াত।
১৯৫৪ সালের ২৯ জুলাই এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম মেহতার। জায়গা গুজরাটের রাজকোট জেলার পানেলি মোতি গ্রামে। তবে তার ছেলেবেলা কেটেছে মুম্বাইয়ের উপশহরে, যেখানে তার বাবা শান্তিলাল মেহতা কাপড়ের ব্যবসা করতেন। কয়েক বছর পর তার পরিবার ছত্তিশগড়ের রায়পুরে চলে যাওয়ার পর সত্তরের দশকে আবারো মুম্বাইয়ে চলে আসেন তারা।
ক্রিকেট নিয়ে ব্যাপক উৎসাহী মেহতা তার ছত্তিশগড়ের স্কুলের ক্রিকেট দলের সদস্য ছিলেন। মুম্বাইয়ের লাল লাজপাতরায় কলেজ থেকে কমার্স নিয়ে ১৯৭৬ সালে পড়াশোনা শেষ করেন। তারপর বেশ কিছু বছর বিভিন্ন ধরনের কাজ করে বেড়িয়েছেন, সিমেন্টের কন্ট্রাকটর, ইন্স্যুরেন্স ক্লার্ক, হীরার মান পরীক্ষক এবং শেষমেশ স্টক মার্কেটের দালাল। ১৯৮৪ সালে মেহতা তার স্টক ব্রোকিংয়ের লাইসেন্স পেয়ে যান, আর তারপরেই খুলে বসেন নিজের ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান 'গ্রো মোর রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট'। দুই বছরের মধ্যেই মেহতা স্টক মার্কেটে নিজেই বিনিয়োগ করা শুরু করে দেন। ১৯৯২ সালের মধ্যে মেহতা ভারতের সর্বোচ্চ করদাতাদের একজন হিসেবে নাম লেখান।
জালিয়াতির পদ্ধতি
কারো কোনো ধারণাই ছিল না কীভাবে মেহতা বিনিয়োগ করার অর্থ পাচ্ছেন। সে সময়ে ব্যাংকগুলোর সরাসরি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করার অনুমতি ছিল না। কিন্তু স্টকব্রোকারদের মার্কেটে বিনিয়োগ করার জন্য প্রয়োজন অর্থ। ব্রোকাররা সরকারি সিকিউরিটিজের বিনিময়ে ব্যাংকারদের সাথে হাত মিলিয়ে ব্যাংকের সেই টাকা স্টক মার্কেটে নিয়ে আসতে শুরু করে।
তবে কেন ব্যাংকগুলো সিকিউরিটিজের বিনিময়ে টাকা ধার দিচ্ছিলো? প্রথমত, প্রতি ব্যাংকেই নগদ টাকার রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) এবং স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) ঠিক রাখতে হতো। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট নগদ অর্থের (ক্যাশ) পাশাপাশি তাদের অর্থের নির্দিষ্ট একটি পরিমাণ সরকারি সিকিউরিটিজ এবং অন্যান্য অনুমোদিত সিকিউরিটিজ (এসএলআর) হিসেবে ডিপোজিট রাখতে হতো। দ্বিতীয়ত, লাভ করার জন্য। তৎকালীন সময়ে ব্যাংকের লাভ তুলনামূলকভাবে কম ছিল। নগদ অর্থ এবং সিকিউরিটিজ ডিপোজিটের বেশ বড় অংশ তাদের হাতে রাখতে হতো, ফলে চড়া সুদে ধার দেওয়ার জন্য অর্থ খুব বেশি ছিল না তাদের। এ কারণে তাদের লাভও হতো কম।
এদিকে কিছু কিছু ব্যাংকের নগদ অর্থে টান পড়তো, আবার কিছু কিছু ব্যাংকের সিকিউরিটি ডিপোজিট কম ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দুই পক্ষই সিকিউরিটিজের বিনিময়ে নগদ এবং নগদের বিনিময়ে সিকিউরিটিজের খোঁজে ছিল। তবে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত সুদের হার বেশি হওয়ায় অতিরিক্ত নগদ অর্থ রাখা ব্যাংকগুলো সরাসরি সিকিউরিটিজ বিক্রি করা অন্য ব্যাংকগুলোর সাথে লেনদেন করতো না। ব্রোকারদের মাধ্যমে তা-ই এই সিকিউরিটিজ এবং নগদ অর্থ লেনদেন করতো ব্যাংকগুলো।
তবে সে সময়ে সরাসরি সিকিউরিটিজ একজায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া বেশ সমস্যাজনক ছিল। অনেক সময় সেটি দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের বিভিন্নস শাখায় ছড়িয়ে থাকার কারণে আসল সিকিউরিটিজ ইস্যু করতে বহুদিন সময় লাগতো, কোনো কোনো সময় কয়েক বছরও লেগে যেত। তাই সিকিউরিটিজ বিনিময়ের প্রমাণ হিসেবে একটি ব্যাংক রিসিট দেওয়া হতো, যেটি দেখিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়া যেত। মেহতা এই নকল ব্যাংক রিসিটকে কাজে লাগিয়েই ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নগদ অর্থ নেওয়া শুরু করেন।
ব্যাংকগুলো ব্রোকারদেরকে স্টকমার্কেটে বিনিয়োগ করার জন্য অর্থ দিত, স্টকব্রোকাররা সেই অর্থ বিনিয়োগ করে লাভের একটি অংশ ব্যাংকে পাঠিয়ে দিত। এভাবে অবৈধ হলেও বেশ কয়েক বছর ধরে ব্যাংক এবং ব্রোকার, দু পক্ষই লাভ করে আসছিলো। হারশাদ মেহতাও ছিলেন সেই দলে। স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাংক, ইউসিও ব্যাংক এবং এএনজেড গ্রিন্ডলেইজের ব্রোকার হিসেবে কাজ করতেন তিনি।
মেহতা বন্ধ হয়ে যাওয়া কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ার কিনে সে কোম্পানিতে টাকা ঢেলে স্টকমার্কেটে সেই কোম্পানির দাম বাড়িয়ে দিতেন। এর পেছনে কাজ করেছিল তার উদ্ভাবিত 'রিপ্লেসমেন্ট কস্ট তত্ত্ব'। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের স্টক মার্কেটের দাম হওয়া উচিৎ, সে প্রতিষ্ঠানের মতো পণ্য উৎপাদন করতে পারে এমন নতুন প্রতিষ্ঠান বানাতে কত খরচ হবে তার সমপরিমাণ। ধরা যাক, একটি চলমান সিমেন্ট কোম্পানির সমক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি সিমেন্ট কোম্পানি তৈরি করতে খরচ হবে ৫০০ কোটি রুপি। তাহলে ঐ সিমেন্ট কোম্পানির মোট শেয়ারের দামও ৫০০ কোটি হবে। মেহতার এই তত্ত্ব গ্রহন করে নেয় স্টকমার্কেট। এভাবেই অ্যাসোসিয়েটেড সিমেন্ট কোম্পানিজ (এসিসি)-র মতো কোম্পানির শেয়ারের দাম ৩০০ রুপি থেকে ১০ হাজার রুপি হয়ে যায় দুই বছরের মধ্যেই। অন্যান্য বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ারের দামও এই সময়ে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। মেহতাও কম টাকা দিয়ে শেয়ার কিনে সেটার দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে সেটি বিক্রি করে পকেটে টাকা পুরতে থাকেন।
স্টকমার্কেটে মেহতার প্রভাব এতটাই বেড়ে যায় যে, ব্যাংকগুলো তার পেছনে টাকা ঢালতে রাজি হয়ে যায়। স্টক মার্কেটে অ্যাসোসিয়েটেড সিমেন্ট কোম্পানিজ (এসিসি)-র পাশাপাশি সাউদার্ন পেট্রোকেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন, ভিডিওকন ইন্ডাসট্রিজ আর অ্যাপোলো টায়ারের মতো বড় বড় কোম্পানিও চলে আসে মেহতার হাতের মুঠোয়, যেগুলো আজও ভারতের স্টকমার্কেটে বড় নাম।
এদিকে মেহতার সাথে কাজ করা অন্য এক প্রতিষ্ঠানের এক দালাল তার নাম না প্রকাশ করার শর্তে গণমাধ্যম দ্য প্রিন্টকে জানান যে, মেহতা বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তার টার্গেট করা স্টকে বিনিয়োগ করতে আশ্বাস দেন। দালাল জানায়, "দিল্লীর বড় বড় ক্ষমতাশালীদেরর সাথে হারশাদের পরিচয় রয়েছে এবং তাদের সাহায্যে হারশাদ অনেক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাৎক্ষনিক লাভের বিনিময়ে বড় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করাতে রাজি করেন।"
স্টক মার্কেটের 'বেয়ার (ভাল্লুক) কার্টেল' হিসেবে পরিচিত ব্যাংক আর দালালদের সিন্ডিকেটের মনোপলি ভেঙেছেন বলে দাবি করেছিলেন মেহতা। সেটিকে ইঙ্গিত করেই এক টেলিভিশন চ্যানেলে তাকে দেখা যায় মুম্বাইয়ের চিড়িয়াখানার ভাল্লুককে তিনি পিনাট বাটার খাওয়াচ্ছেন। ইন্ডিয়া টুডের সাথে এক সাক্ষাৎকারে মেহতা তাদেরকে 'কষ্টের বার্তাবাহক' বা 'প্রফেটস অফ গ্লুম' হিসেবে অ্যাখ্যা দেন, যাদের একমাত্র লক্ষ্য তাকে [মেহতাকে] মার্কেট থেকে সরিয়ে দেওয়া।
মেহতার পতন
সুচেতা দালাল নামের এক সাংবাদিকের হাত ধরে প্রথম মেহতার জালিয়াতির কথা প্রকাশ পায়। তার লেখা বই 'দ্য স্ক্যাম: ফ্রম হারশাদ মেহতা টু কেতান পারেখ'-এ সুচেতা ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে মেহতা ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকাকে ব্যবহার করে স্টক মার্কেটের এই জালিয়াতি নিশ্চিত করেছেন।
১৯৯২ সালে সরকারের সিকিউরিটিজের পরিমাণে টান পড়তেই এসবিআই তদন্ত শুরু করে। এবং তারপর হিসাব করে মোটা অঙ্কের গরমিল দেখতে পায় তারা। মেহতা যে নকল ব্যাংক রিসিট দেখিয়ে টাকা নিয়েছেন সে জালিয়াতি ধরা পড়তেই স্টক মার্কেটে ৭২ শতাংশ ধ্বস নামে। এই ধ্বস ঠিকঠাক হতে লেগে যায় দুই বছরেরও বেশি সময়।
১৯৯২ সালের ৯ নভেম্বর সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) '৯০ টি কোম্পানির ২.৮ মিলিয়ন শেয়ার আত্মসাৎ'-এর অভিযোগে গ্রেফতার করে মেহতাকে। একইসাথে তাকে স্টকমার্কেটে বিনিয়োগ করা থেকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। মেহতা অবশ্য দাবি করতে থাকেন তাকে 'এস্কেপগোট' হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও ১৯৯৫ সালে তিনি 'স্টক মার্কেট গুরু' হিসেবে কিছুদিনের জন্য ফেরত আসেন, ১৯৯৯ সালে তাকে আবার জেলে পাঠানো হয়। ২০০১ সালে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে মারা যান মেহতা, বিচার চলাকালীন অবস্থাতেই। অদ্ভুত বিষয় হলো, তার মৃত্যুর পর সেনসেক্স ইন্ডেক্স ৭৭ পয়েন্ট বেড়ে যায়, সম্ভবত তাকে সম্মান জানাতেই।