কাগজের আবিষ্কার পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে, কাগজ ফুরিয়ে যাবে না
জার্মানির মাইঞ্জ শহরের স্বর্ণকার ইয়োহানেস গুটেনবার্গের প্রিন্টিং প্রেস আবিষ্কারকে ধরা হয় মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হিসেবে। দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকবে এরকম প্রচুর সংখ্যাক ধাতব অক্ষর (মেটাল টাইপ) কীভাবে তৈরি করা যায় এবং সেগুলোকে পাশাপাশি রেখে কীভাবে একটি পৃষ্ঠার শত শত কপি বানানো যায়, তার উপায় খুঁজে বের করেছিলেন গুটেনবার্গ। সাথে ঐ মেটাল টাইপগুলোকে পুনরায় সাজিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পৃষ্ঠা প্রিন্ট করার পদ্ধতিও বের করেছিলেন তিনি।
ইউরোপের খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের ক্যালিগ্রাফিক বাইবেলগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে নিজের বাইবেলকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিলেন গুটেনবার্গ। কালো রঙের ঘন ল্যাটিন অক্ষরের মাঝখানে প্রায়ই দেখা যেত হালকা লাল রঙের ছোঁয়া।
তবে গুটেনবার্গের আবিষ্কারকে চাইলে অনেকে ইতিহাসের পাতা থেকে উড়িয়েও দিতে পারেন। মুভেবল টাইপ প্রেসের প্রথম আবিষ্কর্তা গুটেনবার্গ নন, বরং বহু আগে থেকেই সেটি চীনে ব্যবহার করা হয়েছে। এদিকে গুটেনবার্গ যখন জার্মানিতে তার প্রিন্টিং প্রেস নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, কোরীয়রা প্রিন্টিংকে আরও সহজ করার জন্য তাদের লিপি থেকে দশ হাজারেরও বেশি অক্ষর ছেঁটে ফেলে মাত্র ২৮টি অক্ষরে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে। তাছাড়া গুটেনবার্গের হাত ধরেই যে গণসাক্ষরতার শুরু হয়েছে তা-ও নয়। তার ছয়শ থেকে সাতশ বছর আগেই আব্বাসী খেলাফতের সময় মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকায় সাধারণ ব্যাপার ছিল এটি।
এরপরেও পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার পেছনে গুটেনবার্গ প্রেসের কম ভূমিকা নেই। ইউরোপ পুনর্গঠিত হয়েছে এর ওপর ভর করেই; বিজ্ঞান, সংবাদপত্র, উপন্যাস, স্কুলের পাঠ্যবইসহ অনেক কিছুরই মূল ভিত্তি ছিল গুটেনবার্গের প্রেস। তবে আরেকটি আবিষ্কার ছাড়া হয়তো এই বিশাল উন্নতি সম্ভব হতো না, এবং প্রেসের মতোই গুরুত্বপূর্ণ এই বস্তু, যাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। আর সেটি হলো কাগজ।
কাগজের ধারণাও এসেছে চীন থেকে, প্রায় দুই হাজার বছর আগে। প্রথমে দামী দামী বস্তু সুরক্ষিত রাখতে সেগুলোকে মোড়ানোর কাজে কাগজ ব্যবহার করা হতো। তবে খুব দ্রুতই চীনারা লেখার কাজে কাগজ ব্যবহার শুরু করে। কারণ? প্রথমত এটি বাঁশের চেয়ে হালকা, ফলে সহজে বহনযোগ্য। এবং দ্বিতীয়ত, এটি সিল্কের মতো দামী নয়।
চীনের কাছ থেকে কাগজের জ্ঞান পেতেই সাথে সাথেই সেটিকে গ্রহণ করে নেয় আরবরা। কিন্তু ইউরোপীয়রা সেটি গ্রহণ করে অনেক পরে। গুটেনবার্গের প্রেস আবিষ্কার হওয়ার মাত্র কয়েক দশক আগে জার্মানিতে কাগজ আসা শুরু হয়।
কিন্তু কেন? কারণ এর আগে ইউরোপীয়দের কাগজের তেমন দরকার ছিল না। ইউরোপীয়দের কাছে তখন কাগজের বিকল্প হিসেবে পার্চমেন্ট ব্যবহার হতো। তবে এটি ছিল বেশ দামী। পার্চমেন্টের একটি বাইবেল বানাতে প্রয়োজন হতো প্রায় আড়াইশ ভেড়ার চামড়া। তবে যেহেতু খুব কম মানুষই পড়তে বা লিখতে পারতো, তাই পার্চমেন্টের দাম নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হতো না তাদের। তবে যখনই ইউরোপ বাণিজ্যের দিকে নজর দেয়, চুক্তিপত্র বা হিসাব রাখার জন্য লেখালেখির প্রয়োজন হয়, তখনই সস্তা লেখার উপকরণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
সস্তা কাগজের সাথে সাথে প্রিন্টিং শিল্পও লাভজনক হয়ে উঠতে শুরু করে। লক্ষ লক্ষ ভেড়া না মেরেই প্রিন্ট করার মতো হাজার হাজার কাগজ পাওয়ার ফলে আরও বেশি প্রিন্ট করা হতে লাগে সবকিছু।
তবে এখন কেবল লেখা কিংবা প্রিন্ট করার জন্যই কাগজ ব্যবহার হয় না। ওয়ালপেপার দিয়ে দেয়ালের সৌন্দর্যবর্ধন, পোস্টার আর ফটোগ্রাফ প্রিন্ট, চা-কফির ফিল্টার হিসেবে কিংবা টি-ব্যাগ হিসেবেও ব্যবহার হয় এই কাগজ। দুধ কিংবা জুসের প্যাকেট, বাক্সের কার্ডবোর্ড, র্যাপিং পেপার, শিরিষ কাগজ, গ্রিজপ্রুফ পেপার, পেপার ন্যাপকিন, পেপার রিসিট কিংবা টিকিট, সবকিছুই কাগজ।
আঠারোশ সত্তরের দশকে টেলিফোন আর লাইট বাল্ব আবিষ্কারের পাশাপাশি আরও একটি জিনিস আবিষ্কার হয়। ব্রিটিশ পারফোরেটেড পেপার কোম্পানি তৈরি করে নরম আর পানি শোষণ করা এক বিশেষ ধরনের কাগজ, পৃথিবীর প্রথম টয়লেট পেপার।
ইউরোপ কাগজকে গ্রহণ করতে দেরি করলেও যখন একে গ্রহণ করে নেয়, তখন তর্কযোগ্যভাবে কাগজ উৎপাদন শিল্পই হয়ে ওঠে ইউরোপের প্রথম ভারি শিল্প। প্রথমদিকে, তুলার পাল্প দিয়ে কাগজ উৎপাদন করা হতো। কাঁচামালকে আলাদা করার জন্য কিছু কেমিক্যাল ব্যবহার করা হতো। প্রস্রাবের অ্যামোনিয়া এক্ষেত্রে ভালোই কাজ করতো। ফলে ইউরোপের কাগজের কারখানাগুলো কয়েক শতাব্দী চলেছে এই মানবীয় তরল বর্জ্যের মাধ্যমে।
তাছাড়া পাল্পিং করার জন্যেও প্রচুর যান্ত্রিক শক্তির প্রয়োজন হতো। কাগজ উৎপাদনের অন্যতম প্রাচীন কেন্দ্র ইতালির ফ্যাব্রিয়ানোতে পর্বত থেকে পড়া প্রচণ্ড গতির স্রোতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশালাকার হাতুড়িকে কাগজ সোজা করার কাজে লাগানো হতো। তুলাকে ভালোমতো নরম করার পর তুলা থেকে সেলুলোজ আলাদা হয়ে পানির উপর ভাসে। এরপর এই সেলুলোজকে পাতলা করে শুকানো হলে একটি শক্ত নমনীয় কাগজে পরিণত হয় এটি।
সময়ের সাথে সাথে কাগজ উৎপাদনের প্রযুক্তিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। থ্রেশিং মেসিন, ব্লিচসহ নানা জিনিস উদ্ভাবনের ফলে কাগজ উৎপাদন আরও দ্রুত ও সহজ হয়ে উঠেছে। যদিও অনেকসময় এর ফলে কাগজ আরও কম টেকসই হয়ে উঠেছে।
১৭০২ সালের মধ্যে কাগজ এতটাই সস্তা হয়ে ওঠে যে এটি এমন এক পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়,যার মেয়াদ মাত্র ২৪ ঘণ্টা। ২৪ ঘণ্টা পর সেই কাগজটি ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হতো। আর তার নাম ডেইলি কুরান্ট, পৃথিবীর প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র।
কাগজ উৎপাদনের চাহিদা এতটাই বেড়ে যায় যে, লোকজন হন্য হয়ে কাপড় খুঁজতে থাকে সর্বত্র। ইউরোপ আর আমেরিকার বাসা-বাড়ি থেকে ন্যাকড়াও হারিয়ে যেতে শুরু করে। অবস্থা এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে, যুদ্ধের পর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সৈন্যদের শরীর থেকে রক্তাক্ত জামাকাপড় খুঁজে বের করে কারখানায় বিক্রি করা হয়ে ওঠে এক নতুন পেশা। অবশেষে সেলুলোজের নতুন উৎস হিসেবে কাঠ আবিষ্কৃত হয়। চীনারা অবশ্য কাঠ থেকে সেলুলোজ বের করার পদ্ধতি বহুদিন ধরেই জানতো। তবে ইউরোপীয়রা এই গোপন জ্ঞান জানতে অনেক দেরি করে ফেলে।
১৭১৯ সালে ফরাসি জীবনিজ্ঞানী রেনেঁ আতোয়াঁ দ্যু রেয়ামুঁ একটি গবেষণাপত্রে লেখেন, যেখানে তিনি দেখান ভিমরুল যদি কাঠ চিবিয়ে কাগজের চাক বানাতে পারে, তবে মানুষ কেন পারে না? যখন তার এই ধারণা অনেক পরে পুনরাবিষ্কৃত হয়, ততদিনে কাগজ উৎপাদনকারীরা জেনে গিয়েছে যে, তুলার তুলনায় কাঠ থেকে সেলুলোজ প্রক্রিয়াজাত করা বেশ কঠিন, তাছাড়া কাঠে সেলুলোজের পরিমাণও কম।
পশ্চিমের দেশগুলোতে কাগজ উৎপাদনের মূল কাঁচামাল হিসেবে কাঠ প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত। তবে সাম্প্রতিক সময় কাগজ উৎপাদনের কাঁচামাল কাগজই, বিশেষ করে চীনে। পুরনো কাগজকেই পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করে নতুন কাগজ তৈরি করা হয়।
সাংহাই থেকে ১৩০ মাইল দক্ষিণের শহর নিংবোর কারখানা থেকে উৎপাদন হয় ল্যাপটপ প্যাকেজিংয়ের কাজে ব্যবহৃত কার্ডবোর্ড বক্স। এরপর বক্সটিকে প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সিয়াটল কিংবা ভ্যাঙ্কুভারের মতো শহরে। এরপর কার্ডবোর্ডের বক্সটিকে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হয়। এ ধরনের বক্স অনেকগুলো জমা হলে সবগুলো একত্র করে পুনরায় ফেরত পাঠানো হয় নিংবোতে, যেখানে সেটিকে পাল্পে পরিণত করে পুনরায় আরেকটি বাক্সে রূপ দেওয়া হয়।
যখন লেখালেখির কথা চলে আসে, তখন অনেকেই মনে করেন যে লেখার কাগজের দিন শেষ। আগামী দিনগুলোতে 'কাগজমুক্ত অফিস' থাকবে, সব কার্যক্রম চলবে কম্পিউটারের স্ক্রিনে। তবে এই ধারণা চলে আসছে সেই উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকেই, যখন টমাস আলভা এডিসন ভেবেছিলেন যে অফিস মেমোগুলো তার ফোনোগ্রাফেই সংরক্ষিত থাকবে।
তবে ধারণাটি শক্তপোক্ত হওয়া শুরু করে সত্তরের দশকে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অফিসে কম্পিউটারের আগমন হয়। ব্যক্তিগত কাজেও কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় সে সময় থেকেই। তখন অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন কাগজের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তবে কাগজের উৎপাদন ও বিক্রি মোটেই কমেনি, উল্টো বেড়েছে কয়েকগুণ। কম্পিউটারের মাধ্যমে ডকুমেন্ট সরবরাহ করা কাগজ ছাড়া সম্ভব হলেও ডকুমেন্টের গ্রাহক সহজেই সেটিকে প্রিন্টারের মাধ্যমে প্রিন্ট করে নিতে পারছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ফটোকপিয়ার মেশিন, ফ্যাক্স মেশিন আর প্রিন্টারগুলো যে পরিমাণ কাগজ প্রিন্ট করে বের করে, তা দিয়ে প্রতি পাঁচ বছরে পুরো যুক্তরাষ্ট্র কাগজ দিয়ে ঢেকে ফেলা সম্ভব।
তবে কাগজের এই একাধিপত্য কিছুটা কমার সম্ভাবনা একেবারেই যে নেই, তা নয়। অনেকেই স্ক্রিন সোয়াইপ করার বদলে আসল বই বা সংবাদপত্র ছুঁতে পছন্দ করেন। কিন্তু ডিজিটাল সংস্করণের খরচ এতটাই কম যে অনেকেই সেদিকে ঝুঁকে পড়ছেন। তাছাড়া কম্পিউটারের সাথে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম বেড়ে ওঠার সাথে সাথে কাগজের চাহিদা আরও কমার সম্ভাবনাও একেবারে ফেলে দেবার মতো নয়। তবে ডিজিটাল স্ক্রিন কাগজের সাথে ঠিক তা-ই করছে, যেটি কাগজ করেছে পার্চমেন্টের সাথে। স্ক্রিন কাগজকে গুণমানের দিক থেকে হারিয়ে দেয়নি, বরং হারিয়ে দিয়েছে দামের দিক থেকে।
পুরনো প্রযুক্তিগুলোর টিকে থাকার অভ্যাস রয়েছে। যে কারণে আমরা আজও পেন্সিল বা মোমের মতো জিনিস ব্যবহার করি। গাড়ির তুলনায় আজও বাইসাইকেল বেশি উৎপাদিত হয়। কাগজের ব্যাপারটিও সেরকম। কাগজের চাহিদা হয়তো পড়তে থাকবে, কিন্তু এটা টিকে থাকবে সবজায়গাতেই, রাস্তার দোকান থেকে অফিস, গবেষণাগার থেকে অফিস পর্যন্ত সবজায়গাতেই।
কাগজ কখনোই লেখার একটি সুন্দর উপকরণ ছিল না, বরং ছিল প্রাত্যহিক কাজের জিনিস। আর তালিকা বানানো, আঁকিবুঁকি করা কিংবা কোনো তাৎক্ষনিক পরিকল্পনা লিখে রাখার জন্য প্যাডের শেষ পৃষ্ঠার চেয়ে ভালো কিছু হয় না।