এডওয়ার্ড সাঈদ: ‘দ্য ফলস প্রফেট অব ফিলিস্তিন’
'সন্ত্রাসের অধ্যাপক' শিরোনামে মার্কিন মাসিক সাময়িকী কমেন্টারির ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দের একটি সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনি ছাপা হলো। কাহিনির নায়ক হলেন এডওয়ার্ড সাঈদ। সাঈদ সে সময়ে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি এবং তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক। এ নিবন্ধে সাঈদকে চিত্রিত করা হলো ফিলিস্তিনি 'সন্ত্রাসীদের' প্রতিনিধি হিসেবে। এ ছাড়া তাকে ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের মিত্র হিসেবেও দাবি করা হয়। কেন এমনটি হলো?
তারও আগে সাঈদেরই বা পশ্চিমের প্রতি মোহভঙ্গ হলো কীভাবে? সে ঘটনাবলির সূত্র মেলে খানিকটা নিউ ইয়র্কার সাময়িকীতে পঙ্কজ মিশ্রের লেখা 'দ্য রিঅরিয়েন্টশন অব এডওয়ার্ড সাঈদ' নিবন্ধে।
এডওয়ার্ড সাঈদকে নিয়ে মার্কিন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা এফবিআইয়ের গোপন নথির পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩৮! এতে এডওয়ার্ড সাঈদের নাম লাতিন ভাষায় লেখা। এদওয়ারদো সাঈদ। সম্ভবত এফবিআই ধরে নেয় যে সন্ত্রাসীদের নাম হতে হবে লাতিন ভাষায়। সাঈদ নামটি ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত করে উচ্চারণ করতেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ত্রিনিদাদে জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ লেখক ভি এস নাইপাল। ফলে নামটির অর্থ দাঁড়াত 'প্রধান'। সাঈদকে তিনি বলতেন, একজন মিসরবাসী, যিনি পৃথিবীর পথে দিগ্ভ্রান্ত হয়েছেন। অথচ আরব-খ্রিষ্টান সাঈদকে অনেকেই মুসলমান বলেই ধরে নিতেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাটিও একবার তাকে মুসলিম বলে উল্লেখ করে পরে ভুল স্বীকার করে। নিজ পরিচয় নিয়ে এমন সংশয় সৃষ্টির বিষয়ে খোদ এডওয়ার্ড সাঈদ ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন।
সাঈদের বিখ্যাত বই 'ওরিয়েন্টালিজম'-এ (১৯৭৮) আত্মপরিচয় অন্বেষণ প্রধান সূত্র হয়ে ওঠে। প্রখ্যাত সাহিত্য তত্ত্ববিদ হওয়ার পাশাপাশি, তিনি একজন ধ্রুপদি পিয়ানোবাদক, সংগীত সমালোচক এবং নিউ ইয়র্কের একজন নেতৃস্থানীয় গণব্যক্তিত্ব। (জার্মানিতে জন্মগ্রহণকারী রাজনৈতিক দার্শনিক এবং কর্তৃত্ববাদবিরোধী লেখার জন্য পরিচিত) হান্না আরেন্ডট এবং (সংস্কৃতি, শিল্প এবং রাজনীতিতে প্রবন্ধের জন্য প্রশংসিত আমেরিকান লেখক এবং সমালোচক) সুসান সন্টাগকে অনুসরণ করেন বলে জানিয়েছিলেন একদা তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, পরবর্তী সময়ে এডওয়ার্ড সাঈদ আমেরিকায় ফিলিস্তিনি অধিকারের শীর্ষ সমর্থক হয়ে ওঠেন।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিম জেরুজালেমে জন্মগ্রহণ গ্রহণ করেন সাঈদ। জন্মক্ষণ থেকেই বিপরীতমুখিতার স্রোতে পড়তে হয় তাকে। ধনাঢ্য এপিস্কোপ্যালিয়ন খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম নেওয়া সত্ত্বেও সাঈদের জন্মগ্রহণের পরপরই ধাত্রী আরবি এবং হিব্রু ধর্মগীতি আওড়ান। তার বাবা থাকতেন আমেরিকায় এবং শ্বেত চামড়াকে মূল্য দিতেন তিনি। তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের নামের সাথে নাম মিলিয়ে তার নাম রাখা হলো এডওয়ার্ড সাঈদ। সাঈদ তার এই নামকরণকে সহজভাবে নেননি। সব সময় তার নিজ নামের প্রতি বিবমিষা ছিল। বিশেষ করে এডওয়ার্ডকে সংক্ষিপ্ত করে এড বানানোকে আদৌ পছন্দ করতেন না। কিশোর বয়সে তাকে পাঠানো হলো মার্কিন এক আবাসিক বিদ্যালয়ে। স্কুলের অভিজ্ঞতাকে তিনি বলেন, 'বিচূর্ণকারী এবং বিভ্রান্তিকর।'
প্রিন্সটন এবং হার্ভার্ডে সাহিত্য নিয়ে অধ্যয়ন করেন। তার অধ্যয়নের কেন্দ্রে ছিল ইউরোপ এবং মার্কিন সাহিত্য ঐতিহ্যধারা। পরে ফরাসি চিন্তাধারার বড় ভক্ত হয়ে ওঠেন। মিশেল ফুকোর অনুরক্ত বনেও যান। দুই দশক শিক্ষাদানসংক্রান্ত পর্ব পার করার পর সাঈদের পোড় খাওয়া কলম থেকে বের হলো 'ওরিয়েন্টালিজম'। তিনি নিজেকে 'প্রাচ্যের মানুষ' বলে আশ্চর্যজনকভাবে তুলে ধরেন। দান্তে থেকে মার্ক্সসহ অনেক পশ্চিমা লেখকের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন। প্রাচ্যকে ভুলভাল উপস্থাপনের অভিযোগ এনে তাদের কঠিন সমালোচনা করেন।
২০ শতকের শেষার্ধে সাঈদের এ বইটি শিক্ষাজগতের অন্যতম প্রভাবশালী পুস্তক হয়ে ওঠে। ঔপনিবেশবিরোধী এবং উত্তর-ঔপনিবেশ উভয় নিয়ে অধ্যয়নকে বাড়িয়ে দেয় ওরিয়েন্টালিজম। কিন্তু পরে তিনি মনে করতে থাকেন, উত্তর আধুনিকতার 'তত্ত্ব' ছাত্রদের ভুল পথে নিয়ে যেতে পারে। জ্যাক দেরিদার মতো পণ্ডিতদের জটিল ভাষার সমালোচনা করে তাদের রচনাকে অসার বলে মন্তব্য করতে পিছপা হন না। জীবনের শেষ দিকে সাঈদ 'সন্ত্রাসের অধ্যাপক'-এর মতো বিতর্কিত অভিধায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি আরব এবং ইসরায়েলের সংগীতকারদের নিয়ে ড্যানিয়েল বারেনবোইমের সাথে অর্কেস্ট্রা পরিবেশন করার লক্ষ্যে উঠেপড়ে লাগেন। এই তৎপরতার মধ্য দিয়ে নিজ পরিবারসহ ইসরায়েলবিরোধী অনেকের জন্যই বিরক্তির ইন্ধন জুগিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী বাম ঘরানার কর্মীদের কাছে প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন সাঈদ; তারপরও রোলেক্স ঘড়ি, বারবেরির স্যুট এবং জেরমিন স্ট্রিটের জুতার ভক্ত ছিলেন জীবনের শেষ অবধি। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে লিউকেমিয়ায় পরলোকগমন করেন তিনি।
লেভানটাইনবাসী (পূর্বাঞ্চলীয় ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল) হওয়ার জটিলতা নিয়ে লিখেছেন সাঈদ। সাঈদ বলেন, লেভানটাইনবাসী মানে দুই বা তিন জগতে একযোগে বসবাস করা কিন্তু সত্যিকারভাবে কোনো জগতেরই অধিবাসী না হওয়া। ইতিহাসবিদ আলবার্ট হাউরানির বরাত দিয়ে তিনি এ রকম অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করেন। নিন্দা এবং হতাশার মতো, যা আবেগকে ধাবিত করেছে। নিজ স্মৃতিকথা 'আউট অব প্লেস'-এ (১৯৯৯) ব্যক্তিগত এমন সব অনুভূতিকে ছুঁয়ে যান। ভবিষ্যৎ জীবনীকারদের সাঈদের বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মানসিক যাত্রাপথ অনুসরণে প্ররোচিত করে।
সাঈদের বন্ধু এবং সাবেক ছাত্র টিমোথি ব্রেনান 'প্লেস অব মাইন্ড' নামে তার জীবনী লিখেন। সাঈদের ব্যক্তিগত জীবনকেন্দ্রিক হওয়ার বদলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর নজর দেন এই লেখক। সাঈদের বিয়ে রোমান্সসহ অন্যান্য বিষয়ও তুলে আনেন। বইতে তিনি আভাস দেন যে বিত্ত এবং আইভি লিগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থকার সুবাদে সাঈদ সহজেই উঁচু সমাজের ফুর্তিবাজ বা প্লেবয়ে পরিণত হতে পারতেন। জেরুজালেমে তিনি বিত্তশালীদের বিদ্যালয় সেন্ট জর্জে পড়ালেখা করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাড়িত হয়ে তার পরিবার কায়রোতে চলে যাওয়ার পর সেখানে ব্রিটিশ পরিচালিত ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলেন সাঈদ। এসব শিক্ষাঙ্গনে তার অর্জনকে গড়পড়তার কাতারবন্দী করা যায়। তবে আচরণে বিদ্রোহের অনুপান জুটেছিল তখন থেকেই। জর্ডানের রাজা হুসাইন এবং অভিনেতা ওমর শরিফের মতো ভবিষ্যতের ব্যক্তিত্বরা ছিলেন তার সহপাঠী।
কায়রো ছিল সে সময়কার আরব বিশ্বের প্রধান নগরী। সদ্য স্বাধীনতা লাভকারী এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করেছে এ নগরী। এদিকে ফিলিস্তিনের মাটিতে উড়ে এসে জুড়ে বসা ইসরায়েল ডেকে আনে লড়াই এবং শরণার্থী ঢলের সংকট। সবার আলোচনায় এসব বিষয়ই বারবার উঠে আসে। সাঈদ বিত্তবানদের পরিমণ্ডলে ছিলেন ঠিক। কিন্তু বিশ্বমুখিতা ছিল তার। আরবির চেয়ে ইংরেজি এবং ফরাসিতে দক্ষ ছিলেন। অপেরা উপভোগ করতেন। ছয় বছর বয়সে পিয়ানো বাজাতে শেখেন। পরবর্তী সময়ে তাকে পিয়ানো শেখাতেন খ্যাতনামা পিয়ানোবাদক ইগসেন টাইগারম্যান। সাঈদের বাবার ব্যবসা ছিল রমরমা। আমেরিকায় থাকার কারণে পশ্চিমের প্রশংসার খই ফুটাতেন। এমনকি সপরিবারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাওয়ার কথা নিয়েও নাড়াচাড়া হচ্ছিল। তার বদলে হঠাৎ ছেলেকে ১৯৫২ সালে নর্থফিল্ড মাউন্ট হারমোন স্কুলে পাঠালেন। বিদ্যালয়টির অবস্থান ছিল ম্যাসাচুসেটসের গ্রামীণ অঞ্চলে।
ব্রেনান তুলে ধরেন, সাইদ মূলত আমেরিকান উন্নাসিক শিক্ষার ফল। এ শিক্ষার প্রভাব-বোধ তাকে আরব ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তিনি চীন বা আলজেরিয়ার দুনিয়া কাঁপানো আন্দোলনের মতো বৈশ্বিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জগতের ভূকম্পনে বিচলিত হন না। বরং বোস্টনের সংগীতানুষ্ঠান তাকে বেশি প্রভাবিত করে। মিসরের বিপ্লবের পর তার বাবার দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সাইদের পরিবার লেবাননে চলে আসে। যা-ই হোক, শীতল যুদ্ধের সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান সাঈদ। সেখানকার রাজনীতি তার মনোজগতে আরও গভীর প্রভাব-ধারা বিস্তার করে। ব্রেনান উল্লেখ করেছেন যে টান টান এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতিতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকেন। সেখানকার রাজনীতি তার মনোজগতের অনেকটাই রাঙিয়ে তোলে। সাঈদসহ সে যুগের বুদ্ধিজীবীরা আমেরিকাকে দেখতেন আশা-ভরসার বাতিঘর হিসেবে। কিন্তু বুদ্ধিজীবী ভূমিকা পেশাদার পর্যায়ে উঠে আসলে, বেতন আরও ভালো এবং মর্যাদামণ্ডিত হয়ে উঠলে সাইদ প্রত্যক্ষ করেন যে অনেক বুদ্ধিজীবী শক্তিধর প্রশাসন কর্তৃপক্ষদের সাথে দহরম-মহরম করছে। তাদের তৎপরতাকে সমর্থন জুগিয়ে চলছে।
প্রাথমিকভাবে অভিবাসীসুলভ নিরাপত্তাহীনতার জেরে সাঈদ নিজেকে মার্কিন প্রথাবদ্ধ জীবনের সাথে প্রত্যাশিতভাবেই মানিয়ে নেওয়ায় তৎপর হয়ে ওঠেন। আর পি ব্ল্যাকমুর এবং লিওনেল ট্রিলিং-এর মতো মার্কিন সাহিত্যিক প্রাথমিকভাবে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। কনরাডকে কেন্দ্র করে পুরস্কারজয়ী উল্লেখযোগ্য গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেন। অস্তিত্ববাদ থেকে কাঠামোবাদ পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষাজগতের জনপ্রিয় দর্শনের ধারাবাহিকতাকে ধারণ করেন তিনি। শাস্ত্রীয় সংগীত এবং হলিউড চলচ্চিত্রকে তার পছন্দের মধ্যেই ফেলা যেত। কিন্তু তিনি ব্লুজ, জ্যাজ বা আরবি সংগীতের বিশেষ ভক্ত ছিলেন না। প্রভাবশালী আফ্রিকান-আমেরিকান লেখকদের কাজ বা নাগরিক-অধিকার আন্দোলনের সাথে তিনি তখনো খুব বেশি যুক্ত বলে মনে হয় না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদকারী ছাত্রদের আন্দোলন তার ক্লাস নেওয়ায় ব্যাহত করলে তিনি ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা বাহিনীকে তলব করতেও দ্বিধায় ভোগেননি।
কনরাডের দ্বৈত-দৃষ্টিভঙ্গি, একটি হলো খুশি করতে আগ্রহী; অন্যটি হলো বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত, নিয়ে মন্তব্য করার পথ ধরেই ভবিষ্যতের সাঈদের দেখা মেলে বলে ব্রিনান উল্লেখ করেন।
আরব এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে পশ্চিমের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি সাঈদকে ঠেলে দেয় হতাশার প্রান্ত সীমায়। (লাটিভিয়ায় জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ সমাজ ও রাজনৈতিক তাত্ত্বিক এবং মতবাদবিষয়ক ঐতিহাসিক) ইসাইয়া বার্লিন এবং (মার্কিন ধর্মতত্ত্ববিদ এবং খ্রিষ্টীয় বাস্তবতা মতামতের জন্য পরিচিত) রেইনহোল্ড নিবুহরের মতো ব্যক্তিত্বরাও আরবদের নিয়ে একপেশে মনোভাব ব্যক্ত করতেন। ১৯৭৩-এ প্রকাশিত রাফেল পাটাইয়ের বই 'দ্য আরব মাইন্ড' প্রশংসায় ভাসলেও বিরক্ত হয়ে ওঠেন সাঈদ। এ বইতে আরবদের প্রকৃতিগতভাবে অস্থিরমতি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে।
কলম্বিয়ার 'মহান বই' পাঠ্যধারার মূল্যায়ন করার সময় একই হতাশা অনুভব করেছেন ইউরোপ এবং মার্কিন আধিপত্যাধীন দেশগুলোর অনেক বুদ্ধিজীবী। জন স্টুয়ার্ট মিল এবং উইনস্টন চার্চিলের মতো অনেক শ্রদ্ধেয় পশ্চিমা ব্যক্তিত্ব অশ্বেতাঙ্গ জনগণকে মানুষ পদবাচ্য বলেই মনে করেননি। পশ্চিমা মানদণ্ডে উৎসাহ বোধ করতেন এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার যেসব বুদ্ধিজীবী, তারাও বিশেষভাবে তিক্ততার স্বাদ অনুভব করেন। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে নিজেদের আকণ্ঠ নিমজ্জিত করার পরে তারা দেখলেন যে তাদের পশ্চিমা সমকক্ষরা এই বুদ্ধিজীবীদের স্বদেশ সম্পর্কে খুব কমই জানেন। এই অজ্ঞতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য বয়ে আনে মারাত্মক পরিণতি। প্রায়ই সহিংসতা ডেকে আনে। ঝরে রক্ত।
১৯৬৭-এর ছয় দিনের যুদ্ধে আরবদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বিজয়ে উথলে ওঠে পশ্চিমা দেশগুলো। মার্কিন সংবাদমাধ্যমের একতরফা সংবাদে সয়লাব হয়ে ওঠে। এ ঘটনায় সাঈদের ভূমিকায় পরিবর্তন আসে। তিনি নিজ শ্বেতাঙ্গ অভিভাবকদের তুষ্ট করার বাসনা থেকে সরে আসেন। আরবদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। মধ্যপ্রাচ্য-সংক্রান্ত পশ্চিমা লেখাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়াও শুরু করেন। সেসব লেখা মূল্যায়ন করতে থাকেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াসির আরাফাতের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পশ্চিমে কী করে বন্ধু বানাতে হবে এবং পশ্চিমা মানুষকে কীভাবে প্রভাব বলয়ে আনতে হবে, সে বিষয়ে উপদেশও দেন। তিনি যে মার্কিন প্রতিনিধি নন- সে সংক্রান্ত আরাফাতের ভ্রান্তি দূর করার যথাসাধ্য চেষ্টাও করেন।
ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণায় নিজে গড়ে ওঠার কথা খোলাখুলিভাবেই স্বীকার করেন 'ওরিয়েন্টালিজম' -এ। প্রাচ্যের মানুষের ওপর উপনিবেশের গভীর প্রভাবও খতিয়ে দেখেন তিনি। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংবাদমাধ্যমগুলো কীভাবে নিজ নিজ দেশের বৈদেশিক নীতিমালাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যায়- বইটিতে তারও সমালোচনা করা হয়। বহুকাল শিক্ষাদান পর্বের মতো তৎপরতার সাথে যুক্ত থাকার ফলে এই বই লেখা সম্ভবপর হয়। কিন্তু এর মূল চিন্তাধারা সহজবোধ্য ছিল এবং তা মোটেও অভূতপূর্ব নয়। নোয়াম চমস্কি এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী পূর্বের ব্যক্তিত্বরা জ্ঞান এবং সাম্রাজ্যবাদ শক্তির মধ্যে যোগসূত্রের বিষয় বিস্তর আলোচনা করেছেন। জামালউদ্দিন আফগানি বা আসাদাবাদির মতো ঐতিহাসিক সমালোচকও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমকে পক্ষপাতদুষ্ট বলতে দ্বিধা করেননি। সাঈদের নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিমোন ওয়েইল এবং ফ্রাঞ্জ বোসের মতো শিক্ষাবিদেরাও ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জাতিগত পক্ষপাতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কথা বলেছেন।
পশ্চিমা শীর্ষ প্রতিষ্ঠান থেকে সাঈদের গভীর শিক্ষালাভের পাশাপাশি ইতিহাস, নৃবিজ্ঞান এবং সাহিত্যের অধ্যয়নের সমন্বয়ে দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিয়েছেন। এতেই 'ওরিয়েন্টালিজম' আর দশ-পাঁচটা বইয়ের সারিতে চলে না গিয়ে এককভাবে আলাদা হয়ে আছে। সাঈদের ওপর ফুকোর গভীর প্রভাব রয়েছে। তবে প্রাচ্যকে কীভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, তার ওপরই মনোযোগকে কেন্দ্রীভূত করেন সাঈদ। নিজ অভিজ্ঞান বা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের উপস্থিতির গভীর কারণগুলো খতিয়ে দেখেননি। একইভাবে সাম্রাজ্যবাদে লিঙ্গ বা শ্রেণির ভূমিকা কিংবা শিল্প বা পুঁজিবাদের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে গভীরভাবে তলিয়ে যাননি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের সাম্প্রতিক শতাব্দীগুলোকে মনোযোগের কেন্দ্র করে তোলেননি। বরং ক্ষুরধার যুক্তিতে তুলে ধরেন যে প্রাচীন গ্রিস থেকে রেনেসাঁ হয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো আধুনিককালের সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত সর্বত্রই প্রাচ্যকে হীন চোখে দেখেছে পশ্চিম।
পশ্চিমের সাথে প্রাচ্যের বা অন্যান্য সংস্কৃতির স্থায়ী বিভাজনকে অনিচ্ছাকৃতভাবেই তুলে ধরেন সাঈদ তার ওরিয়েন্টালিজমে। বইতে হাজার হাজার বছরের পশ্চিমা জ্ঞানের সমালোচনা করা হয়। কিন্তু অ-পশ্চিমা জ্ঞান-অবদানকে উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। এসবের মধ্যে এমন সব তত্ত্বও রয়েছে, যা অ-পশ্চিমা অভিজাত শ্রেণি নিজ ক্ষমতাকে ন্যায্য প্রমাণে প্রয়োগ করে। ইতিহাসের রসিকতা হলো, হিন্দু আধিপত্যবাদের কোনো কোনো প্রবক্তা ভারতীয় সংস্কৃতির পাশ্চাত্য ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে খড়্গ চালানোর সময়ে সাঈদের বইয়ের বক্তব্যকে তুলে ধরেন। বইতে প্রাচীন গ্রিসকে আধুনিক সময়ের সাথে সংযুক্ত করতে 'প্লেটো থেকে ন্যাটো' শব্দগুচ্ছ ব্যবহার হয়েছে।
বার্নার্ড লুইসের মতো বিশেষজ্ঞদের সমালোচনার তলোয়ার ঠেকাতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি সাঈদের। বার্নার্ড লুইস পরবর্তী সময়ে ডিক চেনির আস্থাভাজন ইতিহাসবিদ হয়ে উঠলে সাঈদের বক্তব্যই প্রমাণ হয়ে যায়। প্রাচ্যের ব্যক্তিদের রক্ষায় ব্রতী ছিলেন সাঈদ। কিন্তু তারাও ওরিয়েন্টালিজমের সমালোচনার তলোয়ারবাজিতে যোগ দেন। বইটি প্রকাশের কয়েক বছর বাদে ভারতীয় সমালোচক আইজাজ আহমেদ কঠোর ভাষায় ওরিয়েন্টালিজমের সমালোচনা করেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন, নজরে পড়ার মতো ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও এ বই কেন পণ্ডিত মহলে জনপ্রিয়তা পেল! তিনি বলেন, অর্থনৈতিক বা লৈঙ্গিক-বিষয়ক সমস্যাগুলোর প্রতি সাঈদ বেশি মনোযোগ দেননি। বরং তার মনোযোগে ছিল জাতিগত বিষয়গুলো। উন্নয়নশীল দেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে এসেছেন এমন সব শিক্ষিত ব্যক্তিদের কাছে এই দৃষ্টিভঙ্গি আবেদন সৃষ্টি করে। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন পুরুষ এবং নিজ দেশের অভিজাত শ্রেণির। তাদের কারও কারও পরিবারের কাছে উপনিবেশ যুগ ধরা দিয়েছে সুযোগ হয়ে। আহমেদ মনে করেন সাঈদের বই তাদের নিজেদের নিপীড়িত দাবি করার পথ করে দিয়েছে। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আরও ভালো অবস্থান ও বেতন সুরক্ষায় সহায়তা করেছে। কারও কারও কাছে পশ্চিমের সমালোচনায় মুখর হওয়ায় চাকরি লাভের রাস্তাই খুলে দেয়।
প্রভাববিস্তারকারী এ বইয়ের পর শিক্ষাকেন্দ্রে নিজ মনোযোগকে সরিয়ে নেন। আগে যেমন মনোযোগকে সরিয়ে এনেছিলেন, সেই একই ঘটনাই আবার ঘটল। ব্রেনান বলেন যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন পটভূমি অন্তর্ভুক্ত করতে সচেষ্ট হন। ব্যক্তি পরিচয় তুলে ধরার ক্রমবর্ধমান প্রবণতায় উদ্বেগ ব্যক্ত করেন। উত্তর-ঔপনিবেশিক অধ্যয়নের সূচনা নিয়ে গুরুত্ববহ ভূমিকা পালন করার পরও তিনি এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিশ্বজুড়ে ঔপনিবেশিকবাদের চলমান সমস্যার প্রসঙ্গ টেনে এনে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। শিক্ষাবিদদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিরও সমালোচনা করেন। তিনি স্বতন্ত্রধারার চিন্তাবিদদের প্রশংসা করেন। অ-পশ্চিমা লেখকের রচনার প্রতি মনোযোগ দেন তিনি। আগে যাদের কথা বলেননি, তাদের কথা এবারে তুলে ধরেন। জ্যাকুলিন কেনেডি ওনেসিসের সহায়তায় নাগিব মাহফুজের রচনা ইংরেজিতে প্রকাশ করেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নানা মঞ্চ ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিদের সম্পর্কে মার্কিনদের শিক্ষিত করে তোলার কাজে আত্মোৎসর্গ করেন তিনি।
মার্কিনদের শিক্ষিত করার জন্য লিখলেন 'দ্য কোয়েশ্চেন অব প্যালেস্টাইন' (১৯৭৯)। প্যানথিয়ন এ বই প্রকাশ করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিল। টাইমস বুকস এটি প্রকাশ করার পর নিউ ইয়র্কের ইসরায়েলপন্থী গোষ্ঠী সাঈদের ছায়া থেকেও তফাতে হটে যায়। বৈরুতের এক প্রকাশক আবদার করলেন, সাঈদের এ বই থেকে সিরিয়া ও সৌদি আরবের সমালোচনার অংশটুকু মুছে দিতে হবে। ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের তৎপরতা সাঈদকে প্রভাবিত করেছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের কট্টর বিরোধী ছিলেন বেগিন। ১৯৬৭-এ দখলকৃত ফিলিস্তিন ভূমিকে ইহুদি বসতি স্থাপনের বক্তব্য দেন। ১৯৮২ সালে তিনি লেবাননে আগ্রাসনের অনুমতি দেন। ফিলিস্তিন শরণার্থী এবং যোদ্ধাদের হটিয়ে দেওয়াই ছিল এ আগ্রাসনের লক্ষ্য। এতে অনেক নিরীহ বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারায়।
মার্কিন ডান মহলের তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েন সাঈদ। সে ছিল রিগানের যুগ। তাদের শক্তিশালী করেছিল সে সময়টি। সল বেলোর মতো প্রভাবশালীরাও সাঈদকে নিয়ে নেতিবাচক সবকিছু বিশ্বাস করতেন। তাকে বলা হলো 'সন্ত্রাসের অধ্যাপক'। এমনকি সাঈদ জেরুজালেমে তার শৈশবকাল নিয়ে মিথ্যা বলেছেন বলেও একটি নিবন্ধে দাবি করা হয়। ১৯৯৯-এ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে সাঈদকে নিয়ে লেখা এক নিবন্ধের শিরোনাম ছিল 'দ্য ফলস প্রফেট অব ফিলিস্তিন'। সাঈদের বিরুদ্ধে দেওয়া সাক্ষ্যকে বিল তুলে ধরার জন্য ব্যবহার করে মার্কিন হাউস। এই বিলের লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক-পরবর্তী অধ্যয়নগুলোর বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণের লাগাম টেনে ধরা।
অনেকেই ইসরায়েলকে ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে দেখেন। সাঈদ বলেন, ইহুদিদের বিরুদ্ধে ইউরোপের অন্যায় আচরণের ফলে পরোক্ষভাবে ক্ষতির বোঝা বইছেন ফিলিস্তিনিরা। মার্কিনদের কাছে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেন যে ইহুদিবাদের সমালোচনা করা আর ইহুদিবিরোধী হওয়া সমার্থক নয়। ফিলিস্তিনিদের অধিকার সমর্থন করা মানেই সৌদি রাজ পরিবারসহ অন্যান্য আরব একনায়কের পক্ষ নেওয়া নয়।
১৯৮৮-এ ফিলিস্তিন নেতা ইয়াসির আরাফাতের ইসরায়েলের সাথে আলোচনাকে মেনে নেন। তারও অনেক আগেই এমন আলোচনার কথা বলেন সাঈদ। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম অসলো চুক্তি সই হয়। হোয়াইট হাউসের সাউথ লনে ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইসহাক রবিন যখন হাত মেলান; তখন এ চুক্তিকে ফিলিস্তিনিদের আত্মসমর্পণের দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন সাঈদ। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনি ভার্সেই চুক্তি। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণের নতুন পন্থা বের করেছে ইসরায়েল। এমন কড়া বক্তব্যের ফলে সাঈদের বইকে নিষিদ্ধ করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। এতেও দমে যান না সাঈদ। ইহুদি এবং ফিলিস্তিনিদের সমান অধিকার থাকবে এমন একটি একক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন তিনি।
পরবর্তী জীবনে সাঈদ তার রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে আরও কথা বলেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিশেষজ্ঞকে তুলোধোনা করে ছেড়েছেন। এমনকি এককালে যাদের প্রশংসা করেছেন, সেসব চিন্তাবিদের সাথেও দ্বিমত পোষণ করেন তিনি। বাম ধারার চিন্তাবিদদেরও ছাড় দেননি। তাদের বর্জনীয় ভেবেছেন। ইয়ুর্গেন হ্যাবারমাসের লেখাকে 'গরম হাওয়া' বলে উড়িয়ে দেন। ফুকো এবং সার্ত্রের প্রতি মোহভঙ্গ হয়। এমনকি মার্ক্সবাদী সমালোচক ফ্রেডরিক জেমসনেরও কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি মনে করেন, তারা রাজনীতিতে যথেষ্ট সক্রিয় নয়। এখানেও থামলেন না তিনি। আরও বলেন, সমস্যার বাস্তব রূপ থেকেও অনেক দূরে রয়েছেন তারা। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে আরও একটি আদর্শিক ভাবমূর্তি, জার্মান সমালোচক থিউড অ্যাডোরনোকেও ত্যাগ করেন সাঈদ। রাজনৈতিক মতামত দেওয়ার কাজ দেরিতে শুরু করেন সাঈদ। সে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে শেষ দিকে খুবই সোচ্চার হয়ে ওঠেন। প্রায়ই ফুয়াদ আজমি, ড্যানিয়েল পাইপস এবং কানন মাকিয়ার মতো ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করতেন। অনেক মিডিয়া এসব ব্যক্তিত্বকে মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ বলে মনে করতেন। তার সমালোচনার তীর থেকে রক্ষা পাননি নাইপলের মতো খ্যাতিমান লেখকও। সাঈদ বলেন, এশীয় ও আফ্রিকীয় সমাজকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন তিনি। মুসলমানদের নিয়ে তার লেখা অনেকেই পছন্দ করতেন। নাইপলের লেখায় গভীরতার অভাব খুঁজে পেয়েছেন সাঈদ।
নিজেদের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে ইসরায়েলিরা লিপ্ত রয়েছে 'হাসবারা'য়। হিব্রু থেকে শব্দটিকে সরল বাংলা করলে অর্থ দাঁড়াবে নিরলস প্রচারণা যুদ্ধ। এরই সাথে তাল রেখে ফিলিস্তিনিদের ভাবমূর্তি তুলে ধরার চেষ্টাও করেন সাঈদ। লন্ডনের সম্পাদক মেরি কে উইলিমার্স ফিলিস্তিনি দৃষ্টিভঙ্গিকে বৈধ বলে মনে করতে থাকেন। জোডি ফস্টার এবং এমা থমসনের মতো খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরাও ফিলিস্তিনিদের সমর্থনে বক্তব্য দিতে থাকেন। প্যাট্রিসিয়া হাইস্মিথ চিঠি দিয়েছিলেন। তবে তার উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় আছে। সাঈদকে আই এ পথ স্টোন লেখেন, তিনি ইহুদি এবং অ-ইহুদিদের ভূমিকা তুলে ধরতে পেরেছেন।
সাঈদ নিজেকে 'শেষ ইহুদি বুদ্ধিজীবী' বলে অভিহিত করতেন। ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে ম্যালকম এক্স এবং জেমস বল্ডউইনের সাথে সম্পর্কিত বলেই ভাবতেন।
পরবর্তী সময়ে আরব নেতাদের প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মদদ প্রদান এবং ফিলিস্তিন ভূমি নিয়ে ইসরায়েলের নীলনকশার মতো সাম্প্রতিক অপকাণ্ডগুলোতে হতবাক হতেন না সাঈদ।
সাঈদ জানতেন যে বিশাল কোনো প্রভাববলয় তিনি তৈরি করতে পারেননি। ৯/১১-এর ঘটনার পর মুসলমান-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে তৎপরতা চালানোর জন্য উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান সাঈদের কট্টর সমালোচক বার্নাড লুইস। আরবদের নিয়ে একপেশে গতানুগতিক বইকেই ইরাকে মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা ব্যবহার করেছেন। সাঈদ জানতেন তিনি সুবিশাল এক সমস্যার মোকাবেলা করছেন। এ সমস্যা উতরে যাবেন তেমন আশাবাদও ব্যক্ত করেননি তিনি।
১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে লিউকেমিয়ায় প্রায় ধরাশায়ী হয়ে পড়লেও জালিমের বিরুদ্ধে নিজ অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে বজায় রাখেন। তার চরিত্রের দৃঢ়তার পরিচয়ে পাওয়া যায় এক শুভাকাঙ্খীকে লেখা চিঠিতে। তিনি লেখেন, নিষ্ঠুরতা এবং অবিচার সেখানে উদ্বেগজনক, সেখানে হতাশার মানে আত্মসমর্পণ। আমি বিশ্বাস করি, তা হলো অনৈতিক।