মন্দায় লিপস্টিক বিক্রি বেড়ে যায়, লিপস্টিকের বাজার বড় হতে থাকে!
জর্জ ওয়াশিংটন ঠোঁটে লিপস্টিক দিতেন আর রানি ভিক্টোরিয়া মনে করতেন ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়া ঔদ্ধত্যপূর্ণ কাজ।
বাংলাদেশে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্প্রতি বলেছেন, তার এলাকার নারীরা দিনে তিনবার ঠোঁটে লিপস্টিক লাগান। তিনি সরকারেরও মুখপাত্র। তার এলাকার নারীরা যে সুখে আছেন (অন্যান্য এলাকায় নারীরা দিনে কবার ব্যবহার করে থাকেন এ নিয়ে কোনো সমীক্ষার ফলাফল জানা নেই), এটা তারই সূচক। সুখের প্রতিচ্ছবি!
সুখ নিশ্চয়ই সমৃদ্ধির সাথেও কিছুটা জড়িয়ে আছে। অভুক্ত মানুষের সুখে থাকার প্রশ্নই আসে না—তার বেলায় লিপস্টিক তো অবান্তর প্রসঙ্গ। বরং সুখী মানুষের লিপস্টিক ব্যবহার নিয়েই তাত্ত্বিক আলোচনা চলতে পারে।
সানন্দে এখন তিনবার ব্যবহার করেন মানে আগের চেয়ে বেশি ব্যবহার করেন, আগে হয়তো দু'বার কিংবা একবার ছিল কিংবা আদৗ ব্যবহার করার সামর্থ ছিল না কিংবা ব্যবহার করার কথা ভাবেনি। যে কথাটি বলা হয়েছে তার অন্তর্গত কথা হচ্ছে সে এলাকার নারীরা আগের চেয়ে বেশি লিপস্টিক কিনছেন।
এই বেশি কেনাকাটাকে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক তত্ত্ব ইত্যাদির সাথে মিলিয়ে দেখতে গেলে একটি কৌতুহলোদ্দীপক অর্থনৈতিক তত্ত্বের উদ্ভব ঘটানো সম্ভব হবে। লিপস্টিক মার্কেটের গতিময়তার একটি তত্ত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
আরোপিত কোনো কারণেও লিপস্টিক বাজারের পতন বা উত্থান ঘটতে পারে। ১৭৭০ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ঠোঁটে লিপস্টিক লাগানো নিষিদ্ধ করে দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টরিয়ান তখন মনে করতেন লিপস্টিক ব্যবহারকারী পার্লামেন্টরিয়ান তখন মনে করতেন লিপস্টিক ব্যবহারকারী নারী ছলনাময়ী পুরুষকে ফাঁদে ফেলার জন্য ঠোঁট রাঙ্গাচ্ছে। এর সাথে প্রেতচর্চার একটা যোগাযোগ থাকতে পারে।
বৈশ্বিক কসমেটিক বাজারের আকার সমরাস্ত্র বাজারের মতো অতিকায় না হলেও উপেক্ষা করার মতো নয়। ২০২২ সালে এ বাজারের আকার ছিল ৩৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। চক্রবৃদ্ধিতে ২০৩২ সালে এর আকার দাঁড়াবে ৬৬১.১২ বিলিয়ন ডলারে প্রবৃদ্ধি বার্ষিক ৫.৮ ভাগ। এরই একটি ছোট অংশ লিপস্টিক। ২০২১ সালে লিপস্টিকের বিশ্ববাজার ছিল ৯.৫৭ বিলিয়ন ডলারের ২০২২ এ তা বেড়ে হয়েছে ১০.০৮ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩-এ তা দাঁড়াবে ১৪.৬৮ বিলিয়ন ডলারে। প্রবৃদ্ধি বিউটি ইন্ডাস্ট্রির অন্যান্য আইটেমের চেয়ে একটু কম, ৫.৫ শতাংশ লিপস্টিক মার্কেটের টার্গেট মূলত: ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারী। আমাদের প্রতিবেশী ভারতে বিউটি ইন্ডাস্ট্রির আকার ২০২৩ সালে ৩০.৫৪ বিলিয়ন ডলার, এর মধ্যে লিপস্টিকের শেয়ার ১.৩৮ বিলিয়ন ডলার।
একটি গাণিতিক হিসেব উপস্থাপন করা যেতে পারে: বিউটি ইন্ডাস্ট্রির কতো ভাগ লিপস্টিক ইন্ডাস্ট্রি? উপরে পরিসংখ্যান থেকে উঠে আসে বিশ্বের মোট বিউটি ইন্ডাস্ট্রির ০.২৬ ভাগ হচ্ছে লিপস্টিকের বাজার আর ভারতে তা .০৪৫ ভাগ। বিশ্বগড়ের দ্বিগুণের চেয়ে কিছু কম। অর্থাৎ ভারতে অর্ধমূল্যে লিপস্টিক বিক্রি অনেক বেশি। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের একই হিসেব নিয়ে দেখেছি য্ক্তুরাষ্ট্রে লিপস্টিকের শেয়ার ভারতের চেয়ে কম এবং ব্রিটেনে তা প্রায় ভারতের এক তৃতীয়াংশ। এই পরিসংখ্যান প্রচলিত লিপস্টিক ইনডেক্স তত্ত্বের সমর্থন করে। অর্থনীতি অপেক্ষাকৃত খারাপ অবস্থায় থাকলে লিপস্টিক বিক্রি বেড়ে যায়, লিপস্টিকের বাজারের তুলনামূলক আকার বড় হতে থাকে।
অর্থনীতির লিপস্টিক এফেক্ট: যখন অর্থনীতিতে ধস নাম থাকে, ভোক্তার হাতে ব্যয় করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না। তখন দামি প্রসাধন সামগ্রী না কিনে কেবল লিপস্টিক কিনে বাড়ি ফেরে। এ ভাবে ভোক্তার লিপস্টিক কেনা বেড়া যায়। লিপস্টিক এফেক্ট বুঝিয়ে দেয় ভোক্তার হাতে তেমন টাকা নেই, আরো বলে দেয় দেশে মুদ্রাস্ফিতি ঘটেছে। লিপস্টিক এফেক্টের কারণে ইংরেজি R অক্ষরের শব্দ ব্যবহার বেড়ে যায়। সেই শব্দটি হচ্ছে Recession.
লিপস্টিক ইনডেস্ক বা লিপস্টিক সূচক কথাটি নতুন সহস্রাব্দের সংযোজন। বিখ্যাত প্রসাধন সামগ্রী কোম্পানি এস্টি লাউডার-এর চেয়ারম্যান লেলার্ড লাউডার ২০০১ সালে শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন এবং অর্থনীতিবিদরা তা লুফে নেন। তিনি লক্ষ করেন ২০০১ সালের শরতে যখন এক ধরনের আর্থিক অনিশ্চয়তা বিরাজ করছিল সে সময় কমদামি বিউটি প্রোডাক্ট বিশেষ করে লিপস্টিক বিক্রি বেড়ে যায়। ক্রেতার আচরণ বাজারকে তেমন নিয়ন্ত্রণ করে বাজারে বিকল্প পণ্যও ক্রেতার আচরনকে প্রভাবিত করতে পারে।
লিপস্টিক মার্কেটের গতিময়তা আমাদের সঠিকভাবে বুঝতে হবে নতুবা লিপস্টিক বিক্রি বাড়াকে যদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষণ মনে করি, ভুল হবে। তবে সকল ক্ষেত্রেই যে লিপস্টিক অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থা জানান দেবে এটাও মনে না করাই।
তবে সাধারণভাবে যখন লিপস্টিক বন্দনা শুরু হবে ধরে নিতে হবে লিপস্টিক সূচক এসে গেছে অথবা এসে গেছে বলে বন্দনাকারীর কাছে অনুভূত হয়েছে।
তাই বলে আমরা লিপস্টিক ডে পালন করব না এমন কথা নেই। যুক্তরাষ্ট্র ২৯ জুলাই জাতীয় লিপস্টিক দিবস পালন করে যাবে। আমরাও তার সাথে যোগ দিতে পারি অথবা নিজেদের সুবিধে মতো একটা দিন ঠিক করে নিতে পারি। ন্যাশনাল লিপস্টিক ডেতে নিজের জন্য প্রিয়জনের জন্য একটা লিপস্টিক কিনুন। পিঙ্ক পিজিয়ন ব্র্যান্ড যেমন আছে, তেমনি আছে ইউনিকর্ন টিয়ার্স। আরও শত শত দেশি বিদেশি ব্র্যান্ড। বাংলাদেশে এস্টি লাউডারের জেনুইন ব্র্যান্ড তেমন পাওয়া যায় তেমনি মিলে জিঞ্জিরা ব্র্যান্ড, হালাল সাবানের কথা আমরা শুনেছি, কেমন হালাল শব্দ যোগ হওয়াতে মুসলমান ক্রেতার মহানুভূতি ও সমর্থন পেয়ে বাজার মাত করে দিয়েছিল। বাজারে হালাল লিপস্টিকও এসেছে। লাফজ হচ্ছে প্রসাধনীর হালাল ব্র্যান্ড। এতে মূকর তো নয়ই অন্য কোনো প্রাণীর চর্বি ব্যবহার করা হয়না বলে দাবি করা হয়ে থাকে।
কানাডিয়ান একটি সমীক্ষায় (১৯৯৮-সালে) একজন নারী তার জীবদ্দশায় ৪ থেকে ৯ পাউন্ড ওজনের লিপস্টিকের প্রলেপ ঠোঁটের উপর লাগিয়ে থাকেন।
লন্ডন এক্সপ্রেস ২০০১ সালে দাবি করেছে ব্রিটেনে একজন নারী জীবদ্দশায় গড়ে ৫.৬৫ পাউন্ড লিপস্টিক চেটে থাকেন এবং গিলেন। ডেনভারের রকি মাউন্টেন নিউজ মনে করে একজন নারীর জ্ঞাতে অজ্ঞাতে গিলে ফেলা লিপস্টিক প্রায় ৪ পাউন্ড।
লিপস্টিক দেখেই উদ্বেলিত হওয়া সমীচীন হবে না। যারা কেজিবির কর্মকান্ডের সাথে পরিচিত তারা জানেন, কেজিবি ৪.৫ মিলিমিটার সিঙ্গেল শট লিপস্টিক পিস্তল ব্যবহার করত।
উইলিয়াম জর্জ হিরেলস (১৯২৮-২০১২) নামের সিরিয়াল কিলার লিপস্টিক কিলার নামে পরিচিত। তিনি তিনটি খুনের কথা স্বীকার করেছেন। ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৫ ফ্রান্সিস ব্রাউনকে তার অ্যাপার্টমেন্টে খুন করার পর তার লিপস্টিক দিয়ে দেয়ালে লিখে রেখেছে: ঈশ্বরের দোহাই আর একটি খুন করার আগে আমাকে ধরে ফেলুন, আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।
পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। তারপর সুজান ভেগনানকে খুন করে। তারপর ধরা পড়েন। তার আমৃত্যু কারাদন্ড হয়। ৬৫ বছর জেলখাটার পর ৬ মার্চ ২০১২ ইলিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারে মারা যান। লিপস্টিক কিলারকে নিয়ে চার্লস আইস্টাইনের একটি উপন্যাস রয়েছে, তা চলচ্চিত্রায়িত হয়। লিপস্টিক অনুভব: নোবেল বিজয়ী টনি মরিসন লিখেছেন, স্বপ্ন হচ্ছে লিপস্টিক মাখানো দুঃস্বপ্ন।
জোয়ান কলিন্সের কথা : পৃথিবীতে যতো প্রসাধনী দ্রব্য আছে আমার কাছে লিপস্টিকই সর্বোত্তম।