নির্বাচনে মার্কা কী?
আমার স্মৃতিতে বেশ জ্বলজ্বলে দুটি মার্কার একটি হচ্ছে হারিকেন অপরটি গোলাপ ফুল। আমি ক্লাস থ্রিতে উঠেছি, তবে ক্লাস শুরু হয়নি। নির্বাচনের তারিখ ২ জানুয়ারি ১৯৬৫। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। শক্তিশালী প্রার্থী দুজন। একজন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, তার মার্কা গোলাপ ফুল, তার দলের নাম কনভেনশন মুসলিম লীগ। অপরজন ফাতিমা জিন্নাহ, তার প্রতীক হারিকেন এবং তার পেছনে বিরোধী দলগুলো এককাট্টা হয়ে গঠন করেছে কপ—কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি বা সম্মিলিত বিরোধী দল। সেবারই প্রথম আমার বাবা ও মাকে কোনো বিষয়ে সরাসরি একমত হতে দেখলাম। হারিকেনকে বিজয়ী হতে হবে। আমার ঘনিষ্ট একজন আত্মীয় গোলাপ ফুলের এতটাই ভক্ত যে আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন করেন অবস্থা। তারপরও কোটপিন ধরনের একটি গোলাপ আমি তার কাছ থেকে উপহার পেয়ে আমার শার্টের এক পকেটে লাগিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরঘুর করলাম। ব্যাপারটা আমার বাবা পছন্দ করলেন না, তিনি নিশ্চয়ই কাউকে অনেক বলেকয়ে হারিকেন মার্কা কোটপিন জোগাড় করে আমাকে দিলেন এবং গোলাপাটা খুলে এটা লাগাতে বললেন। আমি তা না করে অন্য পকেটে হারিকেন লাগিয়ে বেশ বাহাদুরি করে লোকজনকে আমার শার্টের দুই পকেটের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করলাম।
আমার মার্কা দুটোই। নির্বাচনে গোলাপ মার্কা বেশি ভোট পায়। আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আমার বাবা বললেন, এটা কোনো ইলেকশনই হয়নি। আইয়ুব খান টাকা দিয়ে বিডি চেয়ারম্যানদের কিনে নিয়েছে।
৮০০০০ বিডি চেয়ারম্যানের ৪৯৯৫১ জন ভোট দিয়েছেন গোলাপে আর ২৮৬৯১ জন হারিকেনে। বিডি মানে পরে জেনেছি—বেসিক ডেমোক্রেসি।
আমি দুই পকেটে দুই মার্কা লাগিয়ে রেখেছিলাম; কে প্রেসিডেন্ট হলেন আর কে হারলেন—তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা ছিল না। দুটি মার্কা পেয়ে আমি এমনিতেই যথেষ্ট সন্তুষ্ট ছিলাম।
বাংলাদেশে কত ধরনের মার্কা?
কয়েকটি নির্বাচনের মার্কা তুলে ধরা হলো।
মেয়র নির্বাচন: রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর জন্য মোট মার্কা ৪০টি। ছাতা, বাইসাইকেল, চাকা, গামছা, কাস্তে, নৌকা, ধানের শীষ, কবুতর, কুঁড়েঘর, হাতুড়ি, কুলা, লাঙ্গল, মশাল, তারা, গোলাপ ফুল, মই, গরুর গাড়ি, ফুলের মালা, বটগাছ, হারিকেন, মিনার, রিকশা, হাতপাখা, মোমবাতি, হুক্কা, কোদাল, দেয়ালঘড়ি, কুড়াল, পাঞ্জা, ছড়ি ও টেলিভিশন। স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য রাখা হয়েছে ১১টি—ক্রিকেট ব্যাট, ঘোড়া, চরকা, টেবিলঘড়ি, টেলিস্কোপ, ডিশ এন্টেনা, দেশলাই, ফ্লাস্ক, বাস, ময়ূর, হরিণ, ঈগল, হাতি।
২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থীদের পছন্দের জন্য রাখা হয়েছিল ৬৪টি প্রতীক: আপেল, আম, উদীয়মান সূর্য, একতারা, কবুতর, কলার ছড়ি, কাঁঠাল, কাস্তে, কুমির, কুলা, কুড়াল, কুঁড়েঘর, কোদাল, খাট, খেজুরগাছ, গরুর গাড়ি, গাড়ি, গামছা, গোলাপ ফুল, ঘণ্টা, চাকা, চাবি, চেয়ার, ছড়ি, ছাতা, ট্রাক, টেলিভিশন, ডাব, তবলা, তারা, তরমুজ, দাবাবোর্ড, দালান, দেয়ালঘড়ি, ধানের শীষ, নোঙ্গর, নৌকা, লাঙ্গল, ফুলকপি, ফুলের মালা, বাঘ, বটগাছ, বাইসাইকেল, বাঁশি, বেঞ্চ, বেলুন, মই, মটরগাড়ি, মশাল, মাছ, মাথাল, মিনার, মোমবাতি, রকেট, রিকশা, লাঙ্গল, শঙ্খ, সিংহ, স্যুটকেস, হাত (পাঞ্জা), হাতঘড়ি, হাতপাখা, হাতুড়ি, হারিকেন, হুক্কা।
এত প্রতীকের মধ্যে নৌকা, ধানের শীষ ও লাঙ্গলই তার প্রার্থীদের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন করতে পেরেছে। লেজুড় প্রকৃতির কিছু রাজনৈতিক দল নিজেদের নীতি-আদর্শ (আদৌ যদি থেকে থাকে) বিসর্জন দিয়ে এই তিনটি দলে যোগ দিয়ে, আঁতাত করে তাদের মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছে। কোনো কোনোটি আবার গৃহপালিত বিরোধী দল হয়ে হুঙ্কারের বদলে মিউ মিউ করেছে।
বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে মার্কা গুরুত্বপূর্ণ মহাকারচুপি না হলে মানুষ মার্কা দেখে ভোট দেয় বলেই নিজ দলের প্রতীক ছেড়ে আঁতাতে আসা প্রার্থীরা বড় দলের মার্কার জন্য লালায়িত হয়ে পড়েন। এসব দলের কোনো কোনোটার বয়স অর্ধশতাব্দী ছাড়িয়ে। তারপর তাদের মার্কা ভিক্ষাবৃত্তি বহাল আছে।
নৌকা মার্কার দুই নির্বাচন ১৯৫৪ ও ১৯৭১
১৯৫৪ সালে নৌকা বনাম হারিকেন। এ বছর পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গঠিত একটি চারদলীয় মোর্চা যুক্তফ্রন্ট নাম নিয়ে অভাবনীয় ফলাফল লাভ করে পাকিস্তানের শাসকদের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল। এই মোর্চার প্রতীক ছিল নৌকা। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরস্পরের সাথে হাত মেলানো চারটি দল হচ্ছে আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, গণতন্ত্রী দল ও নেজামে ইসলাম। ৮ থেকে ১২ মার্চ ১৯৫৪—এই সময়ের মধ্যে ৩০৯ আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মুসলিম লীগ পেয়েছিল কেবলমাত্র ৯টি আসন আর যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি। চার দলের সকলেই নৌকা মার্কা নিয়ে মাঠে নেমেছিল। বিজয়ের রূপকার শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তাদের নির্বাচন মেনিফেস্টোর ২১ দফা ১৯তম দফাটির প্রকারান্তরে স্বাধীনতার দফায় পরিণত হয়েছে। এতে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি ছিল। নৌকার বিপরীতে হারিকেন মার্কার এক মহাকাব্যিক বিপর্যয় ঘটে।
নৌকা মার্কা
আওয়ামী লীগ: ১৪৩টি আসন
কৃষক শ্রমিক পার্টি: ৪৮টি আসন
নেজামে ইসলাম: ১৯ আসন
গণতন্ত্রী দল: ১৩ আসন
হারিকেন মার্কা
মুসলিম লীগ: ৯ আসন
পরে স্বতন্ত্র পার্থী হিসেবে বিজয়ী ফজলুল কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে সংখ্যাটাকে টেনে দশে ওঠান।
১৫ মে ১৯৫৪ কৃষক শ্রমিক পার্টির এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট কেবিনেট গঠিত হয়। কেবিনেটের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন আতাউর রহমান খান, আবু হোসনে সরকার, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আজিজুল হক, আবদুস সালাম খান, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল লতিফ বিশ^াস, হামিদ উদ্দিন, ইউসুফ আলী চৌধুরী, রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, আশরাফউদ্দিন চৌধুরী। মাত্র ১৫ দিন পর ৩০ মে ১৯৫৪ কেন্দ্রীয় সরকার মন্ত্রী পরিষদ ভেঙে দিয়ে গভর্নরের শাসন জারি করে।
১৯৬৯-এ সামরিক শাসন জারির পর জনসংখ্যাভিত্তিক আসন নির্ধারণ করে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) আওতায় পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৫ অক্টোবর ১৯৭০ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হলেও বন্যার কারণে নতুন তারিখ নির্ধারিত হয় ৭ ডিসেম্বর। জাতীয় পরিষদের মোট ৩০০ আসনের ১৬২ আসন পূর্ব পাকিস্তানে এবং ১৩৮ আসন পাকিস্তানে। ৬ দফা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট দেবার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সকল আসনে প্রার্থী দেয়। ২টি আসন বাদে ১৬০টিতেই নৌকার প্রার্থীর অভাবনীয় বিজয় হয়। ১টি আসন জেতেন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি ময়মনসিংহের নান্দাইল থেকে নূরুল আমিন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজা ত্রিদিব রায় জেতেন একটি। নৌকার সাথে পাল্লা দিয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টি তরবারি মার্কায় কেবল অর্ধেকের চেয়ে কিঞ্চিত বেশি আসন পায়। নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলের সংখ্যা ২৪টি, কেবল ১০টি দল আসন পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ: ১৬০
পাকিস্তান পিপলস পার্টি: ৮৩
জামায়াতে ইসলাম: ৪
কাউন্সিল মুসলিম লীগ: ৭
পাকিস্তান মুসলিম লীগ: ৯
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম: ৭
জমিয়ত উলামায়ে পাকিস্তান: ৭
কনভেনশন মুসলিম লীগ: ২
ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ: ৬
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি: ১
স্বতন্ত্র: ১৪টি
মোট: ৩০০
সংরক্ষিত নারী আসনের ৭টি আওয়ামী লীগের ও ৫টি পাকিস্তানের পিপলস পার্টির। নৌকা মার্কার এই বিস্ময়কর বিজয় পাকিস্তানের গোয়েন্দারা ভাবতে পারেনি। স্বাভাবিক অবস্থায় একাত্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হবার কথা। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি তা প্রত্যাখ্যান করে এবং রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে।
সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের ২৮৮ পায় নৌকা মার্কা। ৭টি পায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, ৪টি রাজনৈতিক দল পায় ৫টি আসন। সত্তরের নির্বাচনের রায়ই প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতার ম্যান্ডেট।
ব্রাজিলে মার্কা কী?
হাতি-ঘোড়া, গরু-ছাগল, চেয়ার-টেবিল, ফুল-ফল এসবের ধারেকাছেও নেই ব্রাজিল। সেখানে মার্কা ১, ২, ৩ ইত্যাদি; আর যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৯-এর বেশি হয়ে যায়, তাহলে মার্কা হবে ১১, ১২, ১৩ ইত্যাদি। আপনি যদি ব্রাজিলের একজন নাগরিক হয়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোন নম্বরে ভোট দেবেন। যদি আপনি পর্তুগিজ পার্তিদো ডেমোক্রেটিক সোশ্যালকে (পিডিএস) ভোট দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে আপনি ১ মার্কায় ভোট দিন। যদি আপনি পর্তুগিজ পার্তিদো ডেমোক্রেটিকো ত্রাবাল হিস্তা (পিডিটি) দলের সমর্থক হয়ে থাকেন, তাহলে ২ মার্কায় ভোট দিন। যদি পর্তুগিজ পার্তিদো ত্রাবালহিস্তা ব্রাসিলেইরো (পিটিবি) দলকে পছন্দ করে থাকেন, তাহলে ৪ মার্কায় ভোট দিন। ত্রাবালহিস্তা হচ্ছে শ্রমিক। বর্তমানে সক্রিয় দলগুলো হচ্ছে পার্তিদো লিবারেল (পিএল), পার্তিদো দেসে ত্রাবালহার্দোরেস (পিটি), ওনাইয়ো, ব্রাজিল, প্রগ্রেসিস্তা, (পিপি) মুভিমেন্ডো ডেমোক্রেটিকো ব্রাসিলেইরো (এমডিবি), পার্তিদো সোশাল ডেমোক্রেটিকো (পিএসডি), আভান্তে, পার্তিদো ভার্দেসহ ২১টি রাজনৈতিক দল। এই দলগুলোর ৫১৩ আসনের সংসদে ১ থেকে ৯৬টি পর্যন্ত আসন রয়েছে। এ ছাড়া অনেকগুলো প্রাদেশিক পার্টি রয়েছে। সকল ক্ষেত্রে নাগরিককে ভোট দিতে হচ্ছে একটি সংখ্যার অনুকূলে।
মিসরে মার্কা কী?
২০২৪ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ জাতীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষ ন্যাশনাল ইলেকশন অথরিটি ১৫টি মার্কার ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে তারকা, সূর্য, সিংহ, ঘোড়া, ঈগল, মোরগ, পাল্লা, উড়োজাহাজ, ঘড়ি, তালগাছ, নৌকা, ছাতা, টেলিফোন, চশমা ও মই। ভোট অনুষ্ঠানের তারিখ ছিল ১০-১২ ডিসেম্বর ২০২৩। যদি দ্বিতীয় রাউন্ড প্রয়োজন হতো, তাহলে ৮-১০ জানুয়ারি ২০২৪ আবারও ভোট। কিন্তু তা লাগেনি। তারা মার্কা নিয়ে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতা এল সিসি স্পষ্ট ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন। তিনিই প্রেসিডেন্ট থেকে যাচ্ছেন। তিনি প্রদত্ত ভোটের ৮৯.৬ শতাংশ পেয়েছেন। মন্তব্য এসেছে এত বেশি ভোটের কী দরকার ছিল?
ভারতের দলগুলোর মার্কা কী?
ভারত বিশাল দেশ। জাতীয়ভিত্তিক দলের সংখ্যা কম। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—
ভারতীয় জনতা পার্টি: পদ্ম
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস: করতল
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট): হাতুড়ি, কাস্তে ও তারকা
ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি: ঘড়ি
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া: শস্যের শিষ ও কাস্তে
বহুজন সমাজ পার্টি: হাতি
সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস: ফুল ও ঘাস
মার্কা যখন ক্রিকেট ব্যাট
অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করার জন্য নির্বাচনে প্রতীক বা মার্কা ব্যালটে ছাপার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গাধা মার্কা এবং হাতি মার্কা প্রায় ২০০ বছর ধরে প্রধান দুই দলের মার্কা হিসেবে প্রচলিত আছে। ডেমোক্রেটিক পার্টির গাধা আর রিপাবলিকানদের হাতি। পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-ইনসাফ; তাদের মার্কা হিসেবে তারা ক্রিকেট ব্যাট বেছে নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতীক তালিকায় শুরুতে ক্রিকেট ব্যাট না থাকলেও জনপ্রিয় দলের দাবি মেনে নিয়ে ব্যাট মার্কা নির্বাচনে অন্তর্ভুক্ত করে এবং ব্যাট মার্কাধারীরা ক্ষমতার স্বাদও পায়। বিশ^কাপজয়ী পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন ইমরান খানের ব্যক্তি ইমেজকে আরও সম্প্রসারিত করেছে ক্রিকেট ব্যাট।
ডেনমার্ক ও আইসল্যান্ডে ব্যালটের মার্কা হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি হরফ বেছে নিতে দেওয়া হয়। হরফটি পার্টির নামের আদ্যক্ষরও হতে পারে, অন্য কোনো অক্ষরও হতে পারে। ডেনমার্ক লিবারেল পার্টি ভেনস্ট্রে এখন ক্ষমতায়। তারা ভি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে সর্বোচ্চ আসন পেয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেছে। ইসরায়েলে নির্বাচনে এক বা একাধিক হরফ বা অঙ্ক মার্কা হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পাকিস্তানে মার্কা
২০০৮ সালের সংসদীয় নির্বাচনে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন অনুমোদিত মার্কার মধ্যে ছিল রিভলবার, পিস্তল ও ছুরি। বিলেতি বিগবেন ঘড়িও তাতে ঠাঁই পেয়েছে। ভারতের নির্বাচন কমিশন দিয়েছে আস্ত ইট ও করাত। দিয়েছে বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা এবং বেহালা, সাথে হুইসেলও আছে। আরও আছে স্কিপিংয়ের দড়ি, ডিজেলপাম্প, লেডিস ব্যাগ, ড্রিলিং মেশিন ডাম্বেল। দেশশক্তি পার্টি নিয়েছে সিরিঞ্জ, জাতিকে তারা বুস্টার ডোজ দেবে। আপনি জিন্দেগি আপনি দল নামের একটি পার্টি চেয়েছে ফুলকপি। ফুলকপি পাকিস্তানের তালিকাতেও আছে। পাকিস্তানে আরও আছে টুথব্রাশ, মাকড়শা, স্ক্রু, ফটোস্ট্যাট মেশিন, নেইল কাটার, গ্রামোফোন ফ্ল্যামিঙ্গো, স্টেথোস্কোপ, পেঁয়াজ, মোবাইল চার্জার, কুমির, অডিও ক্যাসেট, এয়ার কন্ডিশনার, ল্যাপটপ, ঝাড়ু, এনার্জি সেভার ইত্যাদি। পাকিস্তানে ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক আছে, ভারতে তামিলনাড়ু রাজ্যসভার নির্বাচনে আছে ব্যাটসম্যান, মিসরে অনুমোদিত মার্কার মধ্যে ছিল ব্যালিস্টিক মিসাইল।
বিড়ালের ভয়ে বাঘের কাঁপুনি
পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ শরিফ) সে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল, তাদের মার্কা বাঘ। বাঘ নিয়ে এ দলের সন্তোষ দীর্ঘমেয়াদি হতে পারেনি বিড়ালের ভয়ে। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনে সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র পদপ্রার্থীদের জন্য যেসব প্রতীক বরাদ্দ করেছে, তার একটি হচ্ছে বিড়াল। ২০১২ সালের দলের সাধারণ সম্পাদক জাফর ইকবাল আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছেন, যেন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বিড়াল বরাদ্দ করা না হয়। কারণ, তাদের সমর্থনকারী ভোটারদের অনেকেই ব্যালট পেপারে বাঘের বদলে বিড়ালের ঘরে সিল মারছেন। উদাহরণ হিসেবে বেহারি সংসদীয় আসনে বিড়াল মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকায় তাদের কয়েক হাজার সমর্থক হতবুদ্ধি অবস্থায় বিড়ালকে ভোট দিয়েছে। তাতে বিড়াল মার্কাধারী প্রার্থী জিততে না পারলেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান পিপলস পার্টির নাতাশা দৌলতানা জিতে গেছে। পিএমএলের (এন) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেখানে দেশের ৪৫ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর, সেখানে কাছাকাছি চেহারার প্রতীক সংকট সৃষ্টি করবেই। কাজেই যেখানে বাঘ মার্কার প্রার্থী রয়েছে, সেখানে বিড়াল মার্কা না দেওয়ার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কমিশন যে সিদ্ধান্তই দিক না কেন, কাগুজে বিড়াল যে কাগুজে বাঘকে বিচলিত করতে পেরেছে, এটাই সংবাদে পরিণত হয়েছে।
ছক্কা ছয়ফুরের মার্কা কী?
ভি এস নাইপলের মিগেল স্ট্রিট উপন্যাসের একটি চরিত্র স্থানীয় সরকার থেকে শুরু করে জাতীয় পরিষদ—সব নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করতেন। তিনি বিপত্নীক ছিলেন। কাজেই স্ত্রীর নিশ্চিত ভোটটি পাবেন, সে সম্ভাবনাও ছিল না। কিন্তু প্রতিটি নির্বাচনে তিনি সর্বমোট তিনটি করে ভোট পেতেন। উপন্যাসে তার মার্কা কী ছিল—উল্লেখ করা হয়নি। একটি ভোট যদি প্রার্থী নিজেও দিয়ে থাকেন, অপর দুটি ভোট কে দিয়েছেন—এ নিয়ে প্রার্থী এবং ঔপন্যাসিক উভয়ের আগ্রহের কমতি ছিল না।
বাংলাদেশের সিলেট জেলার ছক্কা ছয়ফুর উপজেলা নির্বাচন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন—সব কটাতেই প্রার্থী হয়েছেন। তার ইসলামিক সমাজতান্ত্রিক দলের তিনিই প্রতিষ্ঠাতা, তিনিই সভাপতি, তিনিই সম্পাদক, তিনিই কর্মী। দলে দ্বিতীয় কেউ নেই, তিনি রাখেননি। কারণ, একাধিক সদস্য থাকলে দল ভাঙার একটা সম্ভাবনা থাকে। একজনের দল হলে দলের ইন্টেগ্রিটি অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা দেওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ভালো ভোট টেনেছেন। অনেককে বিস্মিত করে ডাব মার্কা নিয়ে নির্বাচন করে ১৯৯০-এর দশকে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। বিভিন্ন প্রতীকে বিভিন্ন নির্বাচন করলেও ডাবই তাকে সাফল্য এনে দিয়েছে।
ল্যাটিন আমেরিকার একটি দেশের নির্বাচনের আগে একজন প্রার্থী কমিশনের কাছে উত্থিত যৌনাঙ্গকে তার নির্বাচনের মার্কা হিসেবে বরাদ্দ করার আবেদন করেন; কারণ, তিনি চান তার দেশ জেগে উঠুক। নির্বাচন কমিশন তার প্রতি সদয় হয়নি, তিনি প্রার্থিতা ও মার্কা পাননি। কলম্বিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী একজন নারী তার প্রতীক বিবেচনা করে পুরুষ ভোটারদের মধ্যে ভায়াগ্রা বিতরণ করেছেন এবং বলেছেন কলম্বিয়ার পুরুষদের উত্থান ঘটাতে না পারলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বেশি ভোট মানে নির্বাসন
ব্যালট ব্যবহার করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের এ পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ খ্রিষ্টজন্মের ৪৭১ বছর আগেকার। টেরাকোটার এই ব্যালটের একটি স্তূপ গত শতকের ষাটের দশকে এথেন্সে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় আবিষ্কৃত হয়েছে। তখনকার প্রাপ্ত ব্যালটের সংখ্যা ৮৫০০। গণতান্ত্রিক ধরনটা গ্রহণের চেয়ে বেশি বর্জনের। পরবর্তী দশ বছরের জন্য এথেন্সের নাগরিকগণ কোন কোন দলকে চান না, তা নির্ধারণ করার জন্য এই ব্যালটগুলো ব্যবহৃত হয়েছে। টেরাকোটার ব্যালটে প্রার্থীর নাম লেখা আছে। যদি কোনো প্রার্থী ৬০০০ ভোটের বেশি পেয়ে যায়, তাহলে সে প্রার্থী বিনা বিচারে সমাজচ্যুত ও রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত হবেন। কিন্তু কেউই যদি ৬০০০ ভোট না পান, তাহলে তারা সকলেই রয়ে যাবেন।
এথেন্সের এই মডেলটি কি একবার বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা যায়? হয়তো যায়, কিন্তু তাতেও আবার নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উঠবে।
পাদটীকা: কিছুটা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা একজন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। তার প্রার্থিত মার্কা ছিল কুমির। কিন্তু কুমির কেন—সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করলে আমি দেশে জ্যান্ত কুমির ছেড়ে দেব—যেন খারাপ মানুষগুলোকে গিলে খেতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে ভালো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আর কী হতে পারে? দুর্ভাগ্য সেই প্রার্থীর এবং আমাদেরও—খারাপ মানুষগুলোই ভালো মানুষদের পিটিয়ে বিদায় করছে।