নির্বাচনী প্রতীকের যত গল্প
আর কয়েক দিন পরেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রচারণা শুরু হতেও বেশি দেরি নেই। এ সময় বিভিন্ন প্রতীক রাজনৈতিক দলের পরিচয়স্বরূপ। কাজেই নৌকা, ধানের শীষ কিংবা লাঙ্গল আমাদের প্রায় সবার চেনা মার্কা — তবে চেনা এসব মার্কার বাইরেও আরও অনেক মার্কা বা প্রতীক রয়েছে।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৯টি। এই দলগুলোর মার্কা নির্ধারণ করে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন। ২০০৮ সালের বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের বিধিমালার বিধি ৯-এর উপবিধি ১ অনুযায়ী, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো নির্ধারিত ১৪০টি প্রতীক থেকে প্রতীক বাছাই করতে পারবে। এই বিধির সংশোধন আনা হয় ২০১৭ সালে। ২০১৭ সালের সংশোধিত বিধিতে ৬৪টি প্রতীক উল্লেখ করা হয়। যেখান থেকে পুরাতন দল ছাড়াও নতুন নিবন্ধিত দল প্রতীক বাছাই করতে পারবে।
সে হিসাবে ৬৪টি প্রতীকের মধ্যে রয়েছে আপেল, কলার ছড়ি, কুড়াল, আম, কাঁঠাল, কুঁড়েঘর, উদীয়মান সূর্য, কাস্তে, কোদাল, একতারা, কুমির, খাট, কবুতর, কুলা, খেজুরগাছ, গরুর গাড়ি, দালান, মাথাল, গাভী, দেয়ালঘড়ি, মিনার, গামছা, ধানের শীষ, মোমবাতি, গোলাপ ফুল, নোঙ্গর, রকেট, ঘণ্টা, নৌকা, রিকশা, চাকা, ফুলকপি, লাঙ্গল, চাবি, ফুলের মালা, শঙ্খ, চেয়ার, বাঘ, সিংহ, ছড়ি, বটগাছ, স্যুটকেস, ছাতা, বাইসাইকেল, হাত (পাঞ্জা), ট্রাক, বাঁশি, হাতঘড়ি, টেলিভিশন, বেঞ্চ, হাতপাখা, ডাব, বেলুন, হাতুড়ি, তবলা, মই, হারিকেন, তারা, মোটরগাড়ি (কার), হুক্কা, তরমুজ, মশাল, দাবাবোর্ড, ও মাছ।
এই প্রতীকগুলো থেকেই ৪৯টি নিবন্ধিত দল পছন্দমতো প্রতীক কিংবা 'মার্কা' সংগ্রহ করেছে। প্রতীকের তালিকায় নজর দিলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে নদী ও কৃষিভিত্তিক প্রতীকের পাশাপাশি ফল, ফুল, পশু-পাখি, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী সবই রয়েছে।
মনে করা হয়, নির্বাচন প্রতীক যখন নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন আপামর জনসাধারণের কথা ভেবেই নির্ধারিত হয়েছিল। অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষও যাতে চিহ্ন দেখে ভোট দিতে পারে, তার জন্য নেওয়া হয়েছিল এই ব্যবস্থা। তাই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা নিজেদের প্রতীক চেনানোর জন্য পরিশ্রমও করে অনেক বেশি। ব্যানারে-পোস্টারে ছেয়ে ফেলে পুরো এলাকা। কান পাতলেই শোনা যায় '...মার্কায় ভোট দিন' স্লোগান।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রতীকে দেখতে পাওয়া যায় নৌকার চিহ্ন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। কিন্তু কীভাবে এল নৌকা? ধারণা করা হয়, নদীনালায় ভরপুর পূর্ববঙ্গে নৌকাই ছিল যাতায়াতের প্রধান বাহন। আর পালতোলা নৌকা এই বঙ্গের ঐতিহ্যের অংশ। তাই সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে ধারণ করে নৌকা নিয়েই শুরু হয় যাত্রা। কিন্তু পেছনের গল্প জানতে ফিরে যেতে হবে ১৯৫৪ সালে।
১৯৫৪ সালের পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ নির্বাচনে প্রধান দুটি প্রতিদ্বদ্বী দল ছিল যুক্তফ্রন্ট এবং মুসলিম লীগ। সে সময় মুসলিম লীগ 'হারিকেন' এবং যুক্তফ্রন্ট 'নৌকা' প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করেন। যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরিক দলগুলো ছিল মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক পার্টি, মওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নেজামে ইসলাম, হাজী মোহাম্মদ দানেশের নেতৃত্বাধীন গণতন্ত্রী দল এবং খিলাফতে রব্বানী পার্টি।
১৯৫৪ সালের ৮ থেকে ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ নির্বাচন। সেখানে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা ২২৩টি আসনে বিজয়ী হন। এর মধ্যে ১৪৩টি আসন পেয়েছিল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ। নির্বাচনে হাতে 'হারিকেন' ধরিয়ে দেওয়ার মতো বিশাল পরাজয় হয় মুসলিম লীগের।
১৯৫৭ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ। যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় দল আওয়ামী মুসলিম লীগ হওয়ায় যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ার পর নৌকা প্রতীকটিও চলে আসে আওয়ামী লীগের কাছে। তবে নৌকার মাঝি হওয়ার জন্য অর্থাৎ নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগকে অপেক্ষা করতে হয় ১৯৭০ সাল পর্যন্ত। পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করে ১৬০টি আসনে জয়ী হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে 'নৌকা' প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয় লাভ করে সরকার গঠন করে।
তবে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নৌকার আগে 'লাঙ্গল' প্রতীকটি ব্যবহারের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে অবিভক্ত ভারতের কৃষক প্রজা পার্টির প্রতীক ছিল লাঙ্গল। তাই তৎকালীন পাকিস্তান নির্বাচন কমিশনের বাধায় লাঙ্গল প্রতীক ছেড়ে নৌকার মাঝি হতে হয় যুক্তফ্রন্টকে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১১টি নির্বাচন পেরিয়ে গেলেও প্রতীকে নদী বা পানির ছোঁয়া এখনো বহাল আছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নতুন নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) প্রতীক রেখেছে 'নোঙ্গর'।
মার্কায় কৃষির ছাপ
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের প্রতীকে কৃষির ছোঁয়া পঞ্চাশের দশক শেষ থেকেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠিত করেন। গ্রামবাংলার জনসাধারণের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে 'ধানের শীষ' প্রতীকটিকে ন্যাপ তাদের মার্কা হিসেবে বেছে নিয়েছিল সে সময়।
ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় তার 'বাঙালির ইতিহাস' গ্রন্থে প্রাচীন বাঙালির খাদ্যাভ্যাস প্রসঙ্গে লিখেছেন, 'ইতিহাসের ঊষাকাল হইতেই ধান্য যে-দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে-দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই।' বাংলার মানুষের প্রধান খাবার ভাত আর বাংলার মাঠে মাঠেই ধানের দেখা মেলে। তাই গ্রামীণ ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার উদ্দেশ্যে ন্যাপ প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করে ধানের শীষকে।
ষাটের দশকে বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রভাব পড়ে অখণ্ড ন্যাপেও। ভেঙে যায় দল। ১৯৬৭ সালে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে চীনপন্থী ন্যাপ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের খান আবদুল ওয়ালি খানের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী ন্যাপের পথচলা শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তান ওয়ালি ন্যাপের সভাপতি হন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, যা পরে মোজাফফর ন্যাপ নামে পরিচিতি পায়।
ভাসানী ন্যাপ এবং মোজাফফর ন্যাপ দুটো দলই ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণের সময় ভাসানী ন্যাপ ধানের শীষ প্রতীক এবং মোজাফফর ন্যাপ কুঁড়েঘর প্রতীক গ্রহণ করে। উক্ত নির্বাচনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর ন্যাপ) ৮.৩২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অপর দিকে মাওলানা ভাসানীর ন্যাপ ভোট পায় ৫.৩২ শতাংশ।
জননেতা মাওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর ভাসানী ন্যাপের সভাপতি হন মশিউর রহমান যাদু মিয়া। এর মধ্যেই স্বাধীনতার ৭ বছর পর জন্ম হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি)। ১৯৭৮ সালে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার নেতৃত্বে ভাসানী ন্যাপের একটি বড় অংশ বিএনপিতে যোগ দেয়। এ সময় ধানের শীষ প্রতীকটিও বিএনপি গ্রহণ করে। ১৯৭৯ সালে দেশের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বিএনপি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত ধানের শীষ প্রতীকটি বহাল রেখেছে বিএনপি।
ধানের শীষের পর কৃষির অনন্য প্রতীক হিসেবে যে নামটি উঠে আসে, সেটি হলো লাঙ্গল। অবিভক্ত ভারতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে অবিভক্ত ভারতের কৃষক প্রজা পার্টির প্রতীক ছিল লাঙ্গল। পরবর্তী সময়ে লাঙ্গলের হাল ধরেন বাংলাদেশ জাতীয় লীগের নেতা আতাউর রহমান খান। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনে তিনি ঢাকা ১৯ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৮৪ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে আতাউর রহমান খান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। পাশাপাশি বিলুপ্তি ঘটে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের। পরবর্তী সময়ে লাঙ্গল প্রতীকটি গ্রহণ করেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এটি নিয়েই প্রতিবছর নির্বাচনে অংশ নেয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দল জাতীয় পার্টি।
কৃষিভিত্তিক প্রতীক নিয়ে অন্যান্য দলও অবশ্য থেমে থাকেনি। রাজনৈতিক দলের পছন্দের তালিকায় কাস্তে, কোদাল, সোনালী আঁশ সবই আছে। বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতীক কাস্তে, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির প্রতীক কোদাল। পাশাপাশি নতুন নিবন্ধিত দল তৃণমূল বিএনপির প্রতীক সোনালী আঁশ।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) প্রতিনিধিত্ব করেছিল মশাল মার্কা নিয়ে। মাঝে অনেক উত্থান-পতন এসেছে। কিন্তু মশাল মার্কা নিয়ে লড়াই এখনো চলছে।
বিকল্পধারা বাংলাদেশের মার্কা কুলা। পাশাপাশি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) মার্কা মই। হাতুড়ি নিয়ে নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করছে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।
ফলে-ফুলে ভরপুর প্রতীক
শুধু কৃষিই নয়, ফল-ফুল সবই ঠাঁই পেয়েছে প্রতীকের তালিকায়। ফলের রাজা আম থেকে জাতীয় ফল কাঁঠাল দুটোই দেখতে পাওয়া যায় নির্বাচনী দলের প্রতীকে। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রতীক কাঁঠাল, আবার বাংলাদেশ ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রতীক আম। আম, কাঁঠাল ছাড়াও ডাব প্রতীকেরও দেখা মিলবে বাংলাদেশ কংগ্রেস দলে।
মধ্যে চলতি বছরে নতুন নিবন্ধিত ৫টি দলের মধ্যে ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশের প্রতীক আপেল। তা ছাড়া খেজুরগাছ জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ দলের প্রতীক। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রতীক বটগাছ।
তা ছাড়া ফুলসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতীক বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলোর ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়। জাকের পার্টির প্রতীক গোলাপ ফুল। একই বছরে নিবন্ধিত বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের প্রতীক ফুলের মালা।
ফুল-ফল ছাড়া বিভিন্ন পশু-পাখিও রয়েছে নির্বাচনী প্রতীকের তালিকায়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী গণতন্ত্রী পার্টির প্রতীক কবুতর। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপের প্রতীক গাভী। জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) প্রতীক সিংহ।
বাংলাদেশের নির্বাচনী দলের প্রতীকে পশু, পশুচালিত গাড়ির পাশাপাশি অন্যান্য বাহনও রয়েছে। পশুচালিত বাহনের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) প্রতীক গরুর গাড়ি। আবার জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রতীক বাইসাইকেল। নতুন নিবন্ধিত বাংলাদেশের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করতে যাচ্ছে মোটরগাড়ি (কার) নিয়ে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এমএল) নির্বাচনী প্রতীক চাকা। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নির্বাচনী প্রতীক রিকশা। যদিও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
নির্বাচনে গামছা নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। তাছাড়া হাতপাখা হাতে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। একইভাবে দেয়ালঘড়ি নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে খেলাফত মজলিস।
মজার বিষয়, বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল তিনটি দেশেরই রাজনৈতিক দল পাঞ্জা বা করতল প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করে। বাংলাদেশে পাঞ্জা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)।
এগুলো ছাড়াও ছাতা, উদীয়মান সূর্য, মাছ, চেয়ার, হাতঘড়ি, মিনার, মোমবাতি, টেলিভিশন, একতারা প্রভৃতি প্রতীক নিয়ে বাংলাদেশে নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করছে বিভিন্ন দল।
উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রতীক
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ প্রতীক নির্বাচনে তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ছোঁয়া রেখেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই ধরা যাক। ১৯৫১ সালে ভারতের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে ১৪টি প্রতীক অনুমোদন করে নির্বাচন কমিশন। ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন এবং বৃহত্তম দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির বর্তমান প্রতীক পদ্মফুল। তবে এটি তাদের প্রথম নির্বাচিত প্রতীক নয়। এখন পর্যন্ত বিজেপি তিনবার তাদের নির্বাচনী প্রতীক পরিবর্তন করেছে।
বিজেপি ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় জনসঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তখন তাদের নির্বাচনী প্রতীক ছিল প্রদীপ। এ প্রদীপ অনেকটাই মঙ্গলপ্রদীপের মতো দেখতে; যা ভারতের সংস্কৃতিতে শুভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৭৭ সালের দিকে দলের নাম হয় জনতা পার্টি। সে সময় প্রতীক ছিল চাকার ভেতর লাঙল কাঁধে কৃষক। পরবর্তীকালে বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পার্টি পদ্মফুলকেই তাদের দলীয় প্রতীক হিসেবে বেছে নেয়। তিনটি প্রতীকের মধ্যে বিজেপি তাদের দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে।
বিজেপি ছাড়াও ভারতের অন্যতম পুরোনো দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীকও এখন পর্যন্ত তিনবার বদলেছে। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক ছিল জোড়া বলদ। পরবর্তী ৬ বছর তারা গাই-বাছুরকে প্রতীক হিসেবে বেছে নেয়। গাই-বাছুর প্রতীকের বদল আসে ১৯৭৭ সালে। ইন্দিরা গান্ধীর 'ইন্দিরা কংগ্রেস' প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়ে জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক হয় পাঞ্জা বা করতল।
কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মার্ক্সিস্ট) নির্বাচনী প্রতীকে দেখা যায় কাস্তে-হাতুড়ির সঙ্গে তারা। সিপিআইয়ের প্রতীক কাস্তে ও ধানের শিষ সূচনার সময় থেকেই এক থেকেছে। অপেক্ষাকৃত নবীন দল তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাসফুল এখনো অটুট রয়েছে।
ভারত ছাড়াও নেপালের নির্বাচনী প্রতীকের মধ্যে দেখা যায় বাস, মাদল, সূর্য, গাছ, ছাতা, গ্লাস প্রভৃতি প্রতীক। শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলের তালিকায় প্রায় ৮৫টি দল রয়েছে। ৮৫টি দল ভিন্ন ভিন্ন প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। শ্রীলঙ্কার নির্বাচনী প্রতীকের মধ্যে আছে পাঞ্জা, বাইসাইকেল, প্রজাপতি, ক্যাঙ্গারু, পান, কাপ, টেলিফোন, তারা, চোখ, গাছ, ময়ূর প্রভৃতি।
হাতি বনাম গাধা: শতাব্দীজোড়া দ্বৈরথ
যে নির্বাচনটি ঘিরে বিশ্বজুড়ে উন্মাদনা দেখা যায়, সেটি হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এই নির্বাচনে হাতি বনাম গাধার দ্বৈরথও নতুন কিছু নয়। দুই শতাব্দী পুরোনো নির্বাচনের ইতিহাসে ডেমোক্রেটিক এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রতীকের বয়সও দুই শতাব্দীর মতোই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুই দলের প্রতীকের কারিগর একই ব্যক্তি। আমেরিকান কার্টুনের জনক টমাস ন্যাস্ট প্রধান দুই দলের প্রতীক এঁকে গাধা এবং হাতির দ্বৈরথের সূত্রপাত ঘটান।
১৯ শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক কার্টুন নিয়ে আলোচনা হতো অনেক। ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হওয়া কার্টুনগুলো কখনো হয়ে উঠত হাস্যরসের প্রতীক আবার কখনো বহন করত জটিল অর্থ।
সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন (১৮২৯-১৮৩৭)। নির্বাচনের সময় তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাকে 'জ্যাকঅ্যাস' অর্থাৎ গাধা বলে ডাকত। বিদ্রুপ করে ডাকা হলেও 'জ্যাকঅ্যাস' নামটি তখন জ্যাকসনের পছন্দ হয়। পরবর্তী সময়ে গাধাকে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেন। সেই সময়ে কার্টুনশিল্পী টমাস ন্যাস্ট 'জ্যাকঅ্যাস'কে কেন্দ্র করে একটি কার্টুন আঁকেন, যেখানে দেখা যায় জ্যাকসনের মাথা একটি গাধার শরীরের ওপর বসানো। এর পর থেকেই গাধা প্রতীকের তালিকায় পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের অবসানের পর ডেমোক্রেটিক পার্টির অন্য নেতাদেরও প্রতীক হয়ে ওঠে গাধা।
একইভাবে ১৮৬০ সালে আব্রাহাম লিংকনের নির্বাচনী প্রচারণার সময় হাতিকে তাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করে। পরবর্তী সময়ে টমাস ন্যাস্ট হাতিকে নিয়েও ১৮৭৪ সালের উপনির্বাচনের সময় একটি কার্টুন আঁকেন। এর পর থেকে হাতি রিপাবলিকানদের কাছে মূল প্রতীকরূপে দাঁড়ায়।
ডেমোক্র্যাটদের কাছে গাধা পরিশ্রমী, অধ্যাবসায়ী এবং কষ্টসহিষ্ণুতার প্রতীক। অপর দিকে রিপাবলিকানদের কাছে হাতি নির্ভীকতা, মর্যাদাশীল এবং স্থিতিশীলতার প্রতীক।
প্রতিবার নির্বাচন এলেই শুরু হয়ে যায় প্রতীক বা মার্কা নিয়ে লড়াই। চেনা-অচেনা প্রতীকের ভিড়ে সব রাজনৈতিক দল নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে প্রচারণার মাধ্যমে। জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও জেলা, উপজেলা, অঞ্চলভিত্তিক নির্বাচনে দেখা যায় বিভিন্ন প্রতীকের বাহার। মানুষের মনে প্রতীক দিয়ে বেঁচে থাকাই তাই লক্ষ্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের।