৯৭৭ দিন সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে বন্দিজীবনের গল্প
মাইকেল স্কট মুর একজন আমেরিকান ও জার্মান সাংবাদিক-লেখক। ২০১২ সালে স্কট মুর জার্মানির বিখ্যাত পত্রিকা ডার স্পিগেলের সাংবাদিক হয়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের উপর বিশেষ প্রতিবেদন করতে সোমালিয়া যান। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! স্কট মুর নিজেই জলদস্যুদের হাতে বন্দী হন। শুরু হয় তার বন্দিজীবন। সেই জীবন ছিল ভয়ানক: শারীরিক, মানসিক নির্যাতন তো ছিলই, সেই সঙ্গে দিনের পর দিন কেটেছে এক টুকরো রুটি খেয়ে, কখনো এক ফোঁটা জলের জন্য বুক ফেটে যাবার মতো অবস্থা হয়েছে, কান্নায় চোখের জল শুকয়ে এসেছে। শেষে, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দীর্ঘ ৩ বছর জসদস্যুদের হাত বন্দি থাকার ডর তার মুক্তি ঘটে। আর তার এই মুক্তির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখেন স্কট মুরের মা। তিনি আমেরিকা ও জার্মানির কিছু প্রতিষ্ঠান, তার ব্যক্তিগত বন্ধু, সহযোগী— সবার কাছে ছেলের মুক্তির জন্য অর্থ চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, ক্যাম্পেইন করেছেন এবং শেষে মোটা অর্থের বিনিময়ে ছেলেকে জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত করেছেন।
মুক্তির পর মাইকেল স্কট মুর লিখেন পাইরেটদের হাতে বন্দি জীবনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বই 'ডেজার্ট অ্যান্ড দ্য সি: ৯৭৭ ডেস'।
সাড়া জাগানো এ বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে মুরের সেই দুঃসহ স্মৃতিচারণা। মুর তার গ্রন্থটির মাধ্যমে দেখিয়েছেন কীভাবে সোমালিয়ায় জলদস্যুরা মুক্তিপণের ফাঁদে ফেলে এক একজনের কাছ থেকে অর্থ আদায় করে সর্বস্বান্ত করছে। ছিনতাই করছে জাহাজ ভারত মহাসাগরে। এই গ্রন্থে বন্দি, বন্দি জীবনের পাশাপাশি উঠে এসেছে মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের অসম অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং দস্যুবৃত্তির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও। সঙ্গে এক সাংবাদিকের চোখ দিয়ে দেখা দস্যুজীবনের রোমহর্ষ জাগানো সব গল্প।
লেখক মাইকেল স্কট মুরের জন্ম ১৯৬৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। পড়াশোনা করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৯১ সালে তিনি জার্মান সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৫ সালে তিনি জার্মানিতে চলে যান এবং সেখানে জার্মানির নাগরিকত্ব নিয়ে ডার স্পিগেল পাত্রিকায় যোগ দেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি লিখেছেন একাধিক বই। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে উপন্যাস "Too Much of Nothing" তাঁর ভ্রমণবিষয়ক আরেকটি জনপ্রিয় গ্রন্থ "Sweetness and Blood", এর বাইরে দি আটলান্টিক ইকোনমিস্ট, ডার স্পিগেল, প্যাসিফিক স্ট্যান্ডার্ড এবং ব্লুমবার্গ বিজনেস উইকের নিয়মিত লেখক।
মাইকেল স্কট মুর কীভাবে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে বন্দী হলেন?
মুর তখন জার্মানিতে বসবাস করেন। জার্মানির আদালতে ১০ জন সোমালিয়া জলদস্যুর বিচার চলছিল তখন। তাদের অপরাধ ২০১১ সালে তারা জার্মান কার্গো জাহাজ হাইজ্যাক করার চেষ্টা করেছিল। মুরের কাঁধে দায়িত্ব পড়ল এই জলদস্যুদের নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করার। এই কাজের একপর্যায়ে মুরকে এই প্রতিবেদন তৈরির জন্য সশরীরে সোমালিয়া যাওয়ার প্রয়োজন দেখা দিল। এরমধ্যে মুর জার্মানিতে বিচারাধীন সোমালিয়ান জলদস্যুদের দেওয়া তথ্য, সোমালিয়া সরকারে সহযোগিতা, জলদস্যুদের নিয়ে তথ্যচিত্রসহ নানা মাধ্যম ঘেঁটে সোমালিয়ায় জলদস্যুদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের পথ বের করেন। তিনি জার্মানি থেকে রওনা হলেন সোমালিয়ার পথে।
সোমালিয়ার গালকায়ো নামের একটা শহরে পৌঁছুলেন তিনি । ছোট এক শহর, এখান থেকে গাড়িতে পৌঁছালেন হুবাইয়ো নামের একটি গ্রামে। ভারত সাগর থেকে ১২৫ মাইলের মধ্যে অবস্থান। ২০১২ সালের শুরু দিকে মুর এই গ্রামে আসেন।
তবে মুর গ্রামটিতে পৌঁছানোর পথেই একদল জলদস্যু তাকে ঘিরে ফেলে, ভারি অস্ত্রে সজ্জিত এক টয়োটা পিকভান থেকে দস্যুরা নেমে এসে মুরকে তারা গাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে মারধর শুরু করে, তার চশমা ভেঙে যায় ঘুষি খেয়ে। তারপর স্কট মুরকে বেঁধে ফেলা হয়, শুরু হয় এক অজানা গন্তব্য যাত্রা।
ওই অবস্থায় স্কট মুর চিৎকার করে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলেও কোনো ফল হয়নি, বরং একজন আমেরিকান সাংবাদিককে তারা আটক করতে পেরেছে এতে দস্যুরা আনন্দিত হয়ে ওঠে। বিপুল মুক্তিপণ আদায়ের সম্ভবনায়। মুরের মুক্তিপণ ধার্য হলো ২০ মিলিয়ন ডলার।
শুরু হলো স্কট মুরের বন্দিজীবন। মুর তার বইয়ে লিখেছেন: 'সোমালিয়াতে এবারই আমার প্রথম আসা নয়। আগেও এসেছি। কিন্তু এবার অন্য রকম আসা। জলদস্যুদের হাতে অপহৃত হওয়া মানেই প্রতিদিন নির্যাতনের শিকার হওয়া। মাঝে মাঝে মনে হতো আত্মহত্যা করি। কিন্তু সেই সুযোগও ছিল না।'
সোমালিয়া জলদস্যুদের কথা ছিল একটাই— 'মুক্তিপণ না দিলে মৃত্যু। তোমরা আমেরিকানরা আরাম-আয়েশে থাকবে আর আমরা না খেয়ে মরব? তা হবে না। তোমার দেশ থেকে যত তাড়াতাড়ি আমাদের দাবি মিটিয়ে দেওয়া হবে তত তাড়াতাড়ি তুমি মুক্তি পাবে। নইলে মৃত্যু।' মুর জরদস্যুদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন: 'তোমার ভুলভাবে ভুল মানুষকে অপহরণ করে নিয়ে এসেছ। আমি খুব সাধারণ একজন সাংবাদিক এবং লেখক। আমার নিজের বা আমার মায়ের এত অর্থ নেই।'
সোমালিয়া জলদস্যুদের সর্দার ছিলেন বাসকো। মুর তার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, 'শক্তপোক্ত শরীর। চোখ লাল।' আমি শুধু ভাবছিলাম, আমাকে হত্যা করার আগে তারা আমাকে নিয়ে আর কত তামাশা করবে? আমার মুখের সামনে এসে চোখের উপর চোখ রেখে বাসকোর কড়া বার্তা— 'যদি আমেরিকানরা এখানে তোমাকে উদ্ধার করতে না আসে এবং অথবা অন্য কোনো রকম ফন্দিফিকির করে, তাহলে তোমার লাশ কিন্তু তাদের সঙ্গে যাবে।'
সোমালিয়ার জলদস্যুর দল তার মুক্তিপণ দাবি করেছিল ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! এই অঙ্কের টাকা মাইকেলের পক্ষে জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকা তার মা এই খবর শুনে ছেলের মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে মাঠে নামেন। ব্যক্তিগত বন্ধু, প্রতিষ্ঠান, চার্চ, স্থানীয় মুদির দোকান থেকে শুরু করে আমেরিকা ও জার্মানির সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রাক্তন সহকর্মী, মিডিয়া—সবার নজর কাড়লেন তিনি।
প্রায় দীর্ঘ তিন বছর পর মুক্ত হলেন স্কট মুর। অনেক কষ্ট করে তার মায়ের জোগাড় করা ১.৬ মিলিয়ন ডলার দিয়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে রফা হয়।
মুক্তির পর দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকতে হয় তাকে। সুস্থ হয়ে উঠেই সোমালি পাইরেটদের হাতে বন্দিদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখলেন অসাধারণ বই, দি ডেসার্ট অ্যান্ড দ্য সি: নাইন্টিন সেভেন্টিসেভেন ডেইজ ক্যাপটিভ অন দি সোমালি পাইরেট কোস্ট। অনেকটা জার্নাল এবং আত্মজীবনীর ঢংয়ে লেখা গ্রন্থটি। প্রকাশের পর আমেরিকার সেরা বইয়ের তালিকায়ও উঠে আসে। প্রকাশক হারপার ওয়েভ।
গত বছর বসন্তের মাঝামাঝি সময়ে ম্যানহাটনে অবস্থিত স্ট্র্যান্ড বুক স্টোরে এক 'বুক সাইনিং সন্ধ্যায়' মাইকেল স্কট মুর হাজির হয়েছিলেন। বেস্টসেলার হওয়া গ্রন্থটির স্বাক্ষর সন্ধ্যায় উপস্থিত থাকার সুযোগ আমারও হয়েছিল।
ম্যানহাটনে ব্রডওয়ের ১২তম সড়কের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা লাল ইটের দালান স্ট্র্যান্ড বুক স্টোরের দ্বিতীয় তলার মিলনায়তনে ঢুকে দেখতে পেলাম আসনগুলো কানায় কানায় পূর্ণ। কিছুক্ষণ পরই পিনপতন নীরবতা ভেঙে স্কট মুর মঞ্চে এলেন। সাধারণ কুশল বিনিময় এবং অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তিনি তার গ্রন্থটি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেখক গ্রন্থটি নিয়ে কথা বললেন। গ্রন্থটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি মূলত তার বন্দী সময়ে সোমালিয়ার জলদস্যুদের সঙ্গে টানা ৯৭৭ দিনের রোজনামচার কথাই তুলে ধরলেন। সেই বর্ণনা কখনো ছিল শ্লেষমিশ্রিত হাস্যরসাত্মক আবার কখনো ছিল বুকচাপা কান্না ভরা। উপস্থিত দর্শক তার কথা রুদ্ধশ্বাসে শুনলেন, কাউকে কাউকে দেখলাম— গোপনে পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে চোখ মুছছেন।
মাইকেলে স্কট মুরের বক্তব্য শেষে লেখক-পাঠক প্রশ্ন-উত্তরের একটি পর্ব রাখা হয়েছিল। তবে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, লেখককে কোনো সরাসরি প্রশ্ন করা চলবে না। দর্শকদের কাছ থেকে পাওয়া লিখিত প্রশ্ন থেকে বাছাইকৃত প্রশ্নেরই কেবল উত্তর দেবেন তিনি। উপস্থিত দর্শকদের কিছু প্রশ্ন এখানে তুলে দিচ্ছি:
প্রশ্ন: আপনাকে জলদস্যুদল জিম্মি করল এবং দাবি করল যে ২০ মিলিয়ন ডলারের মুক্তিপণের বিনিময়ে আপনাকে আমেরিকা সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। টাকার পরিমাণটা খুব বেশি ছিল না? ডাকাতদল কী জানে, ২০ মিলিয়ন ডলার কত টাকা?
মাইকেল স্কট মুর: ডাকাত দল ভেবেছিল, যেহেতু আমি আমেরিকার নাগরিক, সে কারণে হয়তো আমেরিকা সরকার কুড়ি মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে তাদের সঙ্গে একটা রফাদফা করে আমাকে মুক্ত করে আনবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। সরকার থেকে আইনি সহায়তা ছাড়া আমি তেমন কিছুই পাইনি। তবে এফবিআই আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। বাকি যা কিছু করেছেন আমার বৃদ্ধা মা। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে, আমার সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান এবং কিছু মানবতাবাদী মানুষের সহযোগিতায় তারা ১.৬ মিলিয়ন ডলার জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছিল। মা ও তাদের এই আন্তরিক চেষ্টার কারণেই আজ আমি আপনাদের সামনে এসে কথা বলতে পারছি। আমার মা যেভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং মিডিয়ার দ্বারে দ্বারে গিয়ে আমার জন্যে টাকা চেয়েছেন, তা বিস্ময়কর! তার এই বিস্ময়কর উদ্যোগের কথা আমি আমার গ্রন্থেও বিশদ উল্লেখ করেছি।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে প্রথম এবং কীভাবে এই জলদস্যুদের পরিচয় হয়েছিল? বলবেন?
স্কট মুর: ২০১২ সালের শুরুর দিকে আমি সোমালিয়া যাই। কোর্টে তখন সোমালিয় জলদস্যুদের একটি ট্রায়াল হচ্ছিল। দুই বছর আগে তাদের ধরে জেলে পুরা হয়। সোমালিয়ার কাছাকাছি সাগর থেকে এমভি তাইপান নামে একটি জার্মান কার্গো জাহাজ কিডনাপ করার চেষ্টা করেছিল তারা। এই বিচারের সময় সোমালিয়ার জলদস্যুদের উপর লেখা আমার প্রতিবেদনগুলো বার্লিন থেকে প্রকাশিত ডার স্পিগেল অনলাইনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল।
এর আগে ২০০৯ সালের দিকে আমার সঙ্গে সোমালিয়ার এক দস্যুর পরিচয় হয়েছিল। ফারাহ ইসমাইল নামের এই সোমালিয় জলদস্যু আমাকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং সাক্ষাৎকার দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। আমি হলিউডের নায়ক জনি ডেপকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তিনি পাইরেট হিসেব খুব স্বার্থকভাবেই জলদস্যু চরিত্রটি তার অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
প্রশ্ন: এই ভয়াবহ জলদস্যুদের উপর প্রতিবেদন করতে আপনার ভয় হয়নি?
স্কট মুর: দেখুন, আমি সাংবাদিক। এটাই আমার পেশা। একজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু নেই। আমার আগেও অনেক সাংবাদিক এই জলদস্যুদের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করার চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু সফল হয়নি। কারণ, এদের বিশ্বাস করাই কঠিন। অনেকে নানা বিপদ থেকে নিজের জীবন রক্ষা করতে শেষ পর্যন্ত পালিয়ে বেঁচে এসেছেন। যেমন আমিও তাদের ফাঁদে পড়ে দীর্ঘ ৩ বছর টানা তাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে শেষে মুক্তি পেয়েছি।
প্রশ্ন: আপনাকে কীভাবে তারা নির্যাতন করেছিল? বলা যায়?
স্কট মুর: আমাকে প্রায় প্রতিদিনই যখন-তখন মারধর করা হতো। এই দেখুন পিঠে এখনো ওদের মারের দাগ রয়ে গেছে। আমার পিঠও বাঁকা হয়ে গেছে। আর খাবারদাবারের কষ্ট তো ছিলই। খেতে না পেয়ে খাবারের জন্যে চিৎকার করতাম। সেইসব অমানবিক অত্যাচারের কথা বর্ণনা দিয়ে বোঝানো যাবে না।
প্রশ্ন: দীর্ঘ ৯৭৭ দিন আপনি ছিলেন এই বর্বর জলদস্যুদের সঙ্গে। বুঝতে কষ্ট হয় না যে আপনার প্রতিটা সময় ছিল কঠিন, কষ্ট জর্জর। তারপরও বলি, এই ডাকাতদলের সঙ্গে থেকে আপনার বিচিত্র কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছিল কি?
স্কট মুর: হ্যাঁ, অবশ্যই হয়েছিল। যেমন ধরুণ, আমি ওদের একটি বিয়েতে থাকতে পেরেছিলাম। ডাকাতদলের একজন বিয়ে করবে। আমাকে বলল যে আমিও যেন তাদের সঙ্গে বরযাত্রী হিসেবে যাই। বিষয়টা আমার জন্য অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা! একদিকে মুক্তিপণের টাকার জন্য তাগাদা এবং মৃত্যু ভয়, অন্যদিকে ওদেরই বরযাত্রী হয়ে বিয়েতে যোগদান। ভাবুন! আরেকটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি দীর্ঘ আড়াই বছরে ছোট একটা ঘরে বন্দী অবস্থায় শুধু বাইবেল ছাড়া আর কোনো কিছু পড়ার সুযোগ পাইনি। যার ফলে গোটা বাইবেল আমি তিনবার পড়ে শেষ করে ফেলেছিলাম।
প্রশ্ন: ডাকাতদলের কারও সাথে কোনো সখ্য হয়েছিল আপনার?
স্কট মুর: ভালো প্রশ্ন। সম্পর্ক ঠিক বলা যায় না; তবে এক তরুণের সঙ্গে আমার অনেক ব্যক্তিগত কথাবার্তা হতো। এই যেমন ধরুণ, সে তার জীবনের পরিকল্পনার কথা আমাকে বলত। তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল, সে একদিন ডাকাতি পেশা ছেড়ে দিয়ে সোমালিয়া ত্যাগ করে কোনো ইউরোপীয় বা অন্য কোনো উন্নত দেশে চলে যাবে। আর তা ছাড়া আমি আরেকটা কাজও করেছিলাম। জলদস্যুদেও আমি যোগ ব্যায়াম শেখাতে শুরু করেছিলাম। তারা বেশ মজা পেত। আমিও কষ্টের মধ্যে আনন্দ পেতাম।
অনুষ্ঠান শেষে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের রাস্তায় নেমে মনে হলো শহরটা কেমন যেন এক ভুতুড়ে হয়ে গেছে! রাস্তার হলুদ নিয়ন বাতির আড়ালে দেখতে পাই হলুদ হলুদ চোখ! বাড়ি ফিরতে ফিরতে মানসপটে শুধু সোমালিয়ার কিছু জলদস্যুদের চেহারাই ভেসে আসছিল। ভাবছিলাম, তাদের চোখও কি ছিল টকটকে লাল! আর কানেও কি গোঁজা ছিল রক্তজবা ফুল?