ফেউয়ের ডাকেই কি বাঘ আসে? কারা এই ফেউ?
চার দশক আগের কথা। গ্রামের বাড়ি। চারপাশ ঝোপ-জঙ্গলে পরিপূর্ণ। আমি তখন ১৩ বছরের কিশোর। গভীর রাত। মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলাম। হঠাৎ করে বাড়ির কাছ থেকে ফেউ-ফেউ শব্দে কোনো প্রাণী ডেকে উঠল। ভয়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী প্রাণী। মা বললেন, ফেউ ডাকছে, গ্রামে মনে হয় বাঘ আসবে। বাঘ আসার আগে ফেউ ডাকে। সেটাই ফেউয়ের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়।
পরদিন রাতে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে শোনা গেল ফেউয়ের ডাক। গ্রামময় চাপা আতঙ্ক বিরাজ করতে লাগল। কারণ, যুগের পর যুগ গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে আসছে, বাঘ আসার আগে ফেউ ডাকে। আমার শিকারি পিতা বিষয়টাতে একটু ভিন্নমত পোষণ করলেন। তিনি বললেন, ফেউ ডাকছে ঠিক আছে, কিন্তু এখন গ্রামে বাঘ আসবে কোথা থেকে। আগে নদী পেরিয়ে গজারি গড় থেকে এদিকে আসত, এখন তো সেখানে কোনো বাঘ নেই। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ফেউ দেখতে কী রকম? আরও অনেকে বাবাকে প্রশ্নটা করেছে। কিন্তু অভিজ্ঞ শিকারির উত্তর কেউ বিশ্বাস করেনি। সবার ধারণা, ফেউ বিশেষ রহস্যময় প্রাণী। সমাজের মানুষ তাকে দেখতে পায় না। এই প্রাণীটির অনেক সাহস, সে বাঘের শত্রু, লোকজনকে আগে থেকে বাঘের আগমনের আগাম সংবাদ জানিয়ে দেয়। মানুষের পরম বন্ধু সে, কিন্তু ঘুরে বেড়ায় বাঘের পিছু পিছু। তখন রাতের পর রাত ফেউয়ের ডাক শোনা গেলেও বাঘ এল না। আমার শিকারি বাবা কখনোই ফেউয়ের পিছু লাগেননি। বরং রাতে ফেউ ডাকলে তিনি মুচকি হাসতেন, আমার কিন্তু বেশ ভয় লাগত। ভয় লাগত গ্রামের সবার, এই বুঝি শুরু হবে বাঘের আক্রমণ।
এই ফেউ কখনো নিয়মিত ডাকত না। দেখা গেল এক রাতে ডাকার কয়েক দিন পর আবার ডেকে উঠত কয়েকবার। এরপর হয়তো ১৫ দিন, কখনো এক মাস-দুই মাস হয়ে যেত। হঠাৎ আবার কোনো রাতে ডেকে উঠত ফেউ। এমনও দেখেছি, মাসের পর মাস সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, কিন্তু ফেউয়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আমি যখন যৌবনে পদার্পণ করলাম, বলতে গেলে নিয়মিত শিকারি, তখনকার সময় ফেউ ডাকলে গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করত বাঘ আর আসবে না। কারণ, আশপাশের অঞ্চলে বাঘ আর চিতাবাঘের বিলুপ্তি তখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। আমি প্রবল নেশায় তখন নদী পেরিয়ে গজারি বনে ঘুরে বেড়াই শিকারের সন্ধানে। তেমন কোনো বৃহৎ বন্য প্রাণী নেই। ক্রমাগত বাড়ছিল মানুষের বিস্তার, বনের ধ্বংস আর আবাদি জমির প্রসার।
এর মধ্যে গ্রামে আবার শুরু হয় রাতের বেলা ফেউয়ের ডাক। লোকজনের মধ্যে আবার সেই পুরোনো ভয়। এই বুঝি বাঘ এল। শুধু এই গ্রাম নয়; আমি দেশের বিস্তীর্ণ জঙ্গল এলাকা ঘুরে এটা নিশ্চিত হয়েছি, ফেউয়ের এই ধারণা দেশজুড়ে বিস্তৃত। একটা প্রাণী কেন বাঘ আসার আগাম সংবাদ দেবে? এতে কী লাভ তার? আমি গভীর চিন্তায় ডুবে যাই, ফেউয়ের বিষয়ে নানা রকম তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি এখন গ্রামে যে ফেউ এসেছে, তাকে খুঁজে বের করে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি গ্রামের লোকেদের নানা রকম সাক্ষাৎকার গ্রহণ করলাম। একেকজন একেক ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বলল। আনোয়ার ডাক্তার বললেন, 'তিন দিন আগে রাইতে রোগী দেইখ্যা ফিরছিলাম, হঠাৎ দেখি একটা জন্তু দাঁড়াইয়া রইছে ধান খেতের আইলে। টর্চের আলো ফেলতেই দেখি, বিরাট দুইটা চোখ জ্বলতাছে, আমি ডরে দিলাম দৌড়।'
বকুল মিয়া বলল, 'কয় দিন আগে আমার বাড়ির পাশের জঙ্গলে ডাইক্যা উঠছিল, মনে হইতেছিল মাটি কাঁপতাছে।'
এ ধরনের কথাবার্তায় আমি বেশ ধন্ধে পড়ে গেলাম। যদিও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ওদের বর্ণনায় বেশ বাড়াবাড়ি রয়েছে। আমি নিজে রাতের বেলায় সতর্ক অবস্থায় রইলাম। কারণ, আমাদের বাড়ির আশপাশেও মাঝেমধ্যে এদের ডাক শোনা যেত। আমি জন্তুটার আকৃতি কল্পনা করে তাকে মারার জন্য 'AAA' কার্তুজ নির্ধারণ করলাম। শটগানের এই কার্তুজে মোট ৩৫টি ছররা রয়েছে। রাতের বেলা সিঙ্গেল ব্যারেল শটগানের চেম্বারে 'AAA' লোড করে ঘুরে বেড়াতাম গ্রামে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, আমি বেশ কয়েকবার ডাক শুনে খুবই দ্রুত ওদের অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, কিন্তু একধরনের বিস্ময় নিয়ে ফেরত আসতে হয়েছে। কারণ, সেখানে ফেউয়ের বদলে অন্য প্রাণীর দেখা মিলেছে। আমি হন্যে হয়ে রাতের পর রাত সেই অজানা প্রাণীর সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছি।
খেঁকশিয়াল ডাকত খেঁক-খেঁক, পাতি শিয়াল কেক্কা হুয়া আর বনবিড়াল ডাকত মউপ-মউ করে। গ্রামীণ রাতে এসব প্রাণীর আওয়াজ ছিল খুবই পরিচিত। কিন্তু ফেউ-ফেউ করে ওঠা প্রাণীটিকে গ্রামের লোক বলত 'ফেউরা', যার ডাক শোনা যেত মাঝেমধ্যে। হয়তো এক-দুই মাস পর, অথবা বছরখানেক পর। নিয়মিত কেন ওরা ডাকে না? আমি হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াই ফেউরার সন্ধানে। বারবার হতাশ হতে হয়। তবে এদের সম্পর্কে পাওয়া বিশেষ তথ্য সংগ্রহে আগ্রহের কমতি ছিল না। এভাবেই জানতে পারি, বিখ্যাত শিকারি কেনেথ অ্যান্ডারন একবার ভয়ানক মানুষখেকো বাঘ শিকারে গিয়ে ফেউরার সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনিও ধন্ধে পড়ে গিয়েছিলেন বাঘের পেছনে কেন ঘুরে বেড়ায় ফেউ? এ তো ভয়ানক বিপজ্জনক কাজ। তবে একটা সমাধানও খুঁজে বের করেছিলেন তিনি। তার ধারণা, এই প্রাণীটি শিকারের উচ্ছিষ্ট খাওয়ার লোভেই বাঘের পিছু নিত। তবে কেউ কেউ ধারণা করত এ নিঃসঙ্গ প্রাণীটি শিকারকে তাড়িয়ে বাঘের সামনে নিয়ে আসত। অ্যান্ডারসনের মতে, বাঘের ফেউ আসলে দলছুট নিঃসঙ্গ শেয়াল, তাকে চাক্ষুষ দেখে তিনি খুবই অবাক হয়েছিলেন। অত্যন্ত প্রতিভাবান এই শিকারি একবিন্দুও বাড়িয়ে বলেননি। তবে কিছুটা ফাঁক রয়েছে। সাধারণ শিয়ালের চাইতে তার ডাকের ধরনটা অন্য রকম কেন? আর কোন জাতের শিয়াল সে?
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২। বৃষ্টিমুখর দুপুরে বসে ছিলাম নদীর ধারের বাড়িতে। আকস্মিক বন্যায় শীতলক্ষ্যার জল দুপাড় ছাপিয়ে চরাঞ্চল ডুবে যাওয়ার উপক্রম। টিনের চালে টুপটাপ বৃষ্টি ঝরার শব্দ হচ্ছিল। আর তখনই হঠাৎ আমাকে খুবই অবাক করে দিয়ে চরের দিক থেকে ভেসে এল ফেউয়ের ডাক। কী আশ্চর্য, দিনের বেলায় ডাকছে প্রাণীটা, অথচ কত রাত আমি তাকে দেখার অপেক্ষায় ছিলাম। দৌড়ে গেলাম বারান্দার কাছে। তখনই দেখতে পেলাম চরের ঝোপ থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ডাকছে সে। দ্রুত চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে বন্যার পানি, সেই সাথে লাগাতার বৃষ্টি, খুবই অসহায় অবস্থা তার। কিন্তু এ আমি কী দেখছি, ফেউ আসলে আর কেউ নয়, আমাদের পাতিশিয়াল বা গোল্ডেন জ্যাকেল। অনেকের কাছে রেড উলফ নামেও পরিচিত। নেকড়ের মতিই আকাশের দিকে মুখ তুলে ডেকে চলেছে সে: 'ফেউউউ...ফেউউউ...!' আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।