লেখক যখন বাবুর্চি: পিঁপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে
অসময়ে মন আরও দুঃসময়ের দিকে আরও অঘটনের দিকে দিকনির্দেশ করতে থাকে। তখন হাওয়ামোরগের মতো মনটা ঘুরিয়ে নিতে আপনি কী করেন? হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের বরফঝরা রাতের সেই দেশলাই-বেচুনি মেয়েটির মতো সুসময়ের কথা ভাবেন? বছরের শেষ সন্ধ্যায় হিমে জমে মরতে মরতে সে ভাবছিল—মস্ত হলঘরে একটা টেবিল ধপধপে শাদা কাপড়ে ঢাকা, তার ওপর ঝকঝকে রুপোর থালাবাসন সাজানো—মাঝখানে গোল রুপোর থালায় আস্ত একটা হাঁস, গনগনে ওভেনে রোস্ট করে বের করে আনা, পেটটা আপেল আর শুকনো প্লাম ফলে ঠাসা, এখনো ধোঁয়া উঠছে। একপর্যায়ে ঘোমটার মতো স্বচ্ছ হয়ে আসা ঘরের দেয়াল ভেদ করে বুকে ছুরি-কাঁটা বেঁধানো হাঁসটি থপথপিয়ে এগিয়ে আসছিল ছোট্ট মেয়েটির দিকে। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ানের সেই দেশলাইবালা আর সেই হাঁস, সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি মোরগের কাহিনি কবিতার মোরগটার সঙ্গে একাকার হয়ে গেল যেন,
'ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে-
'প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার!'
হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের আশাহীন ভাষাহীন সেই মরণসন্ধ্যায় দেশলাইবালার এক বাসনাময় স্বপ্নের কথা বাংলা অনুবাদে আমাদের শুনিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। সেই বুদ্ধদেব বসু, যিনি লিখেছেন,
'রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে/ জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,/ নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।/ তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে/ ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার/ সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ-উৎসব।' অন্ধকার কিনু গোয়ালার গলি—সদাগরী আপিসের করুণ কেরানী—গলির কোণে পচে ওঠা ভূতি-আঁটি-কানকোকে ওভাবেই সহসা উজ্জ্বল করে ইলিশ ভাজবার গন্ধ... জীবনযাপনের সহস্র আঁধারে এও যেন 'হঠাৎ আলোর ঝলকানি', সুদিনের বার্তা, জীবনের উদ্রেক, যার পরশ লাগতেই ঝলমল করে চিত্ত।
বুঝতেই পারছেন, সাহিত্যিকের রসনাবিলাসের গল্প করব আজ। সাহিত্যে রান্নাবান্নার প্রসঙ্গ কখন কোথায় এল, কেন এল...কখনো ব্যঞ্জনা হয়ে এল, কখনো বঞ্চনা বোঝাতে এল, কার কলমে রান্নার কথা লিখতে লিখতে সাহিত্যমান উত্তুঙ্গ হয়ে উঠল, কে খুব রাঁধতেন সুসময়ে আর অসময়ে, কে দরাজ হাতে ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের সঙ্গে মিশিয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ব-নৃতত্ত্ব আর রান্না... এসব নিয়ে আজকের আলাপ। রবীন্দ্রনাথের 'বীথিকা'র একটি কবিতায় কবি প্রিয়তমাকে যূথীর মালা আর চুনির দুল পরে আসতে বলছেন, সোনার প্রদীপ হাতে করে অভিসারে আসবার কাল তো পেরিয়ে গেছে বিধায় বেতের ডালায় রেশমী রুমালে ঢেকে কিছু ভোজ্য আনতে বলছেন, 'জেনো, রসনার সেরা বাসা রসনায়' (নিমন্ত্রণ)। তরুতলে কাব্যের বই হাতে ডেকেছিলেন খৈয়ামও, খালিপেটে নয়, 'সঙ্গে রবে সুরার পাত্র, অল্প কিছু আহার মাত্র'। অস্কার ওয়াইল্ড একদা বলেছিলেন, 'ভালোমন্দ খাওয়ার পর লোকে এমনকি খারাপ আত্মীয়স্বজনেরও দিব্যি ক্ষমা করে দিতে পারে' ('আ ওম্যান অব নো ইম্পর্ট্যান্স')। বুদ্ধদেব বসুর প্রসঙ্গ এখানে একটু স্থগিত রাখলাম, এ লেখায় আবার তাকে ফিরিয়ে আনব বলে।
'দ্য থ্রি মাস্কেটিয়ার্স', 'কাউন্ট অব মন্টেক্রিস্টো'র জনক আলেক্সান্দর দ্যুমা চমৎকার রাঁধিয়ে ছিলেন, সপ্তাহে তিন দিন রেস্টুরেন্টে ডিনার খেতেন তিনি, দুদিন বন্ধুর বাসায় নেমন্তন্ন, এক দিন নিজের বাড়িতে একা, আর প্রতি মঙ্গলবার বন্ধুবান্ধব জড়ো করে বাড়িতেই মোচ্ছবের ব্যবস্থা। ভারী চমৎকার স্যালাড বানাতেন দ্যুমা। নুন-গোলমরিচ-জলপাই তেল-হোয়াইট ওয়াইন-ভিনেগার, পার্সলিপাতা আর পেঁয়াজপাতা কুচি দিয়ে তৈরি ওঁর আলুর স্যালাডের রেসিপিটা এখনো টিকে আছে আমেরিকান শেফ জেমস বিয়ার্ডের বইয়ে। দ্যুমা তাঁর নিজের রান্নার বই 'দিক্সিওনেয়্যর দ্য ক্যুইজিনা'তে (১৮৭৩) শত শত স্যুপ, সস, মাছ-মাংসের পদ রাঁধবার উপায় বাতলে গেছেন তিনি, যদিও ওঁর হলান্ডেইজ সস কিংবা নরফোক ডাম্পলিং অনুসরণের অযোগ্য। গাঁজাখুরি গল্পও ফেঁদেছেন কিছু, যেমন রোমানরা ডিনারের জন্য হাঁসের পাল খেদিয়ে আনত আল্পসের ওপর দিয়ে, ক্যারিবীয়রা কেবল নাকি কাঁকড়া খেয়ে বাঁচে। তবে হ্যাঁ, দুঁদে মাস্টারদের খেল দেখাবার সামর্থকে দ্যুমা তাঁর রান্নার বইয়েও প্রমাণ করেছেন। ইতিহাসের টুকরোটাকরা তুলে ধরেছেন দ্যুমা, ফরাসিরা কেন কফিতে চিকোরি মেশায়, তিনবার পৃথিবী প্রদক্ষিণকারী ক্যাপ্টেন কুক কেমন করে কুকুরের মাংসের ব্যুইয়োঁ খেয়ে সেরে উঠেছিলেন (ক্যাপ্টেন কুকের স্ত্রী এলিজাবেথের একটা রান্নার বই আছে, ইঁদুরপোড়া থেকে শুরু করে অ্যালবাট্রসের স্টু হয়ে সয়সসে ভাজা জেলিফিশ...কী নেই সে বইয়ে), কেন ইতালীয়রা একে অপরকে অপমান করতে গেলে ডুমুরের (ফিগ) ভঙ্গি করে। গল্পের সত্যাসত্য জানা ইতিহাসবিদের কাজ, দ্যুমা যে অসামান্য গল্পবলিয়ে—তা-ই ভাস্বর হয়ে ওঠে।
রন্ধনশাস্ত্রে মনোযোগ ছিল সাহিত্যিক নিকোলাই গোগোলেরও। 'দিকানকার কাছে এক গ্রামের সন্ধ্যা'য় ইউক্রেনীয় চাষাদের খাবারের শান্ত স্মৃতিময়তা, কিংবা 'মৃত আত্মারা'তে রুশদের ভোজসভার কদর্য পেটুকেপনা। মনে করুন সকালে বেলা চড়তেই পপি বীজের পুলি, ব্ল্যাক কার্যান্ট পাতা—বুনো থাইম আর আখরোটে জারানো ব্যাঙের ছাতা এবং রুপোর পানপাত্রে ভদকার নাশতা। নিজেদের মাখন নিজেই মন্থন করে তুলতেন গোগোল, ছাগদুগ্ধ ফুটিয়ে তাতে মেলাতেন রাম। গুরুপাক খাবার আর স্নায়বিক উত্তেজনার সমন্বয় তাঁর জীবনে খুব সুখকর হয়নি। অজীর্ণরোগে ভুগেছিলেন জীবনভর, মারাও গেছেন অপুষ্টিতে। নবোকভ বলেছিলেন, গোগোলের সাহিত্যে মূল নায়িকা হচ্ছে পাকস্থলী, নাক বা গন্ধের অনুভূতি হচ্ছে নায়ক। নমুনা পেশ করছি—
'টেবিলে যেসব পদ পরিবেশিত হয়েছিল সেসবের বর্ণনা আমি দেব না। ঐ টক সরে ভাসা ম্নিস্কির কথা বলব না, বর্শট স্যুপ সহযোগে পরিবেশিত ভুড়িসেদ্ধ কিংবা প্লাম আর কিসমিসে ভরা টার্কিটার কথা কিছুই বলব না। ঐ যে খাবারটা দেখতে খানিকটা ক্ভাসে ভিজিয়ে রাখা বুটজুতোর মতো—ওটার কথা বলব না, এমনকি যে সসটা পুরনো বাবুর্চির শ্রেষ্ঠ কেরদানি—অ্যালকহলের শিখা যেটার চারদিকে জ্বলজ্বল জ্বলছে—যেটা দেখে ভদ্রমহিলারা আমোদিতও হচ্ছে ভয়ও পাচ্ছে ওটার কথাও নয়। কোনো কিছুর কথা আমি বলব না, বলার চেয়ে বরং ওসব খাওয়াই ভালো।" ('ইভান ইভানোভিচ ও ইভান নিকিফরোভিচের কলহবৃত্তান্ত')
চার্লস ডিকেন্স ভিক্টোরিয়ান আমলের লোক, দেনার দায়ে বাপ চলে গেছে খেলাপিদের কারাগারে, পড়া ছাড়িয়ে জুতাপালিশের কারখানায় কাজ জুটিয়ে দেয়া হয়েছে ডিকেন্সকে। এ অধ্যায়ের কারণে দুটো ব্যাপার ঘটেছিল তাঁর পরবর্তী জীবনে- ১) খাদ্য আর পানীয়ের ছড়াছড়িই ছিল ডিকেন্সের চোখে প্রাচুর্যের লক্ষণ। (ঝিনুকের পুর ভরা ভেড়ার রান, সেঁকা পনীর... বাড়িতেই এসব ভোজের আয়োজন করতেন তিনি, স্ত্রী ক্যাথরিন সব রকম বাজেটে ভোজসভার ব্যবস্থা করার উপায় লিখে গেছেন।) ২) উপন্যাসে সাধারণ মানুষের জীবনের জয় ঘটাতেন তিনি। মনে আছে, 'আ ক্রিসমাস ক্যারল'-এর খাবারের মেনু ছিল—রোস্ট করা রাজহাঁস, মিন্স পাই, প্লাম পুডিং, লজ্জা-লাল আপেল, রসালো কমলা, নধর নাশপাতি আর খয়েরি চেস্টনাট, একেবারে যা যা ক্রিসমাসে এখনো বানানো হয়, 'ক্রিসমাস ডিনারের জনক' বলা হয় ডিকেন্সকে।
জেমস জয়েসের 'ইউলিসিস'-এ লিওপোল্ড ব্লুম কি খাচ্ছেন? 'লিওপোল্ড গরুভেড়া-হাঁসমুরগির ইনার অরগ্যান তারিয়ে তারিয়ে খেত—লটপটির ঘন স্যুপ, বাদামি গিলা, পুরভরা রোস্ট করা দিল, মুড়মুড়ে গোলায় ভাজা কলিজা, কডমাছের ডিমভাজা। সবচেয়ে ভালোবাসত গ্রিল করা ভেড়ার গুর্দা-জিভে-তালুতে মিশে যেত মিহি পেচ্ছাপের ঘ্রাণ।' চামড়ায়-পেশিতে মোড়া দেহের অন্তিমে লুকোনো যে অঙ্গাবলী, তা খাওয়ার ভেতর কেমন একটা ছিঁড়েখুঁড়ে খাবার স্পৃহা আছে, পড়লে মনে হয় যেন হ্যানিবল লেক্টারের পুর্বপুরুষ!
মার্ক টোয়াইন মাংসের স্টেকের বিবরণ দিতেন—'মস্ত পোর্টারহাউজ স্টেক, দেড় ইঞ্চি পুরু, তপ্ত গ্রিডল থেকে সদ্য নেমেছে- চর্বি বুড়বুড়ি কাটছে এখনো, গোলমরিচের সুগন্ধী ধুলিতে আচ্ছন্ন, আধ-গলা মাখনের ডেলা ইতি উতি ছড়ানো- বড় তরতাজা আর খাঁটি মাখন, মাংসের গা থেকে অমূল্য রক্তরস গিয়ে মিশছে গ্রেভিতে, চারদিকে মাশরুমের দ্বীপমেখলা, বিফস্টেকের এ প্রসারিত ভূখণ্ডের অদূরে নরম হলদে চর্বির ছোট দুখানা শহরতলি, লম্বা শাদা হাড়টা স্যরলয়েন আর টেন্ডারলয়েনকে বিভাজিত করে জায়গামতো জেগে আছে।'
হেমিংওয়ের 'আ মুভাবল ফিস্ট', বেকনের ফালি প্যাঁচানো রিভার ট্রাউট মাছের বিবরণ থেকে শুরু করে হাতে ধরা গাঙফড়িং ছিপের চার বানাবার জন্য গলায় ঝোলানো বোতলে রেখে ঘুরে বেড়ানো, ঝিনুকের তরল মাংসে সমুদ্রের নোনা স্বাদ আর ধাতব স্বাদের মিলমিশটুকু আস্বাদনের পর ঝিনুকের খোলা শূন্য পড়ে রয়- আর পূর্ণতায় ভরে ওঠে ঝিনুকখোরের দেহমন। এ বই চেনায় প্যারিসের পথে ২৫ বছরের ক্ষুধার্ত যুবক হেমিংওয়ের অন্বেষাকে, ভালো বেকারি থেকে আসা সুবাসে যেসব পথ ভুরভুর করছে। তিনি লিখেছিলেন, 'খিদেয় কাতর অবস্থাতে লুক্সেমবার্গ মিউজিয়ামের সমস্ত পেন্টিংই একটু বেশি স্পষ্ট- ধারালো- সুন্দর দেখায়।' শুধু কি আর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ানের দেশলাইবালিকা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ক্ষুধায়!
পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী লেখক মারজোরি কিনান রলিংসের একটি মর্মান্তিক গল্প আমাদের পাঠ্য ছিল- 'আ মাদার ইন ম্যানভিল', আমাদের স্কুলজীবনে ওঁর 'দ্য ইয়ারলিং' উপন্যাসের জাপানি অ্যানিমে সিরিজ সম্প্রচারিত হতো বিটিভিতে। পরে পড়েছি তাঁর রান্নার স্মৃতিকথা 'ক্রস ক্রিক কুকারি' (১৯৪২)। ক্রস ক্রিকে তিনি জীবনের পঁচিশটি বছর পার করেছেন, আঞ্চলিক রান্নার সঙ্গে মেখেজুখে আছে অঞ্চলের আলো-বাতাস, তার একান্ত মানুষজন আর তাদের কৃষ্টি। এত ওমে ভরা কোনো লেখা আমি আজ অবধি পড়িনি, পড়তে পড়তে চলে গেছি শীতকালের ফার্নেসের পাশে ডেভিলস ফুড কেক আর কফি খেতে, পড়ন্ত বিকেলে পর্চের দোলনায় বসে ডোরার আইসক্রিম খেতে। আহা, কোনো রুটির নাম নাকি ভিমরুলের চাক! পাইয়ের নাম 'ব্ল্যাক বটম' (পেছনপোড়া?)! স্যুপের নাম 'গালফ অব মেক্সিকো'! এ বইয়ে রলিংস এক ভক্তের কথা জানান, ভক্ত একবার চিঠি লিখেছিলেন যে- রলিংসের কোনো এক আত্মীয় তাঁর পরিচিত। তা ভক্ত রলিংসের আত্মীয়কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'আচ্ছা, লেখিকা রলিংস দেখতে কেমন?' হৃদয়হীন আত্মীয় জবাব দিয়েছিলেন, 'দেখতে ভালো রাঁধুনীর মতোই, যে রাঁধুনী তার নিজের রান্না ভারী ভালোবাসে!'
রান্নায় আর বেকিংয়ে সিদ্ধহস্ত ছিলেন সিলভিয়া প্লাথ, পঞ্চাশের দশকের স্ত্রী এবং মা, রাঁধতে তো তাঁকে হতোই, রান্নার বই পড়তেও ভারি ভালোবাসতেন তিনি, প্রিয় ছিল ইরমা রমবাওয়ারের 'দ্য জয় অব কুকিং' বইটি। টেড হিউজ ওঁর একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, সিলভিয়া রন্ধনজগতের রাজকুমারী, তাঁর হাতের রান্নার মতো স্বাদ তিনি আর কোথাও পাননি। 'লেডি ল্যাজারাস' লিখবার সময় সিলভিয়া নাকি 'লেমন পুডিং কেক' বেক করছিলেন, ডিম-ময়দা-মাখন-চিনি-ঘোল-লেবুর কাস্টার্ড বানিয়ে কুড়ি মিনিট বেক করে নিলেই হলো, ডিমের সফেদি আর কুসুম আলাদা করে ফেটাতে হবে এই যা। রান্নাবান্নার কাজ যদিচ ক্যাথারসিসের নিষ্কৃতি দেয়, এটা উদ্বেগের কাজও তো বটে। এ পৌনঃপুনিক কাজটা মনোজগতের একটা দুয়ার-আঁটা নিষ্ফলতার জায়গাতেও নিয়ে যেতে পারে। সিলভিয়া তাঁর জার্নালে লিখেছিলেন, 'গার্হস্থ্যের ভেতর পালাও, বিস্কুটের গোলা বোঝাই গামলায় হেঁটমুণ্ডু ডুব দিয়ে টের পাবে- দম আটকে আসছে।' শেষ পর্যন্ত ওভেনে আত্মাহুতি দেয়া সিলভিয়া প্লাথ যেন একটা অসামান্য ফেমিনিস্ট ভাস্কর্য, মনোজাগতিক মেটাফরে পূর্ণ। মেটাফরের কথা যদি বলা হয়, মার্গারিট অ্যাটউডের প্রথম উপন্যাস 'দ্য এডিবল ওম্যান'কে ছাড়া এ আলাপ পূর্ণ হবে না, উপন্যাসটি নাকি তিনি কিচেনেই বসে বসে লিখেছিলেন। খাদ্যকে চরিত্রে এবং পটভূমিতে ব্যবহার করার আরেক সিদ্ধহস্ত লেখক ছিলেন আগাথা ক্রিস্টি, তাঁর খলনায়কেরা খাবারের বেলায় দিলখোলা হেডোনিস্ট ('এন্ডলেস নাইট', 'দ্য ম্যান ইন ব্রাউন স্যুট')। ডেভনের মেয়ে, অতএব ক্রিম বা সর খেতে খুব ভালোবাসতেন আগাথা ক্রিস্টি (ঠিক যেমন বাসতেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্র মিস মার্পল), আগাথার টাইপরাইটারের পাশেই নাকি একটা মস্ত কাপে ক্রিম রাখা থাকত, কাপের গায়ে লেখা ছিল 'লোভ করিও না'।
এমএফকে ফিশারের কথা একটু বলতেই হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পার্ল হারবার আক্রমণের পরপর তিনি লিখলেন বই, 'হাউ টু কুক আ উলফ', কি করিয়া নেকড়ে রাঁধিবে। ডব্লু এইচ অডেন যাঁর তারিফ করে বলেছিলেন, আমেরিকায় তাঁর জানামতে এত ভালো গদ্য আর কেউ লিখতে পারে না। ফুড-রাইটার তিনি, অথচ তাঁর গদ্যের স্থান হতে পারে ফকনার কিংবা হেমিংওয়ের পাশাপাশি। ফিশারের গদ্য ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা মিশিয়ে রান্নাবান্নার গল্প। বিবাহসূত্রে আমেরিকা ছেড়ে ফ্রান্সে এলেন ফিশার। দশ বছরের পুরোনো 'পাটেই' এর চর্বির স্তরে ছত্রাক জমে গেছে- সেটা খুঁচিয়ে উঠিয়ে ভেতরের পাটেই খাওয়ার কথা লিখলেন, শিকার শেষে ঝুলিয়ে রাখা কাদাখোঁচা পাখি হুক থেকে ছিঁড়ে পড়েছে তার নষ্ট মাংস রোস্ট করে ব্র্যান্ডি সহযোগে খাওয়ার কথা, ডিজোঁর প্রাচীন ধরণিতে উৎপন্ন ছোট ছোট সরস ফুলকপির কথা। বর্ণনা শুনে আপাতদৃষ্টে মনে হবে, দারুণ সুখাদ্যকে ফিশার দারুণতর ভাষায় পরিবেশন করছেন। ফিশারের মতে জীবনের মৌলিক চাহিদা ছিল তিনটি—খাদ্য, নিরাপত্তা আর ভালোবাসা, তিনটেই একে অন্যের সঙ্গে এমন জড়িয়ে-পেঁচিয়ে রয়েছে যে একটি ব্যতিরেকে আরেকটির কথা ভাবা অসম্ভব, এ গদ্য তাঁর ক্ষুধার মতোই, স্বাধীনচেতা। আপন হৃদয়দাক্ষিণ্যে সে মানুষের একান্ত ক্ষুধা আর বাসনাকে মুক্তি দিয়েছে।
স্কট ফিটজেরাল্ডের 'অন বুজ' নিয়ে কথা হলো না, জুলিয়া চাইল্ড, এলিজাবেথ ডেভিডের কথাও না, রেবেকা ওয়েস্টের 'ব্ল্যাক ল্যাম্ব অ্যান্ড গ্রে ফ্যালকন', ইসাবেল আলেন্দের 'আফ্রোডাইট', ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের 'কনসিডার দ্য লবস্টার', 'অ্যালোন ইন দ্য কিচেন উইথ অ্যান এগপ্ল্যান্ট', জোয়ান হ্যারিসের বইগুলোর কথা বলা হলো না।
এবার বাংলায় ফিরব আবার। ইতিউতি অনেক রান্নার বিবরণ আছে আমাদের সাহিত্যে, গরিবদের ঈশ্বরবিহীন জেলেপাড়াতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুবেরের পিসি পাড়া মাত করে ইলিশের তেলে ইলিশ রাঁধে। বিমল করের 'ইঁদুর'-এ মলিনা স্বামীর জলখাবারের থালায় গুছিয়ে দেয় দালদায় লালচে করে ভাজা খানচারেক বাসি রুটি, দু-টুকরো বেগুনভাজা আর গুড়। নবেন্দু ভাতের পাতে খায় পেঁপে সেদ্ধ, হলদেটে চালের ভাত, কালো এবং জোলো পালংশাকের তরকারি, কড়ে আঙুলের সমান আর কাঁটায় ভর্তি নদীর ছোট মাছ—বাঙালদের মতো লঙ্কাবোঝাই করে রাঁধা, কিছুই স্বাদু লাগে না, কেননা জীবন হতাশায় আর সন্দেহে বিস্বাদ ('শীতের মাঠ', বিমল কর)।
হতদরিদ্রে আর বনেদীতে খাদ্যাভ্যাসের যে চল আর তার প্রতিফলন তাদের স্বভাবে, এই নিয়ে রবীন্দ্রনাথের 'যোগাযোগ'কে ব্যবচ্ছিন্ন করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী একটা চমৎকার প্রবন্ধমূলক বই লিখেছিলেন, নাম 'কুমুর বন্ধন'। স্বভাবে যে মিনমিনে, উচ্চবংশীয়, সে খায় স্টু, ফল, বার্লি-দুধ; স্বভাবে যে গর্জমান- নিম্নপংঙ্ক্তি থেকে উঠে আসা নতুন পয়সার মালিক—সে পেট ভরিয়ে মন ভরিয়ে খায় মোটা চালের ভাত, কলাইয়ের ডাল, কাঁটাচচ্চড়ি, তেঁতুলের অম্বল। এখানে বিভূতিভূষণের 'পথের পাঁচালী'র বালক অপুর কথা মনে পড়ে গেল, যে পরের বাড়ির কিশমিশ দেয়া মোহনভোগ খেয়ে বুঝতে পেরেছিল বাড়িতে তার মায়ের ঐ জলে সেদ্ধ সুজি আর গুড়ের ক্বাথকে মোহনভোগ বলে না, মায়ের প্রতি সকরুণ সহানুভূতিতে তার আকাশ ভরে উঠেছিল। 'অশনি সংকেত' কিংবা 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' উপন্যাসে 'পুঁইমাচা' বা 'তালনবমী' ছোটগল্পে খাদ্য পটভূমি, খাদ্যই মেরামতযন্ত্র।
গল্পগুচ্ছে বাসনায়-রসনায় আর্টিস্টিক যোগ প্রচুর। যেমন রবীন্দ্রনাথের 'চোরাই ধন'-এ বরফ দেয়া ফলসার শরবতের পাশেই রুপার থালায় গোড়ে মালা, আইসক্রিমের যন্ত্রে জমানো তালশাঁসের পাশে পিরিচে একটি মস্ত সূর্যমুখী! রবীন্দ্রনাথের 'ল্যাবরেটরি'তে নীলচে সবুজ বেনারসী- বাসন্তী কাঁচুলি পরা নীলা সাজিয়ে দিচ্ছে ডালি, তাতে সাজানো দুর্লভ-জাতীয় অর্কিডের মঞ্জরি, রুপোর থালায় বাদামের তক্তি, পেস্তার বরফি, চন্দ্রপুলি, ক্ষীরের ছাঁচ, মালাইয়ের বরফি, চৌকো করে কাটা ভাপা দই। বর্ণনাটি একেবারে আঁকা ছবি। যেমন আঁকা ছবি বুদ্ধদেব বসুর 'মেঘ-বৃষ্টি-রোদ'-এ সফেদ সুগন্ধী সরু চালের ভাতের সাথে মিহি সোনাালি গাওয়া ঘি- গাঢ় সবুজ কাঁচালঙ্কা- টিয়ে সবুজ কাগজিলেবু- 'ঝিরঝিরে আলুভাজা, মুচমুচে কাচকি মাছের ঝুরি। কুচিকুচি নিমপাতা আর খেসাড়ি ডালের বন্ধনে ভাজা বড়া।'
পঁয়ষট্টি বছর বয়েসে বুদ্ধদেব বসু লিখলেন 'ভোজনশিল্পী বাঙালি', তাঁর মতে ইলিশ এক দেহে এতটা প্রতিভা ধারণ করে যে, শুধু ইলিশ মাছ দিয়ে পাঁচ পদ করে মধ্যাহ্নভোজ খাবার উপায় হতে পারে। প্রথম পাতে ইলিশের মুড়োর সাথে স্নিগ্ধ শাদা লাউ, তারপর ইলিশের ঝড়তি পড়তি কাঁটা দিয়ে রাঁধা ঘন মুগডাল আর তার সঙ্গে কালচে-ব্রাউন কড়কড়ে ভাজা গলকাঁটা, তৃতীয় দফায় কাঁচা কুমড়া আর কালোজিরে দিয়ে ইলিশের পাতলা ঝোল- কুমড়া আর মাছ দুইই থাকবে অনতিপক্ক, এরপর শর্ষেবাটা দিয়ে কলাপাতা মোড়া ইলিশপাতুরি, সবশেষে জিভ জুড়ানো 'চিনি-মেশানো পাতিলেবুর একটা ঠান্ডা অম্বল—যাতে বিন্দু বিন্দু কালোজিরে, আর দু-একটা সুবাস-নিস্রাবী কাঁচালংকার সাথে ইলিশের ওঁচা অংশ ল্যাজার দিকটা ভাসমান'। মনে পড়ছে, বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস 'তিথিডোর'-এ স্বাতীর বিয়েতে সতেরো পদের খানা পরিবেশিত হয়েছিল—ফুলকপি দিয়ে রুইমাছ, বেসনে বেগুনের চাকতিভাজা, ভেটকি ফ্রাই, পাপড়, বাঁধাকপি দিয়ে মাছের মুড়োঘন্ট, ছোলার ডালের ছেঁচকি, মটরশুঁটির কচুরি, শর্ষে ভাপা চিংড়ি, পেস্তা দিয়ে পোলাও, মুগডাল, মাংস, টমেটোর চাটনি, জলপাইয়ের টক, কাঁচা ছানার বরফি, রসগোল্লা, রসমালাই, আর পান। যেদিন বাড়িতে বাজার নেই, পড়ে দেখি এই নির্ঘন্ট, হেমিংওয়ে জানেন—খিদে-পেটে উজ্জ্বল হয়ে উঠি।
বাঙালির রসনাবিলাসে আরেক বুদ্ধদেব আছেন, তিনি বুদ্ধদেব গুহ, তাঁর সবজিমন্ডীর বাঈ সকালে কলিজাভাজা-বাকেরখানি খাওয়ায়, ইংরেজির অধ্যাপিকা খাওয়ায় আমেরিকান চপস্যুয়ে, প্রেমিকা খাওয়ায় সাবুর খিচুড়ি। বুদ্ধদেব গুহ শৈশবে আমাদের পড়িয়েছেন 'বাঘের মাংস', পড়িয়েছেন 'ঋভুর শ্রাবণ'-এ কুমিরের ডিম খাওয়ার কথা। লীলা মজুমদার আর তদীয় কন্যা কমলা চট্টোপাধ্যায়ের রচিত 'রান্নার বই' এক অসামান্য সুখপাঠ্য বই, আয়া আমোদিনীর সেই কলার খোসা, মূলার বুকা মিলিয়ে চচ্চড়ির যে বর্ণনা ওতে আছে, তা পড়ে এক বিচিত্র আনন্দ হয়। সাধনা মুখোপাধ্যায়, কবিতা লিখেছেন, রান্নার বইও লিখেছেন। কল্যাণী দত্তর 'থোড় বড়ি খাড়া', শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'বাজার সফর সমগ্র', রাধাপ্রসাদ গুপ্তের 'মাছ আর বাঙালি', স্বপ্নময় চক্রবর্তীর 'গিন্নি যখন বাপের বাড়ি', সোমব্রত সরকারের 'সাধুর হেঁশেল' এবং 'তান্ত্রিকের রান্না' ছাড়া এ লেখা শেষ হওয়া উচিত নয় জানি। শিবরাম চক্রবর্তী আর জসীমউদ্দীনের রসনাস্মৃতি বাদ পড়ল এখানে।
মনে পড়ছে সৈয়দ মুজতবা আলীর স্টিমারঘাটের চিকেনকারির বর্ণনা, কায়রোর রেস্তোরাঁয় পোলাওয়ের পুরভরা শসা খাওয়ার কথা আর সেটস্কয়ার দিয়ে নিখুঁত লাচ্চেদার-পরাটা বানানেওয়ালী 'মণি'কে। রশীদ করিম 'প্রসন্ন পাষাণ'-এ মুসলমান অন্দরমহলের বাবুর্চিখানা, দস্তরখান, খঞ্চা, কফগির চিনিয়েছিলেন আর চিনিয়েছিলেন রান্না (হাড়িয়া কাবাব, লাউয়ের হালুয়া)। গোয়ালন্দ ঘাটের রান্নার অত্যন্ত সুলিখিত সৈয়দ আলী আহসানের বই 'আমার পছন্দ দেশবিদেশের রান্না'তে আছে। স্মরণীয় হয়ে থাকবে দিঘাপাতিয়ার রানি কিরণলেখার বইয়ের সাহিত্যগুণ। বাংলাদেশের পুষ্টিহীন শিশুদের উৎসর্গ করে সিদ্দীকা কবীর তাঁর জনপ্রিয়তম রান্নার বইটি লিখেছিলেন, সাহিত্যমূল্যের বিচারে সে বইটির শুরু আর শেষ দিকের পাতাগুলো কম নয়। সামরান হুদার ফুড রাইটিং আমার খুব প্রিয়। স্মৃতি ভদ্র লিখেছেন 'রসুইঘরের রোয়াক', রান্নাঘর কেন্দ্র করে মেদুর দিনযাপনের কাহিনি- হিন্দু-মুসলমানের সহাবস্থানের ভারী মিষ্টি বুনোট সে স্মৃতিকথার গায়ে। আর কল্লোল লাহিড়ীর 'ইন্দুবালা ভাতের হোটেল', মূলনায়িকা নারীর হোটেল গড়ে তুলবার মনকেমনিয়া গল্প, তাতে মেখে আছে দেশভাগের বিয়োগব্যথা। হায়, ঈশ্বর গুপ্তের কষিত-কনককান্তি তপসে মাছ ভুলে গেলাম কী করে!