ওই ইনিংসের কথা মনে পড়লে গর্ব হয়: আকরাম খান
৪ এপ্রিল, ১৯৯৭। ২৩ বছর আগে আজকের এই দিনেই মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ ক্রিকেটের বীজ বুনেছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, আকরাম খানরা। নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। বৃষ্টি বাগড়ার সেই ম্যাচটি হারলেই কয়েক বছরের জন্য থেমে যেতে পারত বাংলাদেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন যাত্রা।
সেদিনের সেই দিনটা ছিল অধিনায়ক আকরাম খানের। ১৫ রানেই চার উইকেট হারিয়ে ঘোর অন্ধকারে পড়ে যাওয়া দলকে আলোর পথে এগিয়ে নেন আকরাম একাই। আলোক বর্তিকা হাতে ২২ গজে নেমে ৬৮ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে বাংলাদেশকে মহামূল্যবান এক জয় এনে দেন সাবেক এই ব্যাটসম্যান।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাঁক বদলের সেই ম্যাচে আকরাম খানের বীরত্বগাঁথা কেবল ব্যাটিংয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। আগে বোলিং করে দুটি উইকেটও নেন তিনি। দিনটার কথা মনে করতেই যেন ২৩ বছর আগে ফিরে গেলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুঃসময়ের এই সেনানী। ম্যাচটার কথা মনে করিয়ে দিতেই আকরাম খান বলে উঠলেন, 'দিনটা শুক্রবার ছিল। অনেক কঠিন অবস্থা হয়ে গিয়েছিল।'
আইসিসি ট্রফির অবিস্মরণীয় সেই ম্যাচের অনেক কিছু নিয়েই দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন বর্তমানে বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বরত আকরাম খান।
টিবিএস: আইসিসি ট্রফির সেই ম্যাচটার কথা মনে পড়লে কেমন অনুভূতি কাজ করে? দুর্দান্ত জয়ের সেই তৃপ্তি এখনও কাজ করে কিনা?
আকরাম খান: আমরা ৯৪ তে ফেবারিট ছিলাম। কিন্তু সেবার কোয়ালিফাই করতে পারিনি। ১৯৯৭ সালে যেহেতু আমাদের সামনে সুযোগ ছিল, বিশ্বকাপ খেলার একটা সুযোগ এসেছিল, তো আমরা সেভাবে চেষ্টা করি। প্রথম তিনটা দল বিশ্বকাপে খেলবে, আমরা সেভাবে এগোচ্ছিলাম। খুব ভালোভাবেই এগোচ্ছিলাম আমরা। ওই ম্যাচটায় এমন একটা অবস্থা হয়েছিল যে, ওই ম্যাচটা যদি আমরা হারতাম বা টাই হতো, তাহলে আমরা সেমিফাইনাল খেলতে পারতাম না। ওখান থেকেই বিদায় নিতে হতো।
অনেক কঠিন একটা অবস্থা হয়ে গিয়েছিল। ওরা ১৭০ (১৭১) রান করেছিল, ৫০ ওভারে খুব সহজ একটা লক্ষ্য ছিল। কিন্তু ১৪ রানেই (১৫ রান) আমাদের চারটা উইকেট চলে যায়। আতহার আলী, দুর্জয়, বুলবুল, সানোয়ার আউট হয়ে যায়। এরপর দলগত পারফরম্যান্স ছিল। আমি একটা ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছিলাম। অসাধারণ একটা ম্যাচ ছিল।
টিবিএস: ব্যাটিংয়ে কান্ডারির ভূমিকায় হাজির হওয়ার আগে বল হাতেও অবদান রেখেছিলেন। দুই উইকেট নিয়েছিলেন। আপনার ব্যাটিং-বোলিং নিয়ে যদি আরেকটু বিস্তারিত বলতেন...
আকরাম খান: আমরা অ্যাস্টোটার্ফে খেলতাম, ওই আইসিসি ট্রফিটা অ্যাস্টোটার্ফে হয়েছিল। ওখানে আমি বোলিংও করতাম। আমাদের বোলিং-ফিল্ডিং ভালো ছিল। কিন্তু ব্যাটিংয়ে আমাদের শুরুটা খুব বাজে ছিল। আবার বৃষ্টি হয়েছিল। খেলা কাটল ওভারে গিয়েছিল। তখন কিন্তু ওভারে ৬ রান করে তোলা অনেক বড় টার্গেট ছিল। তখন খুব কঠিন ছিল, হাতে উইকেটও ছিল না। ৬ জন ব্যাটসম্যান নিয়ে খেলেছি আমরা, এর মধ্যে চারজন আউট হয়ে যায়। তো সবার দোয়া ছিল, আমি খুব ভালোভাবে ইনিংসটা খেলি। আমার স্মরণীয় ইনিংসগুলোর মধ্যে এটা একটা।
টিবিএস: ১৫ রানে চার উইকেট পড়ার পর কী মনে হচ্ছিল? ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়ার আত্মবশ্বাস কী তখন পাচ্ছিলেন?
আকরাম খান: খুব কঠিন অবস্থা ছিল। কারণ আরও অনেক হিসাবই ছিল। শুধু যে ব্যাটিং করে জিতব, সেটাই না, বৃষ্টি একটা ব্যাপার ছিল। বৃষ্টির মধ্যে খেলা হবে কিনা, যদি না হয় পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়ে যাবে। আর পয়েন্ট ভাগাভাগি হয়ে গেলে আমরা সেমিফাইনালে উঠব না। শুধু রান তাড়ার ব্যাপারই ছিল না, এসব ব্যাপারও মাথায় কাজ করছিল। সময় বেধে দেওয়া হয়েছিল। আবার যদি বৃষ্টি হতো, তাহলে কিন্তু এক পয়েন্ট নিয়ে আমাদের বাদ পড়তে হতো।
টিবিএস: ৬৮ রানের সেই ইনিংসটা আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে যুক্ত না থাকলেও বাংলাদেশের ক্রিকেটে ইনিংসটার গুরুত্ব অনেক। ইনিংসটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
আকরাম খান: তখন তো আসলে তেমন ম্যাচ খেলার সুযোগ ছিল না। কারণ আমাদের যখন বয়স ছিল, ফর্মে ছিলাম, আমরা সেভাবে ম্যাচ খেলতে পারিনি। আমরা দুই বছরে তিনটা এশিয়া কাপের ম্যাচ খেলতাম শ্রীলঙ্কা, ভারত, পাকিস্তানের বিপক্ষে। তখন আমরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাইনি। তখন আমাদের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেতে হবে।
সেটার জন্য আমাদের প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে। তারপরও কিছু ইনিংস থাকে যেসবের অনেক মূল্য। তো ওই ইনিংসের কথা মনে পড়লে আমার গর্ব হয় যে, এমন একটা ইনিংস দেশের জন্য খেলতে পেরেছি। এবং দেশ আজ একটা ভালো পর্যায়ে চলে গেছে।
টিবিএস: ইনিংসটা আপনার ক্যারিয়ারের সেরা তিনের মধ্যে আছে কিনা? বাংলাদেশের ক্রিকেটে ওই ইনিংসটার কুতটুকু গুরুত্ব আছে বলে মনে করেন?
আকরাম খান: হ্যাঁ, অবশ্যই এটা সেরা তিন ইনিংসের মধ্যে থাকবে। শুধু ভালো ব্যাটিংয়ের কারণে এই ইনিংসটা থাকবে, তা নয়। একটা ইনিংসের খুব দরকার ছিল ওই ম্যাচে। কারণ ওই ম্যাচটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের অবস্থা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আজ সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ বের হলো, বাংলাদেশ ভালো খেলছে, অনেক দলকে হারাচ্ছে, এগুলো যখন দেখি তখন খুবই ভালো লাগে। আর ওই সময়ের কথা মনে পড়ে।
টিবিএস: ব্যাট হাতে অপরাজিত ৬৮ রান করার আগে বল হাতেও দুই উইকেট নেন। দিনটা আপনারই ছিল…
আকরাম খান: ওদিন শুক্রবার ছিল। দিনটা আমাদের ছিল কিনা জানি না। তবে এটা বিশ্বাস করেছি যে, সবাই আমাদের জন্য দোয়া করেছে। তো দিনটা শুধু আমার না, দিনটা বাংলাদেশেরই ছিল। কারণ ম্যাচটা বাংলাদেশের জেতার কথা ছিল না।
টিবিএস: অধিনায়ক হিসেবে এমন একটি ম্যাচে সামনে থেকে নেতৃত্বে দেয়ার ঘটনা মনে পড়লে কেমন অনুভূতি কাজ করে? ওই সময়ে কেমন অনুভূতি কাজ করছিল?
আকরাম খান: অদ্ভুত এক আনন্দ কাজ করছিল সেই ম্যাচের পর। আমি যেটা বললাম, ম্যাচ জেতার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশকে একটা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। সেটা আমরা করতে পেরেছি। ওই ম্যাচের পর দলের চেহারা বদলে যায়। আমরা কেনিয়াকে হাারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হই। যদিও কেনিয়া তখন খুব ভালো দল। আমাদের চেয়ে অনেক ভালো দল ছিল ওরা। ওই স্মৃতি মনে পড়লে অবশ্যই খুব ভালো লাগে।
টিবিএস: আপনাদের সময়ে সুযোগ-সুবিধা বলতে তেমন কিছুই ছিল না। অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন সবই আছে। এই পরিবর্তনের ব্যাপারটি কীভাবে দেখেন?
আকরাম খান: তখন আমাদের এমন সুযোগ-সুবিধা ছিল না। কিন্তু আমাদের অনেক ইচ্ছা ছিল যে, কোয়ালিফাই করতেই হবে। তখন কিন্তু বাংলাদেশের সেরা খেলা ছিল ফুটবল। আমাদের মাঠ থাকতো না, কোনো সুযোগ-সুবিধা থাকতো না। তারপরও আমরা সেটা করতে পেরেছি। স্বাধীনতার পর আইসিসি ট্রফিটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় একটা অর্জন ছিল। সবাই অনেক বেশি খুশি হয়েছিল আমাদের ওই অর্জনে। ২৬ বছর পরও আপনাদের মনে আছে, এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন।
আইসিসি ট্রফি, ১৯৯৭
বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডস: ৪৯.৫ ওভারে ১৭১/১০ (ডি লিডি ২৩, ক্যানট্রেল ৩৭, ওসটারম ৪০; রফিক ২/৩৩, আকরাম ২/২১)।
বাংলাদেশ: ৩১.৪ ওভারে ১৪১/৭ (আকরাম ৬৮*, নান্নু ২২; লেফেব্রে ৩/৮)
ফল: বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী (ডিএল পদ্ধতিতে)।
ম্যাচ সেরা: আকরাম খান