কোচ নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মাশরাফি
দীর্ঘদিন জাতীয় দলের বাইরে আছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ২০২০ সালের মার্চের পর ওয়ানডের সফলতম এই অধিনায়কের গায়ে বাংলাদেশের জার্সি গায়ে ওঠেনি । কিন্তু দলে না থাকলেও দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত নিজের ভাবনার কথা জানান মাশরাফি।
কয়েকদিন আগে উইকেটকিপিং নিয়ে মুশফিকুর রহিম ও নুরুল হাসান সোহানের মধ্যে তৈরি করা প্রতিযোগিতাকে অসুস্থ বলেছিলেন তিনি। এবার জাতীয় দলের কোচ নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেন অভিজ্ঞ এই ক্রিকেটার।
প্রোফাইল, বাংলাদেশ দলকে নিয়ে জমা দেওয়া পরিকল্পনার ভিত্তিতে কোচ নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু মাশরাফির প্রশ্ন বাংলাদেশের ক্রিকেট, এখানকার সংস্কৃতি, ক্রিকেটারদের সম্পর্কে কোচদের ধারণা আছে কিনা; সেটা কতোটা বিবেচনায় নেওয়া হয়।
মাশরাফির মতে এসব বিষয় প্রাধান্য দিয়েই কোচ নিয়োগ দেওয়া উচিত। তার পরামর্শ, হাই প্রোফাইল কোচ নয়, দেশি কোচ নিয়োগ দেওয়া হোক। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেট সংস্কৃতি, ক্রিকেটারদের সম্পর্কে ধারণা থাকা বিদেশি কোচ নিয়োগ দিলে তা নিয়ে আপত্তি নেই দেশের সফলতম এই পেসারের।
এ নিয়ে ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে দীর্ঘ একটি পোস্ট দিয়েছেন মাশরাফি। তার পোস্টটি তুলে ধরা হলো-
'কোচ যখন নিয়োগ দেওয়া হয়, সেটার প্রক্রিয়া আসলে কী থাকে, তা জানার খুব ইচ্ছা আমার। এ যাবতকালে প্রায় ৯-১০ জন কোচের সাথে কাজ করেছি আমি। যতটুকু দেখেছি, প্রত্যেকটা কোচ তার নিজের মতো করে কাজ শুরু করে, যেটা করাটাও স্বাভাবিক। কারণ একেকজনের কাজের ধরন একেক রকম। কিন্তু সব সময় দেখেছি প্রত্যেকটি কোচ তার নিজস্ব একজন বা দুজন প্রিয় খেলোয়াড় বানিয়ে নেয়, যা পরে নির্বাচক, অধিনায়ক বা অন্য কেউ তাকে আর কিছুই বোঝাতে পারে না।
সম্পর্কগুলো জটিল হতে থাকে আর ওই পছন্দের জন্য সে আবার দুজনকে এমন অপছন্দ করা শুরু করে যে, তাদের আর দেখতেই পারে না। এক পর্যায়ে এমন জিদ শুরু করে যে, প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিব, এমন কথা প্রকাশ্যেও শুনেছি কয়েকবার কোচের মুখে। আমার পয়েন্ট হলো, কোচের পছন্দ নির্দিষ্ট কিছু খেলোয়াড় হতেই পারে। সেটা সব কোচেরই হয়, অনান্য দেশেও হয়, এটাই স্বাভাবিক। তবে কখনও সেটা বুঝতে দেয় না, অনুমান করতে হয়।
কারণ দলের সেরা ৩-৪ জন খেলোয়াড়ই শুধু ম্যাচ জেতায় না। আর জেতালেও আপনি একজনের জন্য আরেকজনকে ছোট করতে পারেন না। দর্শক বা সাংবাদিক অনেক কিছু লিখতে পারে, বলতেও পারে, যেটা একদম স্বাভাবিক ব্যাপার। কোচকে বলা হয় (ফাদার অফ দ্য সাইড) সে সবাইকে দেখে রাখবে, প্রয়োজনে কঠোর হবে আবার দলের সার্থে যাকে প্রয়োজন তাকে ব্যাবহার করবে। তার সব কিছুই হতে হবে ইতিবাচক।
কারও প্রতি কঠোর কারও প্রতি নমনীয়, এটা এক রকমের বৈষম্য তৈরি করে আমাদের দেশে। যা গোছানো দলকে অগোছালো করে ফেলে। এক পর্যায়ে তারা আবার নিজেদের দেশে, না হলে আইপিএল বা আরও ভালো কোনো প্রস্তাব পেয়ে চলে যাবে। কারণ এতোদিনে সে আমাদের দেশের ক্রিকেটকে নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের অভিজ্ঞতা বাড়িয়েছে। নিজের প্রোফাইলও ভারি করেছে। বেতন তো নিয়েছে মাসে ১২-১৫ লাখ টাকা। আর আমাদের কোচরা না খেয়ে মরে। গালিও দেখি আমাদের কোচরাই হজম করে। পরে ওনারা চলে গেলে আমরা পড়ি বিপদে। আবার নতুন কোচ, নতুন পরীক্ষা, নতুন দাবি মেটানো। এভাবেই চলছে বাংলাদেশে কোচদের আসা যাওয়া।
এবার আসি আমার প্রথম লাইনটায়, কোচ নিয়োগের সময় যে নতুন কোচের ইন্টারভিউ নেওয়া হয়, সেখানে আসলে তাকে কী প্রশ্ন করা হয়? আদৌ কি করা হয় কোনো প্রশ্ন? নাকি শুধু জানতে চাওয়া হয় তোমার কী করার ইচ্ছা? হয়তো তখন সে কিছু পয়েন্ট তুলে ধরে। ওখান থেকে নতুন কিছু পেলে চিন্তা করে দারুণ কোচ, কী সুন্দর পরিকল্পনা, এর মতো কোচই হয় না।
আমার তো মনে হয় ভুল ওখানেই হয়ে যায়। কারণ আমরা মানুষকে বোঝাতে সব সময় হাই প্রোফাইল কোচ খুঁজি, যা পরে আর কোনো কাজে আসে না। আমাদের প্রয়োজন আমাদের ক্রিকেট যে অনুসরণ করে বা আমাদের বেশিরভাগ খেলোয়ারদেরকে নিয়ে স্টাডি করে এসে ইন্টারভিউ দিচ্ছে, তাকে বাছাই করা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা নিয়ে আসা। তা না হলে সে তো বুঝবেই না একজন সাকিব, তামিম, মুশফিক, রিয়াদ তৈরি করতে কতো দিন লেগেছে। কিংবা অতীতে তাদের অবদান কী। একজন মুস্তাফিজ কীভাবে উঠে এসেছে। বারবার বলেছি, আবারও বলছি দলের আগে কখনোই কোনো খেলোয়াড় হতে পারে না, ভালো না করলে বাদ পড়তেই হবে।
অফ ফর্ম সব খেলোয়াড়ের জীবনেই যায়। বাদও পড়ে, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট থেকে অপমানিত শুধু আমাদের দেশেই বেশি হয়। পারর্ফম না করলে বাদ দেবেন স্বাভাবিক। সহযোগিতা করতে হবে কীভাবে তাকে ফর্মে আনা যায় বা তাকে মানসিকভাবে কীভাবে সাপোর্ট করা যায়। কোনোভাবেই আপনি বুঝতে দিতে পারেন না যে আপনি তাকে আর আপনার সময়কালে দেখতে চান না। এটার কারণ একটাই, কোনো কোচই আমাদের দেশে কাজ করার আগে আমাদের দেশের ক্রিকেটের ফলোয়ার না। চাকরির জন্য আসে, শেষ হলে চলে যায়। তাই আমার মনে হয়, হাই প্রোফাইল নয়; আমাদের প্রয়োজন, আমাদের কোচ, বাংলাদেশের কোচ। একদম নিজস্ব মতামত, আপনাকে মানতে হবে; তা বলিনি।'