পাড়ার ক্রিকেটে ব্যাটিং না পাওয়া মাহমুদুলই স্বপ্ন ছোঁয়ার নায়ক
ছোট বেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক। টেপ টেনিসে পাড়ার কিংবা স্কুল ক্রিকেটে মাহমুদুল হাসান জয়ের আগ্রহের শেষ ছিল না। বিকেল হলেই ভোঁ দৌড়, লুকিয়ে ছুটে যেতেন মাঠে। কিন্তু মাঠে গিয়ে মন খারাপ হয়ে যেতো তার। বড় ভাইদের ব্যাটিং অর্ডারে জায়গা হতো না মাহমুদুলের। পুরো ম্যাচে কেবল ফিল্ডিংয়েই অবদান রাখার সুযোগ মিলতো। খুব মন খারাপ হতো মাহমুদুলের, হতাশ মনে বাড়ি ফিরতেন।
বাড়ি ফেরার পথটাই ছিল মাহমুদুলের সবচেয়ে আপন। ওই ফেরার পথটা ছিল তার জন্য কেবলই সংকল্প স্থির করার, যে পথে হাঁটতে হাঁটতে অন্য কিছুই মাথায় আসত না। ভালো ব্যাটসম্যান হতে হবে, দেখিয়ে দিতে হবে বড় ভাইদের। ছোট্ট সেই মাহমুদুলের বিরাট জিদ আজ বিশ্ব কাঁপিয়ে দিলো। বাংলাদেশকে যুব বিশ্বকাপের স্বপ্নের ফাইনালে তোলা মাহমুদুল হাসানের ছোট বেলার গল্পটা এমনই।
এতোক্ষণে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যানের নামটা ইন্টারনেটে ছেয়ে গেছে। মাহমুদুল স্তুতি চলছে সবখানে। এমন সময় আনন্দ অশ্রুতে নিশ্চয়ই চোখ ভিজে উঠেছে বাবা আবুল বারেকের। নিজের মতো ছেলেকেও ব্যাংকার বানানোর স্বপ্ন ছেড়ে আবুল বারেক এখন পুরোদস্তর ক্রিকেটভক্ত। ছেলের একটা বলও যেন মিস না হয়, এ জন্য সব চেষ্টাই থাকে তাঁর।
২০০০ সালে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে জন্ম নেয়া মাহমুদুল যুব বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে যেন ছোট বেলার বড় ভাইদের ভূমিকায় চলে গিয়েছিলেন! তিনে ব্যাটিংয়ে নেমে একাই প্রায় সব রান করে ফেলেন তিনি। খেলেন ১২৭ বলে ১৩টি চারে ১০০ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস।
তার এই ইনিংসটি বাংলাদেশকে কেবল প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপের ফাইনালেই তোলেনি, ইতি টেনেছে যুবাদের আসরে দীর্ঘ ২২ বছরের অপেক্ষার। এ ছাড়া, আইসিসির ছেলেদের ইভেন্টে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়ের দল যেটা কখনও করে দেখাতে পারেনি, তার ব্যাটে রচিত হয়েছে সেই ইতিহাস।
সেই ১৯৯৮ সাল থেকে যুব বিশ্বকাপে খেলে আসছে বাংলাদেশ। এবার নিয়ে ১২তম বারের মতো যুবাদের আসরে লড়ছে বাংলাদেশ। এরআগে যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্বপ্ন বয়ে বেড়িয়েছেন আশরাফুল, তামিম, মুশফিক, মিরাজ, শান্তরা। কিন্তু বাংলাদেশের এসব ক্রিকেট কান্ডারির কারোরই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মিরাজের নেতৃত্বে ২০১৬ সালে ঘরের মাঠে তৃতীয় স্থানই ছিল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য।
আকবর আলী-মাহমুদুল হাসানরা এবার শেষ চারের বাধা টপকে দলকে তুললেন ফাইনালে। ৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের বিপক্ষে শিরোপার লড়াইয়ে মাঠে নামবে বাংলাদেশ যুবারা। ফাইনালে ওঠার লম্বা এই পথে দলের প্রয়োজনে বিভিন্ন পজিশনে ব্যাটিং করেছেন মাহমুদুল।
গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিনে নেমে অপরাজিত ৩৮ রান করেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। পরের ম্যাচে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ব্যাটিং অর্ডার পাঁচে নেমে গেলেও মাহমুদুল পেয়েছেন রানের দেখা। এই ম্যাচে ৩৫ রানের হার না মানা ইনিংস খেলেন ভারতের ব্যাটিং কিংবদন্তি রাহুল দ্রাবিড় ও সাকিব আল হাসানকে আদর্শ মানা মাহমুদুল।
গ্রুপ পর্বের পরের দুই ম্যাচে হাসেনি তার ব্যাট (০, ৩)। কিন্তু বৃহস্পতিবার প্রিয় প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ডকে সামনে পেতেই তরবারিতে পরিণত হলো মাহমুদুলের ব্যাট। খেললেন চোখ ধাঁধানো এক ইনিংস। চলতি যুব বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচে ৫৮.৬৬ গড়ে ১৭৬ রান করেছেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। যা বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
নিউজিল্যান্ডকে সামনে পেলেই যেন ছন্দ খুঁজে পান মাহমুদুল। গত বছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রানের ফোয়ারা বয়েছিল তার ব্যাটে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ছয় ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের তৃতীয় ম্যাচে ৯৯ রানে আউট হলেও পরের ম্যাচে মাহমুদুল খেলেন ১০৩ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস।
কিউই যুবাদের বিপক্ষে মাহমুদুলের ইনিংসটি বলে দেয়, এখন তিনি অনেক পরিণত। এখন তার চিন্তা দল নিয়ে, স্ট্রাইক রোটেট করা নিয়ে। এখন আর নিজের ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে ভাবেন না এই তরুণ তুর্কি। ম্যাচ সেরার পুরস্কার নিতে গিয়ে মাহমুদুলও সেটা মনে করালেন, ‘চিন্তা ছিল উইকেটে থাকার। স্ট্রাইক রোটেট করার।’
ছোটদের হাতে বিরাট কাজ। ছেলেদের আইসিসি ইভেন্টে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠলো বাংলাদেশ। আর যেখানে বড় অক্ষরে লেখা থাকলো মাহমুদুল হাসানের নামটি।