ফুটবলে কোথা থেকে এলো হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ?
হাঁটু গেড়ে বসা এখন ক্রীড়াজগতে প্রতিবাদের ভাষায় রূপ নিয়েছে। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এ পথ বেছে নেওয়া হয়েছে। ফুটবল খেলা শুরুর আগে এভাবে প্রতিবাদ জানানো বিস্তার লাভ করে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে। যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণকায় এক ব্যক্তিকে বর্বরোচিতভাবে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদের এ ভাষা ব্যবহার হতে থাকে। হতভাগ্য সে ব্যক্তিটি হলেন জর্জ পেরি ফ্লয়েড। নিরস্ত্র এই কালো আদমিকে গ্রেফতার করার নামে বর্বরভাবে হত্যা করেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক শভিন। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে ঘটে এ হত্যাকাণ্ড।
এ হত্যার প্রতিবাদে ইংল্যান্ডের পুরুষ ও নারী উভয় ফুটবল দলই হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানানোর পদ্ধতি গ্রহণ করে। ২০২১ ও ২০২২-এর গরমকালে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নে এভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে তারা।
কোভিড-১৯-এ সৃষ্ট মহাঅচল অবস্থা কাটিয়ে পুনরায় পুরোদমে ফুটবল শুরু হয় ২০২০-এর গরমকালে। সে সময় ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগের খেলোয়াড়রা হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানানোর প্রথায় অটল থাকেন।
এই ফুটবল মওসুম শুরুর আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, প্রতি ম্যাচের আগে প্রতিবাদ জানানোর বদলে বিশেষ বিশেষ সময়ে প্রতিবাদ জানানো হবে।
প্রতিবাদে নাখোশ অনেকেই
রক্ষণশীল ঘরানার রাজনীতিবিদের অনেকেই এভাবে প্রতিবাদ জানানোয় খুশি হতে পারেননি। নখোশ চিত্তে তারা বলেন যে এ প্রতিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ধরনের রাজনৈতিক বক্তব্য। এ দলে রয়েছেন ব্রিটেনের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল। ইউরো ২০২০ শুরুর আগেভাগে তিনি আর চুপ থাকতে পারলেন না। বলেই বসলেন, এ-জাতীয় তৎপরতায় যারা অংশ নিচ্ছেন তাদেরকে সমর্থন করা যায় না। দেশটির বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী গিলিয়ান কিগান প্রতিবাদের বিপক্ষেই ছিলেন। তিনি মন্ত্রী হওয়ার আগে দাবি করেন, হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে বিভক্তির সৃষ্টি হবে। আরেক ধাপ এগিয়ে যান রক্ষণশীল দলের এমপি লি অ্যান্ডারসন। তিনি ইউরো ২০২০-এর ইংল্যান্ডের খেলা দেখতে সরাসরি অস্বীকার করেন। তার কথা হলো, প্রতিবাদের এ ধারার সাথে জড়িয়ে রয়েছে রাজনীতি এবং তিনি সে রাজনীতি মানেন না।
ফুটবলানুরাগীদের অনেকেই হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানানোর বিরোধিতা করে ধিক্কারমূলক শব্দ করেছেন।
কেউ কেউ যুক্তি দেন, এ ধরনের প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বা কালো জীবনেরও মূল্য আছে নামের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করা হয় না। বরং হাঁটু গেড়ে বসে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার সংস্থার প্রতিই কেবল সমর্থন জানানো হয়।
ইংল্যান্ডের ফুটবল ম্যানেজার গ্যারেথ সাউথগেটের দাবি ভিন্ন। তিনি বলেন, 'ইংল্যান্ডের টিম যে প্রতিবাদ দেখাচ্ছে তার মধ্য দিয়ে মোটেও ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার সংস্থার প্রতি সমর্থন জানানো হচ্ছে না। ২০২১-এর জুনে তিনি আরও বলেন, এমন এক পরিস্থিতি হয়েছে যে কেউ কেউ এই প্রতিবাদকে রাজনৈতিক ভূমিকা বলে ভাবছেন। এ ধরনের রাজনীতিকে তারা সমর্থনও করেন না। কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ থেকে আমরা ফুটবল খেলোয়াড়রা এমন প্রতিবাদ জানাচ্ছি না, বরং আমরা একে অন্যের প্রতি আমাদের সমর্থন জ্ঞাপন করছি।'
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ডাউনিং স্ট্রিট বলেছে, বিশ্বকাপের খেলায় খেলোয়াড়দের হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানাবে তারা।
জুনে ন্যাশনস লিগের খেলায় হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানানোর কর্মসূচি পালান করার সময়ে হাংগেরীয় ফুটবল-ভক্তরা ইংল্যান্ডের দলকে উৎসাহ জোগায়। বুদাপেস্টের সে প্রতিযোগিতায় দর্শকসারিতে যদিও অধিকাংশই ছিল শিশু বয়সি ।
হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদের গোড়ার কথা
মার্কিন ফুটবল খেলোয়াড় কলিন ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে হাঁটু গেড়ে প্রতিবাদ জানান। একটি প্রতিযোগিতায় পূর্বে মার্কিন জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময়ে এভাবে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন তিনি। এখানেই থেমে যাননি তিনি। তিনি আরও বলেন, কালো হওয়ার কারণে যে দেশে নির্যাতনের অসহায় শিকার হতে হয় সে দেশের জাতীয় সংগীতে গৌরব অনুভব করার বা সম্মান দেখানোর কিছু নেই।
বর্ণবাদবিরোধী তার এই বিবৃতি 'সুরের আগুনের' মতোই ছড়িয়ে পড়ল। ক্রীড়াজগতে এভাবে প্রতিবাদ জানানোর ধারা চালু হলো। অন্যদিকে বর্ণবাদী প্রতিবাদের সময়ও এভাবে হাঁটু গেড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হতে থাকল।
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারের বেলায় এ ভাষাকে প্রতিবাদের পন্থা হিসেবে গ্রহণ করা হলো। জর্জ ফ্লয়েডের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরও প্রতিবাদ জানাতে ব্যবহার করা হলো এটি।
আরও হয়েছে প্রতিবাদ
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে মেক্সিকো অলিম্পিকে, মেডেল রোস্ট্রাম বা পদক বেদিতে উঠে টমি স্মিথ এবংও জন কার্লোস মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত তুলে প্রতিবাদী সালাম দেন। প্রতিবাদের এ ধারা ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালিউট নামে পরিচিতি পায়।
১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় সম্মান দেখিয়ে উঠে দাঁড়াতে অস্বীকার করেন দেশটির বাস্কেটবল তারকা মাহমুদ আবদুল রউফ। মার্কিন পতাকাকে জুলুমের প্রতীক হিসাবে বর্ণনা করেন তিনি।
লেব্রন জেমস ও অন্যান্য বাস্কেটবল খেলোয়াড় ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে 'আমি শ্বাস নিতে পারছি না' লেখা টি-শার্ট গায়ে মাঠে নামতেন। নিউইয়র্কে পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে প্রাণ হারানোর আগে এরিক গার্নার এ কথাগুলো বলেছিলেন।