রোমাঞ্চ নাকি সাফল্য? দুনিয়াজুড়ে ব্রাজিলের ফুটবলের এত সমর্থক কেন
একদিকে খুব নিচ দিয়ে উড়ে যাওয়া এফ-১৬ ফাইটার জেটের গর্জন, অন্যদিকে ৬০ হাজার ব্রাজিল ভক্তের গোল উদযাপনের গর্জন? কোন আওয়াজ বেশি জোরালো?
বৃহস্পতিবার লুসাইল স্টেডিয়ামে সার্বিয়ার বিপক্ষে ব্রাজিলের হয়ে রিচার্লিসন দ্বিতীয় গোলটি করতেই এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। এফ-১৬-এর কোনো আওয়াজই কানে ঢুকল না ব্রাজিল সমর্থকদের উল্লসিত গর্জন ছাপিয়ে।
সার্বিয়ার বিপক্ষে এই ম্যাচে স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় ৮৯ হাজার দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে ব্রাজিল। যে দুবার গোল হয়েছে, প্রতিবারই ব্রাজিল ভক্তদের গগনবিদারী চিৎকারে গোটা তল্লাট কেঁপে উঠেছে।
ব্রাজিলিয়ানরা ফুটবল বলতে পাগল—এ তো গোটা দুনিয়া জানে। তবে এই ব্রাজিলের ভক্ত-সমর্থক ছড়িয়ে আছে দুনিয়াজোড়া।
বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিলের পতাকা, খেলোয়াড়দের ম্যুরাল, ব্রাজিলের অতীত ও বর্তমানের কিংবদন্তিদের খেলোয়াড়দের নাম ও ছবি সংবলিত পতাকা ও রেপ্লিকা টি-শার্টে সয়লাব হয়ে যায় ভারতের কোলিকোড ও পাকিস্তানের লিয়ারি।
এখন এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে দোহা-র নাম।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লুসাইল স্টেডিয়ামে জড়ো হওয়ার ব্রাজিল সমর্থকদের অধিকাংশই অ-ব্রাজিলীয়। কিছু পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এই সমর্থকদের গায়ে 'ভুয়া ভক্ত' তকমা সেঁটে দিয়েছে। কিন্তু এই মানুষগুলো যে আন্তরিকতা ও আবেগ নিয়ে ব্রাজিলের জন্য গলা ফাটিয়েছেন, তাতে বিন্দুমাত্র খাদ নেই। ব্রাজিলের ফুটবলাররা দশকের পর দশক ধরে ফুটবলকে যা দিয়ে গেছেন, তার জন্যও গলা ফাটিয়েছেন এই সমর্থকরা।
ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতেছে গুনে গুনে পাঁচবার। তাদের চেয়ে বেশিবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি আর কোনো দল। ব্রাজিল দুবার ফাইনালে হেরে রানার-আপ হয়েছে, আর দুবার তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। হ্যাঁ, এই সাফল্য গোটা দুনিয়ায় ব্রাজিলের এত এত ভক্ত তৈরির বড় কারণ…কিন্তু দলটির বিপুল ভক্তগোষ্ঠী তৈরি পেছনে আরও দুটি কারণ আছে—এক. রোমাঞ্চ, দুই. ফুটবল-নৈপুণ্য।
ভারতের কেরালা রাজ্যের বাসিন্দা আশিক বৃহস্পতিবার ব্রাজিলের খেলা দেখার পর আল জাজিরাকে বলেন, 'ওরা যেভাবে খেলে—ওহ খোদা—অসাধারণ…তারচেয়েও বেশি কিছু। [ওদের] গতি, আক্রমণ, স্টাইল—শ্বাসরুদ্ধকর।'
ব্রাজিলকে এসব বিশেষণে ভূষিত করার সময় উত্তেজনায় রীতিমতো কাঁপছিলেন তিনি।
আশিক জানান, 'ব্রাজিলকে কবে থেকে সমর্থন করা শুরু করেছি, মনেও নেই। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের জন্য আমি খুশি। ওরা যেভাবে একের পর এক দারুণ সব খেলোয়াড় দিয়ে যাচ্ছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর।'
আরেক ব্রাজিলভক্ত জর্ডানের লায়েথ। তিনি অবশ্য কবে থেকে এবং কেন হলুদ জার্সিধারীদের সমর্থন দিচ্ছেন, তা স্পষ্ট মনে করতে পারলেন।
'সেই ছোটবেলা থেকে ওদের খেলা দেখছি। ওদের খেলা দেখার অভিজ্ঞতা অসাধারণ: কী দারুণ সামর্থ্য, নৈপুণ্য,' আল জাজিরাকে বলেন তিনি। 'দ্বিতীয় গোলটাই দেখুন না [রিচার্লিসনের বাই সাইকেল কিকে করা গোলটি]—বুঝে যাবে কীসের কথা বলছি আমি। আর কোনো দল এরকম গোল করতে পারবে না। শুধু ব্রাজিল পারবে।'
কাতারে বিশ্বকাপ দেখতে এসেছেন দুই মেক্সিকান বন্ধু ক্যারিনা ও মেরারি। মেক্সিকান জাতীয় দল তাদের প্রথম প্রেম হলেও বৃহস্পতিবার দুজনেই গলা ফাটিয়েছেন ব্রাজিলের সমর্থনে।
কারিনা জানালেন, 'এর কারণ, ওরাও আমেরিকার দেশ। তবে বড় কারণ ফুটবল।'
'আমি খেলোয়াড়দের জন্য ওদের ভালোবাসি। যে মানের তারকা আছে, সেজন্য ভালোবাসি ওদের। আমরা মেক্সিকান, কিন্তু ফুটবল ভালোবাসি। এখানে ম্যাচ দেখতে আসার কারণ সেটাই,' পাশ থেকে বললেন মেরারি।
গোটা দুনিয়ার নানা প্রান্তের সমর্থকদের কাছ থেকে যেভাবে ভালোবাসা পাচ্ছে, তাতে রীতিমতো অবাক ব্রাজিলিয়ানরাও। এই অবাক হওয়াদের দলে আছেন জুলিয়ানাও।
তিনি বলেন, 'দুনিয়াজুড়ে আমাদের দল কতটা জনপ্রিয়, তা দেখে রীতিমতো অভিভূত হয়ে গেছি। অসাধারণ এই অভিজ্ঞতা। অসংখ্য অ-ব্রাজিলীয়কে দেখছি ব্রাজিলকে সমর্থন দিচ্ছেন। আমাদের দল যখন এমন সমর্থন পাচ্ছে, তখনকার অনুভূতি ভাষায় বলে বোঝানো সম্ভব না। অন্য দেশের লোকজনকে ব্রাজিল সমর্থন করতে দেখাটা খুব সুন্দর অনুভূতি।'
২০০২-এর পর ব্রাজিল আর বিশ্বকাপ দেখেনি। এরপর তারা সর্বশেষ শিরোপার কাছে গিয়েছিল ২০১৪ সালে, ঘরের মাঠের বিশ্বকাপে।
তবে সেই সেমিফাইনালের স্মৃতি ব্রাজিল সমর্থকদের মনে খুশি বয়ে আনতে পারে না। এবার তাদের মনে আশা, এ বছরের বিশ্বকাপ দীর্ঘ দুই দশক পর ব্রাজিলের শিরোপাখরা ঘোচাবে।