ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন
অবিশ্বাস্য, অসাধারণ, দুর্বার, দুরন্ত- এসব কোনো বিশেষণই এখন আর যথেষ্ট নয়। কোন বিশেষণ যথার্থ, সেটাও আর এখন আলোচ্য নয়। বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে এখন শুধু বিজয়ের ঘ্রাণ, মাথায় সেরার মুকুট। ক্রিকেট বিশ্বে সবার মুখে এখন একটিই বাক্য, বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। এক বাক্যেই সব ভাব প্রকাশ।
ছোটদের হাত দিয়ে লেখা হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের বিরাট ইতিহাস। যুব বিশ্বকাপ পেল নতুন এক চ্যাম্পিয়নকে। দীর্ঘ ২২ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে যুব বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট ছিনিয়ে নিলো আকবর আলীর দল।
রোববার শিরোপার লড়াইয়ে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশের যুবারা।
দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রুমে ফাইনাল হলো ফাইনালের মতোই। ক্লাইমেক্স, সাসপেন্স; সবই থাকল ভরপুর। শরিফুল, সাকিব, অভিষেকদের আলো ছড়ানো বোলিংয়ে ভারতকে ১৭৭ রানেই বেঁধে ফেলে বাংলাদেশ।
জবাবে অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে ৭ উইকেট হারিয়ে উইকেটে জয়ের বন্দরে পৌঁছায় বাংলাদেশ। যেখানে ব্যাট হাতে পাওয়া গেছে দুজন কান্ডারিকে, পারভেজ হোসেন ইমন ও অধিনায়ক আকবর আলী। ইমন ৪৭ রান করে ফিরলেও নেতার মতো দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন হার না মানা ৪৩ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরা আকবর।
মাঝে অবশ্য বৃষ্টি হানা দেওয়ায় প্রায় ১০ মিনিট খেলা বন্ধ থাকে। ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে বাংলাদেশের নতুন লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৭০। এরই মধ্যে ১৬৩ রান তুলে ফেলায় ৩০ বলে বাংলাদেশ প্রয়োজন দাঁড়ায় ৭। সেই লক্ষ্যে দ্রুতই দলকে পৌঁছে দেন আকবর ও রকিবুল।
এতদিন বাংলাদেশের ফাইনালের অভিজ্ঞতা ছিল কেবলই বিষাদের। ফাইনাল মানেই ছিল হৃদয়ে রক্তক্ষরণ, বেদনার বালুচর। সব ফাইনালেই লেখা হতো একই গল্প, হৃদয় ভাঙার গল্প। এবার আর সেই গল্প নয়, শৃঙ্খল ভেঙে নতুন সূর্য ছিনিয়ে আনল বাংলার তরুণ তুর্কিরা।
এই ফাইনাল জয় দিয়ে আরও একটি বাধা পেরনো গেল। ফাইনালে ভারত সামনে পড়লেই খেই হারাতো বাংলাদেশ। নিদাহাস ট্রফি এবং এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে হেরেছে বাংলাদেশ। যুবাদের এশিয়া কাপের ফাইনালেও ভারতের বিপক্ষে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। এবার সেই প্রতিপক্ষকে হারিয়েই বিজয় কেতন ওড়ালেন আকবর আলী, তৌহিদ হৃদয়, মাহমুদুল হাসানরা। বাংলাদেশ হলো অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।
জয়ের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে সাবলীল শুরু করেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার পারভেজ হোসেন ইমন ও তানজিদ হাসান তামিম। ৮.৪ ওভারেই ৫০ পূর্ণ হয়ে যায় বাংলাদেশের। কিন্তু এ সময় রবি বিষনয়কে ছক্কা মারতে গিয়ে কার্তিক ত্যাগির হাতে ধরা পড়েন ১৭ রান করা তানজিদ।
তানজিদ ফেরার পরই এলোমেলো হয়ে পড়ে বাংলাদেশের ইনিংস। আকবর আলীর দলকে চেপে ধরেন ভারতের লেগ স্পিনার রবি বিষনয়। দলীয় ৬২ রানে মাহমুদুল হাসানকে ফিরিয়ে দেন তিনি। এ সময় হ্যামস্ট্রিং চোটে মাঠ ছাড়েন পারভেজ হোসেন ইমন।
এই সুযোগটাকেও কাজে লাগান বাংলাদেশের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা বিষনয়। দলীয় ৬২ রানেই তৌহিদ হৃদয়কে সাজঘর দেখিয়ে দেন ভারত যুবদলের এই লেগ স্পিনার। বাংলাদেশকে দিক ভুলিয়ে দেওয়া বিষনয় ৬৫ রানের মাথায় শাহাদাত হোসেনকে নিজের চতুর্থ শিকারে পরিণত করেন।
১৫ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে ঘোর অন্ধকারে পড়ে যান বাংলাদেশের যুবারা। এ সময় দলের হাল ধরেন অধিনায়ক আকবর আলী ও শামীম হোসেন। এই জুটি থেকে আসে ২০ রান। ক্যাচ তুলে ফেরার আগে শামীম করেন ৭ রান।
অভিষেক দাসও আকবরকে বেশি সময় সঙ্গ দিতে পারেননি। দলীয় ১০২ রানে ফেরেন তিনি। এরপর ক্রিজে যান রিটায়ার্ড হার্ট হয়ে মাঠ ছাড়া ইমন। আকবর ও ইমন মিলে বাংলাদেশকে শিরোপা পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন।
এ দুজনের ধীর-স্থির ব্যাটিংয়ে ঠিক পথেই ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু দলীয় ১৪৩ রানে বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে আকাশ সিংয়ের হাতে ধরা পড়েন ৪৭ রান করা ইমন। ৪১ রানের জুটি ভাঙে বাংলাদেশের, বাড়তে থাকে হারের শঙ্কা।
এই পথটুকু ছিল আরও কঠিন। রকিবুল হাসানকে নিয়ে বন্ধুর এই পথ পাড়ি দিতে হয় ফাইনাল জয়ের জয়ের নায়ক আকবরকে। বাউন্ডারি মারার মতো অনেক ডেলিভারি পেয়েও নির্মোহ থেকে গেছেন হিসেবি আকবর। কারণ তাকে উইকেটের কথা মাথায় রাখতেই হয়েছে।
ঠিক যে পরিকল্পনা করে এগোতে চেয়েছেন যুবাদের অধিনায়ক, সেটাই করতে পেরেছেন। রকিবুলও দারুণ সঙ্গ দিয়েছেন তাকে। শেষ পর্যন্ত এই দুজনের ব্যাটেই রচিত হয় ইতিহাস। ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাস্টিক আকবর ৪৩ রানে, রকিবুল ৯ রানে অপরাজিত থাকেন। অবশ্য মাঝে বৃষ্টি বাগড়া ছিল। তবে সেসবও আর বাধা হতে পারেনি। ভারতের রবি বিষনয় ৪টি এবং সুশান্ত মিশ্র ২টি উইকেট পান।
এর আগে আগুনে বোলিংয়ে প্রথম ওভার থেকেই প্রতিপক্ষকে চেপে ধরেন বাংলাদেশের দুই পেসার শরিফুল ইসলাম ও তানজিম হাসান সাকিব। প্রথম দুই ওভারে কোনো রান খরচা করেননি এ দুজন।
সাধারণ একটি ম্যাচের কথা বললেও যুবাদের শারীরিক ভাষা বলছিল অন্য কথা। ভেতরে ভেতরে যে তারা জিদ পুষে রেখেছিলেন, সেটা স্পষ্ট হয় প্রথম ওভারেই। ইনিংসের প্রথম ওভার করা শরিফুল একেকটা আগুনে ডেলিভারি দিয়ে তেড়ে যাচ্ছিলেন ভারতের ওপেনারের দিকে।
নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে সপ্তম ওভারে মিলে যায় সাফল্য। ৬.৪ ওভারে ভারতের রান তখন মাত্র ৯, দিব্যনাশ সাক্সেনাকে ফিরিয়ে বাংলাদেশ শিবিরকে আনন্দে ভাসান তানজিম হাসান।
যদিও বাংলাদেশের ধারালো বোলিংয়ের সামনেও পরিস্থিতি সামাল দিয়ে ফেলেন জাইসওয়াল ও তিলক ভার্মা। দ্বিতীয় উইকেটে ৯৪ রানের জুটি গড়েন এই দুই ব্যাটসম্যান।
অবশ্য তাদের রান তোলার গতি ভালো ছিল না। ৭.৪ ওভারে প্রথম বাউন্ডারির দেখা পাওয়া ভারত ১০ ওভারে তোলে মাত্র ২৩ রান। ২০ ওভারে ৬৩ আর ১০০ ছাড়াতে লেগে যায় ২৯ ওভার।
অতি সাবধানি থাকা তিলক ভার্মা হাত খুলে খেলতে গিয়েই বিদায় নেন। এর আগে ৬৫ বলে ৩৮ রান করেন তিনি। ভারতের অধিনায়ক প্রিয়ম গার্গকে উইকেটে থিতু হতে দেননি রকিবুল হাসান। ৭ রান করা গার্গকে বিদায় করেন বাংলাদেশের বাঁহাতি এই স্পিনার।
অসম্ভব চাপের মাঝেও একপাশ আগলে রাখেন পুরো আসরে দারুণ ব্যাটিং করা জাইসওয়াল। ধ্রুব জুরেলকে সঙ্গে নিয়ে আরও কিছুটা পথ পাড়ি দেন ইনিংস উদ্বোধন করতে নামা বাঁহাতি এই ওপেনার। ৪০তম ওভারে ভারতের ব্যাটিংয়ের কোমড় ভেঙে দেন আগুনে বোলিং করতে থাকা শরিফুল।
পরপর দুই বলে বাঁহাতি এই পেসার ফিরিয়ে দেন ভারতের ইনিংসের কান্ডারি জাইসওয়াল ও সিদেশ বীরকে। ক্যাচ তুলে ফেরার আগে ১২১ বলে ৮টি চার ও একটি ছক্কায় ৮৮ রানের মহা কার্যকর এক ইনিংস খেলেন জাইসওয়াল।
এই দুই ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে ভারতের যুবারা। দিক হারিয়ে রান আউটে কাটা পড়ে ভারতের পরের দুই ব্যাটসম্যান। জুরেল করেন ২২ রান। বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য বোলিং-ফিল্ডিংয়ের সামনে ভারতের পরের ব্যাটসম্যানরা সুবিধা করতে পারেননি।
৪০ রান খরচায় সর্বোচ্চ ৩টি উইকেট নেন অভিষেক দাশ। দোর্দন্ড প্রতাপে বোলিং করা শরিফুল ৩১ রানে ২ উইকেট নেন। এ ছাড়া তানজিম ২টি ও রকিবুল একটি উইকেট পান।