'সাকিবের মতো সামর্থ্য আছে আকবরের'
কখনও কখনও ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাকে রীতিমতো অলৌকিক লাগে। কখনও লাগে রূপকথার মতো। দুনিয়ার ইতিহাস বলে, বিশ্বজয়ী বীরদের পেছনে কোনো না কোনো তাক লাগানো গল্প থাকে। বাংলাদেশকে সেদিন অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জেতানো দলের অধিনায়ক আকবর আলীর জন্য সেই গল্প আসলে কোনটা? সেটির খোঁজে হাতড়ে ফেরা এবং অবশেষে তার দেখা মেলা ১৮ ফেব্রুয়ারি, সাভারের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি)।
বিকেএসপির ক্রিকেটের প্রধান কোচ মাসুদ হাসানের মুখে উঠে এলো আকবরের সেই গল্প। যে গল্প শেষে স্বস্তির উপসংহার, বাদ পড়া আকবরই বিশ্বসম্রাট। এক পর্যায়ে যুব বিশ্বকাপে যার খেলার সুযোগ পাওয়ারই কথা ছিল না, সেই তিনি যদি শেষে বিশ্বজয়ীদের নেতা হন, তাহলে বিরাট ধাক্কা লাগতে বাধ্য!
বিশ্বকাপের স্কোয়াড থেকে আকবরের বাদ পড়া, তার জন্য কোচের লড়াই, যুবাদের কোচিং করানোর অভিজ্ঞতাসহ যুব ক্রিকেটের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেজ স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছেন মাসুদ হাসান।
টিবিএস: প্রিয় শিষ্যরা নতুন বেশে আজ বিকেএসপিতে এসেছে ম্যাচ খেলতে। তাদের দেখে কেমন লাগছে?
মাসুদ হাসান: এ এক দারুণ অনুভূতি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই আনন্দিত। আমি একটা কাজ করেছি, যে উদ্দেশ্যে সেটি করেছি তা এখন মাঠে গড়াচ্ছে, সবাই দেখতে পাচ্ছে। আসলে নিজের কাজের মূল্যায়নও নিজে করতে পারছি।
টিবিএস: এখানেই বেশি সময় কাটে যুব ক্রিকেটারদের। এর আগেও বিকেএসপিতে এসেছেন আকবর, মাহমুদুলরা। এবারের আসার মধ্যে কোনো তফাৎ খুঁজে পাচ্ছেন?
মাসুদ হাসান: আগে ছিল যেমন, রেগুলার ট্রেনিং করিয়েছি, সবকিছু দেখেছি। আর এখন এসেছে অন্য বেশে। সেই চিরাচরিত বেশ যেটা ছিল, সেটা আর নেই। তারা এসেছে ভিন্নভাবে। জাতির পুরো দৃষ্টি মনে হয় তাদের দিকে রয়েছে। তার মানে এটার বিশেষত্ব তো অবশ্যই রয়েছে। সেখানে আমি তো ব্যতিক্রম নই।
টিবিএস: যাদেরকে ক্রিকেট দীক্ষা দিয়েছেন, তারা আজ বিশ্বজয়ী। কোচ হিসেবে এটা কতটা গর্বের?
মাসুদ হাসান: একটা কোচের সাফল্য সেখানে, যখন নিজের সৃষ্ট বা নিজের ট্রেনিং করানো কেউ পারফর্ম করে। তাদের পারফরম্যান্স জাতি উপভোগ করছে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল যেটা, সেটা বয়ে আনছে। বিকেএসপির শপথ বাক্য যেটা রয়েছে, এই ঘটনা এর সঙ্গে মিলে যায়।
টিবিএস: এবারের যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশ স্কোয়াডে বিকেএসপির ৮ ক্রিকেটার ছিলেন। এই যুবারা বিশ্বকাপ জিতবেন, এমন স্বপ্ন দেখেছিলেন?
মাসুদ হাসান: ওইভাবে স্বপ্ন দেখেছি, তেমন নয়। এটুকু বিশ্বাস ছিল, ওরা ভালো ফলাফল করবে। বিশ্বাস ছিল সেমিফাইনাল খেলবে। যখন দেখলাম ফাইনালে উঠে গেছে, তখন আমার কনফিডেন্স লেভেলটা বেড়ে যায়। মনে হয়েছে, ইয়েস উই ক্যান উইন দ্য ট্রফি। তখন বুঝেছি, ওদের কনফিডেন্স লেভেলটা অন্য জায়গায় চলে গেছে।
আমরা ওদের কনফিডেন্স লেভেল নিয়ে অনেক কাজ করেছি এখানে। এখান থেকেই ওরা শিখেছে কনফিডেন্স কখন লো হয়, কখন মিডিয়াম হয়। আসলে কাজ করার ধরন দেখলে বোঝা যায় কেমন করবে।
টিবিএস: ক্রিকেটার আকবর, অধিনায়ক আকবরকে নিয়ে আপনার মূল্যায়ন? অন্যদের মতো আকবরকেও কোচিং করিয়েছেন আপনি। সেই সময়ের গল্পটা যদি বলতেন…
মাসুদ হাসান: আকবর তো আকবরই। এখানে অন্য কোচরাও রয়েছেন। আমার ডিপার্টমেন্টে যারা আছেন, সকলেই তাকে আদর করে। আমি হেড, তাই একটু বেশিই দায়িত্ব থাকে আমার। ওদের ব্যাচের মধ্যে সে ছিল খুবই ধীরস্থির। চঞ্চল প্রকৃতির নয়। বিষয়গুলো হ্যান্ডেল করতে পারে সুন্দরভাবে। ও খুব ভালো চিন্তা করতে পারে। যখন খেলার সময় তখন শুধু খেলা নিয়েই চিন্তা করে। যখন টিমমেটদের সঙ্গে আড্ডা, সেখানে সে অন্যরকম ছিল। বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করা, এসব তার মধ্যে ছিল। এসব দেখে আমরা বুঝেছি, সে পারবে।
টিবিএস: তার মানে নেতৃত্ব গুণটা আকবরের মধ্যে ছোটবেলা থেকেই ছিল?
মাসুদ হাসান: কোচ হিসেবে আমাদের কাজ, ক্রিকেটারদের বিষয়গুলো বুঝে তার ভেতর থেকে সেটা বের করে আনা। লিডারশিপটা ওর মধ্যে ছিল। বুঝতে পারতো- কাকে কখন কীভাবে খেলাতে হবে। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে এমনটা বুঝতে পারা বিশাল ব্যাপার। আমার সঙ্গে কাজ করেছে। আমি বুঝতে পেরেছি, তার মধ্যে এমন অনেক কিছু আছে যা আমিও ভাবি না। আমি চিন্তা করেছি ওদের সবাইকে কীভাবে ট্রেন-আপ করা যায়। আর সে চিন্তা করেছে সামগ্রিক বিষয় নিয়ে। তখনই বুঝতে পেরেছি, সে অসাধারণ।
টিবিএস: আপনার কোচিং করানো জাতীয় দলের এমন কোনো ক্রিকেটারের কথা মনে পড়ে, যে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে আকবরের মতো ভাবতেন?
মাসুদ হাসান: সাকিব আল হাসান যখন এখানে ছাত্র ছিল, তখনও তাদের গ্রুপের কোচ ছিলাম আমি। গ্রুপ ম্যাচ বা ইন্টারনাল ম্যাচগুলোর সময় বলতাম, ট্রেনিংয়ে টেকনিক্যাল কোন কাজগুলা করব। 'ক' বললে সাকিব বুঝে নিত, আমরা কলকাতা বলতে চাচ্ছি। অনেককে হয়তো বারবার যেটা বলা লাগতো, সাকিবকে বলতে হতো না। আকবরকেও বলা লাগেনি। সাকিবের মতো সামর্থ্য আকবরের মধ্যেও ছিল। জিনিসটাকে কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়, সেই জিনিসটা ওর মধ্যে ছিল।
টিবিএস: যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্কোয়াড গঠনে আপনার অবদান ছিল বলে শুনেছি। এই ব্যাপারটা নিয়ে যদি বলতেন…
মাসুদ হাসান: বাংলাদেশের ২৪ জনের স্কোয়াডে আকবর প্রথমে ছিল না। আমি তার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি। বিসিবি বা নির্বাচকদের সঙ্গে কথা বলেছি, কোনোভাবে তৈরি করা যায় কি না ওকে (আকবর)। আর সেই সুযোগটা এসে যায়, যখন নিউজিল্যান্ড সফরের আগে এখানে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অনুশীলন ম্যাচ আয়োজন করা হয়। আমি তখন ভাবলাম, এই একটা সুযোগ। আমাদের দলের অধিনায়ক থাকবে আকবর। সে ভালো পারফর্মার। ম্যাচ খেলা লাগবে, আকবর আলীকে সুযোগ করে দিতে হবে। শেষে চার নম্বর মাঠে আমরা ম্যাচ আয়োজন করি।
টিবিএস: এ বিষয়ে সরাসরি কার সঙ্গে কথা হয় আপনার?
মাসুদ হাসান: প্রথম ম্যাচে আমি এবং হান্নান সরকার ছিলাম। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের টিম ম্যানেজমেন্টের যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে কথা বললাম। আমি হান্নানকে বললাম, ‘দেখ আমি কোনো তদবির সুপারিশ করছি না, কোনোভাবে হয়তো মিসটেক হয়ে গেছে। হয়তো নির্বাচনে কোনো ভুল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় ও (আকবর) সুযোগ পেলে তোমাদের আশা পূরণ হবে।’ এরপর ওই ম্যাচে আকবরের লো পারফরম্যান্সের পর ড্রেসিংরুমে আলোচনা হয়।
বিকেল তখন, ম্যাচ তখনও চলছে। হান্নান আমাকে ডেকে বলে, ‘ওর পাসপোর্টটা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।’ আমি আকবরের পাসপোর্ট আনার ব্যবস্থা করি। পাসপোর্ট হাতে পেয়ে আমি চার নম্বর মাঠ থেকে দূরে গিয়ে ফটোকপি করাই এবং হান্নানকে দেই। ওরা তিনটা ম্যাচ খেলে চলে যায়। এরপর দল ঘোষণার পর দেখি স্কোয়াডে আকবর আলীর নাম আছে।
এরপর আমরা অনুমতি দিয়ে পাঠিয়ে দিলাম, তারপর তো চ্যাম্পিয়ন হয়েই ফিরলো।
টিবিএস: শিষ্যদের মাথায় উঠেছে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট, তারা এখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। কোচ হিসেবে নিজেকে চ্যাম্পিয়ন মনে হয় কি না?
মাসুদ হাসান: যেহেতু আমরা বেতন নিয়ে কাজ করি, এটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। জনগনের ট্যাক্সের টাকায় আমাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে। আমরা কী দিচ্ছি? এই অনুভূতি কাজ করে বলেই কাজের সময়ের বাইরেও কাজ করি ছেলেদের গড়ার জন্য। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ধরলে তো সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমিও গর্বিত। কোচের সফলতা সেখানেই, যখন সাফল্য আসে।
টিবিসি: বিকেএসপির এই ৮ জন যুব ক্রিকেটারের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি পথ পাড়ি দিতে পারবে বলে মনে করেন?
মাসুদ হাসান: কোচ হিসেবে যেটা চিন্তা করি, আকবর আলী তো আছেই। যদিও সবাই আমার ছাত্র। এভাবে নাম বললে ওরা মনে করবে, স্যার আমার কথা বললেন না, ওর কথা বললেন। তারপরও আমার দেখামতে, আমি যতদূর জানি, আমি ট্রেনিং করাচ্ছি, আমার কাছে ভালো লাগে সবচেয়ে মাহমুদুল হাসান জয়কে। কিছু খেলোয়াড় থাকে, যাদের দিয়ে স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করা যায়। জয় তেমন। তার ভবিষ্যত খুবই ভালো। অন্যরাও আছে।
এ ছাড়া শামীম হোসেন আছে। ও অলরাউন্ডার। তাকে একটু সঠিক গাইডলাইনে রাখতে হবে। কারণ, মাহমুদুল হাসান যে মেন্টাল ফ্রেমের মধ্যে আছে, শামীম সে রকম ফ্রেমে নেই। টেকনিক্যালি খুব ভালো প্লেয়ার শামীম, কিন্তু ফ্রেমটা এক রকম না। আবার পারভেজ হোসেন ইমনও ভালো।