বিশ্বের পঞ্চম ধনী বোর্ড বিসিবি, তবু ঘরোয়া ক্রিকেটের কেন এই হাল?
বঙ্গবন্ধু ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ছোট্ট একটি ঘরে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) স্বপ্নের যাত্রা। সে স্বপ্নের আশেপাশে ছিল না আলোর ঝলকানি। থাকবেই বা কী করে, যে ঘরে বিসিবির কার্যক্রম পরিচালিত হতো, সেখানে ছিল না বিদ্যুৎ সংযোগ। রাতের সব কাজ চলতো মোমবাতি জ্বালিয়ে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেট বোর্ড পরিণত হয়েছে আলোর ফোয়ারায়। অর্থবিত্তেও ফুলে ফেঁপে উঠেছে দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে শক্তিশালী এই সংস্থা।
একটু একটু করে পাল্টেছে বিসিবির চেহারা। বঙ্গবন্ধু ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সেই অন্ধকার ঘর ছেড়ে গুলশানের নাভানা টাওয়ার হয়ে বিসিবির কার্যালয় এখন মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। বর্তমানে এসে বিসিবির বিগত সংগ্রামের ইতিহাসকে গল্প বলে ভ্রম হবে। দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এখন বাস করে টাকার পাহাড়ে। যে পাহাড় ক্রিকেট খেলুড়ে অনেক দেশের চেয়েই বড়; বিশ্বের পঞ্চম অর্থবান ক্রিকেট বোর্ড এখন বিসিবি।
কদিন আগে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন জানিয়েছেন, আগের চেয়ে অনেক পরিমাণে ব্যয় বাড়ার পরও বিসিবির মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। খাতা-কলমের হিসাবও সেটাই বলে। এফডিআরসহ (ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট) ২০১৯-২০ অর্থ বছরে (সর্বশেষ অর্থ বছরের হিসাব এখনও চূড়ান্ত নয়) এসে বিসিবির মোট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৩২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা।
২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত এফডিআরে বিসিবির জমা ছিল ৫৪৫ কোটি টাকা। এই অর্থ বছরে বিভিন্ন খাত থেকে বিসিবির মোট আয় ৩৩২ কোটি ৮২ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৪ টাকা। আগের অর্থ বছরে আয় ছিল ৩০৮ কোটি ৪৮ লাখ ৮১ হাজার ৬৩০ টাকা। আগের অর্থ বছরের চেয়ে ২৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বেশি আয় হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ব্যয়ের পর বিসিবির উদ্বৃত্ত ৫২ কোটি ৯১ লাখ ৩৪ হাজার ২৬ টাকা। এফডিআরের ৫৪৫ কোটি ও ২০১৯-২০ অর্থ বছরে আয়-ব্যয়, নিট উদ্বৃত্ত, নগদ ও ব্যাংক জমা মিলে বিসিবির স্থায়ী মূলধন বা পুঞ্জিভূত তহবিলে ৮৩২ কোটি ৬৮ লাখ ৮৭ হাজার টাকা আছে।
বিসিবি এখন এতটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ যে, কারোনাভাইরাসের প্রকোপেও অন্য বোর্ডের মতো টালমাটাল অবস্থা হয়নি তাদের। উল্টো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সংস্থাটি। প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল, বর্তমান-সাবেক খেলোয়াড়দের চিকিৎসা, আম্পায়ার্স সমিতি, করোনায় ক্ষতিগ্রস্তসহ আরও কয়েকটি খাতে প্রায় ৪ কোটি টাকা দান করেছে বিসিবি। করোনাকালের কঠিন এই সময়ে কোচিং স্টাফসহ ৪ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন ছিল নিয়মিত, চাকরিও হারাতে হয়নি কাউকে।
বিসিবির এতো আয়ের পরও বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের উন্নতি নেই বললেই চলে, সেই 'মান্ধাত্বা' আমলের নীতিতেই এগিয়ে চলছে ঘরোয়া ক্রিকেটের কার্যক্রম। এখনও সব কিছু ঢাকা কেন্দ্রিক, বহু বছর আলোচনার পরও আলোর মুখ দেখেনি আঞ্চলিক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। ঢাকায় বসেই সব দল গড়ে দেওয়া হয়। টুর্নামেন্টগুলোয় নেই প্রতিযোগিতা। জাতীয় ক্রিকেট লিগকে এখনও বলা হয় 'পিকনিক ক্রিকেট'। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ বা বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগও মানসম্পন্ন নয়। এ ছাড়া, ক্রিকেটারদের পারিশ্রমিক, উইকেট, আম্পারিংয়ের মান নিয়ে তো হাজারও প্রশ্ন আছেই। এ যেন বাতির নিচে স্থায়ী বাস গড়া অন্ধকারের গান!
জাতীয় দলের বাইরে থাকা একজন ক্রিকেটার চারটি টুর্নামেন্ট থেকে (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ, জাতীয় ক্রিকেট লিগ, বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগ ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) বছরে গড়ে ২৫-৩০ লাখ টাকা আয় করে। যা ভারতের ক্রিকেটাররা আয় করতে পারেন এক রঞ্জি ট্রফি খেলেই। আইপিএলসহ অন্যান্য টুর্নামেন্টের আয় ধরলে সেটার পরিমাণ বেড়ে যায় অনেক গুণে। জাতীয় ক্রিকেট লিগের ম্যাচ ফি ৬০ হাজার ও বাংলাদেশ ক্রিকেট লিগের ম্যাচ ফি ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু ২০টির বেশি ম্যাচ খেলা ক্রিকেটাররা রঞ্জি ট্রফিতে প্রতিদিনই পান ৪০ হাজার রুপি করে।
ধনী একটি ক্রিকেট বোর্ডের তত্ত্বাবধানে থাকা ঘরোয়া ক্রিকেটের কেন এই হাল? কিংবা বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মানটা আসলে কেমন? এমন প্রশ্নে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ও বর্তমানে আইসিসির ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কর্মরত আমিনুল ইসলাম বুলবুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বললেন, 'আমি দেশে থাকি না। আমি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেট যেভাবে দেখি, সেটা হলো সাকিব আল হাসান উইকেটে লাথি মারে। এতেই কিন্তু সারা বিশ্ব জেনে যায় আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট কী।'
'আমি দেখেছি কয়েক বছর আগে একটা ছেলে এক ওভারে ৯০ রান দিয়েছে। এসবই দেখি বাইরে থেকে। একটা ছেলে ৩০০ রান করেছে, সেটা তো দেখি না। আমি দেখিনি ঘরোয়া থেকে এক ঝাঁক ক্রিকেটার উঠে এসেছে, ক্লাব তৈরি হয়েছে, যেখানে সব সুযোগ-সুবিধা আছে। এখনও একাডেমি মাঠে সব দল অনুশীলন করে। একটা ভিডিওতে দেখেছি, এক খেলোয়াড় বলছে, "আমরা আগে থেকেই জানি, খেলায় কী হবে"। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এসবই দেখি। আর এটাই প্রমাণ করে ঘরোয়ার ক্রিকেট কোথায় দাঁড়িয়ে।' যোগ করেন বুলবুল।
২০১৯-২০ অর্থ বছরে ক্রিকেট ডেভেলপমেন্টে বিসিবির ব্যয় ২২ কোটি ২৬ লাখ ২৫ হাজার ২৫ টাকা। আয়ের তুলনায় এই ব্যয় যথেষ্ট কিনা জানতে চাইলে আমিনুল ইসলাম বলেন, 'ডেভেলপমেন্ট একটি বড় খাত। এখানে খেলোয়াড়, কোচ, আম্পায়ারদের ডেভেলপমেন্টের ব্যাপার আছে। কোথায় কোথায় কাজ হয় জানি না আসলে। আমি জানি কোনো কোচিং কোর্স হয় না। কোন কোন প্রোগ্রাম বিসিবি করে থাকে, বাজেট কতো, এসবের ওপর নির্ভর করে খরচটা ঠিক আছে কিনা।'
বিভিন্ন ভূমিকায় বিসিবিতে ১৪ বছর দায়িত্ব পালন করা ও বর্তমানে বিকেএসপির ক্রিকেট উপদেষ্টা নাজমুল আবেদীন ফাহিম বললেন, 'আমার মনে হয় খেলোয়াড়রা তাদের খেলার ব্যাপারে যেসব জায়গার সঙ্গে জড়িত; যেমন ক্লাবের সঙ্গে জড়িত, প্রথম শ্রেণির সংস্থার সঙ্গে জড়িত— এসব দল যারা চালায়, তাদেরকে আর্থিকভাবে আরও শক্তিশালী করা খুব জরুরি। যাতে তারা আদর্শ একটি পরিবেশ তৈরি করতে পারে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট যেখানেই হয়, সেখান সুযোগ-সুবিধা উন্নত নয়। আমাদের যে ক্লাবগুলো লিস্ট 'এ' খেলে, তাদের তেমন সামর্থ্যই নেই। তাদের খেলোয়াড়রা জিম করবে, পুলে গিয়ে রিকভারি করবে, টার্ফে অনুশীলন করবে বা অনুশীলন ম্যাচ খেলবে, এমন সুযোগ-সুবিধা তাদের নেই। সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্রিকেট খেলা দেশগুলোর এসব আছে।'
'লিস্ট 'এ' বা প্রথম শ্রেণিতে আমাদের কোনো অ্যানালিস্ট নেই। জাতীয় দলের ক্ষেত্রে আমরা সব কিছু সেরা মানের দেওয়ার চেষ্টা করি। এর পরের ধাপেই যে ক্রিকেট, সেখানকার সুযোগ-সুবিধা জাতীয় দলের ধারে কাছেও থাকে না। খেলোয়াড়রা যেখান থেকে উঠে আসবে, সেখানে কাজ করতে হবে। খেলোয়াড়রা সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে খেলতে আসতে পারে না। তারা সেভাবে প্রস্তুতির সুযোগই পায় না। এখানে ইনভেস্টমেন্টের দরকার। মাঠ, উইকেটের একটি ব্যাপার আছে। আঞ্চলিক ক্রিকেটে আমরা যেতে পারলে অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা করা সম্ভব হবে। সুযোগ-সুবিধার মান ভালো না হলে খেলোয়াড়ের প্রস্তুতির মান ভালো হবে না। জাতীয় দল এবং এখানকার অনেক পার্থক্য। এখান থেকে গিয়ে জাতীয় দলে মানিয়ে নিতেও সমস্যা হয়ে যায়। এসব কারণেই সেভাবে উন্নতি হচ্ছে না বলে আমার ধারণা।' নাজমুল আবেদীন যোগ করেন।
ক্রিকেট ডেভেলপমেন্টে বিসিবির করা ব্যয় পর্যাপ্ত বলে মনে করেন না নাজমুল আবেদীন। তিনি বলেন, 'আমাদের জন্য এটা পর্যাপ্ত নয় এই কারণে যে, আমাদের কিছুই নেই। ঢাকা বাদ দিলে; ঢাকাতেও যে আছে, তেমনও নয়। এ কারণে পর্যাপ্ত নয়। যদি আমাদের ফ্যাসিলিটি থাকতো, তাহলে হয়তো পর্যাপ্ত হতো। তখন এতো টাকা খরচের প্রয়োজন হতো না। আমাদের যদি জায়গা মতো জিম, অনুশীলনের উইকেট, মাঠ থাকতো, তাহলে এই টাকা অনেক কিছু করতে পারতাম। যেহেতু নেই, তাই মনে হয় আরও ব্যয় করা দরকার। এসব তৈরি করতেই একটা সময়ে বিরাট একটা অঙ্ক খরচ করতে হবে। অনেকগুলো অঞ্চলে যেন সেগুলো থাকে। ওই অঞ্চলের সম্ভাবনাময় ক্রিকেটাররা যেন এসব সুবিধা নিতে পারে। আমার মনে হয় আরও অনেক বিনিয়োগ করা উচিত।'
আগামী ৬ অক্টোবর বিসিবির নির্বাচন। আগের দুইবারের মতো এবারও পরিচালক পদে নির্বাচন করছেন সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয়। মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসে তিনিও উল্লেখ করেছেন ঘরোয়া ক্রিকেটে অপর্যাপ্ত ব্যয়ের বিষয়টি।
তিনি বলেন, 'চট্টগ্রাম ক্রিকেট আসোসিয়েশনের কাজ শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম এবং সিলেটে কাজ আগাচ্ছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে আগে একটা সময় ছিল, যখন বোর্ডের সংকীর্ণতা ছিল, সীমাবদ্ধতা ছিল। সেইগুলো কিন্তু এখন নেই। আমরা যদি শুধু মনে করি টাকা জমিয়ে রাখা, এফডিআর করা; এই বিষয়গুলো থেকে বেড়িয়ে এসে আঞ্চলিক ক্রিকেটের উন্নয়নে, অ্যাকাডেমির উন্নয়নে আরও বেশি ব্যয় করা উচিত।'
বিসিবির আয়ের উৎস
আইসিসির রাজস্ব ও টেস্ট ফান্ড: বিসিবির সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস আইসিসির রাজস্ব ও টেস্ট ফান্ড। বর্তমান অর্থ (২০১৬-২৩) চক্র থেকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সর্বোচ্চ ৪০৫ মিলিয়ন ডলার পাচ্ছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩৯ মিলিয়ন ডলার পাচ্ছে ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। এরপর সমান ১২৮ মিলিয়ন ডলার (১২ কোটি ৮০ লাখ ডলার; বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১১ শত কোটি) করে পাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ড।
এই অর্থ একবারে দেওয়া হয় না, প্রতি অর্থ বছরে আইসিসি থেকে আলাদা আলাদা পরিমাণ অর্থ পেয়ে থাকে বিসিবি। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আইসিসি থেকে ৯৫ কোটি ৪৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছিল বিসিবি। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে পরিমাণ বেড়েছে। এই অর্থ বছরে আইসিসি থেকে ১৩৮ কোটি ৯ লাখ টাকা পেয়েছে বিসিবি।
টুর্নামেন্ট থেকে আয়: বিসিবির আরেকটি বড় আয়ের উৎস ঘরের মাঠে বিভিন্ন সিরিজ ও টুর্নামেন্ট। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এখান থেকে বিসিবির আয় ছিল ১০৩ কোটি ২১ লাখ ২২ হাজার ৬৬ টাকা। পরের অর্থ বছরে সিরিজ-টুর্নামেন্ট থেকে আয় কমেছে বিসিবির। এই অর্থ বছরে বিসিবি আয় করেছে ১০০ কোটি ৮ লাখ ১৪ হাজার ৫৩৬ টাকা। টাইটেল স্পন্সর ও টিকেট বিক্রি থেকে সাধারণত এই আয় হয়ে থাকে বিসিবির। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে শূন্য গ্যালারিতে খেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় গত বছরের মার্চের পর থেকে টিকেট বিক্রি থেকে কোনো আয় হয়নি বিসিবির।
টিভি স্বত্ব: এরপর বিসিবির সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস টিভি স্বত্ব। বিভিন্ন সিরিজ, টুর্নামেন্ট সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি করে বিপুল অর্থ পায় বিসিবি। এটা সাধারণত কয়েক বছরের জন্য চুক্তি করা হয়ে থাকে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ বিসিবির কোষাগারে জমা পড়ে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে টিভি স্বত্ব থেকে বিসিবির আয় ছিল ১৩ কোটি ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪৬২ টাকা। পরের অর্থ বছরে মিলেছে কম অর্থ। এই অর্থ বছরে বিসিবি পেয়েছে ৯ কোটি ৮৩ লাখ ২২ হাজার ২৪০ টাকা।
স্পন্সর থেকে আয়: টিম স্পন্সর, কিট স্পন্সর, ইনস্টেডিয়া স্পন্সর (স্টেডিয়ামে ব্যানার, রোপ ব্যানার, স্ক্রিন, গ্রাস সিগনেচার) থেকে আয় করে বিসিবি। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এই খাত থেকে সংস্থাটির আয় ছিল ৪১ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৭৯৬ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে আয় কমেছে, বিসিবির কোষাগারে জমা পড়েছে ২৯ কোটি ২৮ লাখ ৩৫ হাজার ২৪৬ টাকা।
এফডিআর থেকে আয় (সুদ): বিভিন্ন ব্যাংকে জমা রাখা ফিক্সড ডিপোজিট থেকে প্রতি বছর বড় অঙ্কের সুদ পায় বিসিবি। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ফিক্সড ডিপোজিটের সুদ থেকে বিসিবি পেয়েছিল ৫৩ কোটি ৯৭ লাখ ৮৪ হাজার ৭১৫ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এখান থেকে আয় বেড়েছে, বিসিবি পেয়েছে ৫৪ কোটি ৭৮ লাখ ৫ হাজার ১২১ টাকা।
অন্যান্য আয়: এ ছাড়াও কিছু খাত আছে, যেখান থেকে বিসিবির আয় হয়। তবে এসব আয়ের খাত উল্লেখ করা হয় না। এই বিষয়টি পরিষ্কার করে বিসিবির প্রধান নির্বাহী নিজাম উদ্দিন সুজন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মূল খাতের বাইরে আমাদের কিছু আয় থাকে, যা উল্লেখ করা হয় না। যেমন স্টেডিয়ামে টাওয়ার বসাতে দিলে সেখান থেকে আয় হয়। এ ছাড়া স্টাফদের বেতন কর্তন, বিদেশি লিগে খেলতে গেলে ক্রিকেটাররা রিলিজ ফি দেয়। রিলিজ ফি থেকেই বেশি আসে, যদিও সেটার পরিমাণ বেশি নয়।'
এসব খাত থেকে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বিসিবির আয় ছিল ১ কোটি ৩৩ লাখ ৪২ হাজার ৫৯২ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এসব খাতে বিসিবির আয় কমেছে, এসেছে ৭৮ লাখ ৮১ হাজার ৪৬১ টাকা।
বিসিবির ব্যয়
আয়ের উৎস হাতেগোণা হলেও বিসিবির ব্যয়ের খাত অনেক। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বিসিবির আয় ছিল ৩০৮ কোটি ৪৮ লাখ ৮১ হাজার ৬৩০ টাকা। বিভিন্ন খাতে ব্যয় হয়েছিল ২২২ কোটি ৩ হাজার ২৫১ টাকা। বিসিবির উদ্বৃত্ত ছিল ৮৬ কোটি ৪৮ লাখ ৭৮ হাজার ৩৮০ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বেশি আয় করে বিসিবি, তবে বাড়ে ব্যয়ও।
এই অর্থ বছরে বিভিন্ন খাত থেকে বিসিবির মোট আয় ৩৩২ কোটি ৮২ লাখ ৫৮ হাজার ৬০৪ টাকা। ব্যয় হয়েছে ২৭৯ কোটি ৯১ লাখ ২৪ হাজার ৫৭৮ টাকা। ব্যয়ের পর বিসিবির উদ্বৃত্ত ছিল ৫২ কোটি ৯১ লাখ ৩৪ হাজার ২৬ টাকা। যা আগের অর্থ বছরের চেয়ে ৩৩ কোটি ৫৭ লাখ ৪৪ হাজার ৩৫৪ টাকা কম।
বিসিবির ব্যয়ের খাত
সিরিজ ও টুর্নামেন্ট বাবদ ব্যয়: বিসিবির ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত সিরিজ ও টুর্নামেন্টে বাবদ খরচ। বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিতে ট্রেইনিং ক্যাম্প, বিমান ভাড়া, হোটেল ভাড়াসহ আরও কিছু খাত মিলিয়ে বড় অঙ্কে খরচ হয় বিসিবির। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এই খাতে বিসিবির ব্যয় ছিল ৬৯ কোটি ৬৬ লাখ ৯২ হাজার ৫ টাকা। পরের অর্থ বছরে ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এই খাতে বিসিবির ব্যয় ১৩০ কোটি ৬১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৪৩ টাকা।
বেতন ও ভাতা: বিসিবিতে ৪ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মরত। এই খাতে বিসিবির ব্যয় বিপুল পরিমাণ। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বেতন ও ভাতা বাবদ বিসিবির ব্যয় ছিল ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ ২৩ হাজার ৫৫ টাকা। পরের অর্থ বছরের বিসিবির ব্যয় ৪৮ কোটি ৩১ লাখ ১২ হাজার ৫৬৯ টাকা।
কোচদের বেতন ও ট্রেইনিং: জাতীয় দলের বেশিরভাগ কোচই বিদেশি। তাদের বেতন ও ট্রেইনিংয়ের পেছনে বিসিবিকে বড় অঙ্কে ব্যয় করতে হয়। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বিসিবির ব্যয় ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ ৩ হাজার ৪১ টাকা। পরের অর্থ বছরে বিসিবির ব্যয় ২ কোটি ৩৭ লাখ ৬৮ হাজার ৭১২ টাকা।
বিদেশ সফর: বিসিবির আরেকটি বড় ব্যয়ের খাত বিদেশ সফর। বিমান ভাড়া, হোটেল ও খাওয়া দাওয়া, স্থানীয় যাতায়াত বাবদ অনেক খরচ হয় বিসিবির। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এই খাতে বিসিবির ব্যয় ছিল ১৮ কোটি ৮৬ লাখ ২২ হাজার ১৮৪ টাকা। পরের অর্থ বছরে বিসিবির ব্যয় যায় ১৬ কোটি ২২ লাখ ৮৯ হাজার ৪৮২ টাকা।
ডোনেশন ও চ্যারিটি: প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ তহবিল, বর্তমান-সাবেক খেলোয়াড়দের চিকিৎসা, আম্পায়ার্স সমিতি, অন্যান্য ফেডারেশনসহ আরও কিছু খাতে দান করে থাকে বিসিবি। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৬৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৬৩ টাকা দান করে দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। করোনাকালে বিসিবির দানের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বিসিবি ৪ কোটি ৯০ লাখ ৬৯ হাজার ৯৯৫ টাকা দান করেছে।
বিসিবির অফিস মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য খরচ: এ বাবদ ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বিসিবির ব্যয় ছিল ১২ কোটি ৮৮ লাখ ৯৬ হাজার ২১২ টাকা। পরের অর্থ বছরে বিসিবির ব্যয় হয় ১২ কোটি ৮ লাখ ১ হাজার ৪৩১ টাকা।
ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট বাবদ খরচ: ঘরোয়া বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন, বয়সভিত্তিক ক্রিকেট, কোচিংয়ের পেছনে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বিসিবির ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ২৩ কোটি ৪৭ লাখ ৩৬ হাজার ৮২৬ টাকা। পরের অর্থ বছরে বিসিবির ব্যয় ২২ কোটি ২৬ লাখ ২৫ হাজার ২৫ টাকা।
এ ছাড়া ২০১৯-২০ অর্থ বছরে বিলম্বিত ব্যয়ের সংশোধন বাবদ ৪ কোটি ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৪২৮ টাকা, ভ্রমণ ও যাতায়াত বাবদ ৩ কোটি ১৫ লাখ ৩৬ হাজার ৬৮৮ টাকা, ভাড়া, কর, ইন্সুরেন্স ও বিজ্ঞাপন বাবদ ১ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ৩৫৫ টাকা, প্রফেশনাল ফি বাবদ ২০ লাখ ৭৩ হাজার ১৩৩ টাকা, প্রশাসনিক ও সাধারণ খরচ বাবদ ৬ কোটি ৮৪ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮০ টাকা, অ্যান্টি পাইরেসি ও রাইট প্রটেকশন বাবদ ১৯ লাখ ১৫ হাজার ৬৮৫ টাকা, অডিট ফি বাবদ ৩৪ লাখ ২৬ হাজার ৬০০ টাকা, ফিনান্সিয়াল এক্সপেন্স বাবদ ৩ লাখ ৫৬ হাজার ২৫৯ টাকা, ডিপ্রেসিয়েশন বাবদ ২ কোটি ৭৯ লাখ ৭ হাজার ৩২৫ টাকা, অ্যালাউন্স ফর ডাউটফুল অ্যাকাউন্ট ডেফিনেশন বাবদ ২৩ কোটি ৯৫ লাখ ৫ হাজার ৫৮২ টাকা ও অস্থায়ী সম্পদ সংশোধন বাবদ ২ লাখ ১৪ হাজার ৯৩৭ টাকা ব্যয় হয়েছে বিসিবির।