বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসছে নারী অলিম্পিয়ানদের প্রশিক্ষণে, শিখতে পারবেন আপনিও
মাত্র কয়েক বছর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের ট্র্যাক এবং ফিল্ড অ্যাথলেট অ্যানি কুনজ ওয়ার্মআপের সময়েও শ্রান্তি অনুভব করতেন। এছাড়া, বারবার ক্ষুধা লাগতো তার, মনে হতো যেন সারাক্ষণই শুধু খাবার নিয়েই চিন্তা করছেন। কখনোবা অনুশীলনের মধ্যেও যেন ক্ষিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো!
অস্বাস্থ্যকর ভেবে নিজের ডায়েট থেকে কার্বোহাইড্রেট শ্রেণীর খাদ্য পুরোপুরি বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। তারচেয়েও খারাপ দিক ছিলো, পিরিয়ডের সময় প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতেন কুনজ। টোকিও অলিম্পিকে নারীদের হেপ্টাথলনে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা কুনজের অধিকাংশ সময় মনে হতো যে তিনি তার সেরা পারফরমেন্সটা দিতে পারছেন না।
এসব সমস্যার ফলে কুনজের খেলার পারফরমেন্স নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও কোচদের অধিকাংশই পুরুষ হওয়ায় তিনি কারও সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেননি বললেই চলে। কারণ পুরুষ কোচরা তাদের নারী অ্যাথলেটদের ওজন, হরমোনজনিত সমস্যা বা মাসিক ঋতুচক্র নিয়ে কথা বলার ব্যাপারে অভ্যস্ত ছিলেন না।
অলিম্পিক হেপ্টাথলনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিতে ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে আসেন কুনজ। হেপ্টাথলন এমন একটি প্রতিযোগিতা, যেখানে সাতটি ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এই খেলাটিতে শক্তি, গতির পরীক্ষা দিতে হয় এবং ক্রীড়া সংক্রান্ত প্রায় সব ধরনের দক্ষতাই এখানে প্রয়োজন হয়। তাই নিজেই নিজের সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেন কুনজ। নারী খেলোয়াড়দের শারীরিক নানা সমস্যা সংক্রান্ত গবেষণার উপর চোখ বুলাতে থাকেন।
নারী অ্যাথলেটদের জন্য উপকারী বিষয়গুলো সম্পর্কে কুনজ যতই জ্ঞান অর্জন করেন, ততই তিনি নিজের মাসিক ঋতুচক্র সম্পর্কে কোচের সাথে আরও খোলামেলা আলাপ করতে উদ্যোগী হন। তিনি ও তার কোচ এখন নিজেদের লক্ষ্যও বদলেছেন, তা হলো- "শীর্ণ নয়, বরং শক্তিশালী হও।'
২৮ বছর বয়সী কুনজ এর কাছে বিষয়টি পুরোপুরি তার গোটা পৃথিবী বদলে দেওয়ার মতো পরিবর্তন ছিল। টোকিও অলিম্পিকই তার প্রথম অলিম্পিকে খেলা। টোকিওর উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে কুনজ স্বতঃস্ফূর্ত মনে নিজের মনোভাব প্রকাশ করেছেন, "এখন আর আমার মনে হয়না যে আমি জোর করে ওয়ার্মআপ করছি, এখন আমি পুরো শক্তি নিয়েই নামি"।
২০ বছর আগে ডা. কেট অ্যাকারম্যান প্রথম 'ফিমেল অ্যাথলেট ট্রায়াড' শব্দত্রয়ের কথা জানতে পারেন। আমেরিকান কলেজ অফ স্পোর্টস মেডিসিন এই শব্দত্রয় এর মাধ্যমে তিনটি সমস্যাকে নির্দেশ করেছেন, তা হলো- অ্যামেনোরিয়া (মেনস্ট্রুয়াল পিরিয়ড কম হওয়া), অস্টেওপোরোসিস (শরীরের হাড় চিকন করে দেয় যা) এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস। অতিরিক্ত শরীরচর্চা করা এবং শরীরের ওজন খুব কম হলে এই সমস্যাগুলো দেখা দেয়।
ডা. অ্যাকারম্যান গত ১০ বছর ধরে নারী খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করছেন। অন্যরাও যোগ দিয়েছেন এই গবেষণায়। ফলে 'ফিমেল অ্যাথলেট ট্রায়াড' কথাটি এখন 'রিলেটিভ এনার্জি ডেফিসিয়েন্সি ইন স্পোর্টস' বা রেড-এস নামে পরিচিত। যে পরিমাণ ক্যালরি ব্যয় হচ্ছে, সেই তুলনায় পর্যাপ্ত ক্যালরি গ্রহণ না করার ফলে শক্তির অভাবে অ্যাথলেটরা এ ধরনের অসুস্থতায় ভুগে। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্য নারী অ্যাথলেটদের উদ্দেশ্যে কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন অ্যাকারম্যান, যা হয়তো আপনার ব্যক্তিগত জীবনেও কাজে লাগতে পারে।
'থিনার ইজ ফাস্টার' মিথ থেকে বেরিয়ে আসা
শরীর হালকাপাতলা গড়নের হলেই যে দ্রুত গতিতে খেলাধুলা বা কাজ করা যাবে- এমন প্রথাগত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অ্যাথলেটদের মধ্যে এই ধারণা বেশ জনপ্রিয়, যার ফলে 'রেড-এস' এর মতো ডিসঅর্ডার তৈরি হয়।
কোচ ও প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে একজন অ্যাথলেট কেমন বার্তা পাচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে অ্যাথলেটের লাইফস্টাইল। অনেকেই ভেবে থাকেন যে স্লিম হয়ে গেলেই ভালো পারফর্মেন্স করা যাবে। কুনজ এও জানালেন যে তিনি এমন কোচ এবং ট্রেইনারও পেয়েছেন যারা তাকে বলেছেন, '১০ পাউন্ড ওজন কমালেই তুমি সেরা পারফরমেন্স করবে।' কিন্তু এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ক্যালরি কম গ্রহণ করলে, শরীর দুর্বল হয়ে গুরুতর রোগও তৈরি হতে পারে।
অ্যাকারম্যান জানান, 'এমনকি বর্তমান যুগেও এমন অ্যাথলেট দেখতে পাই, যে কিনা রেড-এস বিষয়ে জানেনা। আর রেড-এস এর চিকিৎসা করতে আগ্রহী, এমন ডাক্তারের সংখ্যাও কম। রেড-এস এর উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত এবং প্রথমে নিজের ডায়েট নিয়ে কথা বলা শুরু করা উচিত। অ্যাথলেটদের উচিত সবার আগে নিজের সুস্থতা বজায় রাখা এবং খেলতে গিয়ে আহত না হওয়ার চেষ্টা করা। আপনি কাজের চাপ নিতে পারবেন কিনা, প্রশিক্ষণের পুরো সময়টা পার করতে পারবেন কিনা এবং সে ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব রাখতে পারবেন কিনা- এগুলোই আগে বিবেচনা করা উচিত।'
ঋতুচক্র ঠিক রাখা
বর্তমানে অনেকেই মনে করেন যে নারী অ্যাথলেটদের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসার জন্য মাসিক ঋতুচক্র একটি প্রধান বিষয়। কিন্তু ২০১৬ সালের অলিম্পিকে চারবার সোনাজয়ী অ্যাথলেট, মায়া ডিরাডো যখন পুরোদস্তুর সাঁতারু ছিলেন, তখন তার ঋতুচক্র কখনোই নিয়মিত ছিলনা। ডিরাডো জানান, তার কোচরাও কখনো তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিক কমিটির সিনিয়র স্পোর্টস ডায়েটিশিয়ান, অ্যালিসিয়া গ্লাস গত কয়েক দশক ধরে ইউএসএ ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড এবং ইউএসএ সুইমিংয়ের সাথে কাজ করছেন। ডিরাডো যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন তিনি তার সঙ্গেও কাজ করেছন। গ্লাস জানালেন, তিনি এখন নিয়মিতই তার নারী অ্যাথলেটদের ঋতুস্রাবের ব্যাপারে প্রশ্ন করেন ও খোঁজখবর রাখেন। যেহেতু প্রত্যেকের হরমোনের মাত্রার উপর ভিত্তি করে ঋতুচক্র কম বা বেশি দীর্ঘ হয়, রক্তপাতের মাত্রাও কম বেশি হয়; তাই তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, অ্যাথলেটরা যেন এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি অ্যাথলেটদের বিভিন্ন অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাবার, যেমন- স্ট্রবেরি, রাসপবেরি ও অন্যান্য ফল এবং ব্যথা শুরুর সময়টায় সামান্য ডার্ক চকোলেট ইত্যাদি খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
সূত্র: এনপিআর