‘আয়নার সামনে দাঁড়ালে হিরোর লুকটা মিস করি’
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/04/30/taskin_ahmed_celebrates.jpg)
তাসকিন আহমেদের প্রিয় ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা। বাংলাদেশের সফলতম পেসার ও ওয়ানডের সাবেক অধিনায়ককে আদর্শ মানেন তিনি। সেই মাশরাফি যখন হিরো বলে ডাকেন, ডাকটা তার কাছে পছন্দের না হয়ে উপায় কী! এ ছাড়া সুদর্শন ব্যাপারটা নিজের মধ্যে থাকায় তাসকিন কখনও কখনও নিজেকে হিরো ভেবে থাকতেই পারেন!
যদিও ডানহাতি এই পেসারের সেই হিরো 'লুক' এখন আর নেই। নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে তাসকিন নিজেকে যেভাবে তৈরি করেছেন, তাকে আর হিরো নয়, লাগে একজন সত্যিকারের পেসার। আর এই চেহারাতেই প্রশান্তি তার, এই শরীরি ভাষাতেই চালিয়ে যেতে চান মাঠের লড়াই। তবে আয়নার সামনে দাঁড়ালে কখনও কখনও হিরোর লুকটা মিস করেন তিনি।
তাসকিনের 'হিরোগিরি' দেখানোর জায়গাটা অভিনয়ের মঞ্চ কিংবা রূপালি পর্দা নয়। সবুজ গালিচার বুকে বসানো ২২ গজে দাপট দেখানো তার কাজ। এই কাজে দলের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠতে পারছিলেন না তিনি। তাই একটা সময়ে তাসকিনের মনে হয় বদলাতে হবে নিজেকে, বাড়াতে হবে গতি। এই মিশনে সফল তিনি, নিজেকে হাজির করেছেন নতুন এক রূপে।
নিউজিল্যান্ড সফরে নতুন যাত্রার শুরু তাসকিনের, শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়ে টেস্ট সিরিজে তিনি বুঝিয়েছেন নিজেকে কতোটা বদলেছেন। সাড়ে তিন বছর পর টেস্টে সুযোগ পেয়ে ক্যান্ডির নিষ্প্রাণ উইকেটেও গতির ঝর তুলে, বুক তাক করা বাউন্সার আর মাপা লাইন-লেংন্থে তাসকিন যেভাবে লঙ্কান ব্যাটসম্যানদের ভুগিয়েছেন, বাংলাদেশের টেস্ট পথচলায় তা রীতিমতো উদাহরণযোগ্য।
নিজেকে বদলে ফেলার পথটা কেমন ছিল, এ পথে অনুপ্রেরণা ছিল কী, কতোটা অধ্যাবসায় আর কঠোর পরিশ্রমে মিলেছে এই আলোর পথ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তা শুনিয়েছেন তাসকিন। জানিয়েছেন নতুন লক্ষ্য আর প্রতিজ্ঞার কথাও।
টিবিএস: কেমন গেলো শ্রীলঙ্কা সিরিজ? নিজের পারফরম্যান্স নিজেকে মূল্যায়ন করতে বলা হলে সেটা কঠিন প্রশ্ন হয়ে যাবে কিনা?
তাসকিন আহমেদ: খুব বেশি কঠিন হবে না। আগের চেয়ে ভালো করেছি, তবে আরও ভালো করার ছিল। ভালোর তো আসলে শেষ নেই। প্রক্রিয়াটা মেনে চলার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে আছে, আমি সেটাই করে যাচ্ছি। প্রতিটা সিরিজই নতুন সুযোগ, প্রতিটা সিরিজই নতুন করে শুরু করতে চাই। একইভাবে প্রতিটা ম্যাচের ক্ষেত্রেও তাই। সব সময়ের মতো করেই বলতে হয়, নিজের সেরাটাই দিতে চাই সব সময়। সব মিলিয়ে ভালো হয়েছে। তবে খুব ভালো বা আহামরি কিছু হয়নি।
টিবিএস: দীর্ঘদিন বাইরে থাকার পর দলে ঢুকলে নিজের ওপর প্রত্যাশা তৈরি হয়, লক্ষ্য থাকে। প্রত্যাশা কতোটুকু পূরণ হলো?
তাসকিন: প্রত্যাশা পূরণ হয়নি আসলে। আরেকটু ভালো করার আশা ছিল। কারণ স্বপ্ন বা আশা করা থেকে তো কেউ আমাকে বাধা দিতে পারবে না। এটা আমার নিজের ইচ্ছা। নিজের ওপর প্রতশ্যা অনেক বেশিই থাকে সব সময়। এটার জন্যই কষ্ট করে যাচ্ছি। ভালো আশা করেছিলাম, তবে যেটা হয়েছে; সেটাতেও শুকরিয়া। এখানকার ভুল থেকে শেখার চেষ্টা করব, যেন সামনে এখান থেকে ২-১ শতাংশও উন্নতি হয়। উইকেট সব সময় বলে বলে নিতে পারব না, তবে চেষ্টা করাটাই আসল।
টিবিএস: বলা হচ্ছে বাংলাদেশের টেস্ট বোলিংয়ে আপনি গতি সঞ্চার করেছেন? শুনতে কেমন লাগছে?
তাসকিন: কেমন আলোচনা হচ্ছে, সত্যি বলতে খুব একটা বেশি জানি না আমি এই বিষয়ে। কারণ কয়েকদিন মাত্র এলাম। আর আলোচনা হচ্ছে, এতে খুব বেশি খুশি হওয়ার কিছু নেই। কারণ খারাপ খেললে আলোচনা হবে না, আবার থেমে যাবে। তখন হবে সমালোচনা। আলোচনা হবে, হবে না; এ নিয়েই আমাদের জীবন। তবে আমি চাই আমাদের পেস বোলারদের যেন আরও বেশি খেলানো হয়। এমনকি ঘরোয়াতেও যেন গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা ঘরোয়াতে বেশি সুযোগ পেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভালো করার সম্ভাবনা বাড়বে। আমাদের শিখতে হবে ম্যাচ খেলেই, আর কোনো অপশন নেই। কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা, প্রক্রিয়া; এসব মাঠের বাইরের ব্যাপার। এসব আমার ফিটনেস, মানসিকতার উন্নতি ঘটাবে। কিন্তু দক্ষতার উন্নয়নে আমাকে ম্যাচ খেলতেই হবে। তো আমরা পেসাররা যতো বেশি সুযোগ পাব, ততো আমাদের ভালো করার সম্ভাবনা বাড়বে।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/04/30/taskins_day.jpg)
টিবিএস: শ্রীলঙ্কা সিরিজের পারফরম্যান্স কিছুটা প্রশান্তি দিচ্ছে কিনা? বর্তমানে মানসিক দিক থেকে কোন অবস্থায় আছেন?
তাসকিন: আমার মেন্টাল হেলথ এন্ড মাইন্ড ট্রেনার সাবিত ভাই (সাবিত রায়হান) আর ফিটনেস ট্রেনার দেবু দা ( মাসল মানিয়া জিমের ট্রেনার দেবাশীষ ঘোষ)। উনাদের সঙ্গে আমার সব সময় যোগাযোগ থাকে। কারণ এই দুটি বিষয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্যারিয়ারে। আমি এসব ঠিক রাখছি। পাশাপাশি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকা সাধারণ প্রক্রিয়াটা আমি ভালোভাবে মানছি যে, কীভাবে আমি আরেকটু ভালো করতে পারি। জীবনে কিছু না কিছু করার জন্য প্রতিদিনই একটা সুযোগ। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে যেমন বোলিং করেছি, কিছুটা প্রশান্তি তো অবশ্যই আছে। দেশের হয়ে অনেকদিন পর টেস্ট খেললাম, এটাই একজন বোলারের জন্য অনেক বড় কিছু। শুকরিয়া যে এবার আমি উইকেট পেয়েছি, আগের চেয়ে একটু ভালো বোলিং করতে পেরেছি। তবে এখনও অনেক কিছু করার বাকি।
টিবিএস: সাদা বল ও লাল বলে বোলিং করায় কতটা পার্থক্য লাগছে? সাদা বলে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণে কী বাংলাদেশের বোলাররা লাল বলে বোলিং করা সেভাবে রপ্ত করতে পারছেন না? এমন কখনও মনে হয়েছে?
তাসকিন: সাদা ও লাল বলে বোলিং করায় অবশ্যই পার্থ্যক্য আছে। লাল বল অনেক কঠিন ক্রিকেট। সত্যিকারের ক্রিকেটই হচ্ছে টেস্ট। এটা তো আমরা সবাই জানি। হয়তো আমাদের দেশে অনেকে টেস্ট ক্রিকেটকে সেভাবে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু এই ফরম্যাটই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট। আমার মনেহয় এই ফরম্যাটে মনোযোগ বাড়াতে হবে সবার। টেস্টের প্রতি ভালোবাসা, গুরুত্ব বেশি দিলে আরও ভালো হবে।
সাদা বল ও লাল বলের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কারণ এখানে শারীরিক-মানসিক সব দিক থেকেই আপনাকে ফিট থাকতে হবে। আর দক্ষ হতে হবে। তো কাজ তো করেই যাচ্ছি, আরও করব। সাদা বলে সুযোগ এলে তখন সেটাতে ফোকাস করব। লক্ষ্য একটাই, শেষ সিরিজের চেয়ে যেন কমপক্ষে ১ শতাংশ উন্নতি নিয়ে পরের সিরিজ খেলতে যেতে পারি।
টিবিএস: এই তাসকিনকে তার দ্বিতীয় ভার্সন বলা যায়?
তাসকিন: হাহাহা, দ্বিতীয় ভার্সন কিনা, এটা বলাটা কঠিন। তবে আগের থেকে সব ক্ষেত্রে অবশ্যই আমার পরিবর্তন হয়েছে, নিজেকে পরিবর্তন করেছি। আরও ভালো ভার্সন হতে হবে আমার লক্ষ্য অনুযায়ী। এখন যে অবস্থায় আছি, সেটা ঠিক আছে। তবে তৃপ্তি পেতে হলে নিজের আরও অনেক উন্নতি দরকার।
টিবিএস: ফিটনেস, বোলিং মিলিয়ে নিজেকে কোথায় দেখছেন? পথটা কি ঠিক মনে হচ্ছে এবার?
তাসকিন: হ্যাঁ, এই পথটা ঠিক আছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ আমি আমার মাইন্ড ট্রেনার, ফিটনেস ট্রেনার, সুজন স্যার, জাকি স্যারদের সঙ্গে কথা বলি নিয়মিতভাবে। তাদের মতেও আমি ঠিক পথে আছি, ভালো চলছে। তবে এই পথের অনেকটা পাড়ি দেওয়া বাকি এখনও। এই প্রক্রিয়াটা ধরে রাখতে হবে।
টিবিএস: আগের লকডাউনে নিজে নিজেই ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছেন, ওজন কমিয়েছেন বেশ। ওজন কমানোর সুফল মিলছে?
তাসকিন: ওজন কমানোর সাথে আপনার ফিটনেস ঠিক রাখাটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। আপনাকে ফিট ও শক্তিশালী থাকতে হবে। এটা নিয়ে বেশ আগে থেকেই কাজ করে আসছি। এখন করছি, সামনেও করে যাব।
টিবিএস: বোলিং থেকে শুরু করে শারীরিক গঠন, সব খানেই পরিবর্তন। তাসকিনের এই রূপ কীভাবে এলো, পুরো প্রক্রিয়াটা নিয়ে যদি বলতেন…
তাসকিন: পুরো প্রক্রিয়াটা গত লকডাউনে শুরু হয়েছিল। তখন আমি আমার ফিটনেস ট্রেনারের কাছে গিয়ে বললাম, আমাকে ট্রেনিং করান। আমাকে উনি বললেন, লকডাউনে সব বন্ধ। তাও আমি বললাম "সেফটি মেইন্টেইন করে একটু করান। আপনি এখন যদি আমাকে ট্রেনিং না করান, তাহলে আমি ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যাব। কারণ আমি অফ ফর্ম, ইনজুরিতে আছি, অনেক স্ট্রাগল করছি।" ওই সময় সাবিত ভাই, দেবু দা; সবার সাপোর্ট আমি নিয়েছি। সাপোর্ট নিয়ে আমার কাজ শুরু করলাম। সব কিছু যেন সুন্দর মতো করা যায়, তা নিয়ে কাজ করেছি। এখনও একই প্রক্রিয়ায় কাজ করছি। আশা করি চালিয়ে যাব।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/01/12/taskin_ahmed.jpg)
টিবিএস: বাউন্সারে আপনার অ্যাকুইরিসি এসেছে, লেংন্থ আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। এই পরিবর্তন কীভাবে?
তাসকিন: স্যারদের সাথে, বোলিং কোচদের সাথে কথা বলেছি। সেই সাথে জাতীয় দলের বোলিং কোচ ওটিস গিবসন, তিনিও অনেক সাহায্য করেছেন কৌশল ও দক্ষতায় উন্নতি করার জন্য। সবাই সবার মতো অনেক সাহায্য করেছেন।
টিবিএস: ওটিস গিবসনের সাথে কতোটা কাজ করেছেন? আপনার এই বদলে যাওয়ার পেছনে মাহবুব আলী জাকি এবং ওটিস গিবসনের অবদান কতোটা আছে?
তাসকিন: দুজনেরই অনেক অবদান আছে। জাকি স্যার আমাকে ছোটবেলা থেকেই চেনেন। আমাকে ছোট থাকা অবস্থায় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। দুজনই আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন সব ক্ষেত্রে। আমি তাদের প্রতি অবশ্যই অনেক কৃতজ্ঞ। জাকি স্যার, সুজন স্যার, সাবিত ভাই, দেবু দা; এই চারজন মানুষ গত লকডাউনে আমাকে অনেক বেশি সাহায্য করেছেন। জাতীয় দলে ওটিস গিবসনও আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন এবং করছেন। আমার বর্তমান পারফরম্যান্সে সেটার প্রভাব আছে।
টিবিএস: দীর্ঘ সময় দলের বাইরে থাকলে মনোযোগ সরে যায়। এভাবে অনেকেই পথ হারিয়েছেন, আপনি কীভাবে মনোযোগ ঠিক রেখেছেন?
তাসকিন: সত্যি বলতে আমার ফিরে আসার ইচ্ছা ছিল, তাই মন থেকে চেয়েছি ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াতে। এ ছাড়া মাশরাফি ভাই আমাদের তরুণ পেসারদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। আমি তো উনার বড় ভক্ত সব সময়ই। মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষেত্রে উনার অনেক কিছুই আমাকে সাহায্য করেছে।
টিবিএস: দীর্ঘ এই সময়ে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কী ছিল, কোন ব্যাপারটা হাল ছাড়তে দেয়নি?
তাসকিন: ব্যাপার একটাই, আমি কামব্যাক করবোই। ইচ্ছাটা, ক্ষিদেটা যখন মনে হয়েছে, তখন আমি ভেবেছি আমি কষ্ট করা বন্ধ করে যদি হেরেই যাই. তাহলে আমি চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড়দের কাতারে পড়লাম না। আর মাশরাফি ভাই এতো কষ্টেও যুদ্ধ করে গেছেন। ওই জিনিসটা আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করেছে। মনে হয়েছে ভাই পেরেছেন, আমরাও পারব।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/07/23/taskin_practice.jpg)
টিবিএস: ক্যারিয়ারের কঠিন এই সময়ে এমন কেউ ছিলেন, সামনে এগিয়ে যেতে যে আপনাকে সব সময় তাড়া দিয়ে গেছেন?
তাসকিন: পরিবারের সবাই এটা করেছেন। জাকি স্যার, সুজন স্যার, সাবিত ভাই, দেবু দা; এই চারটা মানুষ যাদের নাম বললাম, তারা অনেক সাহায্য করেছেন। মাশরাফি ভাইয়ের সঙ্গে যখন কথা হয়েছে, তিনিও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
টিবিএস: কখন মনে হলো এভাবে হচ্ছে না; গতি বাড়াতে হবে, নিজেকে বদলাতে হবে…
তাসকিন: যখন দেখলাম যে দুই বছর আগে সব কিছু পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, একেবারে সবকিছু বদলে যাচ্ছে। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে ক্রিকেট ভক্ত, সব কিছুতে পরিবর্তন আসা শুরু হলো। নিজের মধ্যে যখন মনে হলো আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি, তখনই মনে হয়েছে আমাকে বদলানো উচিত। এরপর মাঠ ও মাঠের বাইরে আমার সেরাটা দিয়েছি। ওভাবেই পরিকল্পনা করি। এরপর চেষ্টা, পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে ঠিক পথে ফেরাতে পেরেছি।
টিবিএস: বারবার বাদ পড়ে, সুযোগ না পেয়ে কখনও কি মনে হয়েছে, আমাকে দিয়ে আর হবে না মনেহয়…
তাসকিন: এ রকম দুই একবার মনে হয়েছে কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু পরে আবার একদিন, দুদিন পরই মনে হয়েছে, তাহলে তো হেরে গেলাম। আমাকে ভিন্ন কিছু করতে হবে। এতকিছু ভেবেই সব আবার শুরু করা। পরিবারের দিকে তাকিয়ে হলেও আমাকে কিছু করতে হবে।
টিবিএস: আপনার চেহারায় হিরো হিরো একটা ভাব ছিল, যেটা এখন নেই। এখন সত্যিকারের পেসার মনে হয় আপনাকে। ব্যাপারটা উপভোগ করার মতো নাকি হিরোর লুক মিস করেন?
তাসকিন: আয়নার সামনে দাঁড়ালে হিরোর লুকটা মাঝে মাঝে মিস করি। সব মেনে কঠোর পরিশ্রম করলে মুখের অবস্থা তুলতুলে থাকে না। সহজ করে বললে চাপা ভেঙে চায়। তো লুক তো আর ইচ্ছে করে পরিবর্তন করিনি, হয়ে গেছে এমন। চেহারা সুন্দর থাকুক, কে না চায়। তবে কিছু পেতে হলে কিছু হারাতে হয়। আর আমি এটাই এখন উপভোগ করছি। কারণ আমার পরিচয় পেসার, পেসার হিসেবে আমাকে যেমন দেখা উচিত, তেমন থাকতে চাই।
টিবিএস: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেক বছর হয়ে গেল। গতি সব সময়ই আপনার বড় অস্ত্র ছিল। এই মুহূর্তে আপনার সবচেয়ে বড় অস্ত্র কোনটা?
তাসকিন: এখনও আমার তেমন কোনো অস্ত্র হয়নি। বেসিক যে জিনিসটা, সেটাই ঠিক করার চেষ্টা করছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া যে, প্রকৃতিগতভাবে আমাকে পেস দিয়েছেন। এটা ধরে রাখার জন্য আমি কঠোর পরিশ্রম করছি। অ্যাকুরিসি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। ওই জায়গা থেকে সুইং, মুভমেন্ট শেখার চেষ্টা করছি। উন্নতি করছি। শেখার চেষ্টা করছি, শিখব আরও, এসবই। বেসিক জিনিসগুলো আরও ভালো করার চেষ্টা করছি। আস্তে আস্তে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য অন্যান্য জিনিসগুলো মাথায় রেখে কাজ করে যাচ্ছি। ইয়র্কার, নাকাল বল, স্লোয়ার সুইং; এগুলো নিয়েও কাজ করছি আমি।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/09/22/taskins_aim.jpg)
টিবিএস: সাড়ে তিন বছর পর টেস্টের একাদশে জায়গা পেলেন। এতোদিন পর সুযোগ, মনে মনে কী ঠিক করে মাঠে নেমেছিলেন?
তাসকিন: আমি যখন নিউজিল্যান্ডে ওয়ানডে খেলেতে নামি, আমার কাছে প্রতিটা ডেলিভারি বিশেষ কিছু ছিল। টেস্ট ম্যাচেও আমি ৭০ ওভার বোলিং করেছি। আমার মনে হয় না আমি একটা বলও হাল্কাভাবে নিয়েছি বা গা ছাড়া ভাব এসেছে। প্রতিটা বল মনোযোগ দিয়ে করার চেষ্টা করেছি। করার জন্য শুধু বোলিং করিনি, প্রতিটি বল আমি মন থেকে করেছি।
একেকটা বল আমার কাছে একেকটা লক্ষ্য ছিল। যখনই একটু ক্লান্ত লেগেছে, আমি মনে করেছি আমি দেশের হয়ে খেলতে নেমেছি, আমাকে পারতে হবে। এভাবে নিজেকে অনুপ্রাণিত করেছি। মনে মনে ভেবেছি, যে দেশের জন্য খেলার জন্য এতো কষ্ট করেছি, আমি সেই দেশের হয়ে এখন খেলছি, হাল ছাড়া যাবে না। অবশ্যই আমার সেরাটা দিতে হবে। এভাবে নিজেকে অনুপ্রাণিত করে বোলিং করে গেছি।
টিবিএস: নিউজিল্যান্ড সফর প্রসঙ্গ যেহেতু উঠলো, ওই সফর নিয়ে একটা প্রশ্ন। নিজের কাছে ওই সফরটা কেমন ছিল? বলা হয় নিউজিল্যান্ড পেসারদের জায়গা, উইকেটে সুবিধা থাকে, আপনার কাছে কী মনে হয়েছে?
তাসকিন: ওয়ানডে সিরিজে হয়তো আমি সেভাবে উইকেট পাইনি, তবে বোলিং মোটামুটি ভালোই হয়েছিল। ওই সিরিজ দিয়েই তো আমার ফেরা। ওখানেই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমার। হয়তো প্রত্যাশা মতো সব হয়নি, তবে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। দুর্ভাগ্যবসত আমাদের দলের ফল ভালো হয়নি তবে আমি আগের চেয়ে বোলিংয়ে ভালো করেছি। আগে যে আরও তিনবার নিউজিল্যান্ডে গিয়েছিলাম, প্রতিবারের চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স করেছি বলে মনে হয়।
টিবিএস: একটা ব্যাপার মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেছে যে, তাসকিনের বলে ক্যাচ পড়বেই। নিউজিল্যান্ডের পর শ্রীলঙ্কা সিরিজসহ আগেও এমন দেখা গেছে। বোলিং শুরুর আগে এই ব্যাপারটা কখনও মাথায় আসে?
তাসকিন: এই ব্যাপারটা একদমই আমার হাতে নেই। যেটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, সেটা নিয়ে ভেবে কিছু হবে না। উল্টো হতাশা বাড়বে। ক্যাচ পড়লে আমি কোনো বাজে রিঅ্যাক্ট করি না। কারণ কেউ তো আর ইচ্ছা করে ক্যাচ ফেলে না। আমি বেশিরভাগ সময় স্বাভাবিক রিঅ্যাকশনই দিই।
টিবিএস: ব্যাপারটা হতাশার কিনা, এর কারণে নিবেদনে প্রভাব পড়ে কিনা? নাকি আরও জেদ বেড়ে যায় কিনা যে এবার বোল্ড বা এলবডব্লিউ করব, যেন ক্যাচ না ধরতে হয়।
তাসকিন: সত্যি বলতে ক্যাচ পড়া কিন্তু ম্যাচেরই অংশ। এটা শুনতে যেমনই শোনাক, বিষয় এটাই। এখানে ব্যাপার হচ্ছে আমরা কী পরিমাণ ক্যাচ ফেলছি। ক্যাচ সব দলই ফেলে, কিন্তু আমাদের পরিমাণটা একটু বেশি ছিল। তো ম্যাচের মাঝে এ নিয়ে তেমন কিছু মনে হয় না। অনেক সময় ম্যাচের পরে মাঝে মধ্যে খারাপ লাগে, হতাশা কাজ করে। মনে হয় ক্যাচগুলো নিলে আরও বেশি উইকেট পেতে পারতাম, দলের উপকার হতো। তবে ক্যাচ পড়ার পর বোল্ড বা এভবিডব্লিউ করার তেমন জেদ কাজ করে না। কারণ এভাবে আপনি মেইন্টেইন করতে পারবেন না। যেটা আপনি সব সময় করতে পারবে না বা নিয়ন্ত্রনে নেই, এমন কিছু নিয়ে জেদ করলে আপনার ক্ষতি হবে, পিছিয়ে যাবেন।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/09/21/taskin.jpg)
টিবিএস: আপনি সব সময়ই বলেন আপনার আইডল মাশরাফি। দলের বাইরে থাকা সময়ে মাশরাফির সাথে কতোটা কথা হয়েছে? তার কোনো উপদেশ বা টিপস আপনার এই উন্নয়নে কাজে লেগেছে কিনা?
তাসকিন: মাশরাফি ভাই আমাদের সবার জন্য বড় এক অনুপ্রেরণার নাম। উনি যেভাবে ক্যারিয়ারে ফিরে এসেছেন বারবার, এটা যে কারও জন্য উদাহরণ, শুধু ক্রিকেটারদের জন্য নয়। প্রতিটা সিরিজের আগে বা পরে ভাইয়ের সাথে একবার হলেও কথা হয়। প্রশ্ন থাকে কেমন দেখলেন বা কোনটা উন্নতি করলে আরও ভালো হয়। কারণ মাশরাফি ভাইয়ের অধিনায়কত্বে আমি অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছি। উনি আমাকে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। তাই সুযোগ হলেই ভাইয়ের সাথে কথা বলি। উনি আমাদের দেশের অন্যতম সফল এবং কিংবদন্তি পেসার। উনার সঙ্গে কথা বলতে পারাও অনেকের জন্য বড় শিক্ষার।
টিবিএস: বাংলাদেশের বেশিরভাগ পেসারই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভোগেন, খারাপ সময় যায়। এর পেছেনে সামর্থ্য, দক্ষতা, ফর্ম বা ইঞ্জুরি থাকে। আপনি কোন জিনিসটা আলাদা করে করছেন, যে কারণে অন্যদের থেকে আপনার উন্নতি বেশি করে চোখে লাগছে? বা অন্য পেসাররা কোথায় পিছিয়ে আছেন?
তাসকিন: আমি যেটা আগেও বলালাম, আমি আমার প্রক্রিয়াটা ঠিকভাবে মেইন্টেইন করেছি। কোনো সময় ঢিল দিইনি। যা করেছি ঠিকভাবে করেছি। একটু কম অনুশীলন করি বা ফিটনেস নিয়ে এই কাজটা পরে করলেও হবে; মনকে এটা মানতে দিইনি। যেটা করা দরকার, সেটা করতে দেরি করিনি। পছন্দের অনেক জিনিস বলি দিয়েছি। আড্ডা দেওয়া, খাওয়া-দাওয়াসহ লাইফ স্টাইলে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইজ করেছি। অনেক পছন্দের খাবার সামনে পড়লেও এড়িয়ে যাই। আগে প্রায় প্রতিদিন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা হতো। ৭-৮ জন মিলে আড্ডা দিতাম। গত ৭-৮ মাসে এমন আড্ডা দিয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি ঠিক রেখেছি, এর বাইরে আসলে কিছু নেই। এই প্রক্রিয়ার মাঝেই আমার মাইন্ড ট্রেইনিং, ফিটনেস, স্কিল সবকিছু আছে।
টিবিএস: দল থেকে বাদ পড়ার প্রথম কোন জিনিসটা মাথায় এসেছিল যে, এটা নিয়ে কাজ করা দরকার বা এটায় ঠিকঠাক শতভাগ দিতে পারছি না বলে ভালো পারফরম্যান্স করতে পারছি না?
তাসকিন: আমার মনে হয়েছে, আমি যেহেতু একজন ফাস্ট বোলার, আমার পেস থাকতেই হবে। আমি যদি ১৩০ কিলোমিটারে সুইং করাই তাহলে অন্যরা আমার চেয়ে ভালো বোলার। ১৩০ কি.মি গতিতে সুইং করালে আমার কোনো লাভ হবে না। আমাকে ১৪০ কি.মি. গতিতে বোলিং করতে হবে, সেই সাথে অ্যাকুরিসি, মুভমেন্ট, সুইং নিয়ে কাজ করতে হবে। দিনশেষে কিন্তু আমাকে ফাস্ট বোলার হিসেবেই নেওয়া হয়। তো আমি স্থির করেছি আমাকে পেস রাখতেই হবে, সঙ্গে অন্যান্য ব্যাপারগুলোও ঠিক জায়গায় রাখতে হবে।
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2020/02/16/taskin-29.jpg)
টিবিএস: মাশরাফির ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে তাকে সোনার ডিম দেওয়া হাসের মতো টানা ম্যাচ খেলানো হয়েছে। তাতে তার ক্যারিয়ারে প্রভাব পড়েছে। তাসকিনের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে কিনা যে, দেশের বাইরে টেস্টে ভালো করছে, তাকে সবখানে সব ফরম্যাটে দেওয়া যায়। কিংবা দলের সবচেয়ে বড় বোঝা টানার জন্য আপনি প্রস্তুত কিনা?
তাসকিন: হ্যাঁ, এটার জন্য আমি প্রস্তুত। আমি যদি ফিট থাকি বা ভালো করি তাহলে দেশের হয়ে খেলাটাই আমার কাছে শেষ কথা। আমার কাছে সুযোগ এলে সেরাটা দিয়ে ভালো করার চেষ্টা করতে হবে। ফিট থাকা, মাঠের বাইরে বাড়তি কাজ করার ব্যাপারে ভালো ধারণা হয়েছে গত কয়েক বছরে। একা একা এটা করতে শিখেছি। আল্লাহর রহমত আর আমার প্রচেষ্টা, এই দুটো হলে ভালো কিছুই সামনে পাব।
টিবিএস: ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ। চেনা আঙিনায় লড়াই, দলে সুযোগ পেলে আরেকটু তোপ দাগা যাবে কিনা?
তাসকিন: আমাদের উইকেটের আচরণ একটু আলাদা থাকতে পারে। তবে ভারসাম্য তো একই, ভালো জায়গায় বল করতে হবে। আর ঘরের মাঠ হলে তো বেশি ভালো করার প্রত্যাশা সবারই থাকে। হোম গ্রাউন্ডে খেলা হবে, এটায় ভালো লাগছে। তবে প্রতিটা ম্যাচই কিন্তু নতুন চ্যালেঞ্জ। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের কন্ডিশনের মিল আছে। ওরা আমাদের মতো কন্ডিশনেই খেলে। ওদের জন্য স্পিনা বা পেস বোলিং খেলা যে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, তা কিন্তু নয়। উপমহাদেশের দলগুলো এখানে যেকোনো কিছু করতে পারে, এটা তো সবারই জানা।
টিবিএস: এবার তাহলে পরিকল্পনা কী? এই ধারাবাহিকতায় কতটা পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব বলে মনে হয়?
তাসকিন: পরিকল্পনা একই, সর্বোচ্চটা দিয়ে ভালো বোলিং করে যাওয়া। ভালো করাই একমাত্র পরিকল্পনা। আমার মনেহয় এরচেয়ে ভালো পরিকল্পনা আর নেই। পরিশ্রম করে যে পথটা পেয়েছি, এই পথেই থাকতে চাই। এখনও প্রত্যাশার কিছুই পূরণ করতে পারিনি, আগামীতে পুরোটা পূরণ করতে না পারলেও এমন একটা জায়গায় পৌঁছাতে চাই, যেখান থেকে পেছন ফিরলে ভালো লাগা কাজ করে।