‘তিন ভাইয়ের’ টিপসে মিরাজের সেঞ্চুরি
অভিষেক যুব টেস্টেই মিলেছিল সেঞ্চুরির দেখা। সেটাও ২০১৩ সালে, ১৫ বছর বয়সে। এরপর স্বীকৃত ক্রিকেটে খেলে ফেলেছেন ২৪৭টি ইনিংস। কিন্তু মেহেদী হাসান মিরাজের সেঞ্চুরির স্মৃতি ওই একটিই। অবশেষে অপেক্ষা ফুরিয়েছে তরুণ এই অলরাউন্ডারের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টের প্রথম ইনিংসে দলকে ৪৩০ রানের বড় সংগ্রহে পৌঁছে দেওয়ার পথে মিরাজ খেলেছেন ১০৩ রানের দারুণ এক ইনিংস।
টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নিয়ে মিরাজ যেন মনে করিয়ে দিলেন, তার পরিচয়টা ব্যাটিং অলরাউন্ডার। দুটি যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়া মিরাজ ছিলেন ব্যাটিং অলরাউন্ডারই। কিন্তু জাতীয় দলে তার পরিচয় হয়ে ওঠে স্পিনার। এই পরিচয় মুছে দিতেই যেন বেরিয়ে এলো মিরাজের ব্যাটিং সত্ত্বা। যে সত্ত্বা ফিরিয়ে আনতে সাকিব, তামিম, মুশফিকদের দেওয়া পরামর্শ কাজ করেছে টনিকের মতো। দ্বিতীয় দিন শেষে মিরাজ এমনই জানালেন। তরুণ এই অলরাউন্ডার কথা বলেছেন প্রথম সেঞ্চুরির অনুভূতি, ভালো ব্যাটিংয়ের রহস্য নিয়েও।
প্রশ্ন: প্রথম সেঞ্চুরির অনুভূতি কেমন?
মেহেদী হাসান মিরাজ: আল্লাহর কাছে লাখও শুকরিয়া। খুব ভালো লাগছে। অনুভূতি সত্যিই অবিশ্বাস্য। অনেক ভালো লাগছে।
প্রশ্ন: একজন ব্যাটসম্যানের ক্যারিয়ারে সেঞ্চুরি কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?
মিরাজ: আমি যখন শুরু করেছি, তখন আমি হয়তো ভালো ব্যাটিং করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি আস্তে আস্তে চেষ্টা করেছি নিজেকে উন্নত করার। আমি মনে করি, গত কয়েকদিনে যা কাজ করেছি, তা অনেক ভালো হয়েছে। সেটার জন্য হয়তো আজকের ব্যাটিংটা ভালো হয়েছে।
প্রশ্ন: এমন ব্যাটিংয়ের রহস্য কী? তামিমের পরামর্শের কতোটা ভূমিকা রেখেছে?
মিরাজ: আমি যখন সেদিন নেটে ব্যাটিং করছিলাম, তখন তামিম ভাই আমাকে দুই-একটা পরামর্শ দিচ্ছিলেন। এরআগে আমি যখন ব্যাটিং করেছি, মুশফিক ভাই অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। উনি যখন ব্যাটিং প্র্যাকটিসে আসতেন আগে আগে, আমাকেও নিয়ে আসতেন। উনিও ব্যাটিং করতেন, আমাকেও ব্যাটিং করাতেন। এক সপ্তাহ আগেও আমি উনার সাথে ব্যাটিং নিয়ে অনেক কাজ করেছি। তারপর তামিম ভাই সেদিন আমাকে একটা পরামর্শ দিয়েছেন জোরে আসা বলগুলো কীভাবে খেলতে হবে, শরীরের দিকে আসা বলগুলো কীভাবে খেলতে হবে।
তামিম ভাই শুধু একটা কথা বলেছেন যে, শরীরের দিকে আসা বলগুলো সোজা রাখার জন্য, এটা যেন না ঘুরিয়ে দেই। আজকে এটা প্রয়োগ করেছি। গ্যাব্রিয়েল যখন আমাকে শরীর বরাবল বল করেছে, যতটা সম্ভব সোজা রাখতে পেরেছি এবং ছেড়ে দিয়েছি। এক সপ্তাহ আগে মুশফিক ভাইয়ের সঙ্গে যে ট্রেনিং করেছি, তখন মুশফিক ভাই একটা কথা বলেছেন যে, সোজা খেলতে হবে এবং বাইরের বলে যেন খোঁচা না দিই। এটা যেন ছেড়ে দিই। পাশাপাশি সব সময় যেন মনোযোগ ধরে রাখি এবং বল টু বল খেলার চেষ্টা করি। দুজনের পরামর্শই অনেক কাজে লেগেছে।
প্রশ্ন: কী লক্ষ্য নিয়ে ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন?
মিরাজ: ব্যাটিংয়ে নামার সময় এমন কিছু মাথায় ছিল না। আমার প্রথম যে কোচ আল মাহমুদ, খুলনা থেকে আমাকে ফোন করেছিলেন যে, 'এই ম্যাচে একটা সেঞ্চুরি দেখতে চাই'। কিন্তু আমার নিজের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আট নম্বরে নেমে সেঞ্চুরি করা কীভাবে সম্ভব। তবে তিনি আমাকে সবসময় উৎসাহ দিচ্ছিলেন, বলছিলেন 'তুই যদি ভালোভাবে খেলতে পারিস, ভালো সুযোগ আছে, সেঞ্চুরি হতে পারে।' সবসময় সাহস দিচ্ছিলেন। তবে আমার নিজের ভেতরে বিশ্বাস হচ্ছিল না। এখন বিশ্বাস হচ্ছে যে, শেষের দিকে যদি ব্যাটসম্যান ভালো খেলে, তাহলে ভালো রান করা, সেঞ্চুরি করা সম্ভব।
প্রশ্ন: সাকিব আউট হয়ে ফিরে যাওয়ার সময়ে কোনো পরামর্শ দিয়েছিলেন?
মিরাজ: আমি যখন উইকেটে যাই, তখন একটু নার্ভাস ছিলাম। সাকিব ভাইয়ের সাথে আমি কথা বলছিলাম যে, ভাই কী করলে ভালো হয়। সাকিব ভাই একটা কথা বলেছেন স্বাভাবিক ক্রিকেট খেলতে এবং যদি আত্মবিশ্বাস থাকে যে মারলে পার হয়ে যাবে বা যে শটই খেলি যেন সাহস নিয়ে খেলি। যেমন মাঝখানে হয়তো আমি নিজের চাপ কমাতে স্লগ সুইপ চেষ্টা করব। তখন সাকিব ভাই আমাকে বলেন যে, এখানে স্লগ সুইপের চেয়ে প্যাডল সুইপ করলে ভালো।
তখন আমার মাথায় চিন্তাটা কাজে লেগেছে যে, আমি যদি স্লগ সুইপের বদলে প্যাডল সুইপ খেলি, তাহলে হয়তো ভালো হবে, আউট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। এসব ছোট ছোট জিনিস অনেক গুরুত্বপূর্ণ, যা আমাকে হয়তো সাহস দিয়েছে। যেমন নামার আগে মুশফিক ভাই দুই-একটা কথা বলেছে যে, 'এই উইকেটে অনেক সুযোগ আছে, ৭০ রানে নটআউট থাকতে পারবি।' ড্রেসিং রুমে সিনিয়র খেলোয়াড়রা যখন ব্যাকআপ করে জুনিয়র খেলোয়াড়কে, তখন আমাদের বুক অনেক বড় হয়ে যায় এবং ভালো করতে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করা যায়।
প্রশ্ন: তাইজুল-নাইমের সঙ্গে জুটি হয়েছে আপনার। ৯০ এর ঘরে গিয়ে মুস্তাফিজকে কী বলেছেন?
মিরাজ: মুস্তাফিজ আমাকে বলেছে যে, 'দোস্ত, আমার খুব ভয় লাগছিল তোর টেনশনে যে, তোর ৯০ হয়ে গেছে, ওখানে যদি আমি আউট হয়ে যাই।' কিন্তু আমি ওকে একটা কথাই বলেছি, 'দোস্ত এটা তোর হাতেও না, আমার হাতেও না। তুই তোর স্বাভাবিক ক্রিকেট খেল। যদি আমার কপালে থাকে, তাহলে ১০০ হবে।' আমার করতেই হবে এটা আমি কখনও চিন্তা করিনি। আমি চিন্তা করেছি যে, আল্লাহ যদি আমার কপালে রাখেন, তাহলে সেঞ্চুরি হবেই। এটার ওপর অনেক বিশ্বাস করেছি।
প্রশ্ন: ২০১৩ সালে যুব টেস্টে সেঞ্চুরি, বয়সভিত্তিকে ব্যাটসম্যান পরিচিত কিন্তু জাতীয় দলে উল্টো চিত্র। এই সেঞ্চুরি কি ব্যাটিং সত্ত্বাকে আবারও বিকশিত করলো?
মিরাজ: আমি ব্যাটিংটাও করতে পারি। আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা করি ভালো ব্যাটিং করতে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমি বোলার হিসেবে শুরু করেছি। আমি যদি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতাম, তাহলে জাতীয় দলে খেলতে পারতাম না। বাংলাদেশ দলে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড় অনেক। আমার জন্য সবচেয়ে ভালো অপশন অফ স্পিনার-ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলা। এটা হলে টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচরা চিন্তা করবে যে, বোলিংয়ের পাশাপাশি ব্যাটিংটাও সে ভালো করে। আমি সবসময় চেষ্টা করি বোলিংটা ভালো করার জন্য। বোলিং আমার অস্ত্র, আর ব্যাটিং হলো আমাকে আত্মবিশ্বাস দেয়।
প্রশ্ন: নাঈম হাসানের সঙ্গে আপনার প্রতিযোগিতা হয়। আজকের ইনিংস কি জায়গা প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করবে?
মিরাজ: আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনেক কঠিন। আজ হয়তো ভালো হয়েছে, ভবিষ্যতে ভালো ও খারাপ সময় যাবে। টিম কম্বিনেশনের জন্য অনেক কিছু হতে পারে। সবার আগে দল প্রথম। আমি আজ ১০০ করেছি, পরেরদিন রান নাও করতে পারি। উইকেট নাও পেতে পারি। এগুলো জীবনের অংশ। সবার মাথায়ই থাকে সবার আগে দল। দলের জন্য খেলতে হবে, দলের চিন্তা করতে হবে। এখন অবশ্যই নিজের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। অনেকদিন ধরে রান পাচ্ছিলাম না। নিজেও হতাশ ছিলাম। নাঈম ভালো অফ স্পিনার। আমিও খেলছি, এটা হয়তো টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। তারা যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই ভবিষ্যতে করবে।
প্রশ্ন: এই সেঞ্চুরি অলরাউন্ডার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে কতোটা সাহায্য করতে পারে?
মিরাজ: আমার নিজের জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। আমি খুব একটা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। কিন্তু এখন আমার মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে যে, যদি আমি ব্যাটিং নিয়ে আরও পরিশ্রম করি, কাজ করি, তাহলে অবশ্যই ভালো অলরাউন্ডার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। আমার কথা হলো যেহেতু আমার সুযোগ আছে, তাহলে কেন আমি সেই সুযোগ কাজে লাগাব না।
প্রশ্ন: কতটুকু পরিশ্রম করলে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব?
মিরাজ: আসলে পরিশ্রম অনেক করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। যারা অভিজ্ঞ হয়েছে, তারা কিন্তু একদিনে হয়নি। এখনও তারা পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আমাদের জুনিয়রদের উচিত অভিজ্ঞদের দেখে শেখা। আমি নিজেও শিখি। ভালো খেলার জন্য তারা যে কষ্ট করেছে, আমি তাদের দেখে পরিশ্রম করার আত্মবিশ্বাসটা পাই। আমি মুশফিক ভাইয়ের সঙ্গে ব্যাটিং, ফিটনেস নিয়ে কাজ করেছি। তার কাছ থেকে অনেক টিপস নিচ্ছি।
প্রশ্ন: সেঞ্চুরিটি কাকে উৎসর্গ করতে চান?
মিরাজ: উৎসর্গ অবশ্যই পরিবারের সকল সদস্যকে করতে চাই। মা-বাবা আমার জন্য দোয়া করেন। আমার স্ত্রী আছে, ছোট বাবু আছে। আমার স্ত্রী আমার সন্তানকে বলে বাবাকে দোয়া করে দাও। এতটুকু বাচ্চা, সে কী বোঝে, তাও তাকে দোয়া করতে বলা হয়। পরিবার সবসময়ই আমার জন্য দোয়া করে।