গোল উৎসব করে শেষ আটে ব্রাজিল, নিভে গেল এশিয়ার আশার সূর্য
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2022/12/06/brazil_1.jpg)
ভিনিসিয়ুস, নেইমার, রিচার্লিসন, পাকেতা; চার তারায় চার ঝলক। এসব ঝলকও নয়, যেন সূর্যরশ্মি। তাতে পুড়ে ভস্ম প্রতিপক্ষ শিবির। যেখান থেকে উঠে আর দাঁড়ানো যায় না। পারেনি দক্ষিণ কোরিয়াও। নেইমারকে একাদশে ফিরে পেয়ে উজ্জীবিত ব্রাজিল করে গেল গোল উৎসব। অনেক চেষ্টায় কোরিয়া একবার জালের ঠিকানা পেলেও তা ব্যবধান কমালো মাত্র। দাপুটে জয়ে কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে গেল পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা।
সোমবার রাতে কাতারের ৯৭৪ স্টেডিয়ামে শেষ ষোলোর ম্যাচে এশিয়ার শেষ প্রতিনিধি দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে ব্রাজিল। সেমি-ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হবে সেলেসাওরা। ম্যাচটি আগামী ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় শুরু হবে। দক্ষিণ কোরিয়ার এই হারে নিভে গেল এশিয়ার সূর্য। আগের ম্যাচে টাইব্রেকারে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে হেরে বিদায় নেয় এশিয়ার আরেক দেশ জাপান।
গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে বেঞ্চ যাচাই করতে গিয়ে বিপাকেই পড়েছিল ব্রাজিল। ৯টি পরিবর্তন এনে ক্যামেরুনের বিপক্ষে হারতে হয় ম্যাচ। তাতে কিছুটা হলেও ছন্দে ছেদ পড়েছিল। শেষ আটে ওঠার লড়াইয়ে একাদশে ফিরলেন চোট কাটিয়ে ওঠা নেইমার, ফিরলেন বাকি তারকারাও। তাকে ব্রাজিল হয়ে উঠলো দুর্বার, দুরন্ত, অপ্রতিরোধ্য। একবার করে জালের ঠিকানা করে দলকে উৎসবে মাতালেন ভিনিসিয়ুস, নেইমার, রিচার্লিসন ও পাকেতা।
ম্যাচ শুরুর বাঁশি বাজতেই ব্রাজিলের চোখ জুড়ানো নান্দনিক ফুটবলের শুরু। নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ, দারুণ ড্রিবলিংয়ে একের পর এক আক্রমণে প্রতিপক্ষকে দিশেহারা করে দেওয়া। প্রথমার্ধেই জয়ের কাজটা প্রায় সেরে ফেলায় দ্বিতীয়ার্ধের অথি সাবধানতা ব্রাজিলের জয়ের মাহাত্ম্য একটুকুও কমাতে পারেনি। ৫৪ শতাংশ সময় বল পায়ে রাখা ব্রাজিল গোলমুখে শট নেয় ১৮টি, এর মধ্যে ৯টি ছিল লক্ষ্যে। ব্রাজিলের গতিময় ফুটবলে দিক হারিয়ে ফেলা দক্ষিণ কোরিয়ার নেওয়া ৮টি শটের ৬টি ছিল লক্ষ্যে।
পুরো মাঠে রাজত্ব কায়েম করে খেলা ব্রাজিল এগিয়ে যেতে সময় নেয়নি। সপ্তম মিনিটেই হলুদ ঢেউয়ে কোরিয়াকে কাঁপিয়ে দেয় তারা। ডান প্রান্ত দিয়ে আক্রমণে উঠে রাফিনহা ক্রস করেন ডি-বক্সে। জটলা পেরিয়ে দূরের পোস্টে বল পান ভিনিসিয়ুস। এগিয়ে যান কোরিয়ান তিন ডিফেন্ডার ও গোলরক্ষক কিম সিউং-গিউ। কিন্তু অসাধারণ শটে তাদের মাথার উপর দিয়ে বল পাঠিয়ে জাল খুঁজে নেন ভিনিসিয়ুস।
ব্যবধান বাড়াতেও সময় লাগেনি। ১৩তম মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করেন নেইমার। রিচার্লিসন ডি-বক্সে ফাউলের শিকার হলে পেনাল্টি পায় ব্রাজিল, স্পট-কিক থেকে সহজেই বল জালে পাঠান নেইমার। বিশ্বকাপে এটা তার তৃতীয় গোল, এবারের আসরের প্রথম। ব্রাজিলের হয়ে করা সর্বশেষ ৬টি গোলই পেনাল্টি থেকে করলেন তারকা এই ফরোয়ার্ড।
১৩ মিনিটের মধ্যেই দুই গোল, বিশ্বকাপে ব্রাজিলের দারুণ এক অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি। নিজেদের দীর্ঘ বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো প্রথম ১৩ মিনিটের মধ্যে দুটি গোল করলো লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের দেশটি। এর আগে ২০০২ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে কোস্টারিকার বিপক্ষে প্রথম ১৩ মিনিটে ২ গোল দিয়েছিল সেলেসাওরা। বিশ্বকাপ জেতার আসরের সেই ম্যাচে ব্রাজিল জিতেছিল ৫-১ গোলের বিশাল ব্যবধানে। এবার জয়টি এলো ৪-১ ব্যবধানে।
দুই গোল হজম করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কোরিয়ানরা। ১৬তম মিনিটে হোয়াং হি-চ্যান ডি-বক্সের বাইরে থেকে দূরপাল্লার শট নেন। ঝাঁপিয়ে দলকে বিপদমুক্ত করেন ব্রাজিলের গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার। ২৯তম মিনিটে আবারও গোল উৎসবে মাতে ব্রাজিল। দারুণ কারিকুরিতে চোখ ধাঁধানো গোল করেন রিচার্লিসন। বল পেয়ে ছোট ছোট দুই হেডে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে মার্কিনিয়োসকে পাস দেন তিনি। এরপর বল পাওয়া থিয়াগো সিলভা রক্ষণচেরা পাস বাড়ান, দারুণ প্লেসিং শটে লক্ষ্যভেদ করেন রিচার্লিসন। এবারের বিশ্বকাপে এটা তার তৃতীয় গোল।
তিন মিনিট পর আক্রমণ সাজায় দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু কোণা থেকে হি-চ্যানের আরেকটি প্রচেষ্টা ফিরিয়ে দেন অ্যালিসন। দুই মিনিট পর কাসেমিরো দূর থেকে শট নিয়ে জালের ঠিকানা পাননি। ৩৬তম মিনিটে মিলে যায় চতুর্থ গোল। নেইমারের পাস থেকে বল পেয়ে ভিনিসিয়ুস বাড়ান পাকেতাকে। সহজেই বল জালে জড়িয়ে দেন তিনি। বিরতির আগ মুহূর্তে আরও এগিয়ে যেতে পারতো ব্রাজিল। কিন্তু রাফিনহার পাস থেকে বল পেয়ে পাকেতার নেওয়া শট রুখে দেন কোরিয়ার গোলরক্ষক।
দুর্বার ফুটবলে প্রথমার্ধেই প্রায় জয় নিশ্চিত করে ফেলে ব্রাজিল। এই অর্ধে চারটি গোল দেওয়ার পাশাপাশি মাঠের প্রতিটা অংশে দাপট ধরে রেখে খেলে সেলেসাওরা। ৫৮ শতাংশ সময় বল পায়ে রাখেন নেইমার, কাসেমিরো, ভিনিসিয়ুসরা। তাদের নেওয়া ১০টি শটের ৬টি ছিল লক্ষ্যে, এর মধ্যে চারবার মেলে জালের দেখা। আক্রমণ সামলাতেই ব্যতিব্যস্ত থাকা কোরিয়া গোলমুখে ৪টি শট নেয়, একটি ছিল লক্ষ্যে।
৪-০ গোলে এগিয়ে থাকায় বিরতির পর একই কৌশলে খেলেনি ব্রাজিল, সতর্কতা বজায় রেখে কিছুটা সাবধানী ফুটবল খেলে তারা। এ সময়ে আক্রমণের ধারা বাড়ায় কোরিয়া। এই অর্ধের শুরুতেই আক্রমণে যায় তারা। ৪৮তম মিনিটে সতীর্থের লম্বা পাস থেকে বল পেয়ে সন হিউং-মিন শট নেন গোলমুখে। অসাধারণ দক্ষতায় তা প্রতিহত করেন ব্রাজিল গোলরক্ষক অ্যালিসন। ছয় মিনিট পর পাল্টা আক্রমণে গিয়ে শট নেন রাফিনহা, ফিরিয়ে দেন সিউং-গিউ।
কিছুক্ষণ পর ভিনিসিয়ুসের শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ৬১তম রাফিনহার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। গোলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা দক্ষিণ কোরিয়া ৭৬তম মিনিটে জালের ঠিকানা পায়। ডি-বক্সের বাইরে থেকে সতীর্থের ফ্রি-কিক ব্রাজিল ডিফেন্ডারের গায়ে ফিরে আসে। ফিরতি বলে বাঁ পায়ের জোরালো শটে গোল করেন পাইক। ৮০তম মিনিটে দুটি পরিবর্তন করে ব্রাজিল। গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার ও নেইমারকে তুলে নামানো হয় উইভারতন ও রদ্রিগোকে।
৮৩তম মিনিটে সম্ভাবনা তৈরি করে দক্ষিণ কোরিয়া, কিন্তু পাইকের নেওয়া নিচু শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। দুই মিনিট পর পঞ্চম গোলের দেখা পেয়ে যেতে পারতো ব্রাজিল। কিন্তু বদলি হিসেবে নামা রদ্রিগোর কাটব্যাক রিচার্লিসনের কাছে পৌঁছানোর পরিষ্কার করে কোরিয়া। ৮৮তম মিনিটে ডি-বক্সের ভেতর থেকে দানি আলভেসের দারুণ শট কোরিয়ার রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের গায়ে লেগে বেরিয়ে যায়। বাকি কয়েক মিনিটে কোনো দলই সম্ভাবনা জাগাতে পারেনি।