এক অসম্মতির চুমু যেভাবে স্পেনের নারীদের বিশ্বকাপ জয় ম্লান করে দিয়েছে
প্রথমবার বিশ্বকাপ জিতেছে স্পেনের নারী ফুটবল দল। নিজ দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা জেনি হেরমোসো মঞ্চে উঠে নিজের পদক সংগ্রহ করে এগিয়ে গেলেন স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট লুইস রুবিয়ালেসের দিকে। এসময় অপত্যাশিতভাবে এবং সম্মতি ছাড়াই হেরমোসোর ঠোঁটে চুমু দিলেন রুবিয়ালেস। যে চুমু আর শুধু চুমু হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকেনি।
ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই, বিশ্বকাপ জয়ের পরপর দলটির কোচ জর্জ ভিলদা গর্ব করে বলতে থাকেন 'আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন'। যদিও তাকে তিরস্কারই করছিলেন সমর্থকরা। কারণ কয়েক বছর ধরেই ভিলদা এবং তার অন্যান্য পুরুষ সহকর্মীদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফুটবলাররা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। খেলতেও অস্বীকৃতি জানায়। তাদের অনেকেরই পরে বিশ্বকাপ দলে জায়গা হয়নি।
অসম্মতিতে ঘটা রুবিয়ালসের এই চুমু যেন স্প্যানিশ নারী ফুটবল দলে চলতে থাকা অসমতা আর নিপীড়নেরই চিত্র। যেখানে খেলোয়াড়দের বেতন যৎসামান্য, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত, থাকার ব্যবস্থাও যথেষ্ট নয়, এমনকি সহায়তা কর্মীরও সংকট বিদ্যমান।
নারী ফুটবল বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির অ্যাকর স্টেডিয়ামে ৭৫ হাজারের বেশি দর্শক উপস্থিত হন। স্পেনের আরো ৯০ লাখ দর্শক টিভিতে ফাইনাল দেখেন। আর ভিআইপি বক্সে বসে খেলা দেখছিলেন রুবিয়ালেস। তার পাশেই ছিলেন স্পেনের রানি লেটিসিয়া এবং ১৬ বছর বয়সী রাজকুমারী ইনফ্যান্টা। এসময় বিশ্বকাপ জয় উদযাপনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে বসেন রুবিয়ালেস।
অন্যদিকে প্রায়ই অনুপস্থিত থাকা কোচ গণমাধ্যমে একের পর এক বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছিলেন। এমনভাবে জয় উদযাপন করছিলেন যেন এটি তার নিজের। স্পষ্টতই, পুরুষতান্ত্রিক আচরণ তখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেরিয়ে আসছিল।
খেলা শেষ হওয়ার পনেরো মিনিট পরে পদক পরিয়ে দেওয়া হয় খেলোয়াড় ও কোচদের। রানি লেটিসিয়া, রাজকন্যা ইনফ্যান্টা, ফিফা প্রেসিডেন্ট জিয়ান্নি ইনফান্তিনো এবং রুবিয়ালেস তাদের অভ্যর্থনা জানান। যখন জেনিফার হেরমোসো রুবিয়ালেসের কাছে পৌঁছান, তিনি প্রথমে তাকে জড়িয়ে ধরেন, তারপর তার মাথার দুই পাশে তার হাত রাখেন। তারপর শক্ত করে তার ঠোঁটে চুমু খান।
চেঞ্জিং রুমে খেলোয়াড়রা জয় উদযাপন করেন। ইনস্টাগ্রাম লাইভে হেরমোসো চুমু সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমি কী করব? আমি এটা পছন্দ করিনি।
এরপর উদযাপনের মধ্যে রুবিয়ালেস আসেন। ইন্সটাগ্রামে লেফট উইঙ্গার সালমা প্যারালুয়েলো তার উপস্থিতি ধারণ করেন। স্প্যানিশ ফুটবলের প্রেসিডেন্ট হেরমোসোর কাঁধে হাত রাখেন। এরপর খানিকটা দূরে সরে হেরমোসোকে বিয়ে করবেন বলে জানান। এবং বিয়ে উদযাপনে তাকে ইবিজা সৈকতে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
চুমুর ছবি এবং ড্রেসিং রুমের ভিডিও এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। অসম্মতিমূলক কাজ এবং অশ্লীল মন্তব্য ভাইরাল হওয়ার পর রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশন (আরএফইএফ) একটি বিবৃতি জারি করে। আরএফইএফ দাবি করেছে যে, হেরমোসোর মন্তব্য নিয়ে তারা বিবৃতি দিচ্ছে।
বিবৃতি মতে হেরমোসো বলেন, এটি ছিল অপরিমেয় আনন্দের একটি স্বতঃস্ফূর্ত পারস্পরিক অঙ্গভঙ্গি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দুর্দান্ত। আমাদের সবার সাথে তার আচরণ অসাধারণ। চুমু ছিল স্নেহ ও কৃতজ্ঞতার বহিপ্রকাশ।
যদিও বিবৃতিতে ইন্সটাগ্রামে করা তার মন্তব্যের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি।
রুবিয়ালেস বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথেও কথা বলে দাবি করেছেন যে, 'ভুল' কারণে হইচই হচ্ছে। চুমু ছিল 'দুই বন্ধু কোন কিছু উদযাপন' করার মতো কিছু। যারা এ বিষয়ে ক্ষুদ্ধ তাদের রুবিয়ালেস 'বোকা' বলে সম্বোধন করেন।
জেনি হেরমোসো গণমাধ্যমকে বলেন, 'আর কিছু বলার নেই' এবং ঘটনাটি একটি 'উপাখ্যান' হয়ে থাকবে।
তবে বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্তে যখন ফেডারেশনের চেয়ারম্যান প্রকাশ্যে তাকে চুমু খান তখন একজন নারী ক্রীড়াবিদ আর কি করবেন বলে আশা করা যায়?
কয়েক ঘণ্টা পর, চাপের মুখে রুবিয়ালেস ক্ষমা চান। সাথে বিজয়ের মুহূর্ত 'বিবর্ণ' করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তবে প্রকৃত অর্থে রুবিয়ালেসই এই ঐতিহাসিক বিজয়ে দাগ লাগিয়েছেন। তার কথায় কেবলমাত্র সম্মানের অনুপস্থিতিই ছিল না; বরং ধর্ষণ সংস্কৃতির ব্যাপকতাও লক্ষ্য করা গেছে। যেখানে বিশ্বাস করা হয় এবং এমন আচরণ করা হয় যে, নারী ও নারীর দেহ পুরুষদের সম্পত্তি।
হেরমোসোর ব্যক্তিগত অনুভূতি বিবেচনা না করে এবং পরিণতি ভোগের শঙ্কা ছাড়া রুবিয়ালেসের চুমু দেওয়ার বিষয়টি সম্মতির সংস্কৃতির অনুপস্থিতির প্রতি ইঙ্গিত দেয়। যেসব গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বিষয়টা 'এতটাও মন্দ নয়' তাদের কোনো কিছুর সীমা কোথায় সে সম্পর্কে বোধগম্যতার অভাব আছে। কিছু পুরুষের কাছে কোন সীমাই নেই। লাখ লাখ মানুষের সামনে এক নারীকে জোরপূর্বক চুমু দেওয়া প্রমাণ করে যে, ধর্ষণ সংস্কৃতি জনজীবনে কত উপায়ে প্রবেশ করানো হয় এবং দায়মুক্তি দিয়ে তার চর্চাও হয়।
স্পেনের সমতা বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী আইরিন মন্টেরো এক্স (টুইটার)-এ লেখেন, আসুন সম্মতি ছাড়া চুমুকে স্বাভাবিক বলে মনে করাকে আমরা মেনে না নিই। এটি যৌন সহিংসতার একটি রূপ যা নারীদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঘটে। আমরা এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিতে পারি না।
সামাজিক অধিকারমন্ত্রী ইওন বেলারা রিটুইট করেন এই টুইটটি। সাথে যোগ করেন, স্পেনের সবাই দেখছে এমন অবস্থায় এ কাজ করা হলো, আর প্রাইভেট মুহূর্তে কি করতে পারে? নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা বন্ধ করতে হবে।
মন্ত্রীরা যে যৌন সহিংসতার কথা উল্লেখ করেছেন তা স্প্যানিশ আইনেই আছে। বলা আছে, অন্য ব্যক্তির সম্মতি ছাড়াই কোনো কাজ যদি তার যৌন স্বাধীনতা লঙ্ঘন করে এবং পদের অপব্যবহার করে কোন যৌন ক্রিয়া সম্পাদিত হয় তাহলে তা যৌন নিপীড়ন বলে বিবেচিত হবে।
দেশের ক্রীড়া আইনেও ফেডারেশন এবং পেশাদার লীগগুলোর জন্য এই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ও পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। এমন ঘটনা গুরুতর অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে শাস্তিযোগ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। রুবিয়ালেসের কাণ্ডের মতো ঘটনায় আইনে তিরষ্কার থেকে শুরু করে ৬০০ থেকে ৩,০০০ ইউরো জরিমানা এবং এক থেকে দুই বছরের জন্য তাকে পদের জন্য অযোগ্য করা যেতে পারে।
২০২২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের আগস্টের মধ্যে স্পেনের নারী ফুটবল দল অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়নশীপ, অনূর্ধ্ব-২০ চ্যাম্পিয়নশীপ এবং সর্বশেষ নারী বিশ্বকাপ জিতেছে। একমাত্র দল হিসেবে একই সাথে এই তিন শিরোপা জেতার কৃতিত্ব দেখিয়েছে স্পেনের নারীরা।
সিডনির রাতটি কেবল বিশ্বমঞ্চে শিরোপা জেতায় সীমাবদ্ধ নেই বরং এটি মেয়ে ও নারীদের জন্য সামাজিক সমতার প্রতীকী জয়ও। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হিসেবেও, বিশ্বকাপ হাতে থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ এই বিজয়ীদের একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোন থেকে দেখেন। আর তা হলো- সম্মতি ছাড়াই তাদের চুমু দেওয়া এবং অশোভন মন্তব্য করা যেতে পারে এবং তারা বিশ্বাস করে তাদের সে ক্ষমতা আছে।