আনন্দ নগরীতে নিরুত্তাপ বিশ্বকাপ, দুঃখ ঘোচানোর আশায় বাংলাদেশ
আনন্দের শহর কলকাতা, ইংরেজি নামটাই অবশ্য বেশি যায় ভারতের এই শহরটির সঙ্গে; সিটি অব জয়। ইতিহাস, সংস্কৃতি, এখানকার মানুষের জীবন যাত্রার ধরন, দারিদ্র্য ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম দেখে নিজের বইয়ের নাম 'সিটি অব জয়' দিয়েছিলেন বিখ্যাত ফরাসী লেখক দোমিনিক লাপিয়ের।
কলকাতাবাসীর আনন্দের বড় একটা অংশজুড়ে থাকে ক্রিকেট, খেলাটি এখানে তুমুল জনপ্রিয়। অনেক পুরনো ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যুগে যুগে এই শহরে ক্রিকেটের অনেক চিত্রনাট্যই মঞ্চায়িত হয়েছে, যার অনেক কিছুই লেখা হয়েছে অমর কালিতে। এসবের সাক্ষী শহরটির ঐতিহাসিক ক্রিকেট গ্রাউন্ড ইডেন গার্ডেন্স। শুরুর ২১ দিন পর সেই ইডেনে এলো বিশ্বকাপ। কিন্তু জেনে অবাক হবেন; কলকাতা ঘুরে বিশ্বকাপের আগমনী বার্তা বোঝার উপায় নেই। এমনকি ইডেন গার্ডেন্সের বাইরেও ক্রিকেট উৎসবের বিশেষ কোনো ছোঁয়া লাগেনি। বিশ্বকাপ ঘিরে দর্শক উন্মাদনা নেই, কাড়াকাড়ি নেই ম্যাচের টিকেট নিয়েও।
অবশ্য ধন্ধে পড়ে যেতে পারেন যে কেউ। কলকাতার অনেক রাস্তাতেই আছে আলোক সজ্জা, রাস্তার দুই পাশে অনেক বাঁশের তোরণ (ব্যানার লাগানোর জন্য)। মনে হতে পারে বিশ্বকাপের জন্যই এই আয়োজন। হয়তো ক্রিকেট আনন্দে মাততেই বাহারি রূপে সাজছে কলকাতা। আদতে এটা ভেঙে যাওয়া হাঁটের শেষ দৃশ্য। এসব আয়োজন ছিল সনাতনী ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গা পূজার জন্য। পুরো শহরই সেজেছিল রঙিন আলোতে, সবখানে নানা রকম ব্যানার-ফেস্টুন। পূজা শেষে এসব খুলে নেওয়ার কাজ চলছে। পার্ক স্ট্রিট যে এখনও আলো-ঝলমলে উৎসবের নগরী, সেটাও পূজা পালনের একটা অংশ।
বিশ্বকাপের জন্য কলকাতার কোথাও কোনো আয়োজন নেই। কেবল ইডেন গার্ডেন্সের বাইরে যে ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো হয়েছে, তা বিশ্বকাপের আমেজ তৈরি করতে পারেনি। স্টেডিয়ামের ভেতরের আয়োজনও উল্লেখ করার মতো নয়। উল্টো দেরি করে সংস্কার, সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু করায় অসংলগ্নতার শেষ নেই। গ্যালারির আসন এখনও পুরোপুরিভাবে পরিষ্কার করা হয়নি, ময়লা-ধুলো জমে অনেক আসনেই। এসব আসনের তলা (ফ্লোর) রং করা হয়েছে ২৬ অক্টোবর, যা এখনও শুকায়নি ঠিকমতো। সাংবাদিকদের কাজের জায়গা প্রেসবক্সে ওঠার পথের হাতলে করা রংও তাজা, সবখানে তাই রংয়ের গন্ধ।
এবারের বিশ্বকাপের ভেন্যু ১০টি, এর মধ্যে ৯টিতে এতোদিন ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে। আয়োজক ভারতের ম্যাচ ছাড়া কোনো ম্যাচেই সেভাবে দর্শক আগ্রহ দেখা যায়নি। অনেক ম্যাচে গ্যালারি একেবারেই ফাঁকা পড়ে থেকেছে। অর্থ দাঁড়ায়, এবারের বিশ্বকাপ নিয়ে দর্শক মনে আগের আসরগুলোর মতো রোমাঞ্চ-উত্তেজনা কাজ করছে না। বিশ্বকাপের দশম ভেন্যু ইডেন গার্ডেন্সের প্রথম ম্যাচ (বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস) নিয়েও বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ এখানে ক্রিকেট উৎসবে রূপ নেয়নি।
বিশ্বকাপ যতোই নিরুত্তাপ যাক, উন্মাদনা না থাকুক; বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বেলায় হিসেবটা ভিন্ন। বাংলাদেশে বিশ্বকাপ জ্বর ঠিকই আছে। সেমি-ফাইনাল খেলার স্বপ্ন নিয়ে ভারতে আসা দলটি টানা চার হারের পর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। আলোচনা না বলে সমালোচনা বলাই ভালো। আফগানিস্তানের বিপক্ষে পাওয়া একমাত্র জয়ের ওই ম্যাচ ছাড়া প্রতি ম্যাচেই ব্যাটিংয়ে খুঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। সবশেষ ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আরও করুণ দশা হয়েছে, চরম ব্যাটিং ব্যর্থতায় অসহায় আত্মসমর্পণ করে তারা। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কাছে জয় তাই এখন 'সোনার হরিণ'।
সমালোচনা করলেও জয়ের সন্ধানে থাকা কোণঠাসা দলের সমর্থন যোগাতে বাংলাদেশি ভক্তদের অবশ্য চেষ্টার কমতি নেই। দলের সেমি-ফাইনাল স্বপ্ন প্রায় শেষ জেনেও অনেকেই কলকাতায় এসে হাজির হয়েছেন। এই ম্যাচ নিয়ে কলকাতায় যতোটুকু উন্মাদনা, পুরোটাই বাংলাদেশি সমর্থকদের কারণে। খেলা দেখতে কলকাতায় আসা শাহরিয়ার নামের এক চাকুরিজীবি বললেন, 'বাংলাদেশ সেমিতে আর উঠতে পারবে না, সেটা বুঝতে পারছি। আবার নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচটি তেমন উপভোগ করার মতোও নয়, তবু এসেছি মাঠে থেকে প্রিয় দলকে সমর্থন জানাতে।'
ভক্তদের অভিযোগও আছে, বিশ্বকাপের মাঝে সাকিব আল হাসানের দেশে যাওয়াটাকে অনেকেই ইতিবাচকভাবে নিতে নারাজ। দেশে গিয়ে শৈশবের কোচ নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সঙ্গে বাংলাদেশ অধিনায়ক ব্যাটিং অনুশীলন করলেও এটাকে অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত মনে করেন খেলা দেখতে আসা ৫০ বছর বয়সী সরকারি চাকুরিজীবি রায়হান খন্দকার, 'যেটাই হোক, দল ছেড়ে যাওয়া ঠিক হয়নি তার। দলের আরও অনেকেই তো ভালো করছেন না, রান পাচ্ছেন না; তাহলে তারাও কি দেশে গিয়ে অনুশীলন করবেন? সাকিব বলে কিন্তু প্রশ্ন ওঠে আসলেই তিনি ব্যাটিং নিয়ে কাজ করার জন্য গিয়েছিলেন কিনা। কারণ সিরিজের মাঝেও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে তাকে।'
সাকিব দেশে গিয়ে ব্যাটিং নিয়ে কাজ করেছেন, বাংলাদেশ দল মুম্বাইয়ে ম্যাচ খেলে কলকাতায় এসে প্রথমদিন বিশ্রামে ছিল। বৃহস্পতিবার ইডেন গার্ডেন্সে ফ্লাড লাইটের আলোয় সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত অনুশীলন করে বাংলাদেশ দল। ২৭ অক্টোবর দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও এদিনই কলকাতায় ফিরে এসেছেন সাকিব, রাতে তাকে বরণ করে নেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। আজ বাংলাদেশের অনুশীলনে যোগ দেন সাকিব। অনুশীলনের আগে সংবাদ সম্মেলনে আসা বাংলাদেশের পেসার তাসকিন আহমেদকে দলের অনেক বিষয়ের পাশাপাশি কথা বলতে হয় তার দেশে যাওয়ার ঘটনা নিয়েও।
সাকিব নিয়ম মেনে দেশে গেছেন, এ কারণে তাকে প্রশংসা (অ্যাপ্রিশিয়েট) করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। সাকিব দেশে যাওয়ায় দলে কোনো প্রভাব পড়েনি বলেও জানান তাসকিন। ডানহাতি এই পেসার বলেন, 'এটায় (সাকিবের অনুপস্থিতি) খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। সে যখন ফিরে এসেছে, আমরা দলের সবাই খুব ভালো সময় কাটিয়েছি। সে নিজের কিছু উন্নতির জন্য গিয়েছিল। ব্যাটিং প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালো করছিল না, এ জন্য নির্দিষ্ট কিছু অনুশীলনের জন্য গিয়েছিল যেন আমাদের দলের জন্য ভালো কিছু করতে পারেন। আমি মনে করি, আমাদের এটাকে প্রশংসা করা উচিত। সে আমাদের ম্যানেজমেন্ট বিসিবির সঙ্গে কথা বলেছে এবং তারপর গিয়েছে।'
পাঁচ ম্যাচে এক জয়, বাংলাদেশের সেমি-ফাইনাল খেলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পরের চার ম্যাচে বাংলাদেশের অনুপ্রেরণা কী? তাসকিন বললেন, এখনও স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়নি তাদের। চার ম্যাচ জিতে লড়াইয়ে টিকে থাকার কথা জানিয়ে তাসকিন বলেন, 'এখনও শেষ (সেমি-ফাইনাল স্বপ্ন) হয়ে যায়নি, আরও চারটি ম্যাচ আছে। ওই চার ম্যাচ জিততে পারলে যেকোনো কিছু হতে পারে। কারণ এখানে রান রেটের ব্যাপার আছে। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছে আফগানিস্তান, পরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও হারে ইংল্যান্ড। চার ম্যাচ জিততে পারলে হয়তো ভিন্ন গল্পও হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে আমরা ম্যাচ বাই ম্যাচ ভাবছি। আগের ম্যাচগুলোয় ব্যাটিং-বোলিংয়ে আমরা প্রত্যাশিতভাবে পারফর্ম করতে পারিনি, তবে আরও চার ম্যাচ আছে। আমরা সামনে ভালো করার দিকে তাকিয়ে আছি।'
এর আগে অবশ্য নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচেই দৃষ্টি বাংলাদেশের। হারের বৃত্তে থাকলে ডাচদের মতো অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের বিপক্ষে অতি সাবধানী থাকতে হয় বলে মনে করেন তাসকিন, 'ম্যাচ হেরে গেলে সবই ট্রিকি। অবশ্যই এমন ম্যাচগুলোয় আরও বেশি চাপ থাকে। সবার প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। জিততে চাই আমরা সবগুলো ম্যাচই। তবে বললেই তো আর জিততে পারবো না, সঠিক জিনিসগুলো প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্পন্ন করে জিততে হবে। এখন শুধু পরের ম্যাচটা ফোকাস করে সবকিছু ঠিকঠাক করে ম্যাচটা জিততে হবে। তারপর পরের ম্যাচগুলো নিয়ে ভাবতে চাই।'
বিশ্বকাপে এর আগে একবারই নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে বাংলাদেশের। ২০১১ বিশ্বকাপে সহ-আয়োজক বাংলাদেশ চট্টগ্রামে ডাচদের ৬ উইকেটে হারায়। তবে দলটির বিপক্ষে ওয়ানডেতে হারও আছে তাদের। বিশ্বকাপের বাইরে এই ফরম্যাটে একবারের সাক্ষাতে ২০১০ সালে গ্লাসগোতে বাংলাদেশকে ৬ উইকেট হারিয়ে দেয় ডাচরা। কলকাতার এই মাঠে বাংলাদেশ এর আগে একটি ওয়ানডে খেলেছে। ১৯৯০ এশিয়া কাপের সেই ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭১ রানে হেরে যায় তারা।