পাইলটের দক্ষতায় যেভাবে রক্ষা পেল ২৩৩ যাত্রী
রাশিয়ার পাইলট দামির ইউসুপভের কৃতিত্বে শস্যক্ষেতে জরুরি অবতরণ করে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পায় ইউরাল এয়ারলাইন্সের ৩২১ এয়ারবাসের ২৩৩ যাত্রী।
পাখির ঝাঁকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গত বৃহস্পতিবার মস্কোর কাছে একটি ভুট্টার ক্ষেতে জরুরি অবতরণ করেছিল রাশিয়ার যাত্রীবাহী বিমানটি। সেসময় বিমানটি জ্বালানি পরিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। কিন্তু তারপরেও রুশ পাইলটের তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতার কারণে বিমানের ২৩৩ জন যাত্রীর বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয়নি। দামির ইউসুপভ এখন অনেকের কাছেই নায়ক হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছেন। খবর বিবিসি বাংলার।
রাশিয়ার মানুষ এ ঘটনাটিকে ২০০৯ সালে নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে একটি বিমানের জরুরি অবতরণের সাথে তুলনা করছেন। নিউইয়র্কের সে ঘটনায় বিমানটি উড্ডয়নের সময় ইঞ্জিনে পাখির আঘাত লাগে। এরপর পাইলট হাডসন নদীতে বিমানটিকে জরুরি অবরতণ করিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার ইউরাল এয়ারলাইন্সের ৩২১ এয়ারবাসটি রাশিয়ার ক্রাইমিয়ার সিমফেরোপলে যাচ্ছিল। বিমানটি ওড়ার অল্পক্ষণের মধ্যেই এক ঝাঁক চিলের সাথে ধাক্কা খায় এবং ফলে বিমানের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়।
বিমানটিতে কী ঘটেছিল?
ইউরাল এয়ারলাইন্সের বিমানটির ওজন ছিল ৭৭ টনের মতো।
পাইলট দামির ইউসুপভ সাংবাদিকদের জানান, বিমানের যাত্রী এবং ক্রুরা কিভাবে অল্পের জন্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছে।
বিমানটি যখন দ্রুত গতিতে আকাশে উঠছিল,তখন প্রথম একটি ইঞ্জিন বন্ধ হয়। এরপর দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বেশ ঠান্ডা মাথায় বিমানটিকে জরুরি অবতরণ করিয়েছেন পাইলট দামির ইউসুপভ।
তিনি বলেন, যখন একটি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায় তখন তিনি ভাবছিলেন যে বিমানটিকে হয়তো বিমানবন্দরে ফিরিয়ে নিতে পারবেন। যখন আমি দেখলাম, বিমানের দ্বিতীয় ইঞ্জিনটিও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তখন বিমানটি মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। আমি কয়েকবার আমার মত পরিবর্তন করেছি। কারণ আমি বিমানটিকে উপরে তোলার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ফ্লাইট রাডারে দেখা যাচ্ছিল যে বিমানটি মাত্র ৭৯৭ ফুট ওপরে আছে।’
‘আমি বিমানটিকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করলাম। ততক্ষণ বিমানটিকে সে উচ্চতায় ধরে রাখতে চেষ্টা করছিলাম। তখন ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাবার বিষয়টি দেখলাম। চেষ্টা করছিলাম একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু হাতে একেবারেই সময় ছিল না।’
তখন বিমানের পাইলট এবং কো-পাইলট ইঞ্জিনে তেলের সরবরাহ বন্ধ করতে সক্ষম হন। ভুট্টা ক্ষেতে জরুরি অবতরণের পর যাত্রীদের দ্রুত বের করে আনা হয়। এরপর বিমানটি ধীরে-ধীরে শস্য ক্ষেতে নামিয়ে আনেন। তখন বিমানটির চাকাও খোলা যায়নি।
পাইলট জানান, কিভাবে জরুরি অবতরণ করতে হয়, সে বিষয়টি তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ইউরাল এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সিমুলেটরে।
‘নিজেকে আমার নায়ক মনে হচ্ছে না। আমরা যেটা করণীয় ছিল, আমি সেটাই করেছি,’ বলেন তিনি।
রাশিয়ার একজন শীর্ষ পাইলট ইউরি সাইতনিক বলেন, বিমানের ক্রুরা সবকিছু বইয়ের নিয়ম অনুসারে করেছেন। প্রথমে ইঞ্জিন বন্ধ করেছেন, এরপর বিমানটিকে ধীরে-ধীরে মাটিতে নামিয়ে এনেছেন। জরুরি নির্গমণ পথ দিয়ে যাত্রীদের দ্রুত নামিয়ে আনা হয়।
১১ বছর বয়সী এক বিমানযাত্রী বলেন, ‘একজন বিমানবালা বললেন, বিমান থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। তখন আমরা সাথে সাথে আতঙ্কিত হয়ে গেলাম। বিমানের অবতরণ মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। প্রায় ৭০ জন যাত্রীকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।’
সৌভাগ্যবশত ভুট্টা ক্ষেতটি নরম আবরণের মতো কাজ করেছে। বৃষ্টিতে ভিজে ভুট্টা ক্ষেতটি কিছু স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় ছিল। ফলে ঘর্ষণের কারণে আগুন ধরেনি।
মস্কো শহরের অন্য কোন জায়গায় হলে বিমানটি রাস্তা কিংবা বিল্ডিং-এর উপর আছড়ে পড়তো।
পাখির আঘাত কতটা গুরুতর?
রাশিয়ার একটি দৈনিক বলেছে, ২০১৫ সালে রাশিয়ায় পাখির সাথে বিমানের ধাক্কা খাওয়ার ৪১১টি ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু গত বছর এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২১টি। বিশ্বজুড়ে বিমান উড্ডয়নের ক্ষেত্রে এটি নিত্যদিনের ঝামেলা। সিভিল এভিয়েশনের তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে ব্রিটেনে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৮৩৫টি। রাশিয়াতে এ সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে।
জুকোভস্কি বিমানবন্দর থেকে দুই কিলোমিটার দূরে একটি ময়লার ভাগাড় আছে। এর ফলে সেখানে বিভিন্ন ধরনের পাখির আনাগোনা বেশি হয়।
তবে মস্কোর কর্মকর্তারা বলেছেন, বিমানবন্দর থেকে সবচেয়ে কাছে ময়লার স্তূপটি ১৪ কিলোমিটার দূরে।
রাশিয়ার একজন সামরিক পাইলট ভ্লাদিমির পপভ বলেন, রাশিয়ার বিমানবন্দরগুলোতে পাখি পর্যবেক্ষণের জন্য বিশেষজ্ঞ আছে। কিন্তু কোন পদক্ষেপই পুরোপুরি কাজে লাগছে না।
তিনি বলেন, বিমানের ইঞ্জিনের সামনে কোন খাঁচা তৈরি করা যাবে না। কারণ, তাতে বাতাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটবে। এর ফলে বিমানের গতি কমে যাবে।
জেনারেল পপভ আরও বলেন, অগাস্ট মাসটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ সময় নতুন পাখিদের ডানা বড় হতে থাকে। তখন তারা বেশি ওড়ার চেষ্টা করে।
আরেকটি উপায় হচ্ছে বিমানবন্দরে রানওয়ের পাশের জমিতে ঘাসগুলো একেবারে ছোট করে দেয়া। যাতে এটি পাখিদের চারণভূমি হতে না পারে।