শুরুতে বিমানের খাবার ছিল সুস্বাদু, অফুরন্ত, বিলাসী - তারপর যেভাবে বদলে গেল
আপনার যদি ১৯৬০এর দশকে আমেরিকান এয়ারলাইন্সে যাতায়াতের সুযোগ হয়ে থাকে, তবে আপনার নিশ্চয়ই কোচ-ক্লাসের (প্লেন বা ট্রেনের সবচেয়ে সস্তা আসন) 'রয়েল কোচম্যান'-এর খাবারের মেনুর কথা মনে আছে।
সেসময় খাবার শুরুই হতো গরুর মাংসের কনসোমে দিয়ে, খাওয়ার শেষে মিষ্টান্ন হিসেবে থাকতো ফলের টার্টলেট (চাটনি)। ধবধবে সাদা টেবিলক্লথের উপর খাবার পরিবেশন করা হতো। স্টুয়ার্ডেসরা (যারা বিমানে খাবার পরিবেশন করতেন) যখন ট্রে বা ট্রলি নিয়ে আসতেন, চারপাশ খাবারের ঘ্রাণে মঁ মঁ করত।
বর্তমানের অবস্থা সম্পূর্ণ আলাদা। এখন স্বল্প দূরত্বের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে খুব কমই বিনামূল্যের খাবার পাওয়া যায়। বিমানের ইন-ফ্লাইট ডাইনিংয়ের খাবারের সেই গৌরবময় দিনগুলো বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। সংক্ষিপ্ত ফ্লাইটগুলোতে যাত্রীদের বড়জোর বিসকফ কুকিজ বা প্রিটজেল খেতে দেওয়া হয়।
বিমান সংস্থাগুলোর ব্যয় সংকোচন নীতিই শুধু এসব সুস্বাদু খাবার হারিয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ নয়। সরকারি নিয়ন্ত্রণ, বিমানের নকশা এবং স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে যাত্রীদের ইন-ফ্লাইট ডাইনিংয়ে খাওয়ার হার কমে যাওয়া প্রভৃতিও এর জন্য দায়ী।
৯/১১ এর পর থেকে থেকে বিমান আকাশে ওড়ার সময় ক্রুরা কোন ধরনের ছুরি ব্যবহার করতে পারবে, এ সংক্রান্ত নিরাপত্তা প্রোটোকল এবং প্রবিধানে পরিবর্তন করা হয়েছে।
বর্তমানের বিমানের গ্যালিগুলো (রান্নাঘর) হয় ছোট ছোট। অ্যালার্জি আক্রান্ত যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে চিনাবাদামের মতো কিছু খাবার পরিবেশন থেকে বিরত থাকে এয়ারলাইনগুলো। এছাড়া খাবারগুলোর আকারও বেশ ছোট এবং মান ও স্বাদও অতি সাধারণ।
অ্যাটমোস্ফিয়ার রিসার্চ গ্রুপের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা হেনরি হার্টভেল্ট বলেন, 'এয়ারলাইনগুলোর খাবার পরিষেবা একসময় গর্বের বিষয় ছিল। এখন এগুলোর মান এত খারাপ যে আপনি অবাক হয়ে ভাববেন; এয়ারলাইন এক্সিকিউটিভদের কি আসলেই স্বাদেন্দ্রিয় বলে কিছু আছে কি না।'
বিমান সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে খাবারের খরচ কমানো এবং ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্টদের খাবার তৈরির সময় কমানোর উপায় খুঁজছিল।
১৯৮০ এর দশকের এর একটি বিখ্যাত উদাহরণ রয়েছে। একবার আমেরিকান এয়ারলাইন্সের তৎকালীন প্রধান রবার্ট ক্র্যান্ডাল বলেছিলেন, কীভাবে প্রতি বাটি সালাদ থেকে মাত্র একটি করে জলপাই কম দিয়ে, এয়ারলাইনটি বছরে ৪০ হাজার ডলার সাশ্রয় করে।
তখন থেকেই খাবারের স্বাদের চেয়ে ব্যয় এবং সময় বিমান সংস্থাগুলোর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স বা ডেল্টার মতো ক্যারিয়ারগুলোর হয়ত বিভিন্ন তারকা সেলিব্রিটি শেফদের সঙ্গে অংশীদারিত্ব আছে, তবে তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ক্যাটারিং পরিষেবা থেকে নিজেদের খাবার সংগ্রহ করে। এসব ক্যাটারিং প্রতিষ্ঠাগুলো বেশ কয়েক ঘন্টা আগেই খাবার প্রস্তুত করে রেখে দেয়। ফলে বিমানের যাত্রীদের ফ্রেশ খাবার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
ফ্লোরিডার ডেটোনা বিচের এমব্রি রিডল অ্যারোনটিক্যাল ইউনিভার্সিটির এয়ারলাইন মার্কেটিংয়ের অধ্যাপক ব্লেইস ওয়াগসপ্যাক বলেন, 'মানুষ ভাড়া কমানোর জন্য খাবার কিনে খেতে ইচ্ছুক। তাই বর্তমানে আপনার টিকিটের বিনিময়ে যাত্রীদের বসতে দেওয়া হয়। ওই সিটের বাইরের সব পরিষেবার জন্যই তাদের থেকে অর্থ নেওয়া হয়।'
এছাড়া বিমান সংস্থাগুলো কর বাঁচানোর উপায় হিসেবে ভ্রমণের সময় স্যান্ডউইচ, স্ন্যাক বক্স বা এক প্লেট পনিরের জন্যও যাত্রীদের থেকে কয়েক ডলার দাম নেয়।
স্বল্প দূরত্বের বিমান ভাড়ার ওপর ৭.৫% ফেডারেল আবগারি ট্যাক্স আরোপ হয়, কিন্তু সেই ট্যাক্স লাগেজ ফি এবং অন-বোর্ড খাবারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
ক্যাভিয়ার এবং বিনামূল্যে চিউইং গাম
প্রায় এক শতাব্দী ধরে বিমানে খাবার খাওয়ার চল রয়েছে। ১৯২০ এর দশক থেকে ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা যাত্রীদের কানে চাপ কমানোর জন্য চুইংগাম খেতে দিতেন।
স্মিথসোনিয়ানের মতে, প্রথম দিকের বিমানগুলো ওড়ার সময় এত বেশি বাউন্স করত যে কাগজ দিয়ে তৈরি পাত্রে খাবার পরিবেশন করা হতো।
কয়েক দশক ধরে ফেডারেল সরকার বিমান ভাড়া এবং রুট নিয়ন্ত্রণ করে। তাই বিমান সংস্থাগুলো পরিষেবা, খাবার এবং সাধারণত ক্রুজ যাত্রীদের যে ধরনের সেবা দেয় সেগুলোতে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করে।
স্মিথসোনিয়ান অনুসারে, ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত যখন এয়ারলাইন শিল্প ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল। তখন আইন অনুসারে প্রত্যেক যাত্রীকে তাদের টিকিটের দামের অংশ হিসেবে একটি প্রবেশটিকিট, দুটি সবজি, একটি সালাদ, মিষ্টান্ন এবং একটি পানীয় দেওয়া হতো।
প্যান অ্যামেরিকা ১৯৫৮ সালে এক বিজ্ঞাপনে লিখেছিল, 'সুস্বাদু খাবার আনন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে। এটি একই সঙ্গে চারটি অপারেটিং গ্যালিতে প্রস্তুত করা হতো, যেখানে পাঁচ মিনিটেই ওভেনে খাবার রান্না করা যায়।'
১৯৬০ এবং ১৯৭০- এর দশকে বিমান সংস্থাগুলো বিমানে বিলাসবহুল রান্নাঘরের ব্যবস্থা করেছিল এবং গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য তাদের মেনুগুলোর বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। গরুর মাংস ছিল ব্যবসার কৌশল।'
হার্টভেল্ট বলেন, 'বিমান সংস্থাগুলো পরিষেবা এবং সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতো। খাবার পরিষেবা [প্রতিযোগিতার] আগ্রহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিল, কারণ এখনকার তুলনায় তখন বিনোদনের সুযোগ খুব কম ছিল। বিমান সংস্থাগুলোতে শেফদের টিম থাকতো, তাদের নিজস্ব কেটারিং রান্নাঘর থাকতো এবং চারপাশে খাবারের বিজ্ঞাপন থাকতো।'
নিয়ন্ত্রণহীনতা ধরা পড়ায় বিমান সংস্থাগুলো টিকিটের দাম কমিয়েছে। কিন্তু ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তারা খাবারের মান এবং অন্যান্য পরিষেবাগুলো কাটছাঁট করেছে।
৯/১১ হামলার পর থেকে বিমানে বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার হার কমে গেছে। যাত্রীরদেরও বিমানে খাওয়ার প্রবণতা একেবারে কমে গেছে, এর ফলে ফ্লাইটে খাবার পরিষেবা হ্রাস করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। ওই হামলার পরপরই ইউনাইটেড, আমেরিকান এয়ারলাইন্স, ডেল্টা এবং অন্যান্যরা ফ্লাইটে খাবার পরিষেবা একেবারে সীমিত করার করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
প্রধান বিমান সংস্থাগুলোর মধ্যে কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্স সবশেষে ২০১০ সালে ইকোনমি ক্লাসে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া বন্ধ করে দেয়।
বিভিন্ন বিমানে পরিবেশিত খাবার নিয়ে কয়েক দশক ধরে বহু ব্যঙ্গ ও সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু এখন এসব খাবারই মিস করে যাত্রীরা।
তবে, ইকোনমি এবং প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের ক্ষেত্রে বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন।
ইন-ফ্লাইট কেটারিং কোম্পানি গেটগ্রুপের উত্তর আমেরিকার রান্নাবিষয়ক নির্বাহী শেফ মলি ব্র্যান্ডট বলেছেন, 'এয়ারলাইন খাবারের জন্য স্বর্ণযুগ এখন। এটা নির্ভর করে আপনি কোন এয়ারলাইনে যাত্রা করছেন এবং আপনি কোন ক্যাটাগরিতে আছেন।'
তিনি বলেন, 'উদাহরণস্বরূপ আপনি যদি আমেরিকান কোনো বিমানের ফার্স্ট ক্লাসে থাকেন, আপনি মন ভরে বিলাসবহুল বিভিন্ন খাবার খেতে পারবেন।'
এমনকি কিছু এয়ারলাইন্স প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের ক্যাভিয়ার পর্যন্ত অফার করে। কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ যাত্রী বিনামূল্যে একটি চুইংগামও নিতে চান না।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি