অসুস্থ প্রাণীদের এক আশ্রয়স্থল
![](https://tbsnews.net/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2021/01/18/ctg_animal_care_care_center_04.jpg)
ছয় মাস বয়সী কুকুর ছানাটির নাম কাজু। ওর জীবন কাটছে এক পায়ে ভর করে। দেড় মাস আগে সিএনজি অটোরিকশার চাপায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এক পা। একইসঙ্গে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পেছনের দুই পা-ও। এতে সামনের বাম পা কেটে ফেলা হয় আর স্থায়ীভাবে পেছনের দুই পায়ের নার্ভ ড্যামেজ হয়ে পড়ে।
তবে সময়মতো চিকিৎসা ও সেবা যত্ন পেয়ে এখন অনেকটাই সুস্থ এ কুকুর ছানা। অক্ষম তিন পায়ে শুয়ে বসেই দিন কেটে যায় তার।
গত নভেম্বরে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবর পেয়ে নগরের লাভ লেন এলাকা থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় ওকে উদ্ধার করেন অ্যানিম্যাল কেয়ার চট্টগ্রাম (এসিসি) নামে সংগঠনের সদস্যরা। সংগঠনটি ২০১৬ সাল থেকে চট্টগ্রামে অসহায় ও আহত প্রাণীদের সেবা ও চিকিৎসার কাজ করে আসছে। হালিশহরের আনন্দবাজারে রয়েছে তাদের একটি শেল্টার সেন্টার। অভিভাবকহীন ও বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার কুকুর, বিড়াল, বানর, পেঁচা ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল এ শেল্টার সেন্টার।
আহতবস্থায় উদ্ধারের পর থেকে কাজুর ঠাঁই মিলেছে এখানেই।
এখানে এখন কাজুর মতো বিভিন্ন বয়সী আরও ১০টি কুকুর ও ১টি পেঁচা রয়েছে। ওদের কোনোটার পা কাটা, কোনোটার এক চোখ নেই, কোনোটা আবার অসুস্থতার কারণে হয়েছে মালিকহারা। শুধু তাই নয়, কোনোটা এখানে এসেছে মানুষের নির্মমতার শিকার হয়ে। সাড়ে ৩ হাজার ফুট আয়তনের এই অ্যানিমেল কেয়ার শেল্টারই এখন এসব প্রাণীর নিরাপদ আবাস।
সুমি বিশ্বাস নামে এক তরুণী ২০১৫ সাল থেকে সড়কে থাকা অসুস্থ প্রাণীদের সেবা-যত্নের কাজ করছেন। তার কাজের পরিধি বাড়ার জন্য ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অ্যানিমেল কেয়ার সংগঠনটি। পরবর্তীকালে এ সংগঠনে যুক্ত হন আরও ১৫ স্বেচ্ছাসেবী তরুণ।
সংগঠনটির প্রধান উদ্যোক্তা সুমি বিশ্বাস ২০১৯ সালে নিজ বাড়িতে ৩ হাজার স্কয়ার ফিট জায়গাজুড়ে গড়ে তোলেন একটি শেল্টার সেন্টার। সংগঠনটির মাধ্যমে এ পর্যন্ত পথে-ঘাটে প্রায় ৭০০ কুকুর বিড়াল ও অন্যান্য প্রাণীর সেবা দিয়েছেন তারা।
সুমি বিশ্বাস জানান, 'অ্যানিমেল কেয়ার শেল্টার প্রতিষ্ঠার আগে কুকুর, বিড়াল আহত হলে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য পশু হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। অনেক প্রাণীর ক্ষেত্রে গভীর ক্ষতের কারণে অপারেশনের পরেও সুস্থ হয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগত। এতে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে প্রতিদিন ড্রেসিং, ইনজেকশন ও খাবার দিতে হতো। পশু হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাও সম্ভব ছিল না। তাই শেল্টার গড়ার চিন্তা-ভাবনা মাথায় আসে।'
শেল্টার সেন্টার করার পর থেকে গত দুই বছরে এখানে সেবা মিলেছে দেড় শতাধিক প্রাণীর। এর মধ্যে কুকুরের সংখ্যা বেশি হলেও রয়েছে বিড়াল, হুতোম পেঁচাসহ আরও অনেক পাখি।
শৈশব থেকেই পোষা প্রাণী ভালোবাসেন সুমি বিশ্বাস। নিজের ঘরেই পুষতেন নানা রকমের কুকুর, বিড়াল ও পাখি। এতে সমর্থন পেতেন মা-বাবার। অ্যানিমেল কেয়ার শেল্টারের বিশাল জায়গাটিও তার বাবার দেওয়া। এ কারণেই আহত ও অসহায় প্রাণীদের এই আশ্রয়স্থল গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
গত শুক্রবার বিকেলে ওই শেল্টারে গিয়ে দেখা যায়, একটু কুকুর এক পা খোড়াচ্ছে, অন্যটির ডান চোখজুড়ে ক্ষতচিহ্ন। মানুষের নির্মমতার শিকার হয়ে এ অবস্থা ওদের। তবে শেল্টারে এসে সেবা ও মমতার আবেশ পেয়েছে। এ সময় দেখা যায়, কোনোটা খাচ্ছে, কোনোটা ঘুমাচ্ছে, কোনোটা আবার ঘুরে বেড়াচ্ছে চারপাশ। জাম্পি ও চিনুক নামে ডাকতেই সুমি বিশ্বাসের কাছে ছুটে আসে দুটি কুকুর।
উদ্যোক্তারা জানান, সেবা যত্নে প্রাণীগুলো এতটাই আপন হয়ে যায়, সুস্থ হবার পরও অনেক প্রাণী শেল্টার ছেড়ে যেতে চায় না।
সুমি জানান, কোথাও কেউ আহত বিড়াল-কুকুর দেখলে তাদের খবর দেন। পরে ভেটেরিনারি হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করার আগ পর্যন্ত শেল্টারেই রাখা হয় ওদের।
'ছোট কুকুরকে কেউ যেন দত্তক নেয়, সে চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে নিশ্চিত করি, যেন ওই প্রাণীর দুই বেলা খাবার ও থাকার ভালো জায়গা জোটে। আর বড় কুকুরের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এলাকায় ছেড়ে দিয়ে আসা হয়,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন সুমি বিশ্বাস।
অ্যানিমেল শেল্টারে চিকিৎসার পাশাপাশি সুস্থ হওয়ার পর কুকুরদের বন্ধ্যাত্বকরণ ও জলাতঙ্কের টিকা দেওয়া হয়, যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে বংশবৃদ্ধি এবং ওদের কামড়ে কেউ জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত না হয়।
প্রাণীগুলোর সেবা-যত্ন ও আহারের অর্থ জোগানোর বিষয়ে অ্যানিমেল কেয়ার শেল্টারের প্রধান উদ্যোক্তা সুমি বিশ্বাস জানান, এই খরচ সংগঠনের সদস্যদের অর্থায়নেই পরিচালিত হচ্ছে। তবে মাঝে মধ্যে ফান্ডের প্রয়োজনে সংগঠনের ফেসবুক পেজে পোস্ট দেওয়া হয়। এতে অনেকে আর্থিক সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসেন।
শেল্টারের হেড অব অপারেশনস সাদমান ইত্তেহাদ জানান, সংগঠনটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকভিত্তিক হলেও ফেসবুকের বাইরেও বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই প্রাণীদের রক্ষায় সচেতনতামূলক বিভিন্ন আয়োজন করেন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা।
শেল্টারে প্রাণীদের সেবা দেওয়া ছাড়াও সংগঠনটি ফেসবুকে প্রাণী রক্ষায় নানা প্রচার-প্রচারণা চালায়। একইভাবে প্রাণী সচেতনতামূলক এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে 'অ্যানিমেল কেয়ার চট্টগ্রাম'।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার কিউরেটর ও প্রাণী চিকিৎসক ডা. শাহাদাত হোসেন শুভ টিবিএসকে বলেন, উদ্ধার ও চিকিৎসার পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে, যেন প্রাণীর প্রতি কেউ নির্মম আচরণ না করে।