অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন কি নিরাপদ, নাকি ঝুঁকিপূর্ণ?
অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিড-১৯ টিকাদান গত মাসেই স্থগিত করে বেশ কিছু ইউরোপিয় রাষ্ট্র। দেশগুলোর ওষুধ প্রশাসন নিয়ন্ত্রকেরা আশঙ্কা করেছিলেন, টিকা নেওয়ার কারণেই কিছু ব্যক্তি পরে রক্ত জমাট বাঁধার শিকার হয়েছিলেন। এতে প্রাণহানিও ঘটে। একইসময়, যুক্তরাজ্য ভ্যাকসিনটির লাখ লাখ ডোজ দিলেও, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তেমন বিরূপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হননি।
সেই পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, ব্রিটিশ নিয়ামক সংস্থাও এখন রক্ত জমাট বাঁধার মতো প্রাণনাশক ঝুঁকি টিকাটির অতি-বিরল এক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এই ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি অপেক্ষাকৃত তরুণদের মধ্যে। তাই ৩০ বছরের কম বয়সীদের ফাইজার/ বায়োএনটেক বা মডার্নার তৈরি টিকা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে কর্তৃপক্ষটি।
ইউরোপিয় ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার প্রত্যেক সদস্য দেশের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তবে ইইউ এবং যুক্তরাজ্য দুই জায়গার কর্তৃপক্ষ এখনও বলছেন যে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার সুফল এর কারণে সম্ভাব্য ঝুঁকির তুলনায় অনেক বেশি।
এব্যাপারে ব্লুমবার্গের ওষুধ শিল্প বিষয়ক মতামত কলাম লেখক স্যাম ফাজেলি অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী ও সম্ভাব্য ঝুঁকির ব্যাপারে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
ব্লুমবার্গ: অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের কারণে কি রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকির পরিমাণ বেড়েছে? হলেও সেটা কতোটা মারাত্মক?
স্যাম ফাজেলি: যুক্তরাজ্য ও ইইউ নিয়ন্ত্রকরা যেসব তথ্য দিয়েছেন তাতে অন্তত সেটাই উঠে আসে। তারা বলছেন, টিকাটির কারণে খুবই বিরল ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যার মূল বৈশিষ্ট্য রক্তে শ্বেতকণিকার সংখ্যা হ্রাসের কারণে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা। বিপরীতমুখী এসব প্রভাবের কারণে সুচিকিৎসা করাও কঠিন। বিপরীত এই কারণে যে, স্বাভাবিক অবস্থায় শ্বেতকণিকা রক্তপাত বন্ধ করে রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে। কিন্তু, অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার ফলে দেহে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়- তা কিছু ব্যক্তির দেহের শ্বেতকজণিকাকে ক্ষতিকর ভাইরাস মনে করে আক্রমণ করে বসে, একারণেই কণিকাটির সংখ্যা হ্রাস পায় এবং ওই ঘাটতি পূরণে দেহ আরও বেশি করে তা তৈরি করে, যা শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার মতো ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
ইইউ হিসাব করে দেখেছে, প্রতি এক লাখ টিকাগ্রহীতার মধ্যে একজনের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। টিকা ছাড়া সাধারণ জনসংখ্যার মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার বার্ষিক যে হার দেখা যায়- এটি তার চেয়ে দুই থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত বেশি।
প্রশ্ন: শারীরিক এই অবস্থা কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ? সময় থাকতে থাকতেই কি শনাক্ত করে চিকিৎসা করা সম্ভব?
স্যাম: দুর্ভাগ্যজনকভাবে, রক্ত জমাট বাঁধার কারণে বেশ কয়েক জন ব্যক্তি মারা গেছেন। যুক্তরাজ্যে ৭৯টি এমন ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১৯ জনের। সে তুলনায় গত ৩১ মার্চ নাগাদ দেওয়া হয়েছে ভ্যাকসিনটির ২ কোটি ২ লাখ ডোজ। মৃতদের মধ্যে তিনজনের বয়স ছিল ৩০ এর কম।
স্বাস্থ্য পরীক্ষার পূর্বশর্ত রক্ত জমাট বাঁধার বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন; মাথাব্যথা, ত্বকের ওপর অস্বাভাবিক রকমের আঘাতের মতো দাগ এবং তলপেট ব্যথা করার মতো ঘটনা সম্পর্কে আক্রান্ত ব্যক্তির অবহিত থাকা। অর্থাৎ, গুরুতর আকার ধারণ করার আগেই সমস্যার শিকার ব্যক্তির বিষয়টি সন্দেহ করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়ার উপরই চিকিৎসা নির্ভর করছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় তাদের সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হলেও কোন পদ্ধতির মাধ্যমে এটি সবচেয়ে ভালোভাবে দূর করা যাবে- সেই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কোনো ঐক্যমত্য নেই বলেই জানিয়েছে ইইউ ও যুক্তরাজ্যের নিয়ামক সংস্থা। এর প্রধান কারণ হিসেবে তারা বলেছে, একইসঙ্গে শ্বেতকণিকা হ্রাস ও রক্ত দানা বাঁধার রোগটি খুবই বিরল হওয়ার কারণেই থেরাপি নিয়ে নানামত রয়েছে।
প্রশ্ন: যুক্তরাজ্য তরুণদের অন্যান্য ভ্যাকসিন নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, অন্যদিকে ইইউ ততোটা অগ্রসর পদক্ষেপ নেয়নি। এটা কি বিভ্রান্তিকর নয়- কেন ইইউ এমন ঝুঁকি নিল?
উত্তর: ইইউ ওষুধ প্রশাসন- ইউরোপিয়ান মেডিসিন্স এজেন্সি (ইএমএ) বলেছে, বয়সের সঙ্গে ঝুঁকির নির্দিষ্ট কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি, তবে তরুণেরা অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলেও তারা স্বীকার করে নিয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের নিয়ামক সংস্থা- মেডিসিন্স অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি (এমএইচআরএ) নিশ্চিতভাবে বলেছে, বয়স কম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রক্ত জমাটের ঝুঁকিটিও বাড়তে থাকে।
তবে আমার মনে হয়, ইএমএ যাই বলুক না কেন দিন শেষে প্রত্যেক ইইউ সদস্য দেশ তাদের নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে। আমার ধারণা, তারা সকলেই বয়স ভেদে টিকাটি দেওয়ার পথেই হাঁটবে। অনেকে তেমন সিদ্ধান্ত নিয়েও ফেলেছে।
প্রশ্ন: অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ডোজ কি তবে শুধু বয়স্কদের দেওয়া উচিৎ?
উত্তর: এটি একটি সমাধান হতে পারে এবং অনেক ইইউ দেশ সেকাজই করছে। আগেই বলেছি, যুক্তরাজ্য ৩০ বছরকে বিভাজন রেখা ধরে নিয়ে তার বেশি বয়সীদের টিকাটি দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু, যদি বিরল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও থাকে তাহলে বিষয়টি গুরুতর ভুল হবে। ব্রিটিশ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য তেমনটি নয় বলেই মনে করছেন। তাদের মতে, যেহেতু বয়স্করা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে অনেক বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে পড়েন, সেই তুলনায় তাদের মধ্যে টিকাদানের সুফলটাই পাওয়া যাবে বেশি। এব্যাপারে তারা ঝুঁকি ও সুফলের একটি স্পষ্ট গাণিতিক বিশ্লেষণও করেছেন।
এমএইচআরএ ওই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে জানায়, কোভিড আক্রান্ত ৭.৮ শতাংশ ব্যক্তি ফুসফুসের ধমনী বন্ধের শিকার হন, শিরায় রক্ত বাঁধার ঝুঁকিতে থাকেন ১১.২ শতাংশ। এছাড়া, স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে ১.৬ শতাংশ। কোভিডে গুরুতর অসুস্থদের সিংহভাগই বয়স্ক ব্যক্তি হওয়ায় তাদের জন্য বিকল্প টিকার অপেক্ষা করা বা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি নেওয়ার চাইতে- অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়াই সেরা সমাধান।
- লেখক: ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের ওষুধ শিল্প বিশ্লেষক এবং ইউরোপিয়ান মেডিসিন্স এজেন্সির গবেষণা পরিচালক।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত