আক্রান্তদের বয়ানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের ভয়াবহতা
এ বছর করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবার আঘাতে প্রাণ গিয়েছে হাজার হাজার ভারতীয়র। কিন্তু এই মহামারি থেকে বেঁচে ফেরাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত সৌভাগ্যবানদের খাতায় নাম লেখাতে পারেননি। কারণ কোভিডের সঙ্গে লড়াই শেষ না হতেই ভারতবাসীর ওপর, বিশেষত সদ্য কোভিড থেকে বেঁচে ফেরা মানুষদের আক্রমণ করে বসেছে মিউকোরমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামক আতঙ্ক।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দ্বারা সংঘটিত ক্ষতির মধ্যে আছে চোখের দৃষ্টিশক্তি ঘোলা হয়ে যাওয়া, চোখ নিচের দিকে ঝুঁকে পড়া বা নাক দিয়ে তরল নিঃসরণ হওয়া। ডায়াবেটিস আছে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল- এমন ব্যক্তিরা এই মুহূর্তে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছেন। এই রোগ থেকে মুক্তির একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে আক্রান্ত স্থান থেকে ফাঙ্গাসকে কেটে ফেলে দেওয়া; কিন্তু অধিকাংশ সময়ই আক্রান্ত স্থানটি হচ্ছে চোখ।
মুম্বাইয়ের ওকুলোপ্লাস্টিক সার্জন অক্ষয় নায়ার মিউকোরমাইকোসিস রোগের চিকিৎসা দেন। তিনি বলেন, 'এটি এমন এক ছত্রাক যা আক্রমণের স্থানের টিস্যুগুলো নষ্ট করে দেয় ও সেখানকার মাংসপেশীকে গ্রাস করে।'
মহামারির আগে নায়ার বছরে এধরনের ১০ টি রোগী পেতেন, কিন্তু এ বছরের জানুয়ারি থেকে তিনি অন্তত ১০০ জনের চিকিৎসা করেছেন। 'এটি যদি সাইনাসে আক্রমণ করে তাহলে তা পরিষ্কার করতে হবে। চোখে আক্রমণ করলে চোখের মণি, পাতা, আশেপাশের পেশি বাদ দিয়ে দিতে হবে', বলেন নায়ার।
এই মুহূর্তে এই রোগের চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধ অ্যামফটেরিসিন বি এর যোগানে ঘাটতি রয়েছে ভারতে। সার্জারির অন্তত ৩-৫ সপ্তাহ পর এই ব্যয়বহুল ঔষধটি নিতে হয়, ফলে চিকিৎসার খরচ অনেক বেড়ে যায়, চিকিৎসা প্রক্রিয়া জটিল করে তোলে এটি।
চিকিতসকদের দের মতে, কোভিডজনিত রোগ সারাতে অধিক স্টেরয়েড নেওয়ায় ভারতীয়দের মধ্যে এই রোগ দেখা দিয়েছে। স্টেরয়েড নেওয়ার ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামক ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। একারণে ডায়াবেটিস রোগীরাও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন।
ভারতীয় আলোকচিত্রী রনি সেন জুন মাস জুড়ে মহারাষ্ট্রে এমন কিছু রোগীদের খুঁজে পেয়েছেন যারা এই প্রাণঘাতী ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে বাঁচার জন্য নিজেদের একটি চোখ বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়েছেন। মহারাষ্ট্রে প্রায় ৮ হাজার ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগী পাওয়া গেছে, মারা গেছেন ৭০০ জন। আজ ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়া কয়েকজন ভুক্তভোগীর গল্প জানবো আমরা।
খুরশিদা বানু
৪৯ বছর বয়সী খুরশিদা বানু সারাজীবন নিজের সংসার আগলে রেখেছেন; ছেলেরা বিয়ে করার পর তার অবসর কাটতো বিশ্রাম নিয়ে ও নাতি-নাতনিদের সাথে খেলা করে। কিন্তু এবছর সেই চিত্রটা পাল্টে গেছে।
গত ফেব্রুয়ারিতে খুরশিদা কোভিডে আক্রান্ত হন এবং তার ফুস্ফুস মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাসপাতাল থেকে ফেরার দুই সপ্তাহ পর তিনি নিজের একটি চোখ খুলতে পারছিলেন না। ডাক্তার যখন বললেন, তার এই চোখ বাদ দিতে হবে; তিনি হতভম্ভ হয়ে গেলেন।
চোখ না বাদ দিলে মাকে বাঁচানো যাবেনা-বানুর ছেলেকে এমনটাই বলেছিলেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। বানুর ডায়াবেটিস আছে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা নিতে তিনি ৪০ দিন হাসপাতালে কাটিয়েছেন।
কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার সময় যখন ঘনিয়ে এলো, শেষ মুহূর্তে তিনি স্ট্রোক করেন এবং তার ডান হাত-পা অবশ হয়ে যায়।
এখন তিনি ঘরে ফিরেছেন ঠিকই, কিন্তু তার দিন কাটছে ফিজিওথেরাপি সেশন নিয়ে এবং চোখের ড্রেসিং করাতে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে। বানু বলেন, 'আল্লাহ সহায় ছিল যে তিনি আমার আরেকটা চোখ রক্ষা করেছেন। আমি আমার পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পেরে খুশি।'
অনিল বাবুরাও ওয়াংখেড়ে
একজন আলোকচিত্রী হিসেবে অনিল বাবুরাও ওয়াংখেড়ের সম্পদ ছিল দুটি-তার চোখ আর তার নাইকন ক্যামেরা। তিনি মানুষের বিয়ে বা বাগদানের অসাধারণ সব ছবি তুলতেন। অনিলই ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
গেল এপ্রিলে কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ফেরার কিছুদিন পরই অনিলের ডান চোখ মারাত্মক ফুলে ওঠে। জুনের মধ্যেই অনিলের মুখ অনেকগুলো টিউবের দ্বারা আটকানো হয়, তার ডান চোখটি বাদ দেওয়া হয়। অনিল প্রায় মরতে বসেছিলেন যখন তার দেহের একাধিক অঙ্গ যখন ঠিকঠাক কাজ করছিল না।
অনিল জানালেন, তিনি এখন অনুভূতিহীন হয়ে আছেন। তার চিকিৎসার জন্য তার ভাইকে লাখ লাখ টাকা ঋণ করতে হয়েছে।
'আমি জানিনা আমি আমার চাকরি ফিরে পাবো কিনা। আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে, এখন আমার সামনে শুধু অন্ধকার', বললেন অনিল।
সুরেখা খারচে
গত এপ্রিলে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর সুরেখার ডান চোখ দিয়ে পানি ঝরতে থাকে, সাথে অসহ্য যন্ত্রণা এবং চোখ ফুলে যায়। এমআরআই স্ক্যানে পাওয়া যায়, তার সাইনাস ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে ভর্তি।
চিকিৎসকরা জানান, তাকে অতি দ্রুত সার্জারি করতে হবে, তা নাহলে ছত্রাক তার মস্তিষ্কে পৌঁছে যাবে। কিন্তু কোভিড নেগেটিভ না আসা পর্যন্ত তারা অপারেশনও শুরু করতে পারছিলেন না।
সুরেখা খারচের এক মাস হাসপাতালে কাটানোর বিল আসে প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা । তার পরিবারের জমানো অর্থে অনেকটাই চলে যায় তার চিকিৎসার পেছনে। হাসপাতালে নেওয়ার পর যখন তার জন্য অ্যান্টি ভাইরাল ঔষধ অ্যাম্ফোটেরিসিনের খোঁজ করছিল তার পরিবার, ততদিনে ফাঙ্গাস তার বাম চোখেও পৌঁছে গেছে। তিনি তার বাম চোখ খুলতে পারেন না বললেই চলে।
এই মুহূর্তে অন্য চোখ বাঁচাতে অতিসত্ত্বর চিকিৎসা নেওয়া দরকার তার। সুরেখা জানালেন, 'মিউকোরমাইকোসিসের তুলনায় কোভিড কিছুই না। আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই।'
বাবুরাও কাম্বলে
৪৫ বছর বয়সী বাবুরাও কাম্বলে পুনের একজন চা দোকানি। সময় ভালো থাকলেও তার মাসিক উপার্জন সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা। অন্যান্য সময় তিনি দশ হাজারও আয় করতে পারেন না।
গত বছর লকডাউনের সময় তিনি চরম অর্থকষ্টে পড়েন এবং এবছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি কোভিড আক্রান্ত হন।
এর এক সপ্তাহ পরই তার রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে যায় এবং ডান চোখের দৃষ্টি ঘোলা হতে থাকে।
কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, তিনি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত। যে ঔষধটি তাকে বাঁচাতে পারে তা সহজলভ্য নয়, এর মূল্যও তার মাসিক আয়ের চেয়েও বেশি। এক মাসে প্রতিদিন তার ছয়টি করে অ্যামফোটেরিসিন ইঞ্জেকশন লাগে যার মোট মূল্য দাঁড়ায় ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা।
চিকিৎসার টাকার জন্য বাবুরাও ব্যাংক থেকে মেয়াদ শেষের আগেই টাকা তুলে নেন, স্ত্রীর গয়নাও বিক্রি করেন। প্রাত্যহিক খরচ বাঁচাতে তার পুরো পরিবার এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে ওঠে।
এই মুহূর্তে বাবুরাও ভাবছেন, কিভাবে তিনি এই ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত হবেন।
চিত্রা অর্জুন রাক্ষে
গত মার্চে পুনে শহরের ৪৭ বছর বয়সী গৃহবধূ চিত্রা অর্জুন রাক্ষে তার বাবাকে হারিয়েছেন। দশদিন ধর্মীয় আচার পালনের জন্য বাবার বাড়িতে থেকে তিনি ও তার স্বামী ফিরে আসেন নিজেদের বাড়িতে।
কিন্তু এসেই তারা করোনা পজিটিভ হন। কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে, শেষকৃত্যে যোগ দিতে আসা আত্মীয়দের থেকে হয়তো তারা আক্রান্ত হয়েছেন। এপ্রিলে তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ১০ দিনের জন্য হাসপাতালে কাটান। বাড়ি ফিরে আসার পর তাদের সন্তানরা খুশি হয়ে উঠলেও, এই খুশি দীর্ঘায়িত হয়নি।
চিত্রার ডান চোখে জ্বালাপোড়া আরো বেড়ে যায় এবং তিনি ব্যথায় কাঁদতে থাকেন। তার চোখের পাতা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। যখন জোর করে তার চোখের পাতা খোলা হয়, তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না।
তিনি চিকিৎসকের কাছে অনেক অনুরোধ করেন যেন তার চোখটা বাদ দেওয়া না হয়, কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায়ই ছিলনা। এখন তার মেয়ে কাজল প্রতিদিন তার চোখের ব্যান্ডেজ বদলে দেন। কাজল বলেন, 'এখন সেখানে শুধুই চামড়া আর একটা ফাঁকা গর্ত।'
চিত্রার চিকিৎসক জানান, আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে হয়ত তিনি কৃত্রিম চোখ পাবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে চিত্রা মানসিকভাবে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়েছেন।
তিনি বলেন, 'আমার শত্রুরও যেন কখনো এমন রোগ না হয়।'
- সূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট