আনোয়ার হোসেন: এক ইন্ডাস্ট্রি মোঘলের প্রয়াণ
অন্যের দোকানে কর্মচারি হিসাবে কাজ করে পাওয়া বেতন ৯০ টাকা ও মায়ের দেয়া ৩৯০ টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন আনোয়ার হোসেন। লুঙ্গি বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করে বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, আবাসন, পলিমার, আসবাব, অটোমোবাইল, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে হয়েছেন বহুন ব্যবসার অগ্রদূত।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে ৪৮০ টাকা মূলধন দিয়ে ব্যবসা শুরু করে একে একে গড়েছেন ২০টি বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। তার প্রতিষ্ঠানে সরাসরি কর্মসংস্থান এখন ১৪ হাজারের বেশি মানুষের। পরোক্ষভাবে কয়েক লাখ মানুষ ও ব্যাকওয়ার্ড হিসাবে বহু শিল্পের নায়ক আনোয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন।
আজকের আনোয়ার গ্রুপ নামের যে বড় শিল্পগোষ্ঠী, আনোয়ার হোসেন তারই প্রতিষ্ঠাতা। দেশের কয়েকটি পুরোনো ও সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ করলে রাখতে হবে তার গড়ে তোলা এই শিল্প গ্রুপকেও।
আনোয়ার হোসেনদের পারিবারিক ব্যবসা অনেক পুরোনো। তবে তিনি নিজে পরিচিতি পেয়েছিলেন মালা শাড়ি দিয়ে। সবাই তাঁকে বলতেন, মালা শাড়ির আনোয়ার। ১৯৬৮ সালে আনোয়ার হোসেন আনোয়ার সিল্ক মিলস প্রতিষ্ঠা করে মালা শাড়ি বাজারে আনেন। গত শতাব্দীর আশির দশকেও বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি জনপ্রিয় জিঙ্গেল ছিল 'মালা শাড়ি না দিলে বিয়া করমু না'।
আনোয়ার গ্রুপ এখন বস্ত্র, পাট, সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্যাংক, বীমা, গাড়ি, আবাসন, অবকাঠামো, আসবাবসহ ৩৬টি পণ্য ও সেবা খাতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। গ্রুপটির অধীনে কোম্পানি রয়েছে ২০টি।
দেশের শিল্পখাতের এই অগ্রদূত আনোয়ার হোসেন গত ১৭ আগস্ট রাত ১০টায় রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে বার্ধক্যজনক জটিলতায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
লুঙ্গির ব্যবসা থেকে বৃহৎ শিল্প উদ্যোক্তা
১৯৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করা আনোয়ার হোসেনের ব্যবসা শুরু ১৯৫৩ সালে। ১৫ বছর বয়সে এ ব্যবসা শুরু করার আগে কয়েক বছর তিনি পারিবারিক ব্যবসা সামলেছেন। ভোলা মিয়া নামে এক কাপড় ব্যবসায়ীর দোকানে কর্মচারীও ছিলেন কিছুদিন।
কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আনোয়ার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার হোসেন বলেন, ১৯৪৫ সালে আনোয়ার হোসেনের বাবার মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল সাত বছর। বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসা বিপাকে পড়ে যায়। বিশ্বস্ত কর্মচারীদের কয়েকজন টাকাপয়সা আত্মসাৎ করেন।
ফলে মাত্র ১২ বছর বয়সে বাবার ব্যবসা সামলানোর দায়িত্ব পড়ে আনোয়ার হোসেনের ওপর। তার আগে তাঁর বড় ভাই তাঁকে নিজেদের দোকানের পাশে ভোলা মিঞা নামের এক ব্যক্তির দোকানে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত পড়াশোনা, এরপর দোকানে কাজ। আনোয়ার হোসেনের ভাতা ছিল মাসে ১৫ টাকা। আর দৈনিক ২ আনা নাশতার খরচ।
ভোলা মিঞার দোকানে কাজ করে জমানো ৯০ টাকাই সম্বল। মা দিলেন ২০০ রুপার মুদ্রা, যা বিক্রি করে পাওয়া গেল ৩৯০ টাকা। মোট মূলধন ৪৮০ টাকায় ১৯৫৩ সালে চকবাজারে ২২০ নম্বর দোকান নিলেন তিনি। নাম দিলেন আনোয়ার ক্লথ স্টোর। বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর।
দোকান দেওয়ার পর আনোয়ার হোসেনকে কঠোর পরিশ্রম শুরু করতে হলো। ঢাকার রায়েরবাজারে তখন হাট বসত। সেখানে তিনি লুঙ্গির গাঁটরি মাথায় করে নিয়ে যেতেন। পরনে লুঙ্গির ভাঁজে থাকত মুড়ি আর পেঁয়াজি। খিদে পেলে তাই খেতেন।
ব্যবসা বাড়তে থাকে। একসময় চকবাজারে পাশের ছয়টি দোকান কিনে নেন আনোয়ার হোসেন। লুঙ্গি থেকে কাপড়, এরপর শাড়ি, ব্যবসা বাড়ছিল। আনোয়ার হোসেন নামেন ঢেউটিন আমদানির ব্যবসায়—সবই ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে।
১৯৬০ সালের দিকে ঢাকার পাশাপাশি দেশের প্রায় সব বড় শহরে ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে আনোয়ার হোসেনের। পাকিস্তানের করাচিতেও কাপড়ের ব্যবসায় নাম করেন তিনি। দোকান, কার্যালয়, বাড়ি-গাড়ি গড়ে তুলেন পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতেও।
বাণিজ্যে ভালো করে আনোয়ার হোসেনের ইচ্ছা হয় শিল্পকারখানা করার। ১৯৬৮ সালে তিনি একটি সিল্ক মিল কিনে নিয়ে চালু করলেন আনোয়ার সিল্ক মিলস। তৈরি হলো মালা শাড়ির ইতিহাস। তখন ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলায় আনোয়ার হোসেনের ব্যবসা ছড়িয়ে পড়ে।
মালা শাড়ি, বাংলাদেশের শাড়ির জগতে প্রথম সুপরিচিত ব্র্যান্ড। দেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে এই শাড়ি এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, বিয়ে মানেই ছিল মালা শাড়ি।
এর আগে ১৯৫৬ সালে দেশে প্রথম ইলেকট্রিক ক্যাবল উৎপাদনের কারখানা গড়ে তুলেন আনোয়ার হোসেন।
মালা শাড়ির সফলতার পর 'দ্য ফার্স্ট স্টেইনলেস স্টিল কাটলেরি ম্যানুফ্যাকচারার' নামে ইস্পাত কারখানা গড়ে তুলেন ১৯৬৮ সালে। তবে মুক্তিযুদ্ধের কারণে কিছুটা আটকে যায় এ ব্যবসা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আনোয়ার হোসেনের বয়স ৩৩ বছর। তিনি সে সময় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ২৪ এপ্রিল চকবাজারে আগুন দেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। পুড়ে যায় আনোয়ার হোসেনের দোকান।
স্বাধীনতার পর অর্থনীতি মৃতপ্রায়। ব্যবসার বহু বকেয়া টাকা আটকে যায় আনোয়ার হোসেনের। তবে প্রতিকূলতা কাটিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। তখন বাঙালিদের মধ্যে বড় ব্যবসায়ীর সংখ্যা ছিল খুবই কম। শিল্পোদ্যোক্তা ছিল হাতে গোনা। আনোয়ার হোসেন ছিলেন তাঁদের একজন।
দেশের অর্থনীতি পুনর্গঠনের সময় পুরানো ব্যবসা সতেজ করার পাশাপাশি ১৯৭৮ সালে খালেদ আয়রন এন্ড স্টিলস লিমিটেড নামে নতুন ইস্পাত কারখানা গড়ে তুলেন। এরপর আর পেছনে না তাকিয়ে একে একে গড়ে তুলেন টেক্সটাইল মিলস, আনোয়ার ইস্পাত, আনোয়ার সিমেন্টসহ বহু প্রতিষ্ঠান।
সরকারি ব্যাংকে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সময়ক্ষেপণ ও হয়রানি দূর করতে অনেক প্রচেষ্টায় গড়ে তোলেন বেসরকারি শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক ব্যাংক দ্য সিটি ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দ্য সিটি ব্যাংকে চারবার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আনোয়ার হোসেনের সফলতা নিয়ে তারই ছেলে গ্রুপের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনোয়ার হোসেন বলেন, "আমি মনে করি, দাদীর প্রতি অসম্ভব শ্রদ্ধা বাবাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। দাদী যেটা বলতেন, তাঁর ওপরে কোনো কথা বলতেন না।"
তিনি বলেন, "বাবা প্রায়ই একটা উপদেশ দিতেন, 'কালকের কাজ আজকে। আজকের কাজ এক্ষুনি। অফিস থেকে যখন যাবা, তখন টেবিল খালি করে দিয়ে যাবা। তুমি এক মানোয়ার একটা কাগজে সই না করলে হয়তো ৫০০ লোকের বেতন হবে না। নয়তো একটি মেশিন চলবে না।"
সামাজিক উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ী নেতা
নিজে শিল্প উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি অন্য উদ্যোক্তাদের জন্য পথ তৈরি করেন আনোয়ার হোসেন। দেশের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মধ্যে স্বনামধন্য ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আজকের অবস্থানে আসার পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল আনোয়ার হোসেনের। তিনি এবং সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান (এখন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ বা আইসিসিবির সভাপতি) মূলত সংগঠনটির অভিভাবক। তাঁরা দুজন আবার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
মাহবুবুর রহমান ছেলে ঢাকা চেম্বারের বর্তমান সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, আনোয়ার হোসেন নতুন ব্যবসায়ী তৈরিতে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন।
সামাজিক কাজের জন্য রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিন বছর সংসদ সদস্য ছিলেন। হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সংগঠনে সহায়তায় উদারহস্ত আনোয়ার হোসেন। নিজের নামে একটি ফাউন্ডেশনও প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেটি সামাজিক কল্যাণে ভূমিকা রাখছে।
পারিবারিক ব্যবসা ১৮৪ বছর
আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩৭ সালে। তাঁদের পারিবারিক ব্যবসার শুরু তারও ১০৪ বছর আগে, ১৮৩৪ সালে। ওই বছর তখনকার কুন্ডু রাজার কাছ থেকে চকবাজারে বছরে এক টাকা খাজনায় একটি ভিটা ইজারা নেন আনোয়ার হোসেনের দাদা লাট মিয়া। ফলে এখন আনোয়ার হোসেনের পরিবারের ব্যবসার বয়স দাঁড়িয়েছে ১৮৩ বছর।
আনোয়ার হোসেনের বাবার নাম রহিম বখস। তিনি (রহিম বখস) বাবার ব্যবসাকে বড় করেন। শিংয়ের চিরুনির পাশাপাশি কাপড়সহ আরও কিছু পণ্যের ব্যবসা করতেন তিনি।
আনোয়ার হোসেন উল্লেখ করেছেন, ১৯৪৫ সালে ৮৫ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে রহিম বখ্স ছিলেন ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে চারজন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর একজন।