ইউটিউব ভিউয়ের জন্য বেপরোয়া ‘বাস রেস’
'ইমরুল হাসান' নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলের পোস্ট করা মিনিট দুয়েকের একটা ভিডিওতে দেখা যায়, অন্তত তিনজন মানুষ একটা বাস রেসের ভিডিও ধারণ করছেন। একটা বাস আরেকটা বাসকে ওভারটেক করে এগিয়ে যাবার জন্য ক্রমাগত হর্ন দিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে কয়েকজন মানুষ, সম্ভবত ইউটিউবাররা, চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছেন চালককে।
'চলো, চলো, হ্যাঁ, এই তো হয়ে গেছে,'—এমন চিৎকারে ওভারটেক করা বাসের চালককে উৎসাহ দিতে থাকেন তারা। বাসটা গতি বাড়িয়ে অন্য বাসকে পেরিয়ে যেতেই তারা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে বলেন, 'ইয়াহ!'
ইউটিউব ভিডিওর শিরোনাম থেকে জানা যায়, হানিফ পরিবহনের বাসটির চালকের নাম নিজাম। শিরোনামে লেখা: 'রাস্তার হানিফ নিয়ে কক্সবাজার রোড কাঁপিয়েছিলো কিং নিজাম [সারপ্রাইজ ইমোটিকন] …বাস রেস [ভয় পাওয়ার ইমোটিকন] …এস. আলম অ্যান্ড রিলাক্স বনাম হানিফ।'
কয়েক সেকেন্ড পর নিজাম অন্য একটা বাসকে ওভারটেক করতে গেলে একই কাহিনির পুনরাবৃত্তি হয়।
ইউটিউবাররা চেঁচিয়ে 'রাজা' নিজামকে সামনের অন্য বাসটাকেও ওভারটেক করার জন্য উৎসাহ দেন। নিজাম ওই বাসটাকেও পাশ কাটিয়ে গেলে ফের উল্লসিত হয়ে ওঠেন তারা।
নিজামের মাথার ওপরে মুসলমানরা বিপদে পড়লে যে দোয়া পড়েন, সেটি লেখা: 'লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা...'। মৃত্যুশয্যায় মুসলমানের কানের পাশে অন্য দোয়ার সঙ্গে এই দোয়াও পড়া হয়।
কক্সবাজারগামী বাসগুলোর অধিকাংশই পর্যটকদের নিয়ে যাতায়াত করে। তাই এই বাহনগুলোর অধিকাংশই যাত্রীপূর্ণ থাকে। অর্থাৎ ওই বাসে প্রায় ৫০ জন যাত্রী ছিল। সামান্য ভিউয়ের জন্য এই যাত্রীদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছিলেন বাসটির ড্রাইভার আর ইউটিউবাররা। তখন কি যাত্রীরাও বাসের ওপরে লেখা দোয়াটি পড়ছিলেন? উত্তর আমাদের জানা নেই।
ইউটিউবে ভিডিওটির ভিউসংখ্যা দশ লাখের বেশি। 'ইমরুল হাসান' নামের চ্যানেলটিতে এমন বাস রেসের কয়েকশো ভিডিও আপলোড করা হয়েছে।
চ্যানেলটির মোট ভিউ ৩৮ মিলিয়নের বেশি, সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা ১ লাখের বেশি। সবগুলো ভিডিওর শিরোনাম ও থাম্বনেইলই ভীতিকর। আপনি যদি রাস্তায় যানবাহন নিয়ে বেপরোয়া কাজকর্ম করতে পছন্দ করেন, ইমরুল দেশের দুর্ঘটনাপ্রবণ রাস্তায় এসব বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের ভিডিও করে ভিউ কামিয়ে নেবে।
ইমরুল হাসান একা নয়। কমপক্ষে এমন এক ডজন ইউটিউব চ্যানেলের খোঁজ পেয়েছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। এসব চ্যানেল দেশের রাস্তায় বেপরোয়া রেসের ভিডিও আপলোড করে টাকা কামায়। এমন এক দেশে তারা কাজটি করছে, যেখানে প্রতি বছর হাজারো মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।
এমন এক চ্যানেলের মালিক রাইয়ান রহমান। নিজেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেন।
ফেসবুক মেসেঞ্জারে রাইয়ান টিবিএসকে বলেন, 'বাসে ভ্রমণ করতে আমি পছন্দ করি। বাস চালানোর রোমাঞ্চকর মুহূর্তের ভিডিও আর স্থিরচিত্র তুলতে আমার ভালো লাগে।'
টিবিএসের পক্ষ থেকে তার কাছে 'তারকা' বাস রেসার ইমরুল হাসানের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে রাইয়ান বলেন, 'তিনি ক্লাসি বাসের ভক্ত। তার সব ভিডিও তিনি নিজেই করেছেন। তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র।'
রাইয়ান টিবিএসকে ইমরুল হাসানের ফেসবুক আইডি দেন। কথা বলার জন্য টিবিএসের পক্ষ থেকে ইমরুলকে কয়েকবার নক করা হলেও তিনি কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি।
তবে 'বাস ভক্ত' সম্প্রদায় সম্পর্কে রাইয়ানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টিবিএস সুমন এন মাহমুদ নামে আরেক ইউটিউবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তার ইউটিউব চ্যানেল 'বিডি বাস টিউবার'-এর প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার সবস্ক্রাইবার আছে।
পটুয়াখালী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের স্নাতক সুমনও শখের বশে এসব 'রোমাঞ্চকর' ভিডিও বানান। সুমন টিবিএসকে বলেন, 'আমার কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ইত্যাদি সব রুটের ভিডিও আছে। আমি ভ্রমণ করতে পছন্দ করি। তাই বাসভ্রমণের সময় এরকম মুহূর্ত ভিডিও করে রাখি।'
কথোপকথন একটু এগোতেই সুমন সম্ভবত বুঝতে পারেন তার কার্যক্রম হাজারো মানুষকে বিপদে ফেলতে পারে। টিবিএসকে তিনি বলনে, 'আপনি যেহেতু বলছেন, এ ধরনের ভিডিও সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে, তাই আমি এসব ভিডিও বানানো ছেড়ে দেব।'
এই লাইনের অন্য তারকা ইমরুল হাসানও সম্ভবত বোঝেন দ্রুতগতির বাসগুলো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কিন্তু তারপরও তিনি এসব ঘটনাকে রোমাঞ্চকর প্রতিযোগিতা হিসেবে উপস্থাপন করেন। এক ভিডিওতে দেখা যায়, একটা সিএনজি অটোরিকশা অল্পের জন্য ঝড়ের বেগে এগিয়ে যাওয়া একটা বাসের নিচে পিষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে গেছে। ভিডিওটির শিরোনাম, 'অল্পের জন্য বেঁচে গেল সিএনজি অটোরিকশা।'
কিন্তু টিবিএসের সঙ্গে কথা বলার এক মাস পরই সুমন তার চ্যানেলে দুটি ভিডিও পোস্ট করেন। একটার শিরোনাম 'দুই দেশ ট্রাভেলস ও জে লাইন ওভারটেক! থ্রিলিং বাস রেস'! এক সপ্তাহ আগে আরেকটা ভিডিও পোস্ট করা হয়। ভিডিওটার শিরোনাম, 'দুই সাকুরার (বাস) দূরন্ত ছুটে চলা!'
সুমনের ভিডিওগুলো সব মিলিয়ে ২৯ মিলিয়নেরও বেশি ভিউ পেয়েছে।
টিবিএসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক ড. মো. আসিফ রায়হানের কাছে এরকম বেশ কয়েকটি বাস রেসের ভিডিও লিঙ্ক পাঠানো হয়।
উন্মত্ত বাস রেসগুলো দেখার পর ড. ছয়টি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন:
- চালকের এত কাছাকাছি ভিডিও ধারণ করা নিরাপত্তাঝুঁকির কারণ হতে পারে—ড্রাইভিং থেকে মনোযোগ সরে যেতে পারে
- গতিবেগ—আক্রমণাত্মক ড্রাইভিং
- ওভারটেকিং, আক্রমণাত্মকভাবে অন্য বাসের পথ আটকে দেওয়া, হর্ন বাজানো—সড়কে বেপরোয়া হয়ে ওঠা
- যাত্রী, হেল্পার এবং ভিডিওনির্মাতারা চালকদের এ ধরনের কাজ করতে উসকানি দিচ্ছে—এটা সম্ভাব্য নিরাপত্তাঝুঁকি
- এ ধরনের ভিডিও শেয়ার করলে অন্যরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের এমন ভিডিও শেয়ার করতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন—সস্তা খ্যাতির জন্য সড়কে নিরাপত্তারঝুঁকি তৈরি হয়
- এ ধরনের ভিডিও বানিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হলে—সড়কে নিরাপত্তাঝুঁকি আরও বেড়ে যায়
ড. রায়হান টিবিএসকে বলেন, নন-লেনভিত্তিক নানা ধরনের যানবাহন চলে বাংলাদেশের রাস্তায়। আমরা এখনও আমাদের সড়ক নিরাপত্তা লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। তাই এ ধরনের সস্তা খ্যাতি কুড়ানোর কার্যক্রম আমাদের সড়কে যান চলাচল ব্যবস্থাকে আরও বিপদে ফেলবে।
ড. রায়হান জানান, সড়ক দুর্ঘটনাকে সড়কে যানবাহন নিরাপত্তাব্যবস্থার তিন মৌলিক উপাদান—রাস্তা, যানবাহন ও ব্যবহারকারীর (মানুষ) মধ্যে সমন্বিত মিথস্ক্রিয়ার ব্যর্থতা বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, শতকরা ৯০ ভাগ সময় ব্যবহারকারীরাই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটাতে প্রধান ভূমিকা রাখেন। এর অর্থ, ব্যবহারকারী/মানুষ (চালক, যাত্রী বা পথচারী উভয়ই) ট্র্যাফিক ব্যবস্থার সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে। কাজেই চালকরা নিঃসন্দেহে ট্র্যাফিক ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ড. রায়হান বলেন, 'রাস্তায় চালকদের খেপে যাওয়া, আক্রমণাত্মক ও অমনোযোগী ড্রাইভিং চালকদের জন্য সুপরিচিত ট্র্যাফিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ। সড়কে চালকদের খেপে যাওয়ার কিছু সাধারণ ঘটনা হচ্ছে—একটা গাড়ির খুব কাছাকাছি অন্য গাড়ি চালানো, চিৎকার-চেঁচামেচি, হর্ন বাজানো, রাগত অঙ্গভঙ্গি করা, অন্য গাড়িকে লেন পরিবর্তনে বাধা দেওয়া, ইচ্ছে করে অন্য গাড়ির পথ আটকে রাখা, অন্য গাড়ির চালকের সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য নিজের গাড়ি থেকে নেমে যাওয়া, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অন্য গাড়িকে ধাক্কা দেওয়া ইত্যাদি।'
তিনি আরও বলেন আক্রমণাত্মক ড্রাইভিংয়ের সবচেয়ে সাধারণ বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বেপরোয়া গতি। গাড়ি চালানোর সময় অন্য যেকোনো কাজ চালকের মূল কাজ, অর্থাৎ ড্রাইভিংকে বিঘ্নিত করবে। এ ধরনের ড্রাইভিংকে 'ডিসট্রাক্টিং ড্রাইভিং' বলা হয়। এমনকি গাড়ি চালানোর সময় কোনো বিলবোর্ডের দিকে একনজর তাকানোও অমনোযোগী ড্রাইভিংয়ের আওতায় পড়ে।
ইউটিউবে আপলোড করা বাস রেসের ভিডিও পর্যবেক্ষণ করে কি না জানার জন্য টিবিএসের পক্ষ থেকে হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অপারেশনস অ্যান্ড স্পেশাল অ্যাফেয়ার্সের অতিরিক্ত এসপি নাজমুস সাকিব খান বলেন, 'সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের অনেক কার্যক্রম আছে। কিন্তু আমরা এখনও ভ্লগিং পর্যবেক্ষণ করছি না।'
বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক ডা. রায়হান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গাড়ি চালানো খুব চাপের কাজ। এর জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট এবং সুস্থ থাকতে হয়। ড্রাইভারদের মনোযোগ মুহূর্তের জন্য সরে গেলেও নিরাপত্তাঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। ড্রাইভারের কাছে বসে ভিডিও বানালে সহজেই তার মনোযোগ সরে যেতে পারে—ফলে ঘটতে পারে গুরুতর দুর্ঘটনা।'