উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পদ পাবেন না ৮ ধনকুবেরের সন্তানরা
ধনকুবেরের সন্তান হওয়ার কতোই না সুবিধা, তাই না! শুধু সন্তানই নয়, কখনও কখনও ধনকুবেরদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও উত্তরাধিকারসূত্রে বিশাল অর্থসম্পদ লাভ করে থাকে।
কিন্তু বর্তমানে বিল গেটস এবং টেড টার্নারের মতো বিলিওনিয়ারদের সংখ্যাও নেহায়েত কম না, যারা তাদের অর্জিত অঢেল সম্পদ পরিবার ও সন্তানদের মধ্যে রেখে যেতেই ইচ্ছুক নন। এর পরিবর্তে, তারা তাদের ধনসম্পদ দান করে দিতে এবং সন্তান-সন্ততিদের কঠোর পরিশ্রমের মূল্য শেখাতে চান।
টেড টার্নার
'মিডিয়া ম্যাগনেট' এবং বার্তা সংস্থা সিএনএনের প্রতিষ্ঠাতা টেড টার্নার এখন পর্যন্ত জাতিসংঘে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করেছেন বলে জানা যায়।
বিশ্বের শীর্ষ দুই ধনী বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেটের উদ্যোগে গড়ে তোলা জনকল্যাণমূলক সংগঠন 'দ্য গিভিং প্লেজ' এও তিনি ইতিমধ্যে স্বাক্ষর করেছেন।
বাবার পীড়াপীড়িতে খুব ছোটবেলাতেই কাজে নেমে পড়েন টেড। ১৯৬৩ সালে বাবার মৃত্যুর পর টেড পুরোদস্তুর বাবার বিজ্ঞাপনী সংস্থার হাল ধরেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, ১৯৯৬ সালে তিনি টাইম ওয়ার্নারের কাছে টার্নার ব্রডকাস্টিংয়ের স্বত্ব বিক্রি করার সময় ৭.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার লাভ করেন।
ব্যক্তিজীবনে টার্নার তিনটি বিয়ে করেছেন; তবে টেকেনি কোনটিই। টার্নারের ৫ সন্তানের কেউই তার বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে না।
সিএনএন এর তথ্যমতে, 'দ্য গিভিং প্লেজ' ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে অর্ধেক বা তারও অধিক সম্পদ দান করে দেয়া ধনকুবেরদের নামের তালিকায় টার্নারের নাম আছে।
রিড হেস্টিংস
কোন মানুষ বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়, নেটফ্লিক্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও রিড হেস্টিংসের স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী নাকি ঘুম! পেশায় প্রকৌশলী, হেস্টিংস ১৯৯৭ সালে মার্ক র্যান্ডলফের সাথে যৌথভাবে নেটফ্লিক্সের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এখন কোটি কোটি টাকা কামালেও, একটা সময় ছিল যখন রিড মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে 'সেলসম্যান' হিসেবে কাজ করেছেন।
আর দশজন সাধারণ মানুষের মতোই এই বিলিওনিয়ার তার অবসর কাটান সাদামাটাভাবে। বছরে একবার ছুটি নেন, সন্ধ্যায় নেটফ্লিক্সে ডুবে থাকেন। ভালবাসেন স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া কুইলিন এবং তাদের দুই সন্তান ও পোষা প্রাণীর সাথে সময় কাটাতে।
সম্প্রতি, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১২০ মিলিয়ন ডলার অনুদান করেছেন; সিলিকন ভ্যালি কমিউনিটি ফাউন্ডেশনে শিক্ষার জন্য হেস্টিংস ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি তহবিল তৈরি করেছেন। 'দ্য গিভিং প্লেজ' এও স্বাক্ষর আছে রিডের যা তার সন্তানদের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উল্লেখযোগ্য হ্রাসের দিকেই ইঙ্গিত করে।
জর্জ লুকাস
মহাকাশ যাত্রার ওপর নির্মিত ফিল্ম ফ্র্যাঞ্চাইজি 'স্টার ওয়ারস' এর নির্মাতা জর্জ লুকাস ডিজনির কাছে তার প্রতিষ্ঠান লুকাসফিল্ম বিক্রয় করে দেবার পরপরই সম্পদ অনুদানের ঘোষণা দেন। এ কোম্পানির বিক্রয় তাকে প্রায় ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মুনাফা এনে দেয়।
লুকাস জানান, তার সম্পত্তির একটা বড় অংশ শিক্ষাখাতে ব্যয় হবে।
'দ্য গিভিং প্লেজ' উদ্যোগের অংশ হিসেবে লুকাস তার সম্পদের অর্ধেক দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
লুকাসের চার সন্তান রয়েছে। এদের মধ্যে তিনজনকে দত্তক নেওয়া হয়েছে, এবং চতুর্থ সন্তান সারোগেসির মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেছে। শিশুদের শিক্ষায় সাহায্য করার উদ্দেশ্যে তার লক্ষ্য অব্যাহত রাখার জন্য, তিনি দ্য জর্জ লুকাস এডুকেশনাল ফাউন্ডেশনও তৈরি করেছেন।
লরেন পাওয়েল জবস
স্বামী স্টিভ জবসের মৃত্যুর পর লরেন পাওয়েল জবস বিপুল অর্থসম্পদের উত্তরাধিকার লাভ করেন। ২০১১ সালের অক্টোবরে মৃত্যুর সময় অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের সম্পদের মূল্যমান ছিল ১০.২ বিলিয়ন ডলার।
লরেন বলেছেন, তিনি সম্পদের সঞ্চয়ে বিশ্বাস করেন না।
ফোর্বসকে দেয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলে ওঠেন, "অর্থ অবশ্যই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার একটি মাধ্যম কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে আমি কে তার সাথে অর্থের যোগসূত্র নেই"।
বিজনেস ইনসাইডারের মতে, তিনি তার প্রয়াত স্বামীর সম্পদ বিতরণে এমনভাবে জীবন উৎসর্গ করেছেন যেন ব্যক্তি ও সম্প্রদায় কার্যকরীভাবে এবং টেকসই উপায়ে তা ব্যবহার করতে পারে।
লরেন এবং স্টিভের ঘরে তিন সন্তান রয়েছে, আরও রয়েছে স্টিভের আগের ঘরের মেয়ে লিসা ব্রেনান-জবস।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস টাইমসের কাছে লিসা প্রকাশ করেছেন যে, তিনি এবং তার ভাইবোনেরা তাদের বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যে সম্পদ পেয়েছেন তার মূল্যমান মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছিই তবে তিনি বাবার বাকি সম্পদের বরাদ্দের সাথে জড়িত নন।
ওয়ারেন বাফেট
"আমি আমাদের সন্তানদের ততোটুকুই দিতে চাই, যাতে তাদের মনে হয়, তারা এ থেকে কিছু করতে পারবে কিন্তু কখনোই এমন পরিমাণ রেখে যেতে চাই না, যেন তাদের মনে হয় যে, তাদের কিছুই করার প্রয়োজন নেই"- এ উক্তি ওয়ারেন বাফেটের।
বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের সিইও বাফেট, বিল গেটসের সাথে মিলে 'দ্য গিভিং প্লেজ' উদ্যোগটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
বাফেট তার ৯৯ শতাংশেরও অধিক সম্পদ দাতব্য কাজে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তাই বলে তার সন্তানদের জন্য একেবারেই কিছু ছেড়ে যাচ্ছেন না, তা নয়। ওয়ারেন বাফেটের সন্তানদের প্রত্যেকেরই তাদের বাবার ২ বিলিয়ন ডলারের তহবিল রয়েছে।
বিল গেটস ও মেলিন্ডা গেটস
ব্যক্তিগতভাবে, বিল গেটস ১২৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং তার সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডা গেটস ৫.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক।
গত মে মাসে এ দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণার পর মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা, উদ্যোক্তা এবং সমাজসেবক, বিল গেটস মেলিন্ডাকে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি শেয়ার হস্তান্তর করেছেন। ব্লুমবার্গের মতে, এটিই তাকে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল এবং শুধুমাত্র এই স্টকগুলোরই মূল্য এখন ৫.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
বিবাহ বিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠা করা গেটস ফাউন্ডেশনে বিল ও মেলিন্ডার পথ অনেকটাই দু'দিকে বেঁকে গেছে, কিন্তু তাদের সন্তানদের কার ভাগ্যে কী জুটছে?
২০১১ সালের প্রথম দিকে একবার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বিল তার প্রতিটি সন্তানের জন্য ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেখে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন, কিন্তু এটি কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সে বছরই দ্য ডেইলি মেইলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গেটস বলেছিলেন, "বাচ্চাদের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ রাখা তাদের প্রতি কোন অনুগ্রহ নয়" এবং "তিনি আর মেলিন্ডা খুশিমনেই এ উদ্যোগ নেবেন"।
তবে বিচ্ছেদের পরে এটি পরিবর্তন হতে পারে। পেজ সিক্স এর তথ্য অনুসারে, বিচ্ছেদ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, মেলিন্ডার দায়ের করা বিচ্ছেদের ফাইল এটাই ইঙ্গিত দেয় যে তিনি তার তিন সন্তানের উত্তরাধিকার পরিবর্তন করতে পারেন। সেখানে আরও উল্লেখ করা হয়, এই মামলায় মেলিন্ডার সুপরিচিত ট্রাস্ট এবং এস্টেট আইনজীবী নিয়োগ রয়েছেন।
মার্ক জাকারবার্গ
আচ্ছা, কখনো কী আমরা ভেবে দেখি ফেসবুক ছাড়া এই দুনিয়ার কী হবে? কিংবা ফেসবুক আসার আগে কেমন ছিল সব!
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন মার্ক জাকারবার্গ যখন প্রথম এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি চালু করলেন, তিনি বোধহয় নিজেও জানতেন না- একদিন কীভাবে যোগাযোগের ধরন ও উপায় আমূল বদলে দেবেন তিনি!
২০১৫ সালে, জাকারবার্গ এবং তার স্ত্রী প্রিসিলা চ্যান তাদের প্রথম কন্যাসন্তান ম্যাক্সকে স্বাগত জানান। ম্যাক্সের জন্মের সময়ই এ দম্পতি একটি খোলা চিঠিতে ঘোষণা করেছিলেন যে, জীবদ্দশায় তারা তাদের কোম্পানির ৯৯ শতাংশ শেয়ার একটি ফাউন্ডেশনে দেবেন; এই ফাউন্ডেশন পরবর্তী প্রজন্মের সকল শিশুর জন্য সমতা নিশ্চিতে কাজ করবে। উল্লেখ্য, আগস্টে এই দম্পতির জীবনে এসেছে তাদের দ্বিতীয় সন্তান।
এই ৮ জনের বাইরে আরও অনেক ধনকুবের রয়েছেন, যারা সন্তানের জন্য বিপুল অর্থসম্পদ ছেড়ে যাবার মতবাদে বিশ্বাসী নন। এমনই একজন জনপ্রিয় ব্রিটিশ অভিনেতা এবং 'জেমস বন্ড' তারকা ড্যানিয়েল ক্রেগ। তিনি ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিক। তার প্রথম সন্তানের বয়স ২৯; এছাড়া বর্তমান স্ত্রী, হলিউড অভিনেত্রী র্যাচেল ওয়াইজের সাথে তার রয়েছে আরেকটি সন্তান।
এই তারকা তার সন্তানদের কোন অর্থ প্রদান করবেন না; তার ভাষ্যে, "উত্তরাধিকার একটি অরুচিকর ব্যাপার"।
৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের সম্পদের মালিক কানাডিয়ান উদ্যোক্তা কেভিন ও'ল্যারিও চান যে, তার সন্তানরা পরিশ্রমের মূল্য বুঝুক এবং কর্মক্ষেত্রের নৈতিকতা অর্জন করুক। বলাই বাহুল্য, তিনিও কোন উত্তরাধিকারী রেখে যাবার পরিকল্পনা করছেন না।
সূত্র- সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট