এফ-৩৫ ফাইটার জেট বানাতে সাহায্য করেছেন যে বাংলাদেশি ইঞ্জিনিয়ার
পৃথিবীর সব ধরনের ফাইটার জেট বিমানের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর মডেল ধরা হয় লকহিড মার্টিন এফ-৩৫'কে। ফাইটার বিমানটিকে নিজস্ব ঘরানার মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক এবং টিকে থাকতে সক্ষম বলেও মনে করা হয়। পৃথিবীর বেশিরভাগ মহাকাশ কৌতূহলীদের কাছেই এই ফাইটার জেট বানানোর প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকাটা স্বপ্নের মতো ব্যাপার। কিন্তু অসীম রহমানের কাছে সেই স্বপ্নই সত্যি হয়ে ধরা দিয়েছিল ২০১৯ সালের শুরুতে।
ঢাকার ধানমন্ডি ও পরে উত্তরায় বেড়ে ওঠা অসীম প্লেগ্রুপ থেকে এ-লেভেল পর্যন্ত পড়াশোনা সেরেছেন সানবীমস স্কুলে। এ-লেভেল পাস করার পরই ব্যাচেলর ডিগ্রি নিতে ২০১০ সালে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার আটলান্টা শহরে। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে তিনি জায়গা করেন নেন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় সেরা স্কুল জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে।
গ্র্যাজুয়েশনের পর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে স্টার্ট-আপ শুরু করলেও অসীমের মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনীর হয়ে কাজ করা। কিন্তু এ ধরনের সেক্টরে কাজ করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকাটা অত্যাবশ্যক, তাই এদিকে পিছিয়ে যান অসীম। তবু মনে মনে তার ইচ্ছা ছিল এমন কিছু করা, যেন ইতিহাস স্মরণে রাখে তাকে।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সময় নষ্ট না করে অসীম অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিতে আবেদন করেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'জর্জিয়া টেক-এ আমার খুবই কাছের একজন বন্ধু আমাকে জানিয়েছিল লকহিড মার্টিনের একটা সুযোগ নেওয়ার কথা। তাই আমি সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে আবেদন করি। কয়েক রাউন্ড ইন্টারভিউ নেওয়ার পর তারা আমাকে এফ-৩৫ প্রোগ্রামের ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ার হবার প্রস্তাব দেয়। আর সেইসঙ্গে শুরু হয় আমার অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রির রোমাঞ্চকর জীবন।'
অসীম জানালেন, কয়েক মাস আগে হিউস্টনে একটি এয়ার শোতে নিজের এফ-৩৫ বিমান উড়তে দেখার আনন্দের কথা, 'যে যুদ্ধবিমানের সঙ্গে এত কাছ থেকে আমি জড়িত ছিলাম, সেটির কর্মদক্ষতা ও মাধুর্য দেখার মধ্যে একটা অন্য রকম গৌরবের অনুভূতি কাজ করছিল। পরে এই বিমানের পাইলটদের সঙ্গে কথা বলার অনুভূতি তো আরও দারুণ।'
এ পর্যন্ত শুনে মনে হতে পারে, অসীমের জীবন শুধুমাত্র পড়াশোনা আর কাজই সব। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়; অসীম এরইমধ্যে ঘুরেছেন বিশ্বের ৩২টি দেশ।
তিনি জানালেন, ভ্রমণ করা তার প্রিয় শখ এবং তিনি পৃথিবীর সবগুলো দেশ ঘুরতে চান। প্রতিটি দেশের নৌপথে ভ্রমণের ডাকটিকিট সংগ্রহ করাও অসীমের একটি নেশা। অসীমের কাছে এখনো পর্যন্ত তার সবচেয়ে স্মরণীয় ট্রিপ ছিল আইসল্যান্ড ভ্রমণ।
অসীম বাংলাদেশ ক্রিকেট দলেরও দারুণ ভক্ত। গত বছর নিজ দেশকে সমর্থনের জন্য উড়ে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডেও। অসীমের মুখেই শোনা গেল গৌরবের অভিব্যক্তি, 'সৌভাগ্যবশত আমি বাংলাদেশ টিমের খেলোয়াড়দের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছিলাম এবং বিশাল আকারের রয়েল বেঙ্গল টাইগার হাতে টিভিতেও দেখানো হয়েছিল আমাকে।'
অসীমের শখের তালিকা কিন্তু এখানেই শেষ হচ্ছে না। তিনি ব্যস্ত থাকতে বেশ পছন্দ করেন এবং মাঝেমধ্যে হাইস্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীও পড়ান। এছাড়াও নিজেকে একজন ভোজনপ্রেমী দাবি করেন। ভালো খাদ্য ও রেস্তোরাঁর সন্ধানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে দূর-দূরান্তে যেতেও আপত্তি নেই তার।
আমেরিকাভিত্তিক লকহিড মার্টিন হলো অ্যারোস্পেস টেকনোলজি ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠানসমূহের একটি। এখানে অসীমের কাজটা ঠিক কী, তা জানালেন তিনি নিজেই, 'একজন ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে আমি নকশা ও উৎপাদন কার্যক্রমের দিকে বেশি গুরুত্ব দেই। উৎপাদন প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপেই সহায়তা করি এবং নতুন নতুন পদ্ধতি ও যন্ত্রাংশ উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করি। এই যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু অবদান রাখতে পারছি, তা ভেবে নিজের খুব আনন্দ হয়।'
অসীম রহমান নিজের দেশ ছেড়েছেন প্রায় এক দশকেরও আগে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সেরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা শেষ করে কাজও করছেন বিখ্যাত একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে।
বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে জন্ম ও বড় হওয়া একজন মানুষের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি বিশাল সাফল্য। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনের রহস্য কী?
অসীম বললেন, 'সত্যি বলতে, আমি কখনোই খুব বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছাত্র ছিলাম না। আমার সব শিক্ষকেরাই একটা কমন অভিযোগ করতেন, আমি নিজের সেরাটা দিচ্ছি না। তাদের এই কথার গুরুত্ব পরে গিয়ে অনুধাবন করেছি। কিন্তু তাও ভালো, উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার সময়ই আমি সচেতন হয়েছিলাম।'
যদিও অসীম সফলতার কোনো তথাকথিত গোপন মন্ত্র আছে বলে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু তিনি সঠিক সময়ে সঠিক কাজে বিশ্বাসী। অসীম তারুণ্যের পুরো সুযোগ নিতে চেয়েছেন, যেন পরে আফসোস করতে না হয়।
ভবিষ্যতের জন্যে অসীমের পরিকল্পনা একটি গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নেওয়া এবং লকহিড মার্টিনে নিজের ক্যারিয়ার আরও বিস্তৃত করা। অসীমের মতে, 'নিজের ক্যারিয়ারের লক্ষ্য ঠিক করা অবশ্যই জরুরি, তবে সেইসঙ্গে এমন কোনো কাজ বেছে নেওয়া উচিত, যেন তা আপনি আনন্দের সঙ্গে করতে পারেন। আমার আজকের গল্পটা যারা পড়বে, সেই তরুণদের বলব, নিজের যোগ্যতার ওপর বিশ্বাস রাখুন এবং পরিশ্রম করে যান। সাফল্য কোনো সহজ জিনিস নয় কিংবা তা দ্রুত আসে না। যেমনটা কিংবদন্তি ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার বলেছেন, নিজের খেলাকে উপভোগ করো, স্বপ্নকে তাড়া করো, কারণ স্বপ্ন সত্যি হবেই।'
কেমন কাটছে যুক্তরাষ্ট্রের জীবন? এ প্রশ্নের জবাবে অসীম জানালেন, তিনি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসাটা তার জন্য নতুন অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে, যা হয়তো বাংলাদেশে থাকলে সম্ভব হতো না। তবে তিনি এও পরামর্শ দিলেন, কেউ যদি বিদেশে আসতে চায়, তাকে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে আসতে হবে।
অসীমের ভাষ্যে, 'আমরা প্রায়ই নিজের ঘরে থাকার যে সামান্য বিলাসিতা, তাকে গুরুত্ব দেই না। কিন্তু বিদেশে এলে বোঝা যায়, এখানে জীবন অন্য রকম।'
অসীমের যুক্তরাষ্ট্রের জীবনে আরও একটি বড় মোড় ছিল নিজের ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পাওয়া। গত বছরই তারা একটি বিশাল 'দেশি' ঘরানায় বিয়ের পরিকল্পনা করলেও কোভিড-১৯-এর জন্য তা ছোট পরিসরেই সেরে ফেলতে হয়।
অসীম জানালেন, তার স্ত্রী পেশায় একজন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজিস্ট। এও জানাতে ভোলেননি, তারমতো একজন সাপোর্টিভ এবং কেয়ারিং নারীকে পাশে পেয়ে তিনি কতটা আনন্দিত।
মা-বাবা, দাদা-দাদি, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে একটি বড় পরিবারে বেড়ে ওঠাকে অসীম নিজের জন্য আশীর্বাদ মনে করেন। তিনি নিজের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হিসেবে দাদার কথা উল্লেখ করেন। নিঃস্বার্থ ও স্নেহময় পিতা-মাতা থাকাকেও অসীম নিজের সৌভাগ্য বলে মনে করেন।
বর্তমানে অসীম জর্জিয়া টেক-এ লিডারশিপ ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তার কাছে শিক্ষা একটা সারাজীবনের সফর, যা শুধুমাত্র নম্বর ও গ্রেড দিয়ে মাপা উচিত নয়। তারচেয়ে বরং শিক্ষার মানের দিকে তিনি বেশি গুরুত্ব দেন।