কোভিডের পর ভারতে নতুন বিপদ: ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সম্পর্কে কী জানা গেছে?
চলতি মাসের শুরুর দিকেই ভারতের চিকিৎসকরা 'মিউকোরমাইকোসিস' নামক এক বিরল ও বিপদজনক ইনফেকশনের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন যা 'ব্ল্যাক ফাঙ্গাস' নামেও পরিচিত।
এই মুহূর্তে যারা ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের অনেকেই হয়তোবা কোভিড রোগী ছিলেন কিংবা মাত্রই কোভিড থেকে সুস্থ হয়েছেন। কোভিড-১৯ এর প্রভাবে যাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়েছে অথবা শারীরিক নানা সমস্যা, বিশেষত ডায়াবেটিসে ভুগছেন, তারাই এবার এই নতুন রোগের শিকার হচ্ছেন।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারতজুড়ে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হাজার হাজার রোগী পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কয়েক শত রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছে এবং মারা গিয়েছেন অন্তত ৯০ জন। ভারতের দুটি রাষ্ট্র ইতিমধ্যেই একে মহামারি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার এটিকে 'গুরুতর রোগ' হিসেবে অভিহিত করেছে।
চলুন জেনে নেয়া যাক ভারতের নতুন বিপদ 'ব্ল্যাক ফাঙ্গাস' আসলে কী এবং কীভাবে ছড়াচ্ছে?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কিভাবে হয় এবং এর উপসর্গগুলো কী কী?
পরিবেশে মাটি বা জৈব সারের মতো স্যাঁতসেঁতে স্থানে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস জন্ম নেয় এবং এটি শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করতে সক্ষম। এটি কোনো সংক্রামক রোগ নয় এবং মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।
বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক থেকে এই রোগ হতে পারে। এসব ছত্রাক মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, কিন্তু যাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে গুরুতর সংক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন সেন্টার (সিডিসি)।
একজন ব্যক্তি বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সময় এটি নাক দিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে সাইনাস অথবা ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। শরীরের ত্বকে পোড়া ও বা কাটা ক্ষতস্থানের উপর বসেও সংক্রমণ ঘটাতে পারে। শরীরের কোথায় ছত্রাকের সংক্রমণ ঘটে তার ওপর ভিত্তি করে উপসর্গও বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এসব উপসর্গের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মুখ ফুলে যাওয়া, ত্বকে আলসার এবং মুখের ভেতরে ক্ষত।
১৪ মে ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, এই রোগটি 'স্কিন ইনফেকশন' রূপে প্রথম ছড়াতে শুরু করে। আমাদের কপাল, নাক, চোয়াল এবং চোখ ও দাঁতের মধ্যে যেসব এয়ার পকেট রয়েছে, সেসব স্থানে এর সংক্রমণ শুরু হয়। তারপর তা চোখ, ফুসফুস, এমনকি মস্তিষ্কেও ছড়াতে পারে বলে জানানো হয়। নাকের উপর কালচে দাগ হতে থাকা, ঘোলা দৃষ্টি, বুক ব্যথা, শ্বাস নিতে সমস্যা এবং কাশির সঙ্গে রক্ত যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা যেতে পারে।
মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান এবং কার্ডিওমেটাবলিক বিশেষজ্ঞ ডা. হেমন্ত থ্যাকার বলেন, 'মিউকোরমাইকোসিস রক্তের ধমনীর মধ্য দিয়ে ছড়াতে পারে। এটি দূরবর্তী অঙ্গগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বি[পজ্জনকভাবে কমিয়ে এবং এর ফলেই 'নেক্রোসিস বা টিস্যু মরে যাওয়া' নামক সমস্যা তৈরি করে। তারপর তা কালো হতে থাকে এবং এখান থেকেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস নামকরণ।
থ্যাকারের মতে, পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে চলে গেলে ইনফেকশন রক্ত ধমনী হয়ে মস্তিষ্কে চলে যায়। এর ফলে মানুষ দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে অথবা চেহারায় 'গ্যাপিং হোল' তৈরি করতে পারে। যদি এই রোগ নিয়ন্ত্রণ বা চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর সম্ভাবনা রয়েছে।
কোভিড-১৯ এর সঙ্গে এটির সম্পর্ক কী?
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, এমন মানুষরাই এখন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন সবচেয়ে বেশি। এদের মধ্যে কোভিড-১৯ রোগী, ডায়াবেটিস রোগী, স্টেরয়েড গ্রহণ করেন এমন রোগী তো রয়েছেনই, সেইসঙ্গে ক্যান্সার বা কোনো অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে-এমন রোগীরাও ঝুঁকিতে রয়েছেন বলে জানিয়েছে ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
কোভিড রোগীদেরকেই সবচেয়ে সংবেদনশীল মনে করার কারণ হলো এই যে, শুধুমাত্র করনাভাইরাসই নয়, চিকিৎসা নেওয়ার ঔষদ্গও তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। এসব কারণেই কোভিড রোগীরা আবারও নিজেদের জীবন নিয়ে নতুন এক যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছেন।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, কোভিড রোগীরা অক্সিজেন থেরাপি নেয়ার জন্য আইসিইউতে থাকায় ওয়ার্ডে বাতাসের আর্দ্রতা বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে আর্দ্রতার সংস্পর্শে এসে ফাঙ্গাল ইনফেকশন দ্বারা তাদের আক্রান্ত হবার হার আরও বেশি।
থ্যাকার বলেন, 'ছত্রাক আসলে দেহে ঢোকার সুযোগ খুঁজতে থাকে, যেমনটা একটা খোলা জানালার মত। কোভিডের কারণে, উচ্চ গ্লুকোজ মাত্রা বা সুগারের মাত্রার কারণে, অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে দেহে ছোট একটা পথ খুলে যায়। সেই পথ দিয়েই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দেহে প্রবেশ করে।
তবে তার মানে এই নয় যে প্রত্যেক কোভিড রোগীই ব্ল্যাক ফাঙ্গাস দ্বারা আক্রান্ত হবেন। যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের এই রোগের ঝুঁকি অনেক কম।
ভারতের জাতীয় স্বাস্থ্য পোর্টালের তথ্যানুযায়ী, দেশটিতে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ১২ থেকে ১৮ শতাংশ উচ্চ মাত্রায় রয়েছে। বিশেষত, শহুরে এলাকায় ডায়াবেটিসের প্রবণতা বেশি।
থ্যাকার বলেন, 'ভারত বিশ্বে একটি ডায়াবেটিক ক্যাপিটাল অবস্থানে আছে। আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান জলবায়ুতে ছত্রাক দ্রুত জন্মাতে পারে। সে কারণেই এখন ব্ল্যাক ফাঙ্গাস মহামারি হতে যাচ্ছে।'
এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে কীভাবে?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের চিকিৎসা হিসেবে অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষুধ ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ সময়ই এই চিকিৎসা দেহের শিরার ভেতর দিয়ে দেওয়া হয়। সবচেয়ে পরিচিত যে ওষুধটি রয়েছে এ রোগের, তা হলো অ্যামফোটেরিসিন বি, যা এই মুহূর্তে ভারতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
রোগ থেকে সুস্থ হয়ে উঠতে রোগীদের সর্বোচ্চ ছয় সপ্তাহ অ্যান্টিফাঙ্গাল ঔষধ নিতে হয়। তবে সেরে ওঠার প্রক্রিয়া নির্ভর করে রোগ কতোটা দ্রুত শনাক্ত হচ্ছে এবং কতো দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা হচ্ছে তার উপর।
কখনো কখনো মৃত টিস্যু কেটে বাদ দিতে সার্জারিরও প্রয়োজন হতে পারে। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে উপরের চোয়াল বা চোখও বাদ দিতে হতে পারে।
এই মুহূর্তে ভারতে অ্যামফোটেরিসিন-বি এর চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পেলেও, এর সরবরাহ এখনো কম। কারণ হাসপাতালগুলো আগে থেকেই রোগীর পরিমাণ অনুমান করতে পারেনি।
তেলেঙ্গানা রাজ্যের ভব্য রেড্ডি জানান, তার বাবা সবেমাত্র কোভিড থেকে সেরে উঠছিলেন, তখনই গত ২৬ এপ্রিল তার দেহে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ধরা পড়ে। তার মুখ ফুলে উঠতে থাকে এবং ফোলা না কমায় তাকে ইনজেকশন দিতে বলা হয়। কিন্তু ভব্য রেড্ডি হাসপাতালে গিয়ে অযামফোটেরিসিন পাননি। অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ পেতে তাকে মুখ্যমন্ত্রী বরাবর আবেদন করতে হয়েছে।
ভারতের কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্টিলাইজার মন্ত্রণালয়ের এক জুনিয়র মন্ত্রী, মানসুখ মানদাবিয়া বৃহস্পতিবার টুইট বার্তায় জানান, ভারতে আগে থেকেই ছয়টি কোম্পানি এই ঔষধ উৎপাদন করত, এখন আরও পাঁচ কোম্পানিকে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের আক্রমণ ভারতেই প্রথম না হলেও, ভারতীয় অণুজীববিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ভারতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস
সংক্রমণের মাত্রা ৭০ গুণ বেশি।
এর কারণ হিসেবে ভারতীয়দের 'অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস' কে দায়ী করা হচ্ছে। এমনকি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেকে জানতেই না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে। এর দ্বারা বোঝা যায়, ভারতীয়দের মধ্যে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রবণতা অত্যন্ত কম। সঠিক চিকিৎসার অভাবে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারও ভারতে বেশি বলে গবেষণা থেকে জানা যায়।
তবে এর জন্য ভারতের জলবায়ুও অনেকাংশে দায়ী বলে জানালেন থ্যাকার। গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বাতাসে আর্দ্রতার কারণে বাইরে ফেলে রাখা পাউরুটির উপরেও এই ফাঙ্গাস জন্মাতে পারে। এই মুহূর্তে গ্রীষ্মকাল চলতে থাকায় এই রোগের আক্রমণ শুরু হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন।
এখন পর্যন্ত মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, তেলেঙ্গানা ও গুজরাট রাজ্য মিলিয়ে ৩২০০ জন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়েছে।
২০০০ আক্রান্ত ও ৮০০ জন হাসপাতালে স্থানান্তরিত নিয়ে মহারাষ্ট্রেই আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। শুধু মহারাষ্ট্রেই ৯০ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। গুজরাটে এক হাসপাতালেই ৩৬৯ জন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় সরকার ব্ল্যাক ফাঙ্গাসকে 'গুরুতর রোগ' বলে ঘোষণা দিয়েছে। অর্থাৎ সকল রাজ্যকেই তাদের এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কেন্দ্রীয় সরকারকে জানাতে হবে।
- সূত্র: সিএনএন