কোভিড: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকরী উপায় কোনটি?
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের শরীর দু'ভাবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। প্রথমত, প্রাকৃতিকভাবে এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে এবং দ্বিতীয়ত, শরীরে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু এই দুই উপায়ে অর্জিত ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।
তাহলে দু'টির মধ্যে কোনটি বেশি কার্যকর?
এ প্রশ্ন এক বছর আগে, করোনা মহামারির শুরুতেও করা হয়েছিলো। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তি এবং যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা আগে থেকেই কম তাদের জন্য এই ভাইরাসটি মারাত্মক প্রাণঘাতি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
তবে এখন আশার কথা হলো, আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এখন আর শূন্যের কোঠায় নয়। অধিকাংশ মানুষই এখন টিকা নিয়ে ফেলেছে কিংবা কোভিড আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে।
আবার টিকার ক্ষেত্রে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে এসেছে। শিশুদেরকে টিকা দেওয়া হবে কিনা এ নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট বিতর্ক। সেই সঙ্গে বড়রা বুস্টার ডোজ নিবে কিনা এ প্রশ্নেও বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারছেন না।
রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরে যেভাবে কাজ করে
শরীরে ভাইরাসের আক্রমণ হলে দুটি শক্তি তা প্রতিরোধ করে থাকে। একটি হলো, শরীরের অ্যান্টিবডি এবং অন্যটি টি-সেল বা টি-কোষ। অ্যান্টিবডিগুলো ভাইরাসের শরীরে লেগে যায় এবং এটিকে ধ্বংস করে দেয়। অন্যদিকে, আমাদের শরীরের কোন কোষগুলো ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে সেটি টি-কোষগুলো বুঝতে পারে এবং সেগুলো ধ্বংস করতে থাকে।
করোনা ভাইরাস খুবই সরলভাবে আমাদের শরীরকে আক্রমণ করে। এর শরীরের আমিষ দ্বারা গঠিত স্পাইক বা কাঁটাগুলোর মাধ্যমে ভাইরাসটি আমাদের দেহে প্রবেশ করে। এবং শরীরের বাকি ২৮ টি অ্যামাইনো এসিড বা প্রোটিনকে আক্রমণ করে ব্যাপকভাবে বংশ বিস্তার করতে থাকে।
টিকা এবং ভাইরাসের সংক্রামণে যে দুই ধরণের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়, তাদের মাঝে তুলোনার ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কত সংখ্যক ভাইরাসকে আক্রমণ করতে পারে?
টিকা দেওয়ার চেয়ে প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমিত হওয়ার পর যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জন হয় সেটাকেই বেশি কার্যকর বলছেন বৈজ্ঞানিকরা।
মর্ডানা, ফাইজার, কিংবা অ্যাস্ট্রাজেনেকা যেই টিকাই দেওয়া হোক না কেন, এটি শুধু মানুষকে হাসপাতালে যাওয়ার মত গুরুতর অবস্থা থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।
সংক্রমণ এবং গুরুতর রোগ প্রতিরোধে এটি কতটা সুরক্ষা দিতে পারে?
আমরা জানি যে, কারোনা ভাইরাস একই ব্যক্তিকে একাধিকবার সংক্রমিত করতে পারে। এমনকি টিকা নেওয়া ব্যক্তিকেও সংক্রমিত করতে দেখা যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিন বলেন, "ভাইরাসটি থেকে কোনো কিছুই আপনাকে শতভাগ সুরক্ষা দিতে পারবে না। তবে আপনি যেভাবে যতটুকুই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অর্জন করেন, সেটা আপনাকে গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া থেকে সুরক্ষা দিতে পারে।"
টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে যারা কোভিড আক্রান্ত হয়েছে, এখন পর্যন্ত তাদের মধ্যেই সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেখা গেছে।
সুরক্ষা ব্যবস্থা কতদিন স্থায়ী হতে পারে?
অ্যান্টিবডির মাত্রা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হ্রাস পেতে থাকে এবং দুর্বল অ্যান্টিবডি গুরুতর রোগ প্রতিরোধে সক্ষম নাও হতে পারে।
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভাইরাস এবং টিকার গঠন মনে রাখে, যাতে শরীরে ভাইরাসের সম্মুখীন হলেই এটি দ্রুত তা প্রতিরোধ করতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছর পরেও মানবদেহে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কর্যকর থাকে।
তবে লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের প্রফেসর পিটার ওপেনশো বলেন, "স্থায়িত্বের বিষয়টি আমরা এখনও পর্যবেক্ষণ করছি।"
প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি শরীরের কোথায়?
এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। নাক এবং ফুসফুসের অ্যান্টিবডি (ইমিউনোগ্লোবুলিন হিসাবে পরিচিত) এর গঠন ও ধরণ আমাদের রক্তে উপস্থিত অ্যান্টিবডি (ইমিউনোগ্লোবুলিন জিএস) এর তুলনায় ভিন্ন।
গবেষকদের মতে, আগেরটিই বেশি কার্যকর এবং 'নাসাল ভ্যাকসিন' বা নাকের মাধ্যমে যে টিকে শরীরে ঢোকানো হয় সেটির পর্যবেক্ষণও চলছে।
ভাইরাস ও টিকার মধ্যে ভারমাস্য
গবেষকদের মতে, টিকা না নেওয়া প্রাপ্তবয়স্করা যদি টিকা নেয়, তবে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও শক্তিশালী হবে; এমনকি যদি তারা আগে কোভিড আক্রান্তও হয়ে থাকে।
কিন্তু এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আছেঃ
১. প্রাপবয়স্কদের বুস্টার ডোজের প্রয়োজন আছে কিনা, নাকি ভাইরাসের সংস্পর্শে আসাই তাদের জন্য যথেষ্ট?
২. শিশুদের কি আদৌ টিকা দেওয়ার প্রয়োজন আছে, নাকি ভাইরাসের মুখোমুখি জীবনযাপনই তাদের মাঝে ভাল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে?
প্রতিবার ভাইরাসটি মুখোমুখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা একটু একটু করে শক্তিশালী হতে থাকে, এবং এটি বার্ধক্য পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কিন্তু যখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যর্থ হতে শুরু করে তখন সংক্রামণ সমস্যাটি প্রকট হয়ে ওঠে।
যাইহোক, গবেষকরা বলছেন, শিশুদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ শিশু ইতোমধ্যেই সংক্রমিত হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশকেই সামান্য কিংবা গুরুতরভাবে অসুস্থ হতে দেখা যায় নি।
তবে, এখানে পাল্টা যুক্তিও আছে। অধ্যাপক রিলেই শিশুদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী-কোভিডের কথা বলেছেন; এবং অধ্যাপক ওপেনশো ভাইরাসটির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন, যা শরীরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে।
রিলেই মনে করেন, সংক্রমণের পরে মূলত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতেই টিকার ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, "আমাদের সত্যিই ভাবা প্রয়োজন, আমরা কি মানুষকে তাদের জীবনের সঙ্গে মানিয়ে চলার আত্মবিশ্বাস দেওয়ার চেয়ে তাদেরকে ভয় দেখাচ্ছি কিনা? সম্ভবত আমরা এখন শুধু তাদেরকে দুশ্চিন্তাগ্রস্তই করে যাচ্ছি।"
তবে, অনেক বিশেষজ্ঞ আবার এই চলমান করোনা পরিণতির প্রেক্ষিতে বুস্টার ডোজের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন।
সূত্রঃ বিবিসি