কোভিড সংক্রমণে সৃষ্ট প্রতিরোধ ক্ষমতা কি বুস্টার ভ্যাকসিন গ্রহণের চেয়ে অধিক কার্যকর?
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর শরীরে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। অন্যদিকে, ভ্যাকসিন গ্রহণের পরেও মানবদেহ ভাইরাস প্রতিহত করার সক্ষমতা অর্জন করে। তবে, দুটো বিষয়ের মধ্যে সুর্নিদিষ্ট কিছু পার্থক্য রয়েছে।
তাহলে কোনটা বেশি ভালো? এক বছর আগে এ ধরনের প্রশ্ন উঠলে তা প্রলাপ বলেই মনে হতো। বয়স্ক এবং দুর্বল স্বাস্থ্যের অধিকারীদের জন্য প্রথমবারের মতো কোভিড আক্রান্ত হওয়া ছিল মারাত্মক প্রাণঘাতী।
কিন্তু, এখন অধিকাংশ মানুষ হয় ইতোমধ্যে কোভিডে আক্রান্ত হয়েছে, নয়তো ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছেন। আর তাই জিরো ইম্যুনিটির মতো বিষয় থেকে আলোচনা শুরুর প্রয়োজনীয়তা কমে গেছে।
কিন্তু এখন শিশুদের টিকাদানসহ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সুরক্ষা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করতে ভাইরাসের সংস্পর্শতা না কি অতিরিক্ত বুস্টার শট প্রয়োজন তা বিতর্কিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গের ইম্যুনোলজিস্ট প্রফেসর ইলিয়ানোর রিল বলেন, "দীর্ঘ সময় ধরে আমরা এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আছি যেখানে প্রতিবছর বুস্টার শট দেওয়া ব্যতীত আমরা কোভিডকে দূরে রাখার অন্য কোনো কথা ভাবতে পারছি না।"
বিশ্বের অনেক প্রান্তেই মানুষ যখন টিকার প্রথম ডোজ পাননি, তখন কিছু মানুষকে বুস্টারের মতো বাড়তি টিকা দেওয়াকে কেবল বৈষম্য নয়, পাগলামি ও বোকামি বলে মনে করেন ভ্যাকসিন বিষয়ক পরামর্শদাতা অধ্যাপক অ্যাডাম ফিন।
ইম্যুনিটি অর্জন কী?
প্রথমে আমাদের মানব দেহের ইম্যুনিটি সিস্টেম বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছুটা জানতে হবে।
দেহের সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রধান দুই সিপাহী হলো অ্যান্টিবডি এবং টি-সেল। অ্যান্টিবডি ভাইরাসের দেহের সঙ্গে আটকে ধ্বংসের জন্য তাকে চিহ্নিত করে। অন্যদিকে, আমাদের দেহের কোনো কোষ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে টি-সেল তা শনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে।
মানবদেহে প্রবেশের পর ভাইরাস তার স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যে বডি সেলের ভেতরে প্রবেশ করে ২৮টি প্রোটিনের সাহায্যে হাজারো প্রতিলিপি তৈরি করে।
ভ্যাকসিন এবং প্রাকৃতিক ভাবে সংক্রমণের চারটি ভিন্ন ধারা রয়েছে।
১. সুরক্ষা দানের ব্যাপ্তি
ভ্যাকসিন গ্রহণের তুলনায় আক্রান্ত হওয়ার মাধ্যমে শরীরের সুরক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপ্তি ঘটে বেশি।
আপনি মডার্না, ফাইজার বা অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাই গ্রহণ করুন না কেন, প্রতিটি টিকাই আপনার দেহকে স্পাইক প্রোটিন চিহ্নিত করতে শেখাচ্ছে।
দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে স্পাইক প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। অধিকাংশ মানুষকে হাসপাতাল থেকে দূরে রাখতেও সাহায্য করছে এই অ্যান্টিবডি।
কিন্তু, সেই ২৮টি প্রোটিনকে টার্গেট করার মতো সক্ষমতা টি-সেলের হয় না।
প্রফেসর রিলের মতে, "এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, সংক্রমিত হওয়ার পর আপনার দেহে ভাইরাসের স্পাইক ছাড়াও ব্যাপকভাবে ভাইরাস শনাক্ত করার ক্ষমতা থাকায় নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে আপনার সুরক্ষা লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।"
২. প্রতিরোধ ক্ষমতা
আমরা জানি যে, অনেক মানুষই ইতোমধ্যে একাধিকবার কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যদিকে, ভ্যাকসিন গ্রহণের পরেও অনেকের দেহে কোভিড শনাক্ত হয়েছে।
অধ্যাপক ফিন বলেন, "কোনোটাই আপনাকে পুনঃসংক্রমণের হাত থেকে পুরোপুরি রক্ষা করতে পারে না। তবে, দুক্ষেত্রেই আপনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার হাত থেকে অনেকটাই রক্ষা পান।"
সংক্রমণের তুলনায় ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে অ্যান্টিবডির মাত্রা গড়ে প্রায় এক মাস সময় ধরে বেশি থাকে। তবে, উপসর্গবিহীন এবং গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া কোভিড আক্রান্তদের দেহে অ্যান্টিবডির মাত্রার ব্যাপক তারতম্য থাকে।
যারা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর টিকা গ্রহণ করেন তাদের দেহে সবথেকে বেশি প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়। তবে, বিপরীতক্রমে কী হয়ে থাকে, তা জানতে এখনও বিস্তারিত তথ্য লাভের অপেক্ষায় রয়েছেন গবেষকরা।
৩. সুরক্ষা দানের সময়কাল
সময়ের সঙ্গে দেহে অ্যান্টিবডির মাত্রা কমতে থাকে। তবে, দেহের সুরক্ষা ব্যবস্থা ভাইরাস এবং ভ্যাকসিনকে চিনে রাখে। আর তাই কোনো সংক্রমণ ঘটলে দেহ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম হয়।
মানুষের শরীরে রয়েছে 'মেমোরি টি-সেল'। অন্যদিকে, বি-সেল চাহিদা অনুযায়ী দেহে নতুন অ্যান্টিবডি তৈরির জন্য প্রস্তুত থাকে। সংক্রমিত হওয়ার এক বছর পরেও প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাড়া দেওয়ার প্রমাণ রয়েছে। ভ্যাকসিন ট্রায়ালেও দীর্ঘ সময় ধরে উপকৃত হওয়ার তথ্য উঠে এসেছে।
লন্ডনের ইমপেরিয়াল কলেজের অধ্যাপক পিটার ওপেনশো বলেন, "সুরক্ষা ব্যবস্থা কতকাল স্থায়ী হয়, তা দেখার জন্য আমরা এখনও অপেক্ষা করছি।"
৪. শরীরের যে অংশে ইম্যুনিটি তৈরি হয়
দেহের কোথায় ইম্যুনিটি রয়েছে তা একটি জরুরি বিষয়। আমরা রক্তে যে অ্যান্টিবডি মেপে থাকি (ইম্যুনোগ্লোবুলিন জিএস) তার তুলনায় নাকে এবং ফুসফুসে ভিন্নধারার অ্যান্টিবডি রয়েছে (ইম্যুনোগ্লোবুলিন এএস হিসেবে পরিচিত)।
ইম্যুনোগ্লোবিন জিএস সংক্রমণ রোধে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাকৃতিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে হাতে নেওয়া ভ্যাকসিনের পরিবর্তে নাকেই সম্ভবত অ্যান্টিবডির অবস্থান বেশি। নাসিকার মাধ্যমে গৃহীত ভ্যাকসিন নিয়েও গবেষণা চলছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টি-সেল বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক পল ক্লেনারম্যান বলেন, "ভাইরাস একই হলেও আক্রান্ত হওয়ার স্থানের কারণে সুরক্ষা ব্যবস্থায় পার্থক্য দেখা যায়। আর তাই প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমিত হওয়া এবং ভ্যাকসিন গ্রহণের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে বলেই আমাদের ধারণা।"
তাহলে ভ্যাকসিন এবং সংক্রমিত হওয়ার মধ্যকার পার্থক্য থেকে আমরা কী ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম?
ভ্যাকসিন গ্রহণ করলে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সুরক্ষা ব্যবস্থা বৃদ্ধি পাওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এমনকি তারা ইতোপূর্বে আক্রান্ত হয়ে থাকলেও দেহে সুরক্ষা ব্যবস্থা বৃদ্ধি পায়।
কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রশ্ন রয়েছে।
প্রথমত, প্রাপ্তবয়স্কদের কি বুস্টার হিসেবে বাড়তি ভ্যাকসিন প্রয়োজন রয়েছে, না কি ভাইরাসের সংস্পর্শে আসলেই তা যথেষ্ট?
দ্বিতীয়ত, শিশুদের কি ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রয়োজন আছে? না কি জীবনভর ভাইরাসের সম্মুখীন হওয়ার মাধ্যমেই তারা দেহে পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম?
সারাজীবন ধরে অনাক্রম্যতা বাড়ানোর ধারণাটি অন্যান্য অনেক সংক্রমণের ক্ষেত্রেই নতুন কিছু নয়। যেমন, আরসিভি বা অন্যান্য চারটি করোনা ভাইরাস যার সংক্রমণে মানুষের মধ্যে কেবল সাধারণ ঠাণ্ডার উপসর্গ দেখা যায়।
প্রতিবার ভাইরাসের সংক্রমণে আসার মাধ্যমে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পায়। বয়োবৃদ্ধ হওয়া অবধি প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এরপর সংক্রমণ পুনরায় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
অধ্যাপক ফিন বলেন, "এই ভাইরাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রমাণিত নয়। তবে, বহু টাকা ব্যয় করে মানুষকে টিকাদানের চেয়ে আক্রান্ত হতে দেওয়ার বিষয়টি অনেক সহজ"। বুস্টারের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করা ছাড়াই আমরা 'বুস্টার গ্রহণের ধারাবাহিকতা'য় আটকে যেতে পারি বলেও সতর্ক করেন তিনি।
তবে, শিশুদের নিয়ে বিতর্কের জায়গাটি ইতোমধ্যে ইতিবাচক প্রমাণিত হওয়ার কথা জানান তিনি। তিনি বলেন, ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ শিশু ইতোমধ্যে আক্রান্ত হলেও অধিকাংশ শিশুকেই অসুস্থ হতে দেখা যায়নি।
তবে, বিপরীত বক্তব্যও আছে। অধ্যাপক রিলে লং-কোভিডে আক্রান্ত শিশুদের কথা উল্লেখ করেন। অন্যদিকে, অধ্যাপক ওপেনশো'ও দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপর কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
তবে, সংক্রমণ পরবর্তী সময়ে ভ্যাকসিন দানের মাধ্যমে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে কোভিডের তীব্রতা প্রশমনের সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
"আমরা কি মানুষকে আত্মবিশ্বাসী করার পরিবর্তে তাদের ভয় দেখাচ্ছি? আমাদের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত," বলেন তিনি।
সংক্রমণ এখনো ছড়াতে থাকায় খুব বেশি বিকল্প হাতে নেই।
"সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব কি না আমি সেটা ভাবছি। কেননা, ভাইরাস ছড়াতে থাকলে বুস্টিং প্রক্রিয়াও চলতে থাকবে," বলেন অধ্যাপক ক্লেনারম্যান।
- সূত্র: বিবিসি