টিপুর বাঘ এখন কোথায়?
আঠারো শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশদের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা হয়ে উঠেছিলেন সুলতান ফতেহ আলি সাহেব টিপু। কি, চেনা চেনা লাগছে নামটা? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, দক্ষিণ ভারতের মহীশুরের শের টিপু সুলতানের কথাই বলছি।
ইংরেজদের আগ্রাসন থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন টিপু সুলতান। সার্বভৌমত্ব রক্ষায় উপমহাদেশের প্রথম দিকের শাসক হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
কথিত আছে, টিপুর মৃত্যুসংবাদ শুনে ভারতের গভর্নর জেনারেল রিচার্ড ওয়েলেসলি বলেছিলেন, 'ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, ভারতবর্ষের মৃত আত্মার স্মরণে আমি পান করছি।' টিপুর মৃত্যুর খবর ব্রিটেনে পৌঁছালে সেখানেও উৎসবের ঢেউ লাগে।
এ থেকেই বোঝা যায় ব্রিটিশদের কাছে কত বড় আতঙ্কের নাম ছিলেন টিপু সুলতান। কন্নড় ভাষায় টিপু অর্থ বাঘ। তিনি বিখ্যাতও হয়ে আছেন মহীশুরের বাঘ নামেই। টিপুর এই 'মহীশুরের বাঘ' নামটির উৎপত্তি কীভাবে, তা নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
কেউ কেউ বলেন, যৌবনে একবার বন্ধুর সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন টিপু সুলতান। সে সময় এক বাঘের সামনে পড়ে যান তারা। জনশ্রুতি অনুসারে, বাঘটি টিপুর বন্ধুকে হত্যা করে। জন্তুটিকে হত্যা করতে উদ্যত হন টিপু, কিন্তু তার বন্দুক থেকে গুলি বের হলো না। হাতের ছোরাও পড়ে গেল মাটিতে। বাঘটি টিপুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই তিনি ছোরাটি মাটি থেকে উঠিয়ে ওটাকে হত্যা করেন। এর পর থেকেই সবাই তাকে মহীশুরের বাঘ নামে ডাকতে থাকে।
অন্য তত্ত্ব অনুসারে, টিপু সুলতানের সিলমোহরে ছিল বাঘের ছবি। তার সব সৈন্যের উর্দিও দেখতে ছিল বাঘের ডোরাকাটার মতো। টিপুর সমস্ত পোশাক, এমনকি রুমালে পর্যন্ত ছিল হলুদের ওপর কালো ডোরাকাটা। নিজের তরবারির হাতল, বন্দুকের নল-কুঁদো, হ্যামার—সর্বত্র বাঘের হরেক রকমের মূর্তি খোদাই করিয়েছিলেন টিপু। এই ব্যাঘ্রপ্রীতির জন্যই তাকে মহীশুরের বাঘ নামে ডাকতে থাকে লোকে।
এছাড়াও জনশ্রুতি আছে যে, টিপুর সাহস আর দক্ষতার কথা শুনে ফরাসি সেনানায়ক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একবার তার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতে চেয়েছিলেন।
যা-ই হোক, টিপুর ভ্রমণের জামায় থাকত বাঘের গায়ের ডোরার সূচিকর্ম। তার শাসনামলে মহীশুরে বাঘ শিকার ছিল নিষিদ্ধ। যৌবন থেকেই বাঘ পুষতে শুরু করেছিলেন টিপু। তার ঘরের সামনে শেকল দিয়ে বাঁধা থাকত কয়েকটি বাঘ।
মোদ্দা কথা, টিপু সুলতানের ব্যক্তিগত প্রতীক, রাজপ্রাসাদ, অস্ত্র, বর্ম, সিংহাসন, সেনাবাহিনী—সর্বত্র ছিল বাঘের আধিপত্য।
তবে তার বাঘপ্রীতির সবচেয়ে বড় নিদর্শন হয়ে টিকে আছে কাঠের তৈরি রং করা একটি খেলনা। খেলনাটি আর কিছু নয়, চার ফুট লম্বা একটি বাঘের মূর্তি।
এতে দেখা যায়, ডোরাকাটা বাঘটি এক ইংরেজের টুঁটি চেপে ধরে রেখেছে। ইংরেজ লোকটির পরনে সাদা মোজা, ফৌজি টুপি, নীল ব্রিচেস, লাল কুর্তা ও কালো জুতা।
ভয়ালদর্শন বাঘটি হাঁটু গেঁড়ে বসে রয়েছে শিকারের ওপর। জানোয়ারটির দাঁত বিঁধে আছে শিকারের গলায়। বাঘের শরীরের বাঁ পাশের ভেতরে লুকানো একটা ছোট পাইপ অরগান। জন্তুটির পেছন দিকের একটি হাতল ঘোরালেই সেই অরগান বেজে ওঠে। সে আওয়াজ শুনলে মনে হয়, মুমূর্ষু মানুষের আর্তনাদ আর বাঘের গর্জন ভেসে আসছে যেন। শিকার যে তখনও বেঁচে আছে, তা বোঝানোর জন্য ইংরেজ লোকটার বাঁ হাত কনুই থেকে একটু ওপরে ওঠানামা করত।
জনশ্রুতি আছে, ইংরেজ সেনাপতি হেক্টর মানরোর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন টিপু সুলতান। এরকম মানসিক অবস্থায় একদিন শুনলেন, সুন্দরবনের বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছে মানরোর একমাত্র ছেলে। খবরটি শুনেই ওই চার ফুট লম্বা বাঘের মূর্তি তৈরি করান টিপু। প্রকৃতপক্ষে খেলনাটি একের পর এক যুদ্ধে হেরে কোণঠাসা হয়ে পড়া মহীশুরের বাঘ টিপু সুলতানের শত্রুর প্রতি ঘৃণা এবং প্রতিশোধের ব্যগ্র স্পৃহার প্রতীক।
১৭৯৯ সালে ইংরেজবিরোধী যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন টিপু সুলতান। টিপুর দুর্গ শ্রীরঙ্গপত্তমের পতনের পর সেখানে তাণ্ডব চালায় ইংরেজ কমান্ডার ও তাদের সৈনিকরা। লুটপাট চালায় টিপুর গ্রন্থাগার, সমৃদ্ধ অস্ত্রাগার, তোষাখানা, ধনভান্ডারে। মূল্যবান সমস্ত জিনিসপত্র লুট করে চালান করে দেওয়া হয় লন্ডনে।
লুটপাটের সময় টিপু সুলতানের বিখ্যাত খেলনা বাঘটির কথা বিশেষভাবে মনে রেখেছিল ইংরেজরা। গভর্নর জেনারেল লর্ড মর্নিংটন টাওয়ার অভ লন্ডনে প্রদর্শনের জন্য ব্রিটেনে পাঠিয়ে দেন বাঘটিকে।
তবে লন্ডনে পৌঁছে বেশ কয়েক বছর গুদামেই পড়ে থাকে খেলনা বাঘটি। পরে ১৮০৮ সালে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাদুঘরে প্রথম প্রদর্শিত হয় এটি।
অল্প সময়ের মধ্যেই দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মহীশুরের শের টিপু সুলতানের বাঘ। মনোযোগ কেড়ে নেয় তৎকালীন বহু পর্যটক, কবি, নাট্যকার ও চিত্রশিল্পীর।
নানা স্থান ঘুরে সেই বাঘটি এখন ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট জাদুঘরে স্থায়ী আবাস গেড়েছে। এই দীর্ঘ যাত্রায় বাঘটির শরীরে লুকানো অরগানটিকে বেশ কয়েকবার সংস্কার করতে হয়েছে।
বহু বছর নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করে টিপুর বাঘের অবস্থা এখন বেশ খারাপ—ঠিক যেন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। কর্তৃপক্ষ তাই একে আর বাইরে কোনো প্রদর্শনীতে পাঠায় না। তবে টিপুর বাঘের বিপুল জনপ্রিয়তা আর আকর্ষণের কথা বিবেচনা করে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ফাইবার গ্লাস দিয়ে এর একটা হুবহু প্রতিকৃতি তৈরি করেছে।
কালের পরিক্রমায় টিপু সুলতানের বাঘ হয়ে উঠেছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রতীক। টিপুর বাঘ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলও। টিপুর বাঘ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) লোগোতে স্থান পেয়েছে বাঘ।