ডেল্টা ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে প্রথম সারির কোভিড-১৯ টিকাগুলো কতোটা কার্যকর?
বিশ্বজুড়ে ডেল্টা ভেরিয়েন্টের মাধ্যমে বাড়ছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ। বাধ্য হয়ে নতুন করে লকডাউন ও চলাচলে বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের সরকার। সাক্ষাৎ বিভীষিকা এ ধরনটির প্রাদুর্ভাবে চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও টিকা আবিষ্কারক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির বিজ্ঞানীরাও শঙ্কিত। এ বাস্তবতায় বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত ও সবচেয়ে সফল টিকাগুলো ডেল্টা থেকে কতখানি ফলপ্রসূ সুরক্ষা দেয়?- সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন তারা।
তবে ভাইরাসের পুরোনো ধরনের বিরুদ্ধে তুলনামূলক অধিক কার্যকর টিকাগুলো যে ডেল্টার বিরুদ্ধেও শক্তিশালী সুরক্ষা দেয়- সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা প্রায় একমত। তারা বলেছেন, প্রথম সাড়ির ভ্যাকসিন গুরুতর অসুস্থতা রোধসহ হাসপাতালে ভর্তির হারও কমাচ্ছে।
এব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সৌম্য স্বামীনাথনের মন্তব্য, "টিকাপ্রাপ্তদের মধ্যে বা রিয়েল ওয়ার্ল্ড স্টাডিতে দেখা গেছে, কয়েকটি ভ্যাকসিন সবচেয়ে গুরুতর কোভিড-১৯ সৃষ্ট অসুস্থতাকে ভালোভাবেই প্রতিরোধ করতে পারছে।"
প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, "কার্যকারিতার প্রমাণ থাকলেও মূল সমস্যা টিকা ডোজের সংকট। প্রতিরোধের উপায় আমাদের হাতের নাগালেই। এ মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী সব দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা উৎপাদন ও সম-বণ্টনের মাধ্যমে টিকাকরণে গতি আনাটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।"
যুক্তরাজ্যে ১৪,০১৯ জন টিকাপ্রাপ্তের মধ্যে পরিচালিত এক রিয়েল ওয়ার্ল্ড স্টাডিতে দেখা গেছে, ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকার দুই ডোজ টিকাগ্রহণকারীদের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা যথাক্রমে ৯৬ ও ৯২ শতাংশ করে কমে যায়।
তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধেও কার্যকর বলে গত বৃহস্পতিবার ফের দাবি করেছে ফাইজার ইঙ্ক। মার্কিন ফার্মা জায়ান্টটি বলেছে, বুস্টার হিসেবে তৃতীয় ডোজ পাওয়া জনসংখ্যার মধ্যে অতি-উচ্চ মানের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।
এছাড়া, আগামী মাস থেকে ভাইরাসের নতুন ও বিপজ্জনক ধরন প্রতিরোধের লক্ষ্য নিয়ে পৃথক আরেকটি মানব ট্রায়াল শুরুর কথাও জানিয়েছে কোম্পানিটি।
টিকা সফলতার উজ্জ্বল উদাহরণ যুক্তরাজ্য- এমন কথাই জানান পাবলিক হেলথ অব ইংল্যান্ডের মহামারি বিশেষজ্ঞ মেগান ক্যাল।
যুক্তরাজ্যে এখন ডেল্টা ভেরিয়েন্টই সংক্রমণের মূল উৎস, তারপরও টিকাদানে এগিয়ে থাকায় দেশটিতে এখন মৃত্যুহার শূন্য দশমিক শূন্য ৮৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এই হার এমনকি মহামারির সর্বোচ্চ সময়ের চাইতেও ২০ গুণ কম। অথচ তখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল ধরনগুলোই অসুস্থতার জন্য দায়ী ছিল।
অর্থাৎ, ডেল্টার বিরুদ্ধে ফাইজারের মতো কিছু টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ নেই। বরং, টিকাটি ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ সম্পূর্ণ রোধ করতে পারে কিনা-সেটাই প্রধান প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। কারণ, সংক্রমণ পুরোপুরি রোধ হলে ভাইরাসের বিস্তার কমবে এবং অভিযোজনের ঝুঁকি অনেকগুণ হ্রাস পাবে, মহামারিকে বশ মানাতে যার তাৎপর্য অপরিসীম হলেও এ গুণটির মাত্রা নিয়েই চলছে বিতর্ক।
যুক্তরাজ্যে ফাইজার ভ্যাকের রিয়েল ওয়ার্ল্ড স্টাডির প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ডেল্টা ভেরিয়েন্টের লক্ষণযুক্ত সংক্রমণ প্রতিরোধে এটি ৮৮ শতাংশ কার্যকর। এক মাস পর এই হার সংশোধন করে ৭৯ শতাংশ বলে জানান স্কটল্যান্ডের গবেষকরা।
গত শনিবার কানাডার আরেকদল বিজ্ঞানী বিশেষ কয়েক ধরনের পদ্ধতিতে পরিচালিত এক গবেষণার ভিত্তিতে জানান, ডেল্টা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ রোধে ফাইজারের টিকা ৮৭ শতাংশ সফল। আর ব্রিটেনে প্রথম শনাক্ত আলফা স্ট্রেইনের ৮৯ শতাংশ সংক্রমণ রোধ করতে সক্ষম।
আবার ইসরায়েলি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণমূলক চতুর্থ আরেকটি গবেষণা গেল সপ্তাহে প্রকাশিত হয়। সেখানে ডেল্টা প্রতিরোধে ফাইজারের টিকা মাত্র ৬৪ শতাংশ সুরক্ষা দেয় বলে জানানো হয়।
তবে সঙ্গেসঙ্গেই ফাইজার ও ইসরায়েলি কর্মকর্তারা সতর্ক সুরে বলেন, ইসরায়লে বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় প্রাদুর্ভাব এবং তার প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ নির্ভর এ গবেষণা চূড়ান্ত কোনো ফল নয়। এছাড়া, গবেষণার পদ্ধতিগত আরও কিছু দুর্বলতা রয়েছে।
নানা দেশের গবেষক ও বিজ্ঞানীদের দেওয়া এই কার্যকারিতার ভিন্নতা টিকাকরণের পর গ্রহণকারীর স্বাস্থ্যের তথ্য পর্যালোচনার ভিত্তিতে ভ্যাকসিনের সফলতা হার নির্ধারণ করাটি যে কতো জটিল- সেই বাস্তবতাকে প্রকাশ করে। তবে বিজ্ঞানীরা রিয়েল ওয়ার্ল্ড স্টাডিকে গুরুত্ব দিয়েই দেখছেন। ডেল্টার মতো বিপজ্জনক ধরন রোধে তারা এমন গবেষণার পরিধি আরও বিস্তৃত করতেও চান।
এনিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার জৈব-পরিসংখ্যান বিদ্যার সহকারী অধ্যাপক নাটালি ডিন তার টুইটার পোস্টে লিখেছেন, "দীর্ঘমেয়াদে টিকাগ্রহণকারীর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রিত মানব ট্রায়ালের অবিন্যস্ত তথ্য পরীক্ষা এক নয়। তাই ইসরায়েলিদের গবেষণার ভিত্তিতে অন্যান্য যেসকল গবেষণায় টিকার উচ্চ কার্যকারিতা হার উঠে এসেছে- সেগুলো বাতিল করে দেওয়া উচিত হবে না। ইসরায়লে ডেল্টা প্রাদুর্ভাবের সীমিত মাত্রা গবেষণার তথ্যেও 'প্রভাব' ফেলেছে বলে মনে করছেন তিনি।
ফাইজার ছাড়া অন্যান্য প্রথম সাড়ির টিকার রিয়েল ওয়ার্ল্ড স্টাডির তথ্য এখনও অনুপস্থিত। ফলে এসব ভ্যাকসিন দিয়ে ল্যাবরেটরিতে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধ সক্ষমতা যাচাইয়ে বাধ্য হচ্ছেন জনস্বাস্থ্য খাতের গবেষকরা। এমন গবেষণায় ভ্যাকসিন প্রাপ্তের রক্তের নমুনায় ভাইরাসের নিয়ন্ত্রিত সংক্রমণ ঘটিয়ে পরীক্ষা করা হয়।
ল্যাবরেটরিতে এমন গবেষণায় নিজেদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন করোনার মূল ধরনের তুলনায় ডেল্টা ভেরিয়েন্ট নিস্ত্রিয়করণে দ্বিগুণ সফল বলে জানিয়েছে মডার্না। ফাইজারের মতো এ টিকাও এমআরএনএ প্রযুক্তির।
গত জুনে কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহী- স্টিফেন বানসেল ল্যাব টেস্টের তথ্য প্রকাশকালে বলেন, আমাদের আস্থা ছিল মডার্নার টিকা নতুন ধরন প্রতিরোধ করতে পারবে। সাম্প্রতিক পরীক্ষার ফলও সেই আস্থাটি ঠিক ছিল বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে।"
আবার এক ডোজের টিকা উৎপাদক জনসন অ্যান্ড জনসন বলেছে, ল্যাব টেস্টে তাদের প্রতিষেধক ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। কোম্পানিটি কার্যকারিতার হার সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ না করলেও এটি ডেল্টা সৃষ্ট রোগের বিরুদ্ধে স্থায়ী সুরক্ষা দেয় বলে জানানো হয়।
রাশিয়ার স্পুটনিক ফাইভ ভ্যাকসিনের আবিষ্কারকেরাও অন্য সব টিকার তুলনায় তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন ডেল্টার বিরুদ্ধে বেশি কার্যকর বলে দাবি করেছেন। কিন্তু, এই দাবিকে সমর্থন করতে পারে এমন কোনো প্রমাণ তারা দেননি।
এদিকে বেশ কিছু চীনা বিজ্ঞানী স্বীকার করেছেন যে, চীনে উদ্ভাবিত টিকাগুলো ডেল্টা ধরন মোকাবিলায় অপেক্ষাকৃত কম কার্যকর। তবে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত গবেষণার তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি।
সিনোভ্যাকের মুখপাত্র লিউ পেইচ্যাং বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, টিকাপ্রাপ্তদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার পর দেখা যায়, মূল সার্স কোভ-২ ভাইরাসের চাইতে ডেল্টা ধরন নিষ্ক্রিয়করণে সিনোভ্যাক টিকা তিনগুণ কম কার্যকর।
এব্যাপারে, পাবলিক হেলথ অব ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ পিটার ইংলিশ সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেছেন, ডেল্টা ধরনে অসুস্থদের হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা কমাতে কিছু টিকার কার্যকারিতা ইতিবাচক হলেও, অতি-সংক্রামক ধরনটি রোধের সক্ষমতা সে তুলনায় দুর্বল। এনিয়ে তথ্যাবলী এখনও স্পষ্ট নয়।
তিনি বলেছেন, "ডেল্টা ভয়ানক সংক্রামক, খুব সহজেই এ স্ট্রেইন টিকা না পাওয়া মানুষের শরীরে ভর করে। তাছাড়া, নানান রকম ভ্যাকসিন এর বিরুদ্ধে কতোটা সফল বা ব্যর্থ সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য জড়ো হতে অনেকটা সময় লাগবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
- সূত্র: দ্য ফিন্যান্সিয়াল টাইমস