দুর্ধর্ষ জলদস্যু থেকে মুসলিম নাবিক
১৬১২ সালে লন্ডনে নাট্যকার ড্যাবর্নের একটি নাটক প্রকাশিত হয়। 'আ ক্রিশ্চান টার্নড টার্ক' নামের নাটকটি লন্ডনের দর্শকমহলে ভালো সাড়া জাগিয়েছিল। নাটকটির মূল চরিত্র ক্যাপ্টেন জ্যাক ওয়ার্ড—জলদস্যু ও ভয়ংকর অপরাধী। ইংরেজ জাহাজ লুট করে সম্পদের পাহাড় গড়েন তিনি। অনেকটা রবিনহুডের আদলে গড়া হয়েছিল জ্যাক ওয়ার্ডকে। অত্যাচারী ধনীদের সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন।
ড্যাবর্ন কিন্তু জ্যাক ওয়ার্ডকে সৃষ্টি করেছিলেন বাস্তব চরিত্রের আদলেই। সেই বাস্তব চরিত্রের নামও জ্যাক ওয়ার্ড। তার জন্ম ইংল্যান্ডে। পরবর্তী সময়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
ওয়ার্ডের জন্ম ১৫৫৩ সালে, ইংল্যান্ডের কেন্টের এক দরিদ্র পরিবারে। প্রথম জীবনে তিনি কেন্টের উপকূলীয় অঞ্চলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। মাছ ধরে পেট চালালেও তার স্বপ্ন ছিল নাবিক হওয়া।
কেন্ট উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় সেখানে নাবিকদের যাতায়াত ছিল। ১৫৮৮ সালে ওয়ার্ড ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথের লাইসেন্স নিয়ে স্প্যানিশ জাহাজ লুট করেন। সে সময় রাষ্ট্রীয় লাইসেন্স নিয়ে ইংরেজদের বিরোধী শক্তি স্প্যানিশদের জাহাজ লুট করা যেত।
রাষ্ট্রীয় লাইসেন্সপ্রাপ্ত দস্যুদেরকে লুটের মালের পাঁচ শতাংশ জমা দিত হতো রাজ কোষাগারে, দশ শতাংশ পেত লর্ড অ্যাডমিরালের প্রতিনিধিরা। বাকি মাল জাহাজের মালিক ও কর্মীরা ভাগাভাগি করে নিত।
১৬০৪ সালে অ্যাংলো-স্প্যানিশ যুদ্ধের ইতি ঘটলে ওয়ার্ডের বৈধ দস্যু-জীবন বড় ধাক্কা খায়। প্রথম এলিজাবেথের উত্তরাধিকারী রাজা প্রথম জেমস সব ধরনের বৈধ দস্যুতা নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু অনেক দস্যুই এ জীবন ছাড়তে অস্বীকার করে এবং লুণ্ঠন চালিয়ে যায়। এদেরকে জলদস্যু হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বৈধ লুটপাটের সুযোগ হারিয়ে ওয়ার্ড মুষড়ে পড়েন।
এর কিছুদিন পরের এক খবর ওয়ার্ডের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তিনি জানতে পারেন, একটা বাণিজ্য জাহাজ নোঙর ফেলেছে বন্দরে। জাহাজটিতে এক ক্যাথলিক ব্যবসায়ী মালসামান নিয়ে ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে যাচ্ছে। ৩০ জন সঙ্গী নিয়ে সেদিন রাতেই ওই জাহাজে হানা দেন ওয়ার্ড। জাহাজের দুই ওয়াচম্যানকে বন্দি করে ইংলিশ চ্যানেলে ঢুকে পড়েন ওয়ার্ড।
লুটের মাল সংগ্রহ করার জন্য তল্লাশি চালাতে গিয়ে বোকা বনে গেলেন ওয়ার্ড। জাহাজের ক্যাথলিক মালিক তাদের ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে সব মালামাল আগেই তীরে সরিয়ে ফেলেছে। শূন্য জাহাজ লুট করেছেন ওয়ার্ড। আইল অফ স্কিলিতে একটা ফরাসি বাণিজ্য জাহাজ দেখে বন্ধুত্বের সংকেত দেখিয়ে সেটাকে থামায় ওয়ার্ডের সঙ্গীরা। ওই জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে অনেকক্ষণ বন্ধুসুলভ আলাপ করার পর আসল চেহারা দেখান ওয়ার্ডরা। ক্যাপ্টেন ও ক্রুসহ ফরাসি জাহাজটাকে আটক করেন তারা।
এবারও দল ভারী করে ভূমধ্যসাগরে ভেসে পড়লেন ওয়ার্ড। উদ্দেশ্য: লুটপাট। প্রথমেই একটি বাণিজ্য জাহাজ ছিনতাই করে দলটি। এরপর ছিনতাই করে একটি দুই মাস্তুলওয়ালা ক্রীতদাসবাহী জাহাজ। ছিনতাই করা জাহাজ দুটি নিয়ে আলজিয়ার্স বন্দরে চলে যান ওয়ার্ড।
কিন্তু তার কপাল খারাপ। মাত্র কয়েক মাস আগেই রিচার্ড গফ নামে এক ইংরেজ হামলা চালিয়ে গেছে আলজিয়ার্সে। তাই শহরের গভর্নর ইংরেজদের ওপর মহা খাপ্পা ছিলেন। কাজেই সেখানে সুবিধা করতে না পেরে ওয়ার্ড জাহাজ নিয়ে চলে গেলেন মরক্কোর আটলান্টিক উপকূলের সেল বন্দরে। সেখানেও ছিল দস্যু ও দাগি অপরাধীদের আড্ডা। এরা ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের উপকূলবর্তী গ্রামে-গঞ্জে লুটপাট চালাত, আটক করা গ্রামবাসীদের উত্তর আফ্রিকার দাস বাজারে বিক্রি করে দিত।
সেল বন্দরে বেশ কিছু ইংরেজ ও ডাচ জলদস্যু ছিল আগে থেকেই। তারা ওয়ার্ডের দলে যোগ দিতে রাজি হয়ে গেল। সেখানে লুটের মালামাল বেচে দিয়ে ওয়ার্ড তিউনিসের পানে রওনা হলেন। ইচ্ছা সেখানে ঘাঁটি গাড়বেন। সেই যাত্রাই চিরতরে বদলে দিল তার জীবন।
তিউনিস শাসন করতেন অটোমান সুলতানের নিয়োগ করা একজন পাশা। ১৬০৫ সালে সেখানে পৌঁছেন ওয়ার্ড। ততদিনে তিউনিসের প্রকৃত ক্ষমতা চলে গেছে পাশার পদাতিক বাহিনীর প্রধান উসমান বে-র হাতে। উসমান বে-র নিজস্ব জলদস্যু বাহিনী ছিল। এরা ভূমধ্যসাগরে ডাকাতি করে বেড়াত।
উসমান বে বুঝতে পেরেছিলেন, জলদস্যু হিসেবে জ্যাক ওয়ার্ড অত্যন্ত ঝানু। তাই তিনি ওয়ার্ডকে তিউনিসে ঘাঁটি গেড়ে ডাকাতি চালানোর অনুমতি দেন। বিনিময়ে তিনি লুটের মালের বখরা পেতেন।
দস্যু-জীবনে ওয়ার্ড অবিশ্বাস্য সাফল্য অর্জন করেন।
ওয়ার্ড উসমান বে-র প্রতি এত অনুগত ছিলেন যে, উসমান বে তাকে তিউনিসে বিশাল জমি উপহার দেন। সেই জমির ওপর চোখধাঁধানো প্রাসাদ নির্মাণ করেন ওয়ার্ড।
১৬০৭ সালে সাগরে টহলরত অবস্থায় তুর্কি উপকূলে রেনিয়েরা ই সোদেরিনা নামে বিশাল এক বাণিজ্য জাহাজ দেখতে পান ওয়ার্ড। জাহাজটি দেখেই গুলি দাগতে শুরু করেন তিনি। তিন ঘণ্টা গোলাগুলির পর রেনিয়েরা ই সোদেরিনার ডেকে উঠতে গেল ওয়ার্ডের দলের লোকেরা। রেনিয়েরার ক্যাপ্টেন ও নাবিকরা মরিয়া হয়ে শেষ লড়াই করেন। এ লড়াইয়ে দলের বেশ কয়েকজন লোক হারান ওয়ার্ড।
রেনিয়েরা ই সোদেরিয়ানে দখল করে জাহাজটিকে দস্যু-জাহাজে পরিণত করেন জ্যাক ওয়ার্ড। তারপর সেটিকে নিয়ে বের হন সমুদ্রযাত্রায়। কিন্তু জাহাজটি গোলাগুলিতে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই সাগরে ঝড় উঠতেই রেনিয়েরা ই সোদেরিনা ভেঙে যায়—ডুবে যায় ৩০০ যাত্রী নিয়ে। ওয়ার্ড ছোট একটা নৌকায় করে কোনোমতে প্রাণ নিয়ে তিউনিসে ফেরেন।
এ বিপর্যয়ের ফলে ওয়ার্ডের সুনাম মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রিয়জন হারানো বহু তিউনিসবাসীর ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন তিনি। ভীষণ বেকায়দায় পড়ে যান ওয়ার্ড। নিরাপত্তার জন্য উসমান বে-র ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।
১৬১০ সালের দিকে সদলবলে ইসলাম গ্রহণ করে তিউনিসে স্থায়ী হন ওয়ার্ড। নিজের নাম বদলে রাখেন ইউসুফ রইস।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি দ্বিতীয়বার বিয়েও করেন। ইংল্যান্ডে আগে তার বিয়ে হয়েছিল।
ইসলাম গ্রহণের পর ওয়ার্ড অটোমান নৌবাহিনীতে যোগ দেন। ১৬১২ সালে তিনি নাবিকজীবন থেকে অবসর নেন। বাকি জীবন অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন তিউনিসে কাটান। ১৬২২ সালে তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন।
জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন জ্যাক ওয়ার্ড। তাকে নিয়ে বেশ কিছু নাটক ও পুস্তিকা রচিত হয়। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান-এর ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো চরিত্রটি জ্যাক ওয়ার্ডের আদলেই সৃষ্টি করা। জ্যাক ওয়ার্ড ওরফে ইউসুফ রইস সত্যিকার অর্থেই ছিলেন সাগরের রাজা।
- সূত্র: জেস্টর ডেইলি ও হিস্ট্রি এক্সট্রা