দৌলতদিয়া পতিতালয় থেকে এক গৃহবধু যেভাবে উদ্ধার হলেন
২০২০ সালের জানুয়ারির সাধারণ এক বিকেল। রাজবাড়ির একটি পাড়ার হোটেলে তার এক বান্ধবীর সঙ্গে বসে চা খাচ্ছিলেন আঁখি (ছদ্মনাম)। কিছুক্ষণ পরই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন।
কয়েক ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরলে সবকিছুই ঝাপসা লাগছিল আঁখির। কিছুটা স্থিতিশীল হয়ে ওঠার পর নিজেকে আবিষ্কার করেন এক জরাজীর্ণ ছোট্ট রুমে। কেবল একটি কালো দরজা থাকলেও সে রুমে ছিল না কোনো জানালা। রুমটির নোংরা দেওয়ালের ক্ষয়ে যাওয়া রঙ চিৎকার করে যেন জানান দিচ্ছিল জীর্ণতা ও হতাশার।
ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত আঁখি তখনো বুঝতে পারছিলেন না, কী করে ওই ঘরে এলেন। তবে তার শ্বশুরবাড়ি পক্ষের সেই বান্ধবীর সঙ্গে বসে চা খাওয়ার বিষয়টিই ছিল তার মনে পড়া সর্বশেষ ঘটনা।
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের আশ্বাস দিয়ে আঁখিকে সাভার থেকে দৌলতদিয়া নিয়ে এসেছিলেন সে নারী। অন্যদিকে, শশুরবাড়ির করুণ নির্যাতনের শিকার আঁখি এ সুযোগকে বেঁছে নিয়েছিলেন নিজ দুরাবস্থা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে।
বদ্ধ সে রুমে বসে তিনি তার ওই বান্ধবীকে বলতে শুনেন, 'আমি ৬০ হাজার টাকা থেকে এক পয়সাও কম নেব না।' আঁখি ভেবেছিলেন, হয়তো তার আসন্ন সিনেমার পারিশ্রমিক নিয়ে আলোচনা চলছে বাইরে। কিন্তু শিগগিরই বুঝতে পারেন, তাকে আসলে এক দালালের কাছে বিক্রি করার বিষয়ে চলা আলোচনা সেটি। এ উপলব্ধির কিছুক্ষণের মধ্যেই চুরমার হয়ে যায় আঁখির সব স্বপ্ন।
'মাসের পর মাস ধরে কেঁদেছি আমি। বারবার মিনতি করেছি, যেন আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অসংখ্যবার পালানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঠিক কোথায় ছিলাম আর কোথায়ই-বা যাব, জানতাম না। সবকিছুই তখন একটা গোলকধাঁধার মতো ছিল আমার কাছে। তাই পালানোর চেষ্টা করার কিছুক্ষণ পর আমাকে আবারও ঠিক একই জায়গায় ফিরে আসতে হতো। আমার ওপর নির্যাতন চালানো লোকগুলোর সঙ্গেই থাকতে হতো আমাকে,' বলেন তিনি।
অবশেষে, ১৩ আগস্ট ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস বাংলাদেশের সহায়তায় গোয়ালন্দ থানা পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। ভয়াবহ সেই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে এসে আঁখি যে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন, সেটি তার নিজেরই বিশ্বাস হয় না মাঝে মধ্যে।
আঁখিকে তার সর্দার রিতা (পতিতালয়ের অন্যতম প্রধান) ডাকতেন 'অলক্ষ্মী' বলে। আঁখি বলেন, 'আমাকে কুঠিবাড়িতে নিয়ে আসার পর শুরুতে রিতার ব্যবসায় বেশ ক্ষতি হয়। বাস্তবতা মেনে নিতে এবং গ্রাহকদের কাছে যেতে কয়েক মাস সময় লেগেছিল আমার।'
তবে এ কয়েক মাসেও আঁখির কাছে গ্রাহক পাঠানো থেকে বিরত থাকেননি রিতা। অল্প বয়সী ও রূপসী আঁখির জন্য গ্রাহকের চাহিদাও ছিল বেশি। তিনি বলেন, 'মাঝে মধ্যে দিনে তিন-চারবার বা তারও বেশি গ্রাহক এসেছে আমার কাছে। প্রতি রাতেই প্রার্থনা করতাম, যেন সকালে জেগে উঠতে না হয় আমাকে।'
অবশ্য একদিন হঠাৎই ওই পতিতালয়ে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়কে দেখতে পেয়ে আশার আলো খুঁজে পান তিনি। 'দেখামাত্রই তার কাছে ছুটে যাই,' বলেন আঁখি। তবে সেই আত্মীয়কে বারবার অনুরোধ করার পরও তিনি তখন বিতর্কের ভয়ে আঁখিকে তার সঙ্গে নিয়ে আসেননি। অবশ্য তিনি সে সময় আঁখির মাকে এ ঘটনা জানানোর কথা দিয়ে এসেছিলেন, এবং পরবর্তীকালে সে কথা রেখেছেনও।
এর কয়েক সপ্তাহ পরে আঁখির মা সেই পতিতালয়ে তাকে দেখতে এলে আরও বড় ধাক্কার মুখোমুখি হন আঁখি। আসলে তার মা তাকে শুধু দেখতেই এসেছিলেন, উদ্ধার করতে নয়। মূলত তার বাবাকে তার মা কথা দিয়েছিলেন, আঁখিকে আর ফিরিয়ে নেবেন না।
আঁখি বলেন, 'বাবা আমাকে অস্বীকার করেছেন জেনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার অস্তিত্ব যে তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি মেনে নেওয়া ছিল বেশ কঠিন। শেষমেশ মা আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা দিলেও দুর্ভাগ্যবশত তিনি আমার সর্দারের নির্ধারিত পাওনা পরিশোধ করতে পারেননি।'
এদিকে দিনের পর দিন কেটে যেতে থাকে, কিন্তু আঁখির জীবন চলতে থাকে একইভাবে। একদিন তার নিয়মিত গ্রাহক আলমগীরের (ছদ্মনাম) কাছে নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন আঁখি। পরবর্তীকালে আলমগীরই তাকে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করার পরামর্শ দেন।
আলমগীর তাকে আরও জানান, এক মাস আগে ঠিক একই জায়গা থেকে আরেকটি মেয়েকে এ উপায়েই উদ্ধার করা হয়েছিল। অবশ্য তার মুঠোফোন থেকে জরুরি নম্বরে ফোন করে আঁখি নিজের অবস্থা ব্যাখ্যা করলেও সেটি কোনো উপকারে আসেনি।
এ ঘটনায় হতাশ হলেও আশা হারাননি আঁখি। ফলে, পরের বার যখন আলমগীর তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, সেই নম্বরে আবারও ফোন করেন তিনি। এবার তিনি নিজের সমস্ত বিবরণ ও ঠিকানা জানান।
এ বিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে আলমগীর বলেন, 'গোয়ালন্দ থানা থেকে ফোন পাওয়ার পরপরই আমি পতিতালয় থেকে বেরিয়ে আসি। কারণ, সেখানে থাকা আমার জন্য নিরাপদ ছিল না। কিন্তু পুলিশ যেন আঁখিকে খুঁজে পায়, তা নিশ্চিত হতে আমি প্রধান ফটকের কাছেই ছিলাম। আমি শুধু চেয়েছিলাম, সে নিরাপদ থাকুক।'
পুলিশ যখন কুঠিতে পৌঁছায়, তখন আঁখির পরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানান রিতা। কিন্তু তল্লাশি চালানোর মাধ্যমে সেদিন সহজেই তাকে খুঁজে পায় পুলিশ। এ ঘটনার সময় আঁখি এতটাই ভয় পেয়েছিলেন, ফোন করার কথা অস্বীকার করতে থাকে। কিন্তু তার মিশ্র অভিব্যক্তি দেখে মামলাটি তদন্তের সিদ্ধান্ত নেন গোয়ালন্দ থানার ইন্সপেক্টর আবদুল্লাহ আল তৈয়বীর।
'কথা বলার সময় আঁখি তোতলাচ্ছিলেন। কোনো কথারই সরাসরি উত্তর দিতে পারছিলেন না। এ অবস্থা দেখে আমি তদন্তের উদ্দেশ্যে তাকে পাশের রুমে নিয়ে গেলে সেখানে তিনি সবকিছু স্বীকার করেন,' বলেন তৈয়বীর।
অবশেষে তিনি পতিতালয়ের প্রধান রিতা ও তার স্বামী সোহেলকে গ্রেপ্তার করেন। অবশ্য পতিতালয়ের অন্য সর্দাররা এ ঘটনাকে একটি ফাঁদ বলে গোলমাল তৈরির চেষ্টা করায় তাদেরকে গ্রেপ্তারে কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল পুলিশের।
বাস্তবে, আসল ফাঁদের শিকার হয়েছিলেন আঁখি।
দেশের অনেক মেয়েই কেন এই ফাঁদে পড়েন এবং কেনই তারা এটি থেকে বের হতে পারেন না- এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন আতাউর রহমান মঞ্জু। মুক্তি মহিলা সমিতির এই সমন্বয়ক বিশ্বাস করেন, সর্দাররা সাধারণত এসব মেয়ের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করেন, যেন তাদের কাছে নিজেকে নিকৃষ্ট মনে হয়।
'আঁখি এক সাহসী মেয়ে, তাই তিনি ওখান থেকে বেরিয়ে আসার সাহস করেছেন। যদিও ওই পতিতালয়ে আমাদের পোস্টবক্স রয়েছে, এবং সেখানে আমাদের কর্মীরা ২৪ ঘণ্টাই কাজ করে যাচ্ছেন, তবু মেয়েরা নিজেদের কষ্টগুলো সহজে তাদের সঙ্গে ভাগ করেন না। যদি কেউ সমস্যার কথা জানান, তাহলে আমরা অবশ্যই তাদের উদ্ধার করব। এখন পর্যন্ত আমরা ওই পতিতালয় থেকে ২০০ জনেরও বেশি নারীকে উদ্ধার করেছি,' বলেন মঞ্জু।
আঁখি এখন তার মায়ের সঙ্গে নিজ জেলায় থাকছেন। জীবিকার জন্য চাকরি খুঁজছেন। এসব অপরাধীর জন্য তিনি কী শাস্তি চান, তা জানতে চাওয়া হলে আঁখি টিবিএস'কে বলেন, 'আমি যে তাদের ফাঁসি চাই, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আমি চাই হাজারবার কিংবা তারও বেশিবার তাদেরকে ফাঁসি দেওয়া হোক। তাদেরকে যত বেশি শাস্তি দেওয়া হবে, ততই ভালো।'